প্রবাসে পরহিতকর্ম -২২
এপ্রিল ৯, ২০১৬
॥ রীনা গুলশান ॥
আযানের আওয়াজ কানে এলো। ধড়পড় করে উঠে বসলাম। ইশ! ভর মাগরীবের সময় ঘুমিয়ে পড়েছি। কানাডা থেকে বাংলাদেশে এসে এই এক যন্ত্রণা হয়েছে। তাড়াতাড়ি উঠে অযু করে নামায পড়লাম। নামায শেষ হতে না হতে ফোন বেজে উঠলো। ভাবলাম কানাডা থেকে কারো ফোন এসেছে। না, দেখি হাফিজ ভাই। অধ্যাপক হাফিজুর রহমান। একটি সরকারী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে সম্প্রতি অবসর নিয়েছেন। উনি একজন অত্যন্ত ভাল কবিও। মূলত উনাকে একজন ভাল চারণ কবিও বলা যেতে পারে। যে কোন বিষয়ের উপর তিনি তাৎক্ষণিক ভাবে কবিতা লিখতে পারেন। এবারের বই মেলাতে উনার তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ বেরিয়েছে। গ্রন্থটির নাম ‘ছায়ার সাথে বসবাস’। উনি একজন অত্যন্ত উচুঁ দরের কবি। তো আমাকে বললেন, আমার অত্যন্ত ইচ্ছা থাকা সত্বেও নিজ হাতে তোমাকে আমার বইটি তুলে দিতে পারলাম না। কারণটা তুমি জান। তুমি অনুগ্রহ করে বই মেলায় গিয়ে আমার বইটি সংগ্রহ করবে। প্লিজ। ২৩ এবং ২৪ নম্বর স্টলে আমার বইটি পাবে। বুঝলে? (আমার জানা ছিল উনার অপারগতা। অসুস্থ পুত্রকে নিয়ে উনার স্ত্রী গেছেন ভারতে। এদিকে দ্বিতীয় কন্যা স্বাতীপ্রভা দ্বিতীয়বারের জন্য সন্তান প্রসব করতে চলেছে। এটি সিজারিয়ান হবে। তাই বাবাকে দায়িত্ব পালন করতে হবে। সুদূর খুলনা থেকে ছুটে এসেছেন ময়মনসিংহে। সেখান থেকে কন্যাকে নিয়ে আবার ঢাকায় আসতে হবে। বেচারার পিতৃ দায়িত্বের কাছে, নিজের শিল্প স্বত্ত্বার আনন্দকে জলাঞ্জলি দিতেই হবে। সবই জানতাম। তবু একটু মজা করার লোভ সামলাতে পারলাম না। বললাম, জানিতো… এটাই বলবেন। রীনা গুলশান ছাড়া কে আর আপনার কাব্য কিনবে?
হা… হা…হু! ঠিক ধরেছো…আমিতো জানি রীনা গুলশানের বইকেনা এবং বই পড়ার প্রীতির কথা…।
হু! তাছাড়া আর কি? এই টরন্টোতেই দেখেন না… ফি বছর একমাত্র ‘রীনা গুলশান’ই প্রত্যেকের বইগুলো হাসিমুখে কিনে আনে!
জানি জানি… রীনাব্রাউন তোমার এই মহৎ গুনটা আমাকে অত্যন্ত প্রভাবিত করে (বাংলাদেশে আমার প্রায় সব কবি বন্ধুরা আমাকে রীনাব্রাউন বলেই ডাকে)।
হি… হি… এবারে আমি হাসলাম। বললাম, আচ্ছা.. আর পাঠাতে হবে না। আমি আজ এমনিতেই একটি দিন বের করেছি বই মেলাতে যাবো বলে।
মাত্র দশ দিন বাংলাদেশে ছিলাম। তার মধ্যে একটি গোটা দিন বই মেলার জন্য উৎসর্গ করা খুবই কষ্টসাধ্য ছিল। তবু সকাল থেকেই হাকডাক করা শুরু করেছি। রুশদী (আমার ভাইপো), রুমানা (রুশদীর সুযোগ্যা স্ত্রী) এই জলদি কর… আরে কি করছিস তোরা…??
আন্টি এত তাড়াহুড়া করছেন কেন? এটা বই মেলা। একটা মাছিও নাই দেখবেন। যদি বাণিজ্য মেলা হতো তাহলে আপনাকে নিয়ে জলদি যেতাম।
সত্যিই যেদিন বাণিজ্য মেলা ভঙ্গ হলো আমি ঐদিন রাতেই ঢাকায় নেমেছিলাম। আমার মাথা পুরাপুরি আউলা অবস্থা। গাড়ীর বহর এবং হর্নের চিলচিৎকারে আমার আত্মরাম খাঁচাছাড়া হবার উপক্রম হয়েছিল। এবং যে কদিন ঢাকাতে ছিলাম, আমার অবস্থা তথৈবচ ছিল।
যাই হোক, অতি সাড়ম্বরে বই মেলায় রওনা হলাম। ভেবেছিলাম অন্যবারের মত শাড়ী পরে বই মেলাতে যাবো। কিন্তু শাড়ী ছিল না। অগত্যা সেলোয়ার কাজিমই ভরসা। পথে যেতে যেতে মারাত্মক নষ্টালজিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছিলাম। ২০০০ সালে শেষ আমি বই মেলায় গিয়েছিলাম। তারপর থেকে আমি কানাডায়। এরপর বাংলাদেশে দুইবার গিয়েছিলাম। একবার এপ্রিলে অন্যবার জুনে। এবারই কাকতালীয়ভাবে ফেব্রুয়ারীতে গেলাম। এবং বই মেলা।
আমি খুবই উত্তেজনা বোধ করছিলাম। বহুদিন পর কোন মানুষ যখন তার প্রিয় মানুষকে দেখে, সে যেমন বোধ করে, আমিও খানিকটা ঐ রকমই বোধ করছিলাম। ভিতরে প্রবেশ কালে হঠাৎ-ই ঐ গানটি মনে পড়লো কি জানি…“এই সেই কৃষ্ণচূড়া… যার তলে দাঁড়িয়ে…. কথা যেত হারিয়ে…”। হাসি পেল খুুউব। নিজেকে নিজেই বললাম : রীনাব্রাউন এখন তুমি আর ১৬ বছরের কিশোরী নও। এখন পঞ্চাশ উত্তীর্ন এক রমনী, এসব ছেলেমানুষী তোমাকে আর মানায় না!! রুমানা বারবার আমাকে অবলোকন করছিল এবং মিটিমিটি হাসছিল!
সেই একই জায়গা, তবে বেশ পরিবর্তন হয়েছে। আমি শেষ যখন গিয়েছিলাম, তার থেকে এখনকার বই মেলার ব্যপ্তি অনেক বেড়েছে। বইয়ের দোকানও অনেক বেড়েছে। প্রকাশনা সংস্থাও বেড়েছে চোখে পড়ার মত। সারি সারি সব বইয়ের দোকান। অনেক আগে বইয়ের দোকান ছিল চিপা চিপা। এখন সব বড় বড়। বইয়ের প্রচুর লিফলেটও দিচ্ছে। কত পার্সেন্ট ছাড় দিবে তার লোভনীয় প্রস্তাব। দোকানগুলো বেশ সাজানো। অবাক হয়ে বইমেলার আপদোমস্তক সাজ সজ্জা দেখছিলাম। ঘন্টাখানেক শুধু ঘুরপাক খেলাম। মনে হলো আগে থেকে সবকিছু বেশী বেশীই আছে। এমনকি চাকচিক্যেরও অবধি নেই। তবু আমার কেন জানি মনে হলো কি যেন নাই। অনেক্ষণ পরে মনে হলো ক্যামন জানি প্রাণ নাই। সেই অনেক আগে বইগুলোতে যে প্রাণ থাকতো সেটাই কোথাও খুঁজে পেলাম না। মানে ঠিক ঠিক মেলা বলে মনে হলো না। মনে হলো যেন বাংলা বাজারে সার সার সব বইয়ের দোকানে যেমন বই কিনতে যাই, এ যেন তাই।
এরপর আমার বিভিন্ন দোকানে ঢু মারার পালা। একটার পর একটা বুথে যাচ্ছি আর নতুন বইয়ের মাতাল করা গন্ধে আমি বিভোর হচ্ছি। আমি সারা জীবন বই দেখলে পাগল হয়ে যাই। মনে হয় সব বই যদি বস্তা ভরে বাসায় নিয়ে যেতে পারতাম। উহ, কি ভালই না হতো। আজ পর্যন্ত আমার সাথে যারা যারা বই মেলায় গেছে তারা আমার সম্পর্কে প্রায় সকলেই ভেবেছে বইয়ের ব্যাপারে আমি বদ্ধ পাগল গোছের কিছু। কারণ, মহিলারা সাধারণত জুয়েলারী অথবা শাড়ীর দোকানে গিয়ে এইরকম বিহেভ করে। আর আমিতো উল্টো পথের পথিক।
দেখলাম প্রচুর নতুন লেখকের সারি। বইয়ের বিষয়বস্তুর আধিক্যও চোখে পড়ার মত। কৃষ্টি, দর্শন এবং রন্ধনের উপর প্রচুর বই। দেখে ভাল লাগলো। ‘ছায়ার সাথে বসবাস’ বইটাতো সাথে সাথেই কিনে ফেললাম। এছাড়া সম্পূর্ণ নতুন লেখকের একটি দর্শনের উপর বই কিনলাম। অন্যটি কিনলাম ইসলামে দার্শনিক চিন্তাধার এরকম একটি বই। এগুলো কেউ কিনছে না।
মজার ব্যাপার দেখলাম প্রায় ৩/৪ ঘন্টা হয়ে গ্যাল, ঘুরপাক খাচ্ছি, কারো হাতে কোন বই নাই। হা-হতোম্মি!! কিছু কিছু নতুন বাবা/মা (বাচ্চার বয়স ২/৪ বছরের মত) তারা কিছু ছবি সমৃদ্ধ বই কিনছে। আর ফুচকাওয়ালা এবং চটপটি, ক্যান্ডি বারের (হাওয়াই মিঠা) ওখানে উপচে পড়া ভিড়। মেজাজ টা কি খারাপ হলো।
চোখটা ইতি উতি ঘুরপাক খাচ্ছিল পরিচিত কবি পরিজনদের জন্য। কাউকে দেখছি না। রফিক ভাই (আজাদ) অসুস্থ আগেই শুনেছিলাম। (এখন তো উনি না ফেরার দেশেই চলে গেছেন) তিনি আমার পরিচিতজনদের মধ্যে অত্যন্ত প্রিয় একজন শ্রদ্ধাভাজন মানুষ ছিলেন। এমনকি আমার রীনা গুলশান নামটি রফিক ভাই-ই ঠিক করে দিয়েছিলেন। তার আগে আমি গুলশান আরা রীনা নামে লিখতাম। তখন রোববার নামে একটি সাপ্তাহিক বের হতো। সেখানে একটা লেখা পাঠালাম ‘বৈরিতার ধরণ’। রফিক ভাই বললেন, রীনা তোর নামটা কেমন যেন মুখে আটকে যায়। আরা টুকু বাদ দিলে কেমন হয়? সবাই হৈ হৈ করে বলছিল, দারুন হয়। ওখানে তখন নির্মলেন্দু গুণ, রশিদ হায়দার, রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, কামাল মাহমুদ, কামরুল ইসলাম, আর খুলনার কয়েকজন নামী দামী কবি ও লেখক উপস্থিত ছিলেন। সেই থেকে আমি রীনা গুলশান নামেই লিখছি। তাই রফিক ভাইয়ের মৃত্যুতে সত্যি শোকাহত হয়েছি।
কামাল মাহমুদও ফোনে বলেছে আসতে পারবে না। চট্রগ্রামে নেভাল একাডেমীতে ৪৯ দিন দেখা না হওয়া পুত্র দর্শনে গেছে। তাই খুব শুন্যতা অনুভব করছিলাম। এই জন্য বোধ হয় বই কিনছিলাম কিন্তু মজা পাচ্ছিলাম না। অন্য আর একটি জিনিষ দেখলাম। সেই একোদ্বিতম “পুস্তক শ্রেষ্ঠ বিক্রয় সম্রাট” হুমায়ুন আহমেদ এর বই নানাভাবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে প্রকাশকরা নতুন মলাটে নতুন প্রচ্ছদে বের করছে। এবং পাঠক তা খাচ্ছে। ২/৫ জন যে বই কিনছে সবার হাতেই দেখলাম তাঁরই বই।
হঠাৎ অদুরে চেয়ার নাকি একখানা ছোট বেঞ্চের উপর একটি ধবল মূর্তি। অর্থাৎ সাদা, চিকন পাড়, ভেতরে মনে হয় একটু কালোর স্ট্রাইপ দেওয়া শাড়ী পরিহিত একজন রমনী বসে আছে। হাত দুটো কোলের উপর। অবিন্যস্থ চুলের গোছা টেনে হয়ত খোপা করা। আরে খুউব পরিচিত এই মুখটা। চশমা পরেও আজকল একটু ঝাপসা দেখি। একটু এগিয়ে গেলাম। ওমা এ যে গুলতেকিন আহমেদ। হুমায়ুন আহমেদের ৬ সন্তানের জননী (দুই জন মারা গেছে)। অথচ তাকেতো কেউ বলবে না? তবে সে কে? এই তো সেই নারী… নবম শ্রেণীতে পড়াকালিন ঘর থেকে পালিয়ে, কেউ চিনতো না সেই অখ্যাত হুমায়ুন অহমেদের হাত ধরেছিলেন। তার পর কত ত্যাগ তিতিক্ষার পর কত স্বার্থত্যাগ করেছিল এই রমনী তার স্বামীটিকে বিখ্যাত করতে। যখন স্বামীর যশের পেয়ালা কানায় কানায় পূর্ণ হলো, সেই বিখ্যাত ‘সোম রস’ পান করলো অন্য এক রমনী। কি জানি ক্যানো, হঠাৎ চোখ দুটো আরো ঝাপসা হয়ে গ্যালো- হৃদয়ের তন্ত্রীতে কে যেন গেয়ে গ্যালো গান অন্য সুরে –
“মনে হবে সন্ধ্যাবেলা সারা ধরাতলে
অবসন্ন কুসুমেরা ঝড়িতেছে বনবীথিতলে নীরব রোদনে
মনে হবে নীরব রোদনে
যেন, আপনি বলতে চান
মনে রেখ, মনে রেখ সখা
যেন কেহ কোনদিন মনে রাখে নাই
মনে আর রাখিবে না
কেহ ডাকিবে না কোনদিন জোৎস্নার ভিতরে
রক্তের উদগ্রীব তৃষ্ণা কেহ আর মেলিবে না
উষ্ণ ওষ্ঠাধরে।
দৃষ্টি আরও নত হবে…..
সন্মুখে কোথাও যেন দেখিবার মত দৃশ্য নাই।
সব দৃশ্য ঝরে গেছে বনবীথিতলে নীরব রোদনে
নিরন্ত ধূপের সাদা ছাই
রজনী -পোয়ানো কিছু মৃত গোলাপের দীর্ঘশ্বাস…॥
(কানের মধ্যে বেজে চলেছে ক্রমাগত ‘পূর্ণেন্দু পত্রী’।)
হঠাৎ কিছু ফ্লাশ লাইটের চমকানিতে বাস্তবে ফিরে এলাম। ঝাপশা চোখ সকলের অজান্তেই মুছে নিলাম করতলে। দেখলাম বেশ কিছু মানুষ ঐ শোকাতপ্ত মূর্তিটির ছবি তুলছে দূর থেকে। কেউ বা বেশ কাছে থেকে। হঠাৎ আমার নিজেরও ক্যামেরার কথা মনে পড়লো। ব্যাগ হাতড়ে দেখি, নাই। ক্যামেরা নাই। ওমা গ্যালো কই? ওহ…হো- গত রাতে তো ‘খাজানায়’ গিয়েছিলাম ডিনারে, তারপর আমার বেড সাইড টেবিলে রেখে দিয়েছিলাম। ব্যাগে ঢুকাতে আর মনে নেই। ঈশ্… বইমেলার একটা ছবি নিবো না? এত বছর পর এলাম। সেই আমার বইমেলার একটা ছবি নিতে পারলাম না! আমার আক্ষেপ শুনে রূশদী বললো, ওকে আন্টি আগামী বছর ….! আমি মনে মনে বললাম… ইনশাল্লাহ। একটি বই মেলার জন্য আমি প্রতিবার যেতে রাজী আছি বাংলাদেশে। আমার নিজের দেশে। নিজের মাটি…সেই সব মাতাল করা আমার স্মৃতির পাখিরা উড়ে উড়ে আসে। বুকের মধ্যে ক্রমাগত ডানা ঝাপটায়। অকারনে হৃদয়ের কোনায় কোনায় রক্তাক্ত করে।
আবার তখুনি মনে পড়ে আটলান্টিক পাড়ি দেওয়া সেই অসম্ভব ক্লান্তিকর ১৪ ঘন্টা এবং এরপর আরো ৬ ঘন্টা!! তখন আবার বিমর্ষ হয়ে পড়ি।
ব্যাগের মধ্যে হঠাৎ যেন ফোনটা বেজে উঠলো… রিন রিন করে। অবিরত… ধরতেই হলো… কিন্তু সে তো অন্য এক বার্তা!!
রীনা গুলশান, টরন্টো।