প্রবাসে পরহিতকর্ম -২৩
মে ৮, ২০১৬
রীনা গুলশান
একটা ফোন এসেছিল। বই মেলা’র উত্তেজনাতে ফোনটা ধরতে ধরতে কেটে গ্যালো। আর এলো না। দেখলাম আননোন নেম। তাই আর রিং ব্যাক করলাম না। কানাডায় ফিরে আসতে হবে। একা একা আসবো। ২ টা সুটকেস, এখন আবার হাতেও একটা ব্যাগ হয়েছে (বাংলাদেশে যাব আর কিঞ্চিত শপিং করবো না, তাকি হয়??)। তাই যথেষ্ট মস্তক পীড়া দেখা দিয়েছে। কানাডায় আসার পর যথারীতি দীর্ঘ যাত্রাকালীন অসুস্থতা তো থাকবেই।
আসবার তিনদিন আগে আবার এক প্রায় মধ্যরাতে সেই ফোন। এবারে সাথে সাথেই প্রতি উত্তর দিলাম। ওহ! তৌহিদ ভাই। আমি জানতাম উনি বাংলাদেশে আছেন প্রায় ৪ মাস যাবত। কানাডা থেকে উনি প্রতি বছর সৌদীতে যান ওমরাহ করতে। সেখান থেকে সোজা বাংলাদেশে যান বিশ্ব ইজতেমায় অংশ গ্রহণ করতে। কিন্তু এবারে উনি যাবার আগে বলেছিলেন ৪/৫ মাস থাকবেন। উনার নিজ পৈত্রিক আবাসভূমিতে যাবেন কিছু সমাজ কর্ম করার জন্য। সমাজ কর্ম উনি বরাবরই করে আসছেন। সুদীর্ঘ প্রায় বিশ বছর ধরে। টরন্টোর অনেকেই তাকে চিনেন। টরন্টোতে তিনি একাধারে হাই স্কুলের শিক্ষক (টিডিএসবি’র স্কুলে) এবং বাংলাদেশ কমিউনিটির একজন বিনা বেতনের সামাজকর্মী। তার এই সমাজ কর্মের জন্য তিনি ইতিমধ্যেই ৫টি পুরস্কার পেয়েছেন। তার মধ্যে অন্যতম হলো লন্ডনে (অন্টারিও) অবস্থিত ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির পুরস্কার। এটা অত্যন্ত সম্মানীয় পুরষ্কার। যদিও উনি এসব কর্ম পুরষ্কারের আশায় করেন না। মানুষের উপকার করা উনার নেশার পর্যায়ে চলে গেছে। এমনকি সত্যি কথা বলতে, তার এই মানুষের জন্য উপকার করতে করতে উনি নিজের উপকার করতেও ভুলে গেছেন।
গত ৪ বছর আগেই উনার পৈত্রিক আবাসভূমিতে প্রথমে উনি এবং উনার প্রকৌশলী ভাই মিলে একটা মসজিদ করেছেন। এবারে যেহেতু ওখানে একটা ছেলেদের মাদ্রাসা আছে; তাই উনি গ্রামের সবার সাথে মিটিং করে একটি মহিলা মাদ্রাসা করবার পরিকল্পনা করলেন। তার জন্য ভাল একটি জায়গা দরকার। কারণ, মহিলাদের জন্য মাদ্রাসা শুধু করলেইতো হবেনা। সাথে বোর্ডিংও দরকার। অনেক চিন্তা ভাবনা করেই নিজেদের বাপ-দাদার ভিটাতেই মাদ্রাসাটি করবার জন্য মনস্থির করলেন। ভাই বোন সবাই এই উত্তর আমেরিকাতেই থাকেন। বাবা-মা সেই কবেই গত হয়েছেন। অতএব, উনি ভিটা বাড়িতেই মাদ্রাসার কাজ শুরু করলেন। প্রায় দেড় বিঘা জমি। তিনতলা বিল্ডিং করবেন। প্লান করে সেই মোতাবেক কাজ শুরু করলেন। সম্পূর্ণ নিজের টাকায় দোতলা পর্যন্ত করেও ফেললেন।
কিন্তু অসুবিধা দেখা দিল অন্যত্র। তৌহিদ ভাইদের গ্রামের সমস্ত জমিজমা আজ ৩০/৪০ বছর ধরে তার ফুফাতো বোন ও বোনের স্বামী দেখাশুনা করতেন। বিনিময়ে তারা সবকিছুই ভোগ করতেন। এমনকি উনাদের ভিটে জমিতে সবজী লাগাতো তারা। তাদের পুরা বছরের সব ওতেই চলে যেত বেশ ভালভাবেই। এখন তাদের এইরকম মনোভাব যে, ‘এ্যই ব্যাটা কোথা থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসেছে?’। প্রথমেতো নানারকম বিরোধিতা করছিলোই। তারপর দেখলো: গ্রামের সরকারী ডাক্তার, উকিল, স্কুল কলেজের প্রধান শিক্ষক থেকে তামাম শিক্ষিত মানুষেরা উনাকে নানান ভাবে উৎসাহিত করছিল। প্রতিদিনই উনাকে কেউ না কেউ দাওয়াত করে খাওয়াচ্ছিলেন। এমনকি উনার একজন চাচাতো চাচার বাসাতেই উনার থাকা খাওয়ার আপাত স্থায়ী ঠাঁই হয়েছে। ঐ চাচাও শিক্ষিত একজন মানুষ। এমনকি উনার প্রায় বৃদ্ধা স্ত্রী উনাকে তিন বেলা রান্না করে খাওয়ান। গোসল করার জন্য গরম পানির ব্যবস্থা করে দেন।
এরই মধ্যে সেই কাজিন বোনজামাই গ্রামের সব মানুষকে বলতে শুরু করেছে, এই তৌহিদ সাহেব একজন জঙ্গী… মধ্যপ্রাচ্যের ঐসব জঙ্গীদের সঙ্গে তার ডাইরেক্ট সম্পর্ক আছে। গ্রামে এসেছে জঙ্গীবাহিনী গঠন করতে। এসব ‘মহিলা মাদ্রাসা’ বানানো একটা অবতারণা মাত্র। এবং সব জায়গাতেই তো দুই ধরণের মানুষ আছে। খারাপ এবং ভাল। তো ঐ বোনজামাইয়েরও কিছু সাঙ্গ-পাঙ্গ আছে বৈকি। ঐ সব সাঙ্গ-পাঙ্গরাও যথারীতি তাল দিতে শুরু করলো। একবারও ভাবলো না ঐ সব অশিক্ষিত চ্যালা-চামুন্ডারা যে, এই মানুষটা সুদূর কানাডা থেকে তার সমস্ত কার্যক্রম রেখে গ্রামের উপকার করতে এসেছে। তার নিজের কোন স্বার্থ নেই।
যাইহোক, ব্যাপারটি যখন এই পর্যায়ে গড়ালো, তখন তৌহিদ ভাইয়ের চাচা বললো, তুমি কিছুদিনের জন্য ঢাকা যাও। তৌহিদ ভাই ঢাকা যাওয়ার আগে স্থানীয় থানায় একটি জিডি করলেন। তারপর কুমিল্লার ডিআইজি’র সঙ্গে দেখা করে তার পরিচয় দিলেন এবং সব খুলে বললেন। তখন ডিআইজি নিজে তৌহিদ ভাইয়ের এলাকার থানায় ফোন দিয়ে খুব ভাল ভাবে নির্দেশ দিল এসপিকে কি করতে হবে তৌফিক ভাইয়ের ব্যাপারে। তৌহিদ ভাই এর পর ঢাকায় কানাডিয়ান হাইকমিশনে এসেও সব বললেন। তার কথা শুনে হাইকমিশন থেকে বাংলাদেশ শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলো। শিক্ষা মন্ত্রনালয় থেকেও সর্বতভাবে তৌহিদ ভাইকে সাহায্য করেছে।
প্রায় দুই সপ্তাহ পরে তৌহিদ ভাই যখন গ্রামে ফিরলেন তখন অবহাওয়া যথেষ্ট বদলে গেছে। গ্রামের সমস্ত শিক্ষিত মানুষ দলগত ভাবে তৌহিদ ভাইয়ে সাহায্যে এগিয়ে এসেছে। অতপর: তৌহিদ ভাই কাজ জোরে সোরে চালিয়ে যাচ্ছেন। এবারে ঐ বোনাইয়ের মুখপাত্র জানিয়েছে, আপনি যখন চলে যাবেন, তখন পরিমন্ডল বদলে যাবে। তখন ঐ বোনাই মহিলা মাদ্রাসাবাসীদের নানাভাবে উত্যক্ত করবে। তারচেয়ে একটি রফায় আসেন, উনাকে কিছু টাকা দিয়ে দেন। তৌহিদ ভাই বললেন, ওকে টাকা আমি দিবো, তবে গ্রামের সমস্ত গন্যমান্য ব্যক্তিদেরদ সামনে। সেই জন্যই উনি আমাকে ফোন দিয়েছিলেন। টাকার অংকটা বেশ ভাল রকমের। বাংলাদেশে যেহেতু আমার টাকা রাখা আছে। তাই উনার দরকার হলেই আমাকে জানায়, আমার ব্যাংক থেকে পাঠিয়ে দেই।
কিন্তু আমার কথা হলো, অথবা এই সব অবতারণা করলাম এই জন্য যে, এখানে আমরা যারা অধিবাসী হয়েছি, প্রায় সকলেরই দেশে কিছু না কিছু আছে। কারো শহরে বাড়ি আছে। হয়তো বা বাবা-মা, ভাই-বোনকে রেখে এসেছেন। কারো বা জমি জমা আছে। বিশেষ করে প্রত্যেকটি মানুষেরই গ্রামে বাড়ীঘর আছে। কেউ তার শেকড় ছাড়তে চায় না। এমনকি এমন অনেকে আছে, যাদের কেউ নেই তবু ঘরে তালা মেরে রেখে এসেছে। আমার হাসবেন্ডের একজন বন্ধুর নিজস্ব বাড়ীতে (শহরেই) তালা মেরে রেখে এসেছে। উনি ২ বছর পর দেশে গিয়ে দেখে, তালা ভেঙ্গে ঘর থেকে উনার বাবা-মায়ের খুউব দামী সেগুন কাঠের নকশাদার একটা পালঙ্ক ছিল, কারা যেন নিয়ে গেছে। অথচ আশে পাশে চাচা এবং চাচাতো ভাই-বোনরা সবাই আছে। এখন উনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে সব বিক্রি করে দেবেন। সেটাও পারছেন না। কারণ চাচাতো ভাইরা হুমকী দিয়েছে যে, বিক্রি করলে তাদের কাছেই বিক্রি করতে হবে। তার মানে জলের দরে সব তাদের হাতে সোপর্দ্য করতে হবে। না হলে তাদের যতরকম ক্ষমতা, সেটা তারা প্রদর্শন করতে একটুও পিছপা হবেনা। উনি অসম্ভব বিমর্ষ হয়ে আছে। এখানে এতটা বছরেও তেমন কিছুই করতে পারেনি। আমাদের বেশীর ভাগদেরই যা অবস্থা। অনেকটা দিন আনা দিন খাওয়া অবস্থা। ভেবেছিলেন দেশের বাড়ী-জমি সব বিক্রি করে এখানে ডাউন পেমেন্ট দিয়ে একটা ছোট খাট বাড়ী করবেন। এখনতো সবই মরীচিকা মনে হচ্ছে তার কাছে। আর দেশেতো একটা মানুষ খুন করতে পয়সাও লাগেনা। কিছু মানুষ যেন প্রমত্ত নেশায় মগ্ন। খুনের নেশায় মগ্ন। তাদের স্বার্থে আঘাত লাগলেই সোজা খুন। বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকা একটু দেখলেই বোঝা যায়, দেশে আসলে হচ্ছে টা কি?
তৌহিদ ভাইয়ের মতন এই রকম সম্মানীয় মানুষকেও শেষ পর্যন্ত সমঝোতা করতে হলো। অবশ্য নিজের স্বার্থে উনি করেননি। যেহেতু উনি মহিলা মাদ্রাসা করছেন, তাই এই সমস্ত ইবলিশের চ্যালা-চামুন্ডাদের বিশ্বাস নেই বলেই বেশ কিছু টাকা গচ্চা দিলেন। তবে উনি গ্রামের সমস্ত মানুষের উপস্থিতিতে এমনকি পুলিশেরও উপস্থিতিতে এই টাকা দিয়েছেন। সবার সামনে তৌহিদ ভাই বলেছেন, এতদিন আমার এই বোনাই আমাদের জমি জমা দেখা শুনা করেছেন তাই আমি কিছু সম্মানী দিলাম। এটা না বললেতো সবার সামনে টাকাটা দেওয়া যেত না। এবং তিনি যে টাকাটা দিয়েছেন তার লিখিত কাগজও রেখেছেন গন্যমান্য ব্যক্তিদের সিগনেচারসহ।
কানাডাতে আমরা যারা প্রবাসী হয়েছি, বেশীর ভাগই ছেলে মেয়ের ভবিষ্যত ভেবেই এসেছি। এখনতো একটু যাদের পয়সা আছে তারা নিজেরা দেশে থাকছে, ছেলে-মেয়েদের কানাডাতে বা আমেরিকায় পাঠিয়ে দিচেছ। কিন্তু তবু অনেকেই বলে থাকে যে, ছেলে-মেয়ে তাদের প্রফেশনাল ফিল্ডে কাজ করা শুরু করলেই বিয়ে দিয়ে ওদেরকে সংসারী দেখে আমরা দেশে চলে যাব। যাই বলো বাবা, দেশ তো দেশই। শেষ জীবনটা নিজের দেশই কাটাতে চাই। শেষ নিঃশ্বাসটাও ওখানেই নিতে চাই, যাতে কবরটা ওখানে হয়। এরকম মনোভাব অনেকেরই। অনেকে আবার এমনো আছে দেশে বাড়ী ঘর বানিয়ে রাখছে… সামারে ছেলে মেয়ে নিয়ে ওখানে থেকে আসে। এটা কিন্তু যারা করছে, খুবই ভাল করছে। ছেলে-মেয়েরা মোটামুটি দেশটা চিনছে… জানছে। দেশের কৃষ্টির সঙ্গে সরাসরি পরিচিত হচ্ছে।
যারা প্রবাসে আছে তারা অনেকেই দেশে টাকা পয়সা পাঠান। সেই অর্থে দেশের অর্থনীতি অনেক লাভবান হচ্ছে। তাই বাংলাদেশ সরকারেরও উচিত প্রবাসীদের নিরাপত্তার দিকে নজর দেওয়া। প্রকৃত অর্থে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা। মানুষ এবং তাদের সম্পদের উপর যৌথভাবে।
আমরা যেন দেশে গিয়ে সত্যিকার অর্থে নিরাপদ বোধ করি। সর্বতভাবে। এমন কি এখন অনেকে দেশে টিনএজ বাচ্চাদের দেশে নিতে বা তাদের একাকী পাঠাতে ভয় পায়। কারণ আমরা মোটামুটি সবাই জানি, দেশে মূলত হচ্ছেটা কি। প্রবাসী দেখলেই তাদের বাচ্চাদের হাইজ্যাক করছে। অথবা হ্যাইজ্যাক করার প্রয়াস করছে। এবং টাকা দিলেও অথবা দিতে একটু দেরী হলেই এরা অবলিলায় বাচ্চাদের খুন করছে। মানুষ যে এখন কোন পর্যায়ে চলে গেছে, দেশে গিয়ে কিছুদিন থাকলেই টের পাওয়া যাচ্ছে।
আমার একটাই প্রত্যাশা, প্রবাসীদের সুস্থ মনন এবং দুশ্চিন্তাহীন জীবন। এমনিতেই আমরা এখানে যথেষ্ট মনোবেদনায় থাকি দেশের জন্য। প্রিয়জনের জন্য। তাই আরো দুশ্চিন্তায় আমরা যেন জর্জরিত না হই এটাই প্রত্যাশা।
রীনা গুলশান, টরন্টো