প্রবাসে পরহিতকর্ম -২০

ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০১৬

॥ রীনা গুলশান ॥

শুভ নববর্ষ। আমার প্রিয় পাঠক , পাঠিকা এবং আমার শুভার্থী, যারা আমাকে ভালবাসেন অথবা খুবই অপছন্দ করেন সবাইকে আমার অনেক অনেক নববর্ষের শুভকামনা।

২০১৫ আপনাদের সকলের কেমন গ্যালো জানিনা। তবে আশা করছি ২০১৬ আপনাদের আরো ভাল যাবে এবং মনোবাসনা পূরণ হবে।

২০১৫ ব্যাক্তিগত ভাবে আমার ভালই যাচ্ছিল মোটের উপর। ছোট ছেলেটা বিশ্ববিদ্যালয় অতিক্রম করলো। ৫/৬ সপ্তাহের মধ্যে চাকরীও পেয়ে গেল। এরই মধ্যে হঠাৎ গত ১৮ নভেম্বর আমার মাথাটা ঘুড়ে পড়ে গেলাম, পড়ে গিয়েছিলাম সোফার কর্নারে। পড়ে গিয়ে আমার বাম পাশের পাজড়ের ৬ নম্বর রিব ভেঙ্গে ২ খন্ড হয়ে গেল। আজব। এই রকম ঘটনা আমি জীবনে কখনো শুনিনি। শুনেছি, দেখেছি, মানুষের হাত ভাঙ্গে, পা ভাঙ্গে, কোমর ভাঙ্গে, মাথাও ভাঙ্গে এমনকি মনও ভাঙ্গে। কিন্তু পাজর ভাঙ্গার কথা প্রথম শুনলাম। হাসপাতালে ডা: চ্যাং প্রথমে যখন বললো ইউ ব্রোক ইউর রিব! আমি আচমকা ইংরেজী ভাষাটা বিস্মৃত হলাম। ভাবলাম, ব্যাটা চৈনিকটা বলে কি? আমি মনে হয় তিনবার রিপিট করলাম- তুমি কি বলছ? আমি কিছুই বুঝতেছিনা…!

ডা: চ্যাং যদিও ইমার্জেন্সির ডাক্তার, কিন্তু বয়স কম, তাই এখনও অসীম ধৈর্য্য! সে ঠিকই বুঝলো আমি অসম্ভব নার্ভাস হয়ে পড়েছি। তো সে আমাকে রীতিমত ছবি দেখিয়ে বুঝিয়ে বললো – রিব ভেঙ্গেছে এবং কতটুকু  ভেঙ্গেছে তাও দেখিয়ে দিল। যাই হোক, লম্বা সময় বেড রেস্টে ছিলাম। কারণ এর কোন ব্যান্ডেজ হয় না। আর ব্যাথা নাশক ঔষধ ছাড়া কোন চিকিৎসাও নাই। তবে কাজে যোগ দিয়েছি। ৩/৪ ঘন্টা বসে থেকে বাসায় চলে আসি।

এর মধ্যে খবর পেলাম প্রবাসী কন্ঠের সম্পাদক খুরশিদ ভাইয়ের মা ইন্তেকাল করেছেন (ইন্নালিল্লাহে… রাজিউন)। কি যন্ত্রনা। একটার পর একটা খারাপ খবর আসছে বছরের শেষে। এই খবরের দুইদিন পরই খবর এলো আমার সবেধন নীলমনি একটুকরো জমি আছে ঢাকায়। সারাজীবনের সঞ্চিত ধন দিয়ে ঐ একরত্তি জমি (২  ১/২ কাঠা) কিনেছিলাম। আমার স্বামী এত বড় পোস্টে জব করেও ঐ টুকুনই সম্পত্তি করতে পেরেছিল। অথচ, তার কত জুনিয়র কলিগ এবং  কত কত ছাত্রদের দেখেছি বিভিন্ন জায়গাতে বাড়ি,গাড়ি করে এলাহী কারবার! আমার তাতে কোনই দুঃখ নাই। এমনকি কখনো আকাংখাও ছিল না। কারণ শিক্ষকের কন্যা, শিক্ষকের স্ত্রী। এটাই আমার অত্যন্ত আহংকার!! এটাই আমার সান্তনা যে সৎ পয়সায় গোটা জীবনটা অতিবাহিত করছি।

সেই আমার ঐ একরত্তি জমির উপর কেন মাস্তান বাবাদের নজর পড়লো? তাও আবার গুলশান, বানানী, বারীধারা এমনকি উত্তরাতেও নয়। সেই শ্যামলীর ওখানে। একটা রিসিডেন্সিয়াল  এরিয়াতে। তবে জমিটা দুই রাস্তার কর্নারে। তাই বাবাদের জীবনদের নজরে পড়েছে। দিব্যি Ñ “পরের ধনে পোদ্দারী মিয়ার বড় সর্দারী!” ছোট একটা ঘর বানিয়ে রেখেছিলাম সিকিউরিটির জন্য। সেটাতে এখন ক্লাব ঘর বানিয়ে বসে আছে। এর মধ্যে আমার বড়ভাই দেশে গিয়েছিলেন। উনি থাকেন নিউইয়র্কে। বয়স হয়েছে। আজকাল দেশে গেলে আর আসতে চান না। ওখানে তার বিরাট একটা দল আছে। এক সাথে তারা মর্নিং ওয়াকে বের হন। নাম ও আছে ঐ দলটির। ‘সুপ্রভাত হাটা কমিটি’। একই সিলমারা টি শার্ট পরে তারা হাটতে বের হন। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই তারা হাটতে বের হয়েছেন। তখন জোরে হাটার পালা। হঠাৎ ভাইজানের বন্ধু ওমর ভাই চেচিয়ে উঠলেন (উনারা আমার জায়গার পাশ দিয়েই রোজ হাটেন):

এই…মহিউদ্দিন… আপনার বোনের জমিতে যে সাইন বোর্ড দেখতাম সেটি তো আজ দেখছি না…। ঐ সাইনবোর্ডটি তো শক্ত করে লাগানো ছিল কাঠের উপর। পড়ে যাবার কথাতো নয়। ভাইজান বিষ্ময় প্রকাশ করলেন। আমি আবার জমিতে পাইলিং করে পাচিল দিয়ে, গেট দিয়ে মাঝখানে ছোট্ট একটা বেড়ার ঘর বানিয়ে দিয়েছিলাম। ভাইজানের সিকিউরিটি রাতে গিয়ে ওখানে ঘুমাতো মাঝেমধ্যে।

ভাই এবং বন্ধুরা ছুটে গিয়ে ভেতরে ঢুকে দেখেন ঘরে মধ্যে একটা গোল টেবিল ফেলে একদল মাস্তান টাইপের ছেলে ক্যারাম খেলছে আর হৈচৈ করছে। আর জোরে মিউজিক বাজছে। ভাইজানতো হতভম্ব হয়ে কথাই বলতে পারছিলেন না। অনেক্ষণ পর শক্তি সঞ্চয় করে নেতাগোছের ছেলেটাকে বললো : – আপনারা কে ভাই?

আমরা যেই হই… তাতে তোর বাপের কি?

ভাইজান এবারে কি রকম আশ্চর্য হয়ে পড়লো। বাপের বয়সী একজন মানুষের সঙ্গে এভাবে কথা বলছে!

আমার ভাইজান প্রায় ৪০ বছর ধরে প্রবাসী। তাই এভাবে কথা বলা ও শোনার কথা ভাবতেও পারেন না। তাই মিন মিন করে বললো, না… মানে এখানে একটা সাইনবোর্ড ছিল

(আমার নামে লেখা, এই জমির মালিক অমুক, এই ভাবে লিখে রাখতে হয়, যতদিন বাড়ী না বানানো হয়।) দেখছি না তো? উল্টো বাবাজীল্ডে প্রশ্ন -কার সাইনবোর্ড, কিসের সাইনবোর্ড? এই জমিটাতো আমার বোনের, তার নামের সাইনবোর্ড।

হতে পারে… এখন এটা আমাদের নেতাজীর!

নেতাজী? সেটা আবার কে?

এবার ভাইজানও একটু গরম হলো। বললো, এটা কি মগের মুল্লুক নাকি? রাতারাতি আমার বোনের জমি তোমরা দখল করে ফেলবে?

হু, করেছি। কি করবি বলেই ভাইজানের মুখের উপর একটা জোরে ঘুষি মারলো। এর পরই ভাইজানকে একটা চেয়ারের সাথে বেধে ফেললো। তার পর ভাইজান এবং তার বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে বললো, যদি এর জান বাচাতে চাস তো আমাদের চা নাস্তা খাবার টাকা নিয়ে আয়।

ভাইজানের বন্ধুদের অবস্থাতো খুবই খারাপ। এদের সবার বয়সই ষাটের উপর। তাই সবাই যেমন রেগে গেছেন তেমন আবার ভয়ও পেয়েছেন। তবু মিনহাজ ভাই একটু সাহস করে বললেন, চা নাস্তার টাকা কত দিতে হবে বাবারা? (উনি ভেবেছিলেন চা নাস্তা মানে ১ থেকে ২ হাজার টাকা দিলেই চলবে।)

ওকে, ৫ লাখ টাকা নিয়ে আয়, যদি এর জান বাচাতে চাস!

কি বলছেন? ৫ লাখ!

যাই হোক, এরপর ৪/৫ ঘন্টার আলোচনা এবং কান্না কাটি করেছে বন্ধুরা, এরপর দেড় লাখে রফা হলো। ওখান থেকে ওমর ভাই তাড়াতাড়ি গিয়ে (উনার অবস্থা বেশ ভাল) ব্যাংক থেকে টাকাটা  তুলে আনেন। তারপর টাকাটা ঐ ছেলেদের দিয়ে ভাইজানকে ছাড়িয়ে এনেছেন। ভাইজান তো দুই দিন হাসপাতালে ছিলেন। তার যতটা না শারীরিক তার চেয়ে বেশী মানসিক আঘাত লেগেছিল। এর পরতো অনেক দৌড়ঝাপ অনেক ঘাটের জল খাওয়া। তবে এটুকু বলতে পারি Ñ ব্যাপারটি এত সহজ ছিল না। অনেক উপরের সিড়ি থেকে আমার জমিকে অবার ছুঁতে পেরেছি। এ যেন এমন, ‘রাবনের সীতা হরণ’। এবং সীতাকে ছাড়াতে যেয়ে রামের কি কি করতে হয়েছে , যারাই ‘রামায়ন’ পড়েছেন তারাই জানেন। উপরে আল্লাহ, নীচে আমি ও একজন হনুমান পেয়েছিলাম বলেই  অবশেষে জমিটা আবার ফিরে পেয়েছি। এখন এই ভাঙ্গা পাজর নিয়েই আমি বাংলাদেশে যাচ্ছি , জলের দরে জমিটা বেচে দিতে। অথচ এই জমিটা নিয়ে আমাদের অনেক স্বপ্ন ছিল। কত কি যে আমি আর আমার স্বামী দুজন মিলে ভেবে রেখেছিলাম। বাংলাদেশে আমার নিজের বলে কিছুই নাই, এই এক টুকরো জমি ছাড়া। মাত্র ১ বছর আগে আমার স্বামীর একজন প্রিয় বন্ধু হাবিব ভাই, এখানেই থাকেন, উনারও ইস্টার্ন হাউজিং এ ১০ কাঠা জমি ছিল (২৫ বছর আগে কিনা)। গত বছর এখানে একটা বাড়ি কিনবে বলে বাংলাদেশে গিয়েছিলেন, জমিটা বিক্রি করার জন্য। সেতো মহা অবস্থা। রীতিমত ইটের গাথুনী দিয়ে বাবাজীরা একটা ক্লাব বানিয়ে ফেলেছে। এবং তাদের চালাচ্ছে দেশের একজন মহান নেতা। হাবিব ভাই এমনিতেই অসম্ভব ভাল মানুষ এবং ভীতু প্রকৃতির। কয়েকজন বন্ধু বান্ধব নিয়ে ঐ বাবাজীদের কাছে গিয়ে বলেছিলেন, জমিটার মালিক আমি। এরপরই তাকে রীতিমত খুনের হুমকী। পরে তিনিও একজন নেতা ধরেছিলেন। জমিটার অরিজিন্যাল দাম প্রায় ৭ কোটি টাকা বর্তমান বাজার দর অনুযায়ী। অবশেষে “নেতায় নেতায় যুদ্ধ হলো; উলুখড়ের প্রাণ গ্যালো”