প্রবাসে পরহিতকর্ম – ২৭

সেপ্টেম্বর ১০, ২০১৬

॥ রীনা গুলশান ॥

প্রীসিলার ব্যালকোনির দিকের পর্দাটা খোলা ছিল। চোখ তাই সহজেই বাইরের খোলা আকাশের দিকে পড়লো। আবীর দেখলো গোধূলী শুরু হতে যাচ্ছে। আকাশের বুকে সৃষ্টিকর্তা লালিম আভার খেলা শুরু করেছে।

দীপক তাড়া দিল…আবীর জলদি। প্রীসিলা জলদি করে আরো একবার ব্রাশ করে নিল তার ব্লাস্ট কাটা চুলগুলো। আর একবার লিপিষ্টিকও বুলিয়ে নিল দ্রুত। ওরা দ্রুতই দ্বিতীয় তলায় গিয়ে বেল বাজালো। একটি শব্দ হতেই ছেলেটা দরজা খুলে দিল। অনেক লম্বা ছেলেটা। আকর্ণ হেসে হাত বাড়িয়ে দিল ওদের উদ্দেশ্যে।

হ্যাই… আমি জেরমেইন। বলে সবার উদ্দেশেই হাত বাড়িয়ে দিল। তারপর এদের ডেকে ভিতরে নিয়ে বসালো। নীল রঙ এর আজদাহা টাইপের সোফা। ওরা তিনজন বসলো। আবীর বেশ খুটিয়ে খুটিয়ে ছেলেটিকে দেখছিল। ছেলেটা বেশ লম্বা… ৬ ফিট ২/৩ ইঞ্চি হবে। খুব বেশী কালো নয়। তবে তার গেট আপ দেখে আবীর মনে মনে বেশ হকচকিয়ে গ্যালো। ছেলেটা লাল একটা আন্ডার প্যান্ট পরেছে এবং কোমড় থেকে প্রায় ১৪/১৬ ইঞ্চি মতন নীচে তার ব্লু জিন্স আটকে আছে। আবীর কোনদিন দেখেনি এই স্টাইল। আবীর অত্যন্ত চিন্তিত ভাবে তাকিয়ে দেখলো- জিন্স এ কোন দড়ি বা বেল্ট কিছুইতো নাই… তো কি ভাবে তা আটকে আছে? আবার ভাবলো যদি প্রীসিলার সামনেই প্যান্টটা অচমকা খোসে পড়ে… কি বিপদ হয়ে যাবে? দীপক আস্তে করে আবীরকে চিমটি কাটে… আর ফিসফিস করে বলে – আবীর ওভাবে তাকিয়ে থেকো না। এরা খারাপ ভাবে নিতে পারে!

আবীর অগত্যা হালকা চোখে ঘুরিয়ে ইতি উতি তাকায়। আবার বেখেয়ালে ওর চুলের উপর নজর আটকে যায়। সমস্ত চুলে জটা, তারপর মাথার উপর চূড়া করে বাঁধা। হায় হায়, এ আবার সন্ন্যাসী নয় তো? আবীর তো জানে জটাধারীরা সন্ন্যাসী অথবা কাপালিক হয়।

এর মধ্যে হঠাৎ প্রীসিলা বললো – তো আবীর, তুমি কোনটাতে রাজী?

আবীরতো কোন কিছুই খেয়াল করে শোনেই নি। দীপক সাথে সাথে বুঝে ফেললো এবং প্রীসিলার কথা কেড়ে নিয়ে বললো, আবীর জেরমেইনের এই এপার্টমেন্টের (এক বেড রূম) ভাড়া ৪৫০ ডলার। তুমি যদি বেড রূমটা চাও তবে তোমাকে ২৫০ ডলার দিতে হবে। সেই ক্ষেত্রে এই ছেলে লিভিং স্পেসে এই সোফাতে ঘুমাবে। (যেখানে ওরা বসেছিল সেটা আসলে সোফা নয়, সোফা কাম বেড, খুবই বাজে দেখতে। সম্ভত কেউ ফেলে দিয়েছিল, সে সেটাকে উঠিয়ে ঘরে এনেছে)

তুমি কি বল? আমার কি করা উচিৎ?

আমি বলি কি, বেডরূমটাই নিয়ে নাও। তোমার প্রাইভেসি থাকবে। ৫০ ডলার বেশী হলেও লাভ আছে। দরকার হলে লক লাগিয়ে নিতে পারবে।

কিন্তু এই ছেলেকে দেখেতো ভয় লাগছে। কি ভয়ঙ্কর ড্রেস… আর দ্যাখো জটাধারী…

দীপক অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিল। (দারুন জোরে তার হাসতে ইচ্ছা করছিল) তারপর বললো, ছেলেটা কিন্তু খারাপ নয়, শিল্পী ধরণের… ।

তাই নাকি? আবীরতো ওদের কথা ভাল করে শুনেই নি। ওর চুল আর লাল প্যান্ট দেখেই বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে (ভিমরি খাচ্ছিল মনে মনে)।

তুমি ওর সাথে কথা বল সরাসরি।

তখন আবীর ছেলেটিকে সরাসরিই বললো –  তুমি কি কর গানের দলের ওখানে?

আমি একটা ব্যান্ড গানের দলে ড্রাম (কঙ্গো) বাজাই। সাথে নিজেও একটু আধটু গান গাই।

তাই নাকি? তুমিতো তাহলে শিল্পী।

শিল্পী? হতে তো তাই-ই চেয়েছিলাম… হতে পারলাম কোথায়…এখনও আমার নিজেরই কোন স্বকীয়তা হয় নাই।

বাহ্… খুব ভাল বলেছো। তোমাকে আমার ভাল লাগলো। আমি তাহলে বেডরূমেই আসবো।

ওকে, আমি তাহলে বেডরূমে আমার যা সব টুকিটাকি আছে তা লিভিং রূমে নিয়ে আসবো।

তাহলে তোমার কাপড় কোথায় রাখবে?

অসুবিধা নাই। লিভিং স্পেসে একটা ক্লোজেট আছে। তবে কিচেনে সব সব শেয়ার করতে হবে। যেমন ফ্রিজ, তোমার ২টা রেক আর আমার ২টা রেক।

ওকে, অসুবিধা নাই। আমি তাহলে কবে আসবো?

তুমি চাইলে কালই আসতে পারো।

ওকে… তবে এ মাসের তো আর বেশি বাকি নাই… ৫/৬  দিন। আমি বরং কিছু টুকটাক জিনিশ কিনে রেখে যাবো… বলেই পকেটে হাত দিয়ে ২৫০ ডলার বের করে জেরমেইনের দিকে এগিয়ে ধরলো।

না না, আমাকে এ্যাডভান্স দিতে হবে না। তুমি পরের মাসের একেবারে শেষে দিও।

ওহ। তাহলে ঠিক আছে।

ওরা উঠে দাড়ালো। জেরমেইন ঘরে গিয়ে আর একটা চাবি এনে আবীরের হাতে দিল। যাবার আগে ওরা দুজন হাগ করলো। তারপর সবাই একসাথে পথে বের হলো। প্রীসিলা বললো, আমার একটু গ্রোসারী করতে হবে।

একটু পরে ওরা যার যার পথে পা বাড়ালো। তার আগে যথারীতি দীপক ও প্রীসিলা পরষ্পরকে হাগ দিল এবং চুমু খেল। আবীরও হ্যান্ডশেক করতে আর দ্বিধাবোধ করলো না।

পথে যেতে যেতে দুজনের অনেক কথা হলো। দীপক খুব উচ্ছসিত হয়ে বললো, আবীর তুমি খুবই ভাগ্যবান ভাই… আমি আজ ৭ বছরে যা পারিনি… তুমি ৩ মাসেই তা করে দেখালে।

কি করবো? বল…তুমিতো ভাই ব্যাচেলর ছিলে। আমিতো বিবাহিত… চিন্তা কর মাত্র ৩ মাসেই আমার বউ ৩০ বলেছে আমাকে নেবার কিছু কি করলে? আমার নিজেরই ঠাঁই নাই… বোঝ!!

হু! তাছাড়া ঐ নরকে বাস করলে  তুমি স্বাধীনভাবে কোন চিন্তাও করতে পারবে না।

ঠিকই বলেছো। আমার এখন প্রধান তিনটা কাজ। বাসা চেঞ্জ করা, অন্য আরো একটা কাজের সন্ধান এবং কোন একজন ভাল উকিল ধরা।

কিন্তু আবীর, উকিল এখনি? তুমি পারবে এই অল্প আয়ে? উকিলের তো এখানে হাতির খোরাক।

আমার কোন অপশন নাই। কি করবো ভাই?

হু! এসব সাত পাঁচ ভেবেই তো আমি জীবনে উকিল বাড়ি যাই নি। তবে একটা দেশী ভাইকে নিয়ে একবার গিয়েছিলাম উকিলের কাছে। তাই একটা ধারণা হয়ে গেছে।

কিরকম খরচ হয় একটা ধারণা দিতে পার?

এরা দুরকম ভাবে টাকা নেয়। একটা কন্ট্রাক্ট ভিত্তিতে। আর একটা আছে বছরে ৪ বারে টাকাটা দিতে হবে। তবে সেটা কত বছরে ঠেকবে আমি বলতে পারবো না আবীর।

তোমার ঐ দেশী ভাইয়ের কি হয়েছে?

আমি জানি না, অনেকদিন কোন খোঁজ খবর নেওয়া হয় নাই।

তা হলে আমাকে একদিন নিয়ে যাবে ঐ উকিলের কাছে। কথা বললে বুঝতে পারবো কিরকম খরচা পড়বে আর কত মাস সময় লাগবে।

অসুবিধা নাই। আমি কালই এ্যাপয়ন্টমেন্ট করে রাখবো।

ধন্যবাদ দীপক।

উহু, বন্ধুত্বের মধ্যে নো সরি নো থ্যাংস।

দুজনেই গলা মিলিয়ে হেসে ফেললো। তারপর আবীর উদগ্রীব ভাবে জানতে চাইলো –  প্রীসিলাকে পেলে কোথায়?

আর বলো না। ঐ প্রীসিলা যে

বারে কাজ করে ২ বছর আগে একবার খুউব হতাশায় বিমর্ষ হয়ে ঐ বারে গিয়েছিলাম মদ্যপান করতে। অভ্যাস নাই তো… পুরো একটা বোতল সাবাড় করে দিলাম। তারপর যা হবার তাই হলো। চোখে কিছু দেখিনা। মাথা ঘুরে বমি টমি করে একাকার। খুব জঘন্য অবস্থা… এই প্রীসিলাই (ওর তখন ডিউটি শেষ হয়েছিল) আমাকে খুব সেবা করে ওর নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল। পরদিন আমি আবিস্কার করলাম যে আমি অন্য কোন অবস্থানে রয়েছি। কিছুক্ষণ পর একটি উদ্বিগ্ন মুখ আমার মুখের উপর ঝুঁকে এলো এবং জিজ্ঞস করলো –  কেমন আছো এখন? এই নাও, এই লেবুর পানিটুকু খেয়ে ফেলো। সহ্যই যখন হয় না… তখন এগুলো খাও কেন?

আমি তখন খুব অস্বস্থি নিয়ে পানিটা খেয়ে নিলাম। মাথাটা প্রচন্ড ভার অবস্থায় ছিল। ব্যাথার চোটে ছিড়ে যাবে মনে হচ্ছিল। তবু খুব লাজুক কন্ঠে মেয়েটাকে বললাম, কি বলে যে তোমাকে ধন্যবাদ দিব বুঝতে পারছি না।

প্রীসিলা তখন বললো, মুখে আর  ধন্যবাদ বলতে হবে না। তোমার চোখ আমাকে ধন্যবাদ দিয়ে দিয়েছে।  বলেই খিল খিল করে হাসলো। তারপর আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো, আমি প্রীসিলা সালভাদোর। তুমি নিশ্চই ইন্ডিয়ান?

আমি বললাম – না না, আমি বাংলাদেশী। আমি দীপক সেন।

প্রীসিলার ঐ দিন ডে অফ ছিল। আমারতো ছিলই। সারা দিন দুজনে গল্প করলাম। কথায় কথায় আমি প্রীসিলাকে আমার সব কথা বললাম। প্রীসিলাও তার দুঃখের ভান্ডার খুলে দিয়েছিল। তারও বিয়ে হয়েছিল। তাদের ম্যাক্সিকান একটি ছেলের সাথে। কার্লোস সালভাদর। তাদের বিয়ের ২ বছর তিন মাস পর একদিন হাতেনাতে কার্লোসের চিটিং (অন্য নারীর সঙ্গে অবৈধ প্রেম) ধরা পড়লো। তারপর আরো ২ বছর লেগেছিল ডিভোর্স পেতে। সেই থেকে প্রীসিলা দ্বিতীয় বিয়ের কথা আর ভাবেইনি। খুব ঘৃণা হয়েছিল বিয়ের উপর। পুরুষের উপর। চাকরীটাকেই জীবনের শেষ সম্বল করে একাকী পথ চলছিল।

তবে প্রীসিলা আমার সব কথা শুনে বলেছিল – এখানে অনেকে আছে তোমার মত… কাগজ নাই যাদের… দীর্ঘদিন। তারা এভাবেই বাস করে। চিন্তা করো না। শেষ পর্যন্ত একটা ব্যবস্থা হয়েই যাবে। – (চলবে)

রীনা গুলশান

কবি ও লেখক

টরন্টো।

gulshanararina@gmail.com