প্রবাসে পরহিতকর্ম -২৪

জুন ১৪, ২০১৬

রীনা গুলশান ॥

আজ আবার আকাশ ছেপে বৃষ্টি নেমেছে। আমিও এমন… আসবার সময় যে সিপি ২৪ দেখে, শীতবস্ত্র নির্বাচন করবো… তা নয়। ড্রেসিং রূমে যেয়ে যে জ্যাকেটটা ভাল লাগে সেটাই পরে বের হয়ে যাই। আর পরে এই ঝক্কি। আজ প্রিন্টেড লেদার জ্যাকেট-টা পরে এলাম… ঈশ… দিলতো ভিজিয়ে বৃষ্টি! বৃষ্টি আমার খুউব প্রিয়, কিন্তু তা মোটেও কানাডার বৃষ্টি নয়। কানাডার সবই আমার প্রিয়…কিছু কিছু জিনিশ মোটেই প্রিয় না- বৃষ্টি, মাছ এবং আম… হু! বাংলাদেশের বৃষ্টি যেন স্বপ্ন, কবিতা, গান… এক ঐক্যতান। যে একদম অ-কবি… তার মন থেকেও ছিটে ফোটা কবিতা বেরিয়ে আসবে। আর আমিতো খুলনার মেয়ে… মাছের কথা আর কি বলবো? সব মিষ্টি সাদা মাছতো খুলনার পানিতে সাঁতরে বেড়ায়। আর গ্রীষ্মের আম! ন্যাংড়া আম! কতদিন খাইনা…ঈশ! ধান ভানতে শীবের গীত একেই বলে। যতই বয়স বেড়ে যাচ্ছে, ততই বেশী করে স্মৃতি কাতর হয়ে পড়ছি। যদিও দৌড়ে প্রায় ‘গো’ ট্রেনে উঠে পড়লাম তবু ভিজলাম। সাধের লেদার জ্যাকেট-টাও বেশ ভিজে গেছে। কিছু কিছু জায়গায় বেশ চুপচুপে হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি আমার দ্বিতল বিভাগে বসে পড়লাম। জ্যাকেট খুলে টিস্যু পেপার দিয়ে কিছুটা অংশ মুছে ফেলবার একটা ব্যর্থ প্রয়াশ করলাম। ইতিমধ্যে ট্রেন ছেড়ে দিল এ্যাটেনডেন্ট এর দীর্ঘ বক্তৃতার পর। আমিও আমার হাসবেন্ডকে সেলফোনে যথারীতি জানিয়ে দিলাম যে ট্রেন যাত্রা শুরু করেছে। এরপর ট্রেনের মধ্যেই মাগরীবের নামাজটা পড়ে ফেল্লাম। হঠাৎ আমার পেছনের সিট থেকে একটা ফোঁপানির (কান্না) মত শব্দ পেলাম। সরাসরি দেখবো, কিঞ্চিত অস্বস্তি হচ্ছিল। আবার মহিলা না…সেটা আগেই দেখেছিলাম। পুরুষ। এবং ফোঁপানি! কৌতুহল আর নিবৃত করতে পারলাম না। অতঃপর দেখলাম… হু.. একটি যুবক… বয়স? কত হবে… টেনে ৩০ থেকে ৩৫ (বেশী হলে)। এবার খুব ভাল ভাবেই তাকালাম। কারণ ছেলেটা মোটেই আমার দিকে তাকিয়ে নাই। ট্রেনের জানালার কিনারাতে মাথা দিয়ে সেতো অঝোরে কেঁদে চলেছে। কোন দিকে তাকাবার তার ফুরসতই নাই। মাঝে মাঝে আবার ফুঁপিয়ে কাঁদছে। প্রথমে বেশ হাসি পাচ্ছিল। ছেলেরা কি এই ভাবে কাঁদে নাকি? হঠাৎ মনে হলো, ভেতর থেকে কেউ যেন বলছে, ‘কেন রে, মেয়ে কান্না কি তোমাদের (মেয়েদের) পারসোনাল প্রোপারটি??’ ঠিক ই তো! হাসি, কান্না, দুঃখ বেদনা… এইসব নিয়েই তো মনুষ্য সমাজ। জন্তু, জানোয়ার-রা খুউব ভাল আছে… ওদের এই সব যন্ত্রণা (ইমশন) নাই। এবারে ছেলেটাকে ভাল করে দেখলাম। সুন্দর দেখতে। গায়ের রং বেশ ফর্সাই। তবে দক্ষিণ এশিয়ান বা বড়জোর ম্যাক্সিকান ধরণের হবে। মিষ্টি অবয়ব। ছেলেটা কাঁদছে আর ওর জামার হাতা দিয়ে চোখের অঝোর ধারা মুছছে। মনে হয় ওর কাছে টিস্যু পেপার নাই। এখন আর হাসি পাচ্ছে না। আমি সত্যিই কোন ছেলেকে এভাবে কাঁদতে দেখিনিতো! তাই প্রথমে হাসি পেলেও, ক্রমশ ছেলেটার অসম্ভব বেদনার ভার আমাকে ছুঁয়ে গ্যালো। এর মধ্যে ওর একটা ফোন এলো। ছেলেটা ফোনের স্ক্রিনটা দেখে ফোনটা নিল এবং পরিষ্কার বাংলাতে বললো, আমি কিছু ক্ষণের মধ্যে এসে পড়ছি (কথার টানে বুঝেও ফেল্লাম, বাংলাদেশের কোন এলাকার ছেলে)। এবারতো আমিই নড়েচড়ে বসলাম, বিস্মিত এবং বেশ আগ্রহী ভাবে তাকালাম। আকাশ নীল রঙের মখমলের একটা ট্রাক স্যুট টাইপের পোষাক পরা। জামাটাতে আবার হুডিও আছে। মুখাবয়বে বেশ সরলতা প্রচ্ছন্ন। এরপর আর নিজেকে নিবৃত করা গেল না। ব্যাগ থেকে ৪/৫ টি টিস্যু পেপার নিয়ে ছেলেটাকে যেয়ে বল্লাম- এটা নিন। ছেলেটা সাথে সাথেই টিস্যু পেপারগুলো নিয়ে ভাল করে মুখটা মুছলো। কোন ‘ধন্যবাদ’ বলবার বাহুল্যতা প্রকাশ করলো না। আমার খুব ভাল লাগলো যে, খুব সহজ ভাবে সে গ্রহণ করলো। আমি অতপর বল্লাম -একটু পানি খাবেন? – সাথে সাথেই মাথা নাড়লো। আমি পানি দিলাম (১ টা নতুন বোতল ছিল ব্যাগের মধ্যে। প্রায় গোটা বোতলটা শেষ করে ফেললো, এবং এবারেই প্রথম আমার দিকে পূর্ণ চোখে দেখলো আর কিঞ্চিত লাজুক একটা হাসি দিল এবং বললো : থ্যাঙ্কস্ ….আর কিছু বলতে পারছিল না… কারণ ওর বুকের মধ্যে তখনও কান্নার ফেনা গুলো বুদবুদ করছিল। চোখের পাতা তখনও ভেজা! আপনি কি এখন একটু ভাল বোধ করছেন? – আমি একদম পরিষ্কার বাংলাতে কথা বললাম। ছেলেটির অসম্ভব অবাক চোখ… আমাকেও অবাক করলো… ক্যানো আমাকে কি বাঙ্গালী মনে হয় না? অবশ্য হেজাবের কারণে অনেকে অন্য দেশের মনে করে। আমি অবশ্য কিছু মনে করিনা… তবে কেউ যদি আমাকে পাকিস্তানী বলে… মনে মনে প্রচন্ড রেগে যাই… যদিও মেকি হাসিটা ধরে রেখেই বলি – সরি, আমি ঐ দেশের এক সমুদ্র দূরে অবস্থান করি… আমি বাংলাদেশের মেয়ে। ছেলেটাকে অবশ্য ত্যামেন কিছুই বললাম না, বরং ওর মুখোমুখি বসে পড়লাম এবং বন্ধুত্বপূর্ণ একটা হাসি দিলাম। কোন কোন সময় একটি হাসিই যথেষ্ট হয়, কিছু না বলে। তারপর খুব আস্তে আস্তে বললাম, ভাই আপনি আমার ছোট ভাইয়ের মত… তাই অনধিকার চর্চা করছি। জানি এই ভাবে এই পরিস্থিতিতে সেধে কথা বলাটা অত্যন্ত অশোভন। তবুও এলাম… আপনাকে এতটা ভেঙ্গে পড়তে দেখলাম যে নিজেকে কিছুতেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারলাম না…। না না ঠিক আছে আপু… আপনার কথা শুনে আমার খুউব ভাল লাগলো। আমি বরং এখন একটু ভাল বোধ করছি। তুমি কিছু খাবে? কিছু খেলে খউব ফ্রেশ লাগবে। মনে হচ্ছে তুমি অনেক্ষণ কিছু খাওনি। ছেলেটি বিষন্ন একটা হাসি দিল। আমি আমার ব্যাগ থেকে একটা কুকিসের প্যাকেট ওকে দিলাম। দিতে দিতে বল্লাম, আমার ব্যাগ হলো ম্যাজিক ব্যাগ। সবই থাকে। আমার আলসার আছে… আবার প্রেসার খুবই লো… তাই ক্যান্ডিও রাখি। এ কথা বলে ওকে একটা কিটক্যাটের প্যাকেটও দিলাম। এবার ছেলেটি হঠাৎ ঝরঝর করে হেসে ফেললো। ঈশ! ছেলেটির হাসি দেখে আমার এত ভাল লাগলো… খুউব ভাল লাগলো। বলে বোঝাতে পারবো না। মনে হলো আমার বুক থেকে একটা ভারী পাথর গড়িয়ে নেমে গ্যালো প্রচন্ড স্বস্তি দিয়ে। মানুষকে কাঁদানো খুব সহজ… হাসানো বড়ই কঠিন। আমি সেই কঠিন কর্মটি করতে পেরেছি। ছেলেটি হঠাৎ বললো, আপু…আমার নাম আবীর রহমান চৌধুরী। বাহ্ দারুন নাম। আবীর নামটি আমার খুউব প্রিয়। তবে আবীরের পাশে রহমান নামটি ক্যামোন জানি… ‘কাবাব মে হাড্ডি’র মত লাগছে…। আবীর এবারে তো খুউব জোরে হেসে ফেললো…হাসতেই থাকলো অনেক্ষণ। এবার তো আমারই চোখে হালকা কান্না এলো… মনে মনে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলাম : – ‘হে আল্লাহ আবীরের এই প্রাণ খোলা হাসিটিই তুমি অক্ষুন্ন রাখো।’ আপু, আপনি খুবই মজার মানুষ… আমিও হাসলাম। আমি চেষ্টা করি মানুষকে কিছুটা হলেও আনন্দ দিতে। তারপর আমি নিজের নাম বল্লাম। আমি কিঞ্চিত দ্বিধান্বিত ভাবে বল্লাম, আবীর তোমার প্রিয়জনের কিছু হয়েছে? মানে মারা গেছে? এই রকম কিছু…? হু…ঐ রকমই কিছু… মারাই গেছে। তবে শরীরে নয়। একটি সম্পর্কের মৃত্যু হয়েছে…। ওমা… এ দেখি হাইলি দর্শন শাস্ত্রে চলে গেছে। অবশ্য প্রকৃত বেদানাইতো মানুষকে সত্যিকারের দার্শনিক বানিয়ে দ্যায়। এই অল্পবয়সী ছেলেটা এখন বিখ্যাত দার্শনিক ‘চর্বাক’ এর থেকে কিছু কম নয়। কি কর তুমি? আমি একজন শেফ আপু। (রন্ধন শিল্পী) ওমা আগে বলবেতো। এতক্ষনে তাহলে তোমার কাছ থেকে কত কিছু রান্নার টিপস নিতাম… অথবা কয়েকটি রেসিপী। এই পৃথিবীতে কয়েকটি জিনিষের প্রতি দারুন আনন্দ বা আগ্রহ আমার। কবিতা… মানুষকে জানা… এবং রান্না! তা তুমি কি ধরণের রান্না করো? ইন্টারন্যাশনাল… লাইক… মোগলাই, ইটালিয়ান, ইংলিশ এবং ফ্রেঞ্চ। ওমা… বলে কি? এই পিচ্চি ছেলেটা… এত রান্না জানে? ও মাই গড! তা কোথা থেকে এত রান্না শিখলে? তোমার বয়স কত? ঈস! প্রশ্ন করেই নিজের জিব্বাহ কাটলাম। কারো বয়স, বেতন এবং এ দেশে কি জব করো এসব প্রশ্ন করতে নেই। আজ আমার হলোটা কি? সব কার্টিসি কি বিস্মৃত হচ্ছি! কিন্তু ছেলেটাকে দেখলাম, কিছুই মনে করলো না। ওল্টো মিষ্টি করে হেসে বললো, আমার বয়স ৩১। আর রান্না? আসল হাতে খড়ি মা’য়ের কাছেই হয়েছিল। আমার মায়ের কোন মেয়ে নাই তো…আমিই বড় ছেলে। মা যখন রান্না করতো তখন এটা ওটা এগিয়ে দিতাম অথবা পেঁয়াজ বা রসুন ছিলে দিতাম। মাও খুব খুশী হতো। মায়ের রান্নার বেশ কিছু কৌশল ছোট বেলা থেকেই রপ্ত হয়েছিল। তারপর এসএসসি পাশ করে আমি রান্নার স্কুলেই ভর্তি হলাম। বাংলাদেশেও আমি কয়েকটি বড় বড় হোটেলে রান্নার কাজ করেছি। ভালই ছিলাম। হঠাৎ আমার এক বন্ধুর পরামর্শে নর্থ আমেরিকাতে আসবার পরিকল্পনা করলাম। কানাডা আসতে চেয়েছিলাম। আসতে পারছিলাম না। তারপর হঠাৎ আমেরিকার ভিজিটিং ভিসা হয়ে গেল। ওখানেই আসবো বলে ঠিক করলাম। এদিকে আমার এসএসসি পাশের কিছুদিন পরই আমার আব্বা হঠাৎ করে ডেঙ্গু জ্বরে মারা গেল। আমরা তিন ভাই। ছোট ভাইটা বেশ ছোট। বাবা মারা যাবার পর আমার উপর বেশ প্রেশার পড়লো। মূলত সেই জন্যই প্রথাগত শিক্ষায় না গিয়ে এই লাইনে আসলাম। শেরাটনে দুই বছর একটানা কোর্স করলাম – প্রফেশনাল শেফের। তারপর দুই তিনটা বড় হোটেলে শেফের কাজ করেছিলাম। ভাই দুটোকে পড়াচ্ছিলাম। মেঝ ভাইটা সিলেট মেডিকেলে চান্স পেয়ে গেল। ছোট ভাইটা অষ্টম শ্রেনীতে পড়ছিল। হাতে তাই টাকা তেমন ছিলো না। ভিটে বাড়ি বাদে একটা ধানের জমি ছিল। এটাই বেঁচবার সিদ্ধান্ত নিলাম। বেঁেচও দিলাম। মায়ের কোন আপত্তিই ছিল না। ৬ মাসের মত সময় হাতে। ঠিক ঠাক করছি প্রতিদিন একটু একটু। এরই মধ্যে দেশ থেকে ফোন এলো। ভাবলাম মায়ের ফোন। না, দেখি… ‘নবনী’। কাহিনীর এখানে এসে আবীরের মুখে এখন আবীরের রঙ ধরলো। কিন্তু আমি অত্যন্ত উৎসুক এবং নির্বিকার শ্রোতা। শুধু আগুনটা উসকে দিলাম। নবনী… বাহ্ বেশ দারুন নাম তো? নবনীটা কে? ও আমার ইয়ে মানে… আচ্ছা! গার্লফ্রেন্ড! এই মূহুর্তে ইংরেজীকে ধন্যবাদ দিলাম… প্রেমিকা বা প্রত্যক্ষ অর্থগত ভাবে বলতে গেলে ‘বালিকা বন্ধু’… ছি, বিশ্রি শোনায়। কিন্তু গার্ল ফ্রেন্ড কথাটা কানে একটুও লাগে না… ইজি এবং স্মুথ। জি… আমার সাথে মানে আমাদের অনেক দিনের ভালবাসা… নবনী আমার এক ক্লাস জুনিয়র। আমরা একই জায়গায় থাকতামও। একই স্কুলে পড়েছি। আবার আমার আপন খালাতো বোন। ওমা! তাই? তা বাড়ীর সবাই জানে? হু! এতদিন জানতো না… যখন থেকে আমি ঢাকায় এসেছি… এখন সাবই জেনে গেছে। সবাই মেনে নিয়েছে? না… মানে ওর দিকের সবাই মেনে নিলেও, আমার মা ঠিক মেনে নিতে পারেনি। ক্যানো? ওতো তোমার আপন খালাতো বোন? হু! তা ঠিক… দেখতেও নবনী সুন্দর। কিন্তু আমার এই খালা প্রেম করে একটু নীচু বংশের ছেলে বিয়ে করাতে আমার নানার বাড়ির সাবাই প্রায় ২০ বছরের মত মেনে নেয়নি। হু… বুজেছি। বাংলাদেশে তো এই বংশের ব্যাপারটা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। বিশেষ বিশেষ কোন জেলা বা কোন কোন বংশের লোকেরা তো মরে যাবে তবু অন্য বংশ বা ‘নীচু’ বংশ আজো মেনে নিবে না। আমার যদিও এই ব্যাপারটি খুবই খারাট লাগে। বংশ তো তাদের যুগ যুগ কর্মের নাম… নিজেদের বানানো। এমন কত আছে- নিজেরাই বসিয়ে নেয় বংশের নাম! (চলবে) রীনা গুলশান, টরন্টো gulshanararina@gmail.com