প্রবাসে পরহিতকর্ম – ২১
মার্চ ১৩, ২০১৬
॥ রীনা গুলশান ॥
বাংলাদেশ থেকে ফিরে এলাম ১৮ ফেব্রুয়ারি। মাত্র দুই সপ্তাহের জন্য বাংলাদেশ? প্রায় ৬ দিনতো রাস্তায়ই চলে যায়। ১০ দিনের মত সময় থাকে। তাতেই আবার ঢাকা-খুলনা। কি যে যন্ত্রণা! বলে বোঝানো যাবে না। যদিও আমার কাজ ছিল এবার ঢাকাতেই। বাপের বাড়ি শ্বশুর বাড়ি সবই ঢাকায়। তবু হোম সিটি বলে কথা। বাংলাদেশে যাব আর খুলনায় যাবো না! তাও কি হয়? বিশেষ করে আমার কুয়েট ক্যাম্পাসে! দেশে যাওয়ার আগেই কুয়েটে বলা ছিল যে আমি আসছি। একটা গোটা দিন ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত কুয়েটে কাটিয়েছি। এত আনন্দময় সময় বহুবছর অতিবাহিত করিনি। আর বাংলাদেশে যাবার সাথে সাথেই আমার আবাল্যের ছায়াসঙ্গী একমাত্র বন্ধু মিনু আমার সাথে লেগেই রইল। পড়ে রইল পেছনে ওর কলেজ (অধ্যাপনা করে), সংসার, স্বামী, বাচ্চা! ওর স্বামীতো জানেই, রীনা এসেছে, এখন মিনুর জীবন রীনাময়।
৩১ জানুয়ারী ঢাকায় পৌঁছালাম, ঐ দিন ঢাকায় বাণিজ্য মেলা শেষ হলো। মনে হলো মানুষের ঢল নেমেছে। মানুষের না বলে বলা উচিৎ গড়ির ঢল নেমেছে। ঢাকা শহরের আর কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না। গাড়ি আর গাড়ি। ওহ! সে একটা প্রচন্ড ভীতিকর অভিজ্ঞতা। কোন নিয়ম কানুন কিছুই নেই। একটা গাড়ি সোজা যাচ্ছে তো অন্য আর একটা গাড়ি তাড়াতাড়ি ঐ গাড়ির সামেনে চলে আসছে। আবার সিএনজি গুলোতো কোথা দিয়ে কোথায় ঢুকিয়ে দিচ্ছে… আমি ভয়ে আতংকে অস্থির হয়ে পড়লাম! একেতো ২৩/২৪ ঘন্টার জার্নি! তাইতে ঢাকার রাস্তার এই হাল। ফ্লাইওভার ২/৪টা হয়েছে তা চোখেই পড়লো। এত ছোট ছোট ফ্লাইওভার এবং এত সীমিত, যেন ১০ কেজি গরুর মাংশে ১ পিস আলু!!
ঢাকায় যে কদিন ছিলাম, রাস্তায় বের হলেই সমানে ‘দোয়া ইউনুস’ পড়ে চলেছি। মনে হতো জান হাতে করে বাড়ি আসলেই বাঁচি। কিন্তু খুলনায় গেলেই অপার শান্তি। খুলনাতে সব ওয়ান ওয়ে রাস্তা। খুব চওড়া চওড়া ঝকমকে রাস্তা। খুলনায় আবার নতুন একটা যান হয়েছে ‘অটো’। বেশ বড়সড় (আগে যেগুলোকে স্কুটার বলা হতো), কিন্তু খুব চওড়া। মিটারে চলে। বেশ আরামপ্রদ যান। খুলনার রিক্সাগুলোও খুব সুন্দর। সিটগুলো সোজা। হুডগুলো চৌকা মত। আর ঢাকার রিক্সাগুলোর হুডগুলো গোল, সিটগুলো ঢালু, উঠলেই মনে হয় এই বুঝি পড়ে গেলাম। কি যে যন্ত্রণা!! মনে করবেন না হোম টাউন বলে আদিখ্যেতা করছি। স্বচক্ষে দেখে আসতে পারেন। তবে পদ্মার ব্রিজটি হয়ে গেলে খুউব সম্ভবত ঢাকার এই ভিড় বহুলাংশে কমে যাবে। খুলনা, যশোহর, ঝিনাইদহ, ঝিকরগাছা, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, এদিককার বেশ কিছু মানুষ হয়তোবা যার যার নিজ আবাসে ফিরে যাবে। শান্তিতে থাকবে, স্বস্তিতে থাকবে তারা। আমি এটা আশা করছি। এবং অবশেষে ঢাকা হালকা হবে। আমার এখন ঢাকাকে মনে হয় মুড়ির টিন। এবারে যেয়ে দেখলাম (প্রায় ৭ বছর পর গিয়েছি) ঢাকা তার সমস্ত সৌন্দর্য হারিয়ে একেবারে জবুথবু হয়ে বসে আছে। এমনকি উত্তরা গুলশানেও দেখলাম গাড়ির বহর। এককথায় অসহনীয় এই ট্রাফিক। সিএনজি’র আশিভাগ মিটারই নষ্ট। বেশীর ভাগ সিএনজি’র ড্রাইভাররা একটা দাম ধরে বলে দিবে। বিশেষ করে বসুন্ধরা মলের সামনে সিএনজি’র ড্রাইভাররা তো মহা লাটসাহেব। বসুন্ধরা থেকে আদাবর যাব, সিএনজি’র ড্রইভারকে বললাম – যাবেন ভাই?
‘হ যামু, তিনশ টেকা।’
বলে কি! আমি বললাম ভাই মিটারে যা উঠবে তাই নিবেন, তার থেকে না হয় দু-দশটাকা বেশী নিবেন।
‘না যামু না’ সোজা জবাব।
দেশে কি আইন নাই নাকি? আমি ঐ লাইন বাদ দিয়ে অন্য একটা হঠাৎ থেমে পড়া সিএনজি’তে উঠলাম। আদাবর ১১ নম্বর রোডে গেলাম। বাড়ীর সামনে – মিটারে উঠলো ৮০ টাকা। আমিতো সত্যিকারের হতভম্ব হয়ে গেলাম। আমি খুব খুশী হয়ে লোকটাকে আরো ৩০ টাকা বেশী দিলাম। লোকটা খুব ঈমানদার। বললো, আপা, বেশী দিচ্ছেন। আমি বললাম -ভাই, এটা আপনাকে দিলাম। ঈমানের সঙ্গে চললে আল্লহপাক তাদের দু’হাত ভরে দেয়।
যেহেতু এবারে আমি মূলত কাজে গিয়েছিলাম দেশে এবং কাজটি মূলত ঢাকাতেই তাই চরকীর মত ঘুরতে হয়েছে ঢাকাতেই। ঢাকাতে একটি জিনিষ আমার চোখকে খুবই আহত করলো। বাড়িঘরগুলোর খুবই হতশ্রী দশা। বেশীরভাগ বাড়িতেই দেলাম রঙ নেই । আর সরকারী কোয়ার্টারগুলোর অবস্থাতো বলার মতো নয়। প্রথম শ্রেণী থেকে শুরু করে তৃতীয় শ্রেণী কোন কোয়ার্টারেই রঙ নেই। গোটা ঢাকা শহরই এখন পুরানো ঢাকা শহর হয়ে গেছে। বে রঙ। আমাদের রাজধানী বলে কথা।
আর দেখলাম গোটা দেশে বেশ খুচরা মাস্তানে ভরে গেছে। এরা যত্রতত্র মোটর বাই নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। চান্স পেলেই মাস্তানী করে। তাও যেমন তেমন না। ভয়াবহ ভাবে। প্রথমে একবারে কুৎসিৎতম খিস্তি খেউড় করবে। তারপর বলবে-‘ফুটা কইরা ফালামু … শা…’। ভয়ে আত্মারাম খাঁচা ছাড়া হয়ে যায়! মনে হয়, এটাই কি আমার দেশ? এই দেশের জন্য আমরা কি না করেছি? কত অশ্রুপাত, রক্তপাত!!
আর সেই রক্তপাতের মূল সূত্র-ই ভাষা! বাংলা ভাষা। পৃথিবীর সর্বত্তম মিষ্টি ভাষা, আমাদের বাংলা ভাষা। সেখানেও দেখলাম বে রঙ!! বিশেষভাবে ঢাকায়। এদিকে ২১ শে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে দেখলাম শাড়ী, পাঞ্জাবী কেনার ধুম পড়ে গেছে। ১০ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকার সব শাড়ী কিনছে! টাকাই টাকা। ঢাকা শহরে দেখলাম সত্যিই টাকা উড়ছে। শুধু ধরতে জানতে হবে। ঐ জানাটাই তো কখনো হলো না। শুধু চেয়ে চেয়ে দেখেই গেলাম। মানুষ কোথা থেকে কিভাবে কত দ্রুত উপরে উঠে যাচ্ছে। উপরে উঠার মইটা এদের হাতের মুঠোয়। বাংলাদেশে গেলে নিজেকে ভীষণ অকিঞ্চিতকর মনে হয়। ওরা মনে করে আমরা ডলারের দেশ থেকে এসেছি, আমরা কেন এত হিসাব করছি? আমরাতো দু হাতে টাকা উড়াবো। কিন্তু আমাদেরতো রক্ত পানি করা ডলার। ওরা বোঝে না।
তো, বসুন্ধরাতে, দেখলাম এক মহিলা নিমিশেই দেড়লাখ টাকার শাড়ী নিল, (আজকাল ঢাকাতেও ক্রেডিট কার্ড সিস্টেম হয়ে গেছে) সাদা কালো তাতে অ, আ, ক, খ ইত্যাদি বাংলা হরফ খুব যতœ করে ছাপানো। তবে ঐ মহিলা হরফগুলো আদৌ পড়তে পারে কিনা, আমার যথেষ্ঠ সন্দেহ আছে। কারণ তারা তিনজন মহিলা ছিল। (৫০-৬০ এর মধ্যে বয়স হবে) তারা অবশ্যই বাঙ্গালী। যদিও তারা পোষাক পরেছিল পশ্চিাম ঢং এর। তারা অনর্গলভাবে বাংলিশ এ কথা বলে যাচ্ছিল। মাঝে মাঝে ভেঙ্গে ভেঙ্গে বাংলা বলছিল। খুউব কষ্ট হচ্ছিল বাংলা বলতে। দাঁত মুখ ভেঙ্গে যাচ্ছিল বাংলা শব্দগুলো বলতে। বেচারা সেলস ম্যানদের খুবই কষ্ট হচিছল তাদের ভাষা বুঝতে। ওদের কথা শুনে যা বুঝলাম (নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছিল) ২১ ফেব্রুয়ারিতে একটা র্যালী বের করবে এদের কোন ক্লাব থেকে সম্ভবত। তো মোটামুটি সবাই একই ধরণের শাড়ী পরবে।
শুধু এই মহিলা তিন জন নয়, যে সমস্ত আত্মীয় স্বজনদের (ঢাকা) ওখানে বেড়াতে যাচিছ, মোটামুটি একই চিত্র। ভেঙ্গে ভেঙ্গে বাংলা বলছে। এবং বাংলাটা তাদেরকে কষ্ট করে বলতে হচ্ছে , এই জন্য তাদের দুঃখের অবধি নাই। ইশ্ কি যে কষ্ট! এদের কষ্ট দেখে আমারও কষ্টের কোন সীমা রইল না।
বুঝলাম এরা ঢাকার সব বিখ্যাত ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ছে, তাই বলে বাংলা বলতে লজ্জা পাবে কেন? একজন মা’কে কিজ্ঞাসা করলাম, ঘটনা কি? আপনার বাচ্চা ভাল করে বাংলা বলতে পারছে না কেন? মা’য়ের খুবই সাবলিল জবাব, এদের মিস’রা (শিক্ষিকা) বলে দ্যায়, সব সময় ইংলিশে কথা বলবে, পরিবার, বন্ধু, সবার সাথে। না হলে ইংরেজীর উচ্চারণ এবং অনর্গল ভাবটা আসবে না। এইসব স্কুলে (কোন কোন) মাসে ১ লাখ টাকা বেতন। অন্যান্য খরচতো পড়েই রইল। আমার মাথাটা পুরাপুরি আউলা হবার যোগাড়! কি অবস্থা!!! আলেকজান্ডারের মত বলতে ইচ্ছা করলো – হায় সেলুকাস! ‘কই আইলাম’। বাংলাদেশেই তো? না অন্য কোথাও, অন্য কোনখানে?
ভাল লাগলো দেখে ঢাকায় গড়ে ৭০-৮০% লোকের হাতে টাকা আছে। তবে প্রায় ৩০% লোকের হাতে কত টাকা আছে তা অবশ্য তারা নিজেরাও জানেনা। কারণ, এসব টাকা নর্থ আমেরিকার মত হিসাবের মধ্যে থাকলে অবশ্যই বিল গেটসকে হারানোর সম্ভাবনা প্রবল। এদের এক পা থাকে বাংলাদেশে (এখানে বসে টাকা কামায়), অন্য পা থাকে বিদেশে! সব ব্রান্ডের কাপড়, ব্যাগ, কসমেটিকস্ ব্যবহার করে। দেখা গেলো পরিবারের সদস্য সংখ্যা ২/৩ জন। কিন্তু কাজের লোক, ড্রাইভারসহ ৭/৮ জন। সার্ভেন্টস রূম, বাথরূম আলাদা।
এক আত্মীয়ের বাড়িতে গেলাম। লাঞ্চে নেমন্তন্য ছিল। টেবিল লাগাচ্ছিল পরিচারিকা। হঠাৎ দেখলাম, মালকিন উঠে গ্যালো-আমি একটু এমনিই পিছু পিছু গেলাম, দেখলাম – চাল মেপে দিচ্ছে কাজের লোকদের জন্য। আমি বেশ বিস্মিত হয়ে মালকিনের দিকে তাকালাম, তো মালকিন চাপা স্বরে বললো, আমরা যে চাল খাই এগুলোর দাম অনেক বেশী। তাই এই ব্যবস্থা। তাছাড়া ড্রাইভারসহ কাজের লোক তো ৫ জন। ভাবলাম বলি, ভাই তোরা তো নিজেরা ২ জন… কাজের লোক এতগুলো ক্যানো দরকার? তাও যদি ছোট বাচ্চা কাচ্চা থাকতো! মনটা বড়ই খারাপ হয়ে গ্যালো। টেবিলের এ মাথা থেকে ও মাথায় খাবারের আয়োজন দেখে চক্ষু চড়কগাছ। আমি একা মানুষ! এত খাবার? আমার আবার বাংলাদেশে যাবার ৩/৪ দিল বাদেই প্রচন্ড ডায়েরিয়া হলো! তাই খাবার দেখলেই বমি বমি আসছে। আমি শুধু পাবদা মাছ একপিস আর একটু পাতলা ডাল খেলাম। সব খাবার ‘হা’ করে টেবিলে পড়ে রইল। মহিলা ভাবলো আমি ‘ডায়েটে’ আছি। আসলে মনটা খুবই খারাপ হয়ে ছিল ঐ চালের ব্যাপারটি দেখার পর থেকে। এটা অবশ্য অনেক অনেক বাড়িতেই দেখেছি যখন বাংলাদেশে ছিলাম। কিন্তু আমি ব্যক্তিগত ভাবে এগুলো ভাবতেই পরিনা। মনের ভিতর একটা কষ্ট এবং ক্রোধের ভাব জন্ম নিল। ভাবলাম-এরা টাকাতেই বড় হয়েছে। হৃদয়ের দিক থেকে সেই যে বৃত্তে ছিল সেখানেই রয়ে গেছে।
আমি সর্বতভাবে এই সব পরিজনদের কাছ থেকে দূরে থাকতে চাই। কারণ, আমি খুবই নিম্ম মধ্যবিত্তদের একজন। শিক্ষকের কন্যা, শিক্ষকের স্ত্রী। এটাতেই আমার সুখ এবং অবশ্যই একধরণের ভাল লাগার অহঙ্কার!! এখানেও আমার বেশ কিছু নিকটজন আছে, আমি তাদের থেকে শত হস্ত মাই শত মাইল দূরে থাকি, মনে প্রাণে। কারণ, ধর্মে আছে আত্মীয় স্বজন ত্যাগ করলে, আল্লাহপাক ক্ষমা করবেন না… কিন্তু কি করবো, এদের সাথে কথা বলার কিছুক্ষণ পরেই বিষয় বস্তু এসে যায় … পরবর্তী গাড়ি কোনটা কিনবে?
তাই… আমি আমার মত, যেখানেই যাই মাটির কাছাকাছির স্বজন/বন্ধু খুঁজে বেড়াই। পেয়েও যাই… এ ব্যাপারে আমি খুউব ভাগ্যবতী। বন্ধু ভাগ্য খুউব ভাল!
কাকতলীয় ভাবে বইমেলা’র মাসেই গেলাম ঢাকাতে। এটাও প্রায় ১৬ বছর পর ঘটে গ্যালো। তাই বই মেলাতে যাবো না, তা কি করে হয়? অতএব, একটা গোটা দিন বইমেলা দর্শনে গেলাম। তার বিস্তারিত পরবর্তীতে লিখছি। (চলবে)
রীনা গুলশান
কবি ও লেখিকা।
টরন্টো।gulshanararina@gmail.com