প্রবাসী বাঙ্গালীদের সামনে অপেক্ষা করছে কঠিন সময়

জুন ১৪, ২০১৬

॥ খুরশিদ আলম ॥

কানাডা প্রবাসী বাঙ্গালীদের সামনে সত্যিই অপেক্ষা করছে এক কঠিন সময়। শুধু কঠিন বললে বোধ হয় সবটা বলা হবে না। সেই সময়টা হবে বেদনাদায়ক, কষ্টকর, মর্মভেদী এবং মানসিক ভাবে যন্ত্রণাদায়ক।

কিন্তু কি সেই কঠিন সময়? কি-ই বা সেই যন্ত্রণা?

পাঠক, কানাডায় আমরা যারা প্রথম প্রজন্ম এবং যারা কানাডায় এসেছি গত দুই বা তিন দশক আগে তারা প্রায় সবাই এখন পঞ্চাষোর্ধ। অনেকের পার হয়েছে ষাট। সেই হিসাবে আমরা এখন জীবনের অপরাহ্ন বেলায় বাস করছি। আর যারা ছেলে-মেয়ে কর্তৃক স্পন্সর্ড হয়ে এসেছেন কানাডায় তাদের বয়স সত্তর বা তারো বেশী।

প্রবাসী এই বাঙ্গালীদের জীবনে আজকের কঠিন বাস্তবতা হলো, ক্রমেই তারা বয়সের ভারে নুয়ে পড়ছেন। সেই সাথে শরীরে এসে বাসা বাধছে স্থায়ীসব কঠিন রোগ যার মধ্যে আছে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদ রোগসহ আরো সব রোগ যার মধ্যে আছে মানসিক রোগও। ফলে প্রবাসী এই বাঙ্গালীদের জীবনে ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে জটিলতা। বৃদ্ধি পাচ্ছে ডাক্তার বা হাসপাতাল নির্ভরতা। ঔষধের সংখ্যা এবং ঔষধ গ্রহণের মাত্রাও দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে দিন দিন। কারো কারো হয়ত ইতিমধ্যেই ওপেন হার্ট সার্জারী হয়ে গেছে। কিংবা অন্যকোন সার্জারী। যাদের ডায়াবেটিস আছে তাদের স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটছে দ্রুত। কারণ, দেখা গেছে প্রায় নব্বুই ভাগ বা তারো বেশী বাঙ্গালীর মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতার অভাব রয়েছে। কর্ম ক্ষেত্রে শারীরিক পরিশ্রম করেন অনেকেই। কিন্তু সেই পরিশ্রম স্বাস্থ্যের জন্য তেমন কোন সুফল বয়ে আনে না। স্বাস্থ্যের জন্য চাই আলাদা ব্যায়াম। তার মধ্যে অন্যতম হলো নিয়ম করে প্রতিদিন অন্তত অধা ঘন্টা করে হাঁটা। প্রতিদিন না হোক, সপ্তাহে অন্তত পাঁচ দিন হাঁটা উচিৎ। যারা ডায়াবেটিসের রোগী তাদের জন্য এই হাঁটা অবশ্য কর্তব্য। কিন্তু বাঙ্গালীরা এই কর্মটি সযন্তে পরিহার করেন। ব্যস্ততার দোহাই দেন, দোহাই দেন শীতের। কিন্তু রোগ তো আর কারো দোহাই শুনতে রাজী নয়। তার কাজ সে করেই যায়। মানুষ যদি প্রতিরোধের ব্যবস্থা না নেয় তবে রোগের পক্ষে মানুষকে আরো রুগ্ন করার কাজ অনেক সহজ হয়ে যায়।

সময়ের সাথে সাথে মানুষের বয়স বাড়বে এটাই স্বাভাবিক এবং এটাই জগতের নিয়ম। সেই সাথে বৃদ্ধি পাবে রোগের প্রকোপও। আর এর সাথে পাল্লা দিয়ে বৃদ্ধি পাবে যে বিষয়টি তা হলো পরনির্ভরতা। শুরুতে যে কঠিন সময়ের কথা বলেছিলাম, এই পরনির্ভরতাই সেই কঠিন সময়। পরনির্ভর হলে মানুষের যা হয় তা মোটেও সুখকর কোন বিষয় নয়। ক্ষেত্রবিশেষ অপমানকর পরিস্থিতিরও মোকাবেলা করতে হয়। সেই সাথে কষ্ট আর বেদনা তখন নিত্যসঙ্গী হয়ে উঠে বার্ধক্যের জীবনে। সেই কষ্ট আর বেদনা আরো বৃদ্ধি পায় যখন আমরা নিকটজনের আদর যতœ না পাই। কিন্তু এই প্রবাসে সেই নিকটজন কোথায়?

অনেকে হয়তো বলবেন, কেন? আমাদের ছেলে মেয়েরাইতো প্রবাসে আমাদের নিকটজন। আমরা বৃদ্ধ হয়ে যখন পরনির্ভর হয়ে পড়বো তখন তারাই আমাদের দেখাশুনা করবে। আমরা তাদের দেখাশুনা করেছি না? ছোট থেকে কে তাদেরকে বড় করে তুলেছে এই প্রবাসে?

এই রকম দাবী করা একেবারেই স্বাভাবিক। কিন্তু তারপরও কিছু জিজ্ঞাসা থেকেই যায়। সেই জিজ্ঞাসা হলো – দেশে থাকতে আমাদেরকে যারা খাইয়ে পড়িয়ে বড় করেছেন তাদেরকে কি আমরা ঠিকমত দেখাশুনা করতে পেরেছি? আমরাতো স্বার্থপরের মত নিজ নিজ ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে সুদূর কানাডায় পাড়ি জমিয়েছি। পিছনে ফেলে এসেছি বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে। কিছু কিছু প্রবাসী বাঙ্গালী অবশ্য তাদের বাবা-মা’কে স্পন্সর করে এ দেশে নিয়ে এসেছেন নিজেদের কাছে রাখার জন্য। কিন্তু তাদের সংখ্যা এখানে নিতান্তই কম। আবার সম্প্রতি এমনও কথা উঠেছে যে, স্পন্সর করে নিয়ে আসা বাবা-মা’কে কেউ কেউ সেবা যত্ম করার পরিবর্তে এবিউজ বা নির্যাতনও করছেন। অন্যদিকে আমরা বিদেশে চলে আসার পর দেশে বৃদ্ধ পিতা-মাতা যখন কর্মক্ষমতা হারিয়ে পরনির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন তখন আমাদের প্রবাসীদের ক’জন দেশে গিয়ে তাদের সেবা যতœ করেছি কিংবা এখনো করছি? সেই সুযোগ ক’জনেরই বা আছে বা ছিল? হয়তো এক দুই বা তিন বছর পর পর দেশে গিয়ে তাদের দেখে এসেছি (অথবা বলা ভাল বেড়াতে গিয়েছি)। যারা এক বছর বা দুই বছর পর দেশে যেতে পারিনি নানা কারণে, তারা হয়তো সময়ে সময়ে কিছু অর্থ দেশে পাঠিয়েছি বাবা-মায়ের সেবা-যতœ করার জন্য। এবং ওতেই মনে করেছি আমরা আমাদের দায়িত্ব পালন করেছি!

এরকম ‘দায়িত্ববান’ তো প্রবাসে আমাদের ছেলে-মেয়েরাও হতে পারে! ছেলে-মেয়েরাতো সাধারণত বাবা-মা’কে দেখেই সামাজিক ও পরিবারিক দায়িত্ববোধ ও ন্যায় নীতি শিখে থাকে। হয়তো তারা আমাদের কাছ থেকে এরকম শিক্ষাই পেয়েছে। সবাই না হোক, অধিকাংশই এ শিক্ষা পাওয়ার কথা। তার কিছু কিছু উদাহরণ আমরা ইতিমধ্যেই দেখতে শুরু করেছি। আমরা দেখেছি কানাডায় বেশ কিছু তরুন বাঙ্গালী অধিক বেতনের আশায় দক্ষিণে পারি জমিয়েছে। দক্ষিণে অর্থাৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কানাডা থেকে বেতন অনেক বেশী। ক্ষেত্র বিশেষ প্রায় দ্বিগুন। তাহলে তারা কেন যাবেন না? অধিক আয়ের আশায় আমরাও তো বাংলাদেশ তথা আমাদের বৃদ্ধ বাবা মা কে ফেলে চলে এসেছি কানাডায়!

আসলে এটাই জীবনের বাস্তবতা। এখানে কাউকে দোষ দেওয়ার উপায় নেই। কারণ, আজকের যুগে মানুষের জীবন নিয়ন্ত্রিত হয় মূলত অর্থনীতির দ্বারা। যেমন একসময় দেশে আমাদের বাবা-মা’রা অধিক আয় ও উন্নত জীবনের আশায় গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে এসেছিলেন।

তবে কানাডায় প্রবাসী বাঙ্গালীদের পরিস্থিতির সঙ্গে বাংলাদেশের পরিস্থিতির ভিন্নতা রয়েছে অনেক। কানাডায় প্রবাসী বাঙ্গালীরা যখন বৃদ্ধ হয়ে পড়েন তখন সত্যি সত্যি তারা এক কঠিন সময়ের মধ্যে পড়ে যান। নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন চূড়ান্তভাবে। আমি এক বাঙ্গালী বয়স্ক ভদ্রলোকের কথা শুনেছি যিনি এখন একেবারেই নিঃসঙ্গ। স্ত্রী বিয়োগ হয়েছে কয়েক বছর আগে। ছেলে-মেয়েরাও কাছে নেই। নিজের এপার্টমেন্টে দিন রাত কেবল নিজের সঙ্গেই বোঝাপড়া করেন। বয়সের কারণে এখন ড্রাইভও করতে পারেন না। একা একা চলাফেরা করতেও ভয় পান। ফলে কমিউনিটির সমবয়সী লোকদের সঙ্গে যোগাযোগও হয় না। তাছাড়া বন্ধু-বান্ধবের আকালও রয়েছে এই প্রবাসে। আমরা প্রত্যেকে নিজের দিকে তাকালেই বুঝতে পারবো আমাদের কার ক’জন বন্ধু রয়েছে এই প্রবাসে যাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে বা যার সঙ্গে মন খুলে দুটি কথা বলা যায়। অথবা আপদে বিপদে কে কার জন্য এগিয়ে আসেন বা আসতে পারেন নিজেদের কাজ ফেলে সাহায্য করার জন্য?

উপরে উল্লেখিত বয়স্ক বাঙ্গালী ভদ্রলোকটির বয়স যখন আরো বৃদ্ধি পাবে এবং তিনি যখন নিজে থেকে কিছু করতে পারবেন না তখন তার কি অবস্থা হবে? কে তাকে সার্বক্ষণিক দেখাশুনা করবে? তার ছেলে মেয়েরা? ছেলে মেয়েদের অত সময় কোথায়? জীবন জীবীকায় ও সংসার ধর্মে তারাওতো ব্যস্ত।

টরন্টোতে আরেক বয়স্ক দম্পত্তির কথা জানি যারা একেবারেই নিঃসঙ্গ। থাকেন ক্রিসেন্ট টাউনের একটি এপার্টমেন্টে। দুজনেরই ওপেন হার্ট সার্জারী হয়েছে। দুজনেই হাই ডায়াবেটিসের রোগী। আরো নানান ক্রনিক রোগে আক্রান্ত তারা। ভদ্রলোকের বয়স ৮৪। তার স্ত্রীর বয়স ৭৮ বা ৭৯ হবে। সম্প্রতি ডিমেন্সিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন ভদ্রমহিলা। কোন কিছু মনে রাখতে পারেন না। ফলে প্রায় সারাক্ষণ তাকে নজরের মধ্যে রাখতে হয়। এবং নজর রাখেন ঐ ৮৪ বছর বয়সী ভদ্রলোক যার নিজেরও প্রয়োজন কারো না কারো নজরে থাকা। কিন্তু উপায় নেই। তাদের দুই মেয়ে থাকেন টরন্টোতেই। তারা যথাসাধ্য চেষ্টা করেন বাবা মায়ের সেবা যত্ম করার জন্য। কিন্তু এই বৃদ্ধ দম্পত্তির প্রয়োজনের পক্ষে তা যথেষ্ট নয়। তাদের প্রয়োজন সার্বক্ষণিক সেবা যত্মের।

এরকম আরো অনেক উদাহরণ দেয়া যেতে পারে প্রবাসী বাঙ্গালীদের মধ্য থেকে যাদের সার্বক্ষনিক সেবা যত্মের প্রয়োজন। আর কানাডায় এর একমাত্র সমাধান হলো নার্সিং হোম বাংলায় যাকে আমরা বৃদ্ধাশ্রম বলি।

বাংলাদেশের সামাজিক ও পারিবারিক দৃষ্টিকোন থেকে চিন্তা করলে হয়তো অনেকের কাছে বৃদ্ধাশ্রমের বিষয়টি গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারে। কারণ বাংলাদেশে বৃদ্ধাশ্রমের কনসেপ্টটি একেবারেই নতুন এবং এটি এখনো সামাজিকভাবে গ্রহণীয় হয়ে উঠেনি। বৃদ্ধ বাবা মা’কে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানোকে প্রায় সকলেই খারাপ চোখে দেখেন। বাবা-মা’র প্রতি এটি একধরণের অবজ্ঞা ও অবহেলা এবং অবিচার বলেই মনে করেন প্রায় সকলে। বৃদ্ধাশ্রম অবহেলিত বৃদ্ধদের জন্য শেষ আশ্রয় এমনটিই ধারণা সকলের।

কিন্তু আধুনিক যুগে অগ্রসর ও উন্নত দেশসমূহে বৃদ্ধাশ্রমের যে ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে তা আসলে ইমিগ্রেন্ট পরিবারসমূহের জন্যও খুবই উপযোগী। কানাডার কথাই যদি আমরা ধরি তবে দেখবো এখানে গত দুই থেকে তিন দশক সময়ের মধ্যে আসা সাউথ এশিয়ান, বিশেষ করে বাংলাদেশ থেকে আসা ইমিগ্রেন্ট পরিবারগুলো একেকটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মত। বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মত বলছি এই কারণে যে, এই পরিবারগুলোর সিংহভাগই স্বামী-স্ত্রী ও দুই সন্তানের সমন্বয়ে গঠিত। এক সন্তান বা দুইয়ের অধিক সন্তানও আছে কোন কোন পরিবারে। তবে তাদের সংখ্যা কম। আর সাধারণভাবে এই পরিবারগুলোর অধিকাংশেরই কোন আত্মীয়-স্বজন এ দেশে থাকেন না। আর স্বল্প কিছু পরিবারের আত্মীয়-স্বজন থাকলেও তারা সকলেই রুটি-রুজী ও নিজ নিজ পরিবারের দেখাশুনা নিয়ে এত ব্যস্ত থাকেন যে, কেউ কারোর জন্য সময় দিতে পারেন না। এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে স্বামী অসুস্থ স্ত্রীর জন্য বা স্ত্রী অসুস্থ স্বামীর জন্য সময় বের করতে পারেন না ঠিক মত সেবা যতœ করার লক্ষে। আর সন্তানেরা যখন বড় হয়ে নিজ নিজ সংসার জীবনে প্রবেশ করেন তখন অবস্থা হয় আরো সঙ্গীণ। কারণ ইতিমধ্যে স্বামী-স্ত্রীর বয়স বেড়ে যায়। দেখা দেয় নানা রোগ। চলাফেরা হয়ে আসে সীমিত। এবং এক পর্যায়ে ঘরে বন্দি জীবন পালন করতে হয়। আর তখনই শুরু হয় বয়স্কদের দেখভালের সমস্যা। প্রবাসে এই বিচ্ছিন দ্বীপের মত বিচ্ছিন্ন পরিবারে তাদেরকে কে দেখাশুনা করবে? কাজের লোক রেখে? সেটা দিনের বেলায় জেগে জেগে স্বপ্ন দেখার মত বিষয় কানাডায়।

তাহলে সমাধান কি হতে পারে? দেশে চলে যাওয়া? দেশে চলে গেলে অনেক আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব পাওয়া যাবে। তাছাড়া অল্প টাকায় সেবা করার জন্য লোক পাওয়া যাবে। নিজেকে বিচ্ছিন্ন কেউ বলে মনে হবে না। সকলের মাঝে থাকলে বৃদ্ধ বয়সে মনটা এমনিতেই ভাল হয়ে যাবে। রোগ-শোকও অর্ধেক ভাল হয়ে যাবে নিকট আত্মীয়দের কাছে পেয়ে।

আমার কাছে মনে হয় এটাও জেগে জেগে স্বপ্ন দেখারই মতো কোন বিষয়। দেশে গেলে টাকার বিনিময়ে সেবা যত্ম করার লোক হয়তো পাবেন। তবে অল্প টাকায় নয়। বাসা বাড়িতে অল্প টাকায় এখন সাধারণ কাজের লোকই পাওয়া যায় না। তাছাড়া চিকিৎসা? ওষুধ? বয়স বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে এই দুটি বিষয়ে মানুষের নির্ভরতা বহুগুনে বৃদ্ধি পায়। কানাডায় বিনা পয়সায় বিশ্বের সেরা চিকিৎসা পাচ্ছেন, ওষুধের জন্য নামকা ওয়াস্তে একটা অর্থ ব্যয় করছেন। অথবা সেটাও লাগছে না কারো কারো ক্ষেত্রে। আর বাংলাদেশ চিকিৎসা? ঐ দেশটিতে চিকিৎসকেরাই বিদেশে যান উন্নত চিকিৎসা নেবার জন্য। ওষুধ কিনতে হবে নিজের টাকায়। অনেক দাম ওষুধের। সেই ওষুধ আবার নকল না আসল সেই সমস্যাও রয়েছে। একই ব্লাড সেম্পল আপনি তিনটি ল্যাবরটরীতে নিয়ে যান, তিন রকম রিডিং পাবেন। জরুরী অবস্থায় হাসপাতালে যেতে হবে? ঢাকা শহরে থাকলেও অন্তত দুই ঘন্টার আগে হাসপাতালের জরুরী বিভাগে পৌঁছাতে পারবেন না। অফিস টাইম হলে চার ঘন্টাও লেগে যেতে পারে। দীর্ঘ সময় লাগার কারণে হাসপাতালের ঐ যাত্রা আপনার জীবনের শেষ যাত্রা হয়ে যেতে পারে। এরকম বহু ঘটনা ঘটছে ঢাকা শহরে প্রতিনিয়ত। ট্রাফিক জ্যামের কারণে পথেই অনেক রোগীর মৃত্যু ঘটছে।

কানাডায় হাসপাতালে পৌঁছাতে কতক্ষণ লাগে আপনার? ৯১১ এ কল করার পর ৫ থেকে ৮ মিনিটের মধ্যে এম্বুলেন্স এসে হাজির প্যারামেডিক্স সহ। প্যারামেডিক্সরা বলতে গেলে প্রায় হাফ ডাক্তার। তারাই প্রাথমিক ভাবে আপনাকে দেখে শুনে প্রয়োজন মনে করলে পরবর্তী ৫ থেকে ১০ মিনিটের মধ্যে নিকটস্থ হাসপাতালের জরুরী বিভাগে নিয়ে যেতে পারেন।

এখন বৃদ্ধ বয়সে কানাডায়ই থাকবেন না বাংলাদেশে চলে যাবেন এ সিদ্ধান্ত আপাকেই নিতে হবে। যদি বৃদ্ধ বয়সে কানাডায়ই থাকতে চান তবে মানসিকভাবে এখন থেকেই সম্ভাব্য প্রস্তুতি নিতে হবে আপনাকে বৃদ্ধাশ্রমে থাকার জন্য। কারণ আপনি বৃদ্ধ বা বৃদ্ধা হয়ে গেলে আপনার ছেলে মেয়েরা সার্বক্ষণিক আপনার সেবা যত্ম করবে এমন আশা শতভাগ করা উচিৎ নয়।

কেন বৃদ্ধাশ্রমে থাকবেন?

বৃদ্ধাশ্রম সম্পর্কে আমরা যতটাই বীতশ্রদ্ধ হই না কেন, আসলে এটি গড়ে উঠেছে মানুষের প্রয়োজনের তাগিদেই। পশ্চিমা বিশ্বে মানুষের দৈনন্দিন জীবনে ব্যস্ততা যখন বৃদ্ধি পেতে শুরু করে তখন থেকেই এর প্রয়োজনীয়তা বৃদ্ধি পেতে থাকে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকে অনুন্নত দেশগুলো। কারণ, সেখানে প্রতিটি পরিবারেই লোক সংখ্যা বেশী এবং শ্রমের মূল্যও অনেক কম পাশ্চাত্যের তুলনায়। ফলে পরিবারের বৃদ্ধ লোকদের দেখাশুনা করার লোকের অভাব হয় না নিজ বাড়িতেই। এর ভাল দিক হলো এই যে, বৃদ্ধ বা বৃদ্ধারা আত্মীয় পরিজনের সেবা পান যা মানসিক ভাবেও অনেকটা উপকারী। আত্মীয় পরিজনের সেবায় যে আন্তরিকতা থাকে যে ভালবাসা থাকে তা বৃদ্ধাশ্রমে আশা করা যায় না। জীবনের শেষ দিনগুলোতে এই আন্তরিকতা ও ভালবাসার প্রয়োজন খুবই বেশী।

কিন্তু পরিস্থিতি যদি সহায় না হয় বা অনুকুলে না থাকে তখন আর কিছুই করার থাকে না। প্রবাসে ইমিগ্রেন্ট পরিবারগুলোর অবস্থা অনেকটা ঐ রকম। পরিবারে লোক সংখ্যা কম, জীবনের ব্যস্ততা অনেক বেশী। ফলে বৃদ্ধদের বাড়িতে রেখে সার্বক্ষণিক সেবা যত্ম করা সম্ভব হয়ে উঠে না অনেক পরিবারের পক্ষে। তাছাড়া যে সকল বৃদ্ধ বা বৃদ্ধার বয়স ৮০ পেরিয়ে যায় তাদেরকে সর্বক্ষণই নজরে রাখতে হয়। সময়মত খাওয়ানো, ওষুধ সেবন করানো, বাথরুম করানো, নিয়মিত সুগার চেক করা, প্রেসার চেকসহ আরো অনেক কিছুই করতে হয় এই বয়সের লোকদের জন্য। এবং এর জন্য চাই সার্বক্ষনিক সেবক। আর এই সার্বক্ষণিক সেবা দিতে পারে একমাত্র বৃদ্ধাশ্রমই।

অবশ্য একথাও সত্য যে, বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দিলেই সব সমস্যার সমাধান হয় না। বৃদ্ধাশ্রম যদি বৃদ্ধবান্ধব না হয় তবে বৃদ্ধদের সমস্যা বরং আরো জটিল আকার ধারণ করে। বৃদ্ধাশ্রম বৃদ্ধবান্ধব না হওয়ার প্রধান কারণ হলো ভাষা এবং সংস্কৃতির ব্যবধান। কানাডায় আমরা যারা প্রথম প্রজন্মের ইমিগ্রেন্ট, তাদের অধিকাংশেরই রয়েছে ভাষার সমস্যা। ইংরেজীতে আমরা যোগাযোগটা ষোলআনা করে উঠতে পারি না। যোগযোগটা সঠিক ভাবে না হয়ে উঠলে সেবাটাও সঠিক ভাবে পাওয়া যায় না। কারণ যিনি সেবা দিবেন তাকে বুঝতে হবে সেবাগ্রহণকারী কি চাচ্ছেন। আর সেবা যিনি নিবেন তাকেও সঠিকভাবে বুঝাতে হবে সেবাপ্রদানকারীকে যে তিনি কি চাচ্ছেন।

ভাষা ছাড়াও রয়েছে কালচারাল বা সাংস্কৃতিক সমস্যা। সেবা গ্রহীতা ও সেবা প্রদানকারী যদি দুই সাংস্কৃতিক পটভূমির হন তবে সেক্ষেত্রেও সমস্যা দেখা দেয়। যেমন এশিয়দের মধ্যে বয়স্কদের প্রতি শ্রদ্ধা দেখানো একধরনের ম্যান্ডেটরী বা বাধ্যতামূলক বিষয়। প্রথম প্রজন্মের ইমিগ্রেন্টরা সেই সংস্কৃতিকে মনে প্রাণে ধরে রাখেন। কিন্তু এই সংস্কৃতি মূলধারার বৃদ্ধাশ্রমে সবসময় পাওয়া যাবে তার কোন গ্যারন্টি নেই। কারণ সেখানে নানান সাংস্কৃতিক পটভূমির লোকেরা কাজ করেন। ফলে সেখানে বৃদ্ধরা সহজ হতে পারেন না অধিকাংশ সময়।

এর পর রয়েছে ধর্ম, খাদ্য, পোষাকসহ আরো নানা বিষয়। বাঙ্গালীর প্রিয় ভাত মাছ। সেই ভাত মাছ কি নিয়মিত পাওয়া যাবে মূলধারার কোন বৃদ্ধাশ্রমে? শুক্রবার জুম্মার দিন। মসজিদের না যেতে পারুক, মূলধারার কোন বৃদ্ধাশ্রমে কি আলাদা কোন ব্যবস্থা থাকবে একসাথে জুম্মার নামাজ আদায় করার? একজন লুঙ্গি-পাঞ্জাবী পরা বৃদ্ধের সংগে আরেকজন লুঙ্গি পাঞ্জাবী পরা বৃদ্ধ অথবা একজন শাড়ী পরা বৃদ্ধা আরেক জন শাড়ী পরা বৃদ্ধার সঙ্গে যতটা সহজভাবে মিশতে পারবেন, নিজের দুঃখ বেদনা ভাগাভাগি করতে পারবেন তা কি অন্য পোষাক পরা বৃদ্ধ বা বৃদ্ধার সঙ্গে সম্ভব?

সম্ভব নয়। কিন্তু বৃদ্ধাশ্রমের সেবাপ্রদানকারী যদি বাঙ্গালী হন, ব্যবস্থাপক যদি বাঙ্গালী হন এবং সর্বপোরী এই বৃদ্ধাশ্রমের মালিকানাও যদি বাঙ্গালীরই হয় তাহলে কেমন হয়? প্রয়াত লেখক অধ্যাপক ড. মীজান রহমান তার এক লেখায় বলেছিলেন, “আজকাল কানাডা-আমেরিকার অনেক জায়গাতেই মুসলমানদের জমি কেনার হিড়িক পড়ে গেছে। বসতবাড়ির জমি নয়, কবরস্থানের জমি। নিজের জন্য, স্ত্রীর জন্য, অনেকে যারা বাবা-মাকে নিয়ে এসেছে এখানে, তাদের জন্য। শুনেছি কবরের দালালি করে কেউ কেউ নিজের কবর কেনার পয়সাও বানিয়ে ফেলেছে। ভাল কথা, চোখ বুঁজার পর যে কংকালটা থাকবে তার একটা স্থায়ী ঠিকানা হল। কিন্তু তার আগেও তো মানুষের একটা ঠিকানার প্রয়োজন। যত অস্থায়ীই হোক ওই ঠিকানাটা না হলে মানুষ সম্মানের সাথে কবরেও যেতে পারবে না।”

মীজান রহমান আরো লিখেছিলেন, “আমাদের বুড়োবুড়িরা এদেশের হোমে যেতে ভয়

পায়। ওখানে গিয়ে আমরা লুঙ্গি বা ধুতি পরে ঘুরে বেড়াতে পারব? আজান দিয়ে নামাজ পড়তে পারব? সুর করে কোরানশরিফ পড়তে পারব?

কিংবা গীতাপাঠ বা পূজা অর্চনা করতে পারবো? বুড়োবয়সে এই সবই তো আমরা করি সচরাচর। অর্ধেক সময় বাড়িতে অর্ধেক সময় মসজিদে বা মন্দিরে। তাই হোমে থাকবার কথা ভাবতেই আমাদের গা হিম হয়ে যায়। কালচার শক বলতে যা বোঝায়, যা আমরা ত্রিশচল্লিশ বছর এ দেশে থেকেও অতটা টের পাই না, তা যেন জোয়ারের প্রাবল্য দিয়ে হানা করতে শুরু করে হোমে যাবার কথা চিন্তা করে।”

সমস্যাটা এখানেই। আর এ কারণেই আমাদের এখন প্রয়োজন হয়ে দাড়িয়েছে দ্রুত বাঙ্গালীদের জন্য আলাদা বৃদ্ধাশ্রম তৈরী করা। মূলধারার  সরকারী বৃদ্ধাশ্রমের পাশাপাশি চীনারা তৈরী করেছে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির বৃদ্ধাশ্রম, ইটালিয়ানরাও তৈরী করেছে। তৈরী করেছে আরো কিছু এথনিক সম্প্রাদয় তাদের নিজ নিজ সংস্কৃতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বৃদ্ধাশ্রম। এই সব বৃদ্ধাশ্রমে সরকারী বৃদ্ধাশ্রমের মতই সব ব্যবস্থা থাকে। যেমন, প্রত্যেকের জন্য নিজ নিজ ঘর, চব্বিশ ঘন্টা নার্স সেবা, বিনোদনের ব্যবস্থা। আর সবচেয়ে বড় যে সুবিধা এই সব এথনিক বৃদ্ধাশ্রমের তা হলো, এখানে বৃদ্ধদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য অনেক ভাল থাকে মেইনস্ট্রিমের বৃদ্ধাশ্রমের তুলনায়! অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে?

না এটি কোন কল্প কাহিনী নয়, অবিশ্বাস করারও কোন কারণ নেই। কানাডায় এথনিক কোন প্রতিষ্ঠানের নাম শুনলেই যারা নাক সিটকান তাদের জন্য ‘দুঃসংবাদ’ হলো, এই এথনিক বৃদ্ধাশ্রমে যারা থাকেন তারা নিজেদেরকে সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন মনে করেন না, শারীরিকভাবে ও মানসিকভাবে তারা বেশ স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করেন, বিষন্নতা বা মনমরা ভাব তাদের মধ্যে তুলনামূলকভাবে কম থাকে। এবং সর্বপোরি হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার হারও কম এই বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের মধ্যে। কানাডার ওয়েলেসলি ইনস্টিটিউট সম্প্রতি এই তথ্য প্রকাশ করেছে।

প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে মূলধারার বৃদ্ধাশ্রমগুলোতে ভর্তি হওয়ার পর বৃদ্ধ বা বৃদ্ধাদের মধ্যে বিষন্নতার হার ২৫.১%। অন্যদিকে এথনিক বৃদ্ধাশ্রমগুলোতে বৃদ্ধ বা বৃদ্ধাদের মধ্যে এই বিষন্নতার হার মাত্র ৩.৩৫%! গ্রেটার টরন্টোর ই হং নামের বৃদ্ধাশ্রমগুলোতে এরকম চিত্রই দেখা গেছে। ই হং এর চারটি বৃদ্ধাশ্রম রয়েছে জিটিএ’তে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর মূল কারণ এই সকল বৃদ্ধাশ্রমগুলোতে যারা থাকেন তারা তাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলের মধ্যেই থাকেন। তাদের চারপাশে সবাই তাদের নিজেদের সংস্কৃতিরই লোক। তারা স্টাফদের সঙ্গেও নিজের ভাষায় কথা বলতে পারেন। ফলে যোগাযোগটা হয় ষোলআনা। কোথাও কোন ফাক থাকে না। এখানকার অধিবাসীদের অভিমত হলো, “আমরা এখানে একটি পরিবারের মতই বাস করি”। কিন্তু মূলধারার বৃদ্ধাশ্রমগুলোতে এথনিক বৃদ্ধ বা বৃদ্ধাগণ এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন। নিজেরদেরকে তারা বিচ্ছিন্ন মনে করেন যার যুক্তিসংগত কারণও রয়েছে।

ইউনিভার্সিটি অব ভিক্টোরিয়ার সমাজবিজ্ঞানী ও গবেষক কারেন কোবাইশীর মত হলো, “যখন কেউ নতুন একটি পরিবেশে যান এবং সেই পরিবেশের ভাষার সঙ্গে তার কোন ঘনিষ্ঠতা বা নৈকট্য থাকে না তখন স্বাভাবিকভাবেই সেই ব্যক্তির মানসিক স্বাস্থের অবনতি ঘটে। মূলধারার বৃদ্ধাশ্রমে এথনিক বৃদ্ধদের ক্ষেত্রেও তাই ঘটে।

ই হং বৃদ্ধাশ্রমের এক অধিবাসী সু টিন হো। তার বয়স ৮৭। বছর খানেক আগে তিনি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন চিকিৎসার জন্য। দিন দশেক থাকতে হয়েছিল তাকে সেখানে। হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে তাকে ই হং বৃদ্ধাশ্রমে স্থানান্তর করা হয়। তার স্বামীও ছিলেন ঐ বৃদ্ধাশ্রমে আগে থেকেই। এখানে আসার পর তিনি ফিরে পেলেন তার নিজ ভূবন। চারপাশেই তিনি খুঁজে পেলেন তার নিজ ভাষার লোকজন, নিজ সংস্কৃতির লোকজন। এখানে তিনি এতটাই আনন্দ উপভোগ করতে শুরু করেন যে একপর্যায়ে তিনি বলেই ফেলেন, “আমি আমার বাড়িতে আমার সন্তানদের সঙ্গে বাস করতে চাই না। একঘেয়েমী জীবন সেখানে। বরং এই বৃদ্ধাশ্রমে আমি অনেক ভাল আছি।  সূত্র : গ্লোব এন্ড মেইল।

একই সূত্র থেকে আরো জানা যায়, মূলধারার বৃদ্ধাশ্রমগুলোতে প্রতি চার মাসের মধ্যে পড়ে গিয়ে বৃদ্ধদের আহত হওয়ার মাত্রা শতকরা ১৩.৬ ভাগ। অন্যদিকে ই হং বৃদ্ধাশ্রমে এই পতনের মাত্রা ৮.৯%। শরীর ব্যথার অভিযোগ মূলধারার বৃদ্ধাশ্রমগুলোতে ১১.৬ %। ই হং বৃদ্ধাশ্রমে ৪.৪%। আরো দেখা গেছে এথনিক বৃদ্ধাশ্রমগুলোতে বৃদ্ধদের শরীরের ওজন কমার হার মূলধারার বৃদ্ধাশ্রমের চেয়ে অনেক কম। গত বছরের এক হিসাবে দেখা যায় অন্টারিওতে মূলধারার বৃদ্ধাশ্রমগুলোতে শতকরা ৬.৭ ভাগ বৃদ্ধের ওজন হ্রাস পেয়েছিল। অন্যদিকে ই হং বৃদ্ধাশ্রমে এই হার ছিল শতকরা ২.৫৫ ভাগ।

মিসিসাগায় বাস করেন বীন সু যার মা ও শ্বশুড় ই হং বৃদ্ধাশ্রমে থাকেন। তিনি বলেন, মূলধারার বৃদ্ধাশ্রম থেকে এথনিক জনগোষ্ঠির জন্য এথনিক বৃদ্ধাশ্রমগুলো অনেকগুনে ভাল। তার ভাষ্য হলো, “বৃদ্ধ বাবা মা’কে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাতে দেখলে আমাদের অনেকের মধ্যেই বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। লোকজন কটুক্তি করতেও ছাড়েন না। কিন্তু সাম্প্রতিককালে আমাদের চাইনিজ কমিউনিটিতে বিষয়টি এমন হয়ে দাড়িয়েছে যে, কেউ যদি শুনেন একজন তার বৃদ্ধ বাবা অথবা মা’কে ই হং বৃদ্ধাশ্রমে নিয়ে যাচ্ছেন তবে কটুক্তির বদলে যে মন্তব্যটি করা হয় তা হলো – ‘কংগ্রেচুলেশনস’।

কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এথনিক কমিউনিটির এই বৃদ্ধাশ্রমগুলোতে জায়গা পেতে হলে অনেক দিন অপেক্ষা করতে হয়। ওয়েটিং লিস্টে নাম পড়ে থাকে বছরের পর বছর। অন্টারিওতে মূলধারার কোন বৃদ্ধাশ্রমে জায়গা পেতে হলে অপেক্ষা করতে হয় তিন থেকে চার মাস। আর চাইনিজ কমিউনিটির ই হং এ জায়গা পেতে হলে অপেক্ষা করতে হয় গড়ে পাঁচ বছর! ই হং বৃদ্ধাশ্রমের স্কারবরো-ম্যাকনিকল শাখায় জায়গা পাওয়ার জন্য কেউ কেউ অপেক্ষা করছেন দশ বছর ধরে! জিটিএ-তে তাদের শাখা রয়েছে মাত্র চারটি।

উল্লেখ্য যে, আগামী পঁচিশ বছরে কানাডায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের সংখ্যা বর্তমানের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়ে দ্বিগুন হয়ে যাবে। ধারণা করা হচ্ছে এদের সংখ্যা তখন ৯.৯ মিলিয়ন থেকে ১০.৯ মিলিয়নে দাড়াবে। আর এই বিপুল সংখ্যক বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের সেবা প্রদানের জন্য রীতিমত হিমসিম খেতে হবে দেশটিকে। এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে টরন্টোর সাউথ এশিয়ান কমিউনিটিতেও। বর্তমানে টরন্টোতে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের শতকরা ৪৫ ভাগই ইমিগ্রেন্ট পরিবারের সদস্য। এটি কানাডার মধ্যে সর্বোচ্চ রেকর্ড।

টরন্টো স্টারের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, টরন্টোর ২.৬ মিলিয়ন অধিবাসীদের প্রায় অর্ধেকেরই জন্ম কানাডার বাইরে। তাদের মাতৃভাষা ইংরেজী বা ফরাসী নয়। ১৪০টিরও বেশী ভাষাভাষীর সম্প্রদায় বাস করেন টরন্টোতে। এই শহরে এথনিক এই গোষ্ঠিগুলোর বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের সেবা প্রদান করার জন্য চাইনিজ কমিউনিটির ই হং সেন্টার সহ আরো কয়েকটি কমিউনিটি নির্ভর বৃদ্ধাশ্রম গড়ে উঠেছে। যেমন গ্রীকদের জন্য হেলেনিক হোম, ইটালিয়ানদের জন্য ভিলা কলম্বো, ইহুদীদের জন্য বেক্রেস্ট সেন্টার। এছাড়াও আরো কয়েকটি কমিউনিটি নির্ভর বৃদ্ধাশ্রম গড়ে উঠেছে গ্রেটার টরন্টোতে। কিন্তু বাঙ্গালীরা এখনো এ বিষয়ে একেবারেই ‘দুশ্চিন্তাহীন’। কিংবা তারা শতভাগ নিশ্চিত যে, তাদের সন্তানেরাই সবকিছুর দায়িত্ব নিবেন। সুতরাং এ নিয়ে চিন্তা বা দুশ্চিন্তা করে সময় নষ্ট করার কোন অর্থ খুঁজে পান না তারা।

কেউ কেউ অবশ্য মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছেন বৃদ্ধ বয়সে দেশে চলে যাবেন। কিন্তু সেটা কতটা সম্ভব হবে তা সময়ই বলে দিবে।  আমার মনে হয়, আমরা যারা এই প্রবাসে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের কাতারে চলে এসেছি বা খুব শীঘ্রই চলে আসবো এবং ক্রমশ শারীরিক অক্ষমতার দিকে ধাবিত হবো, তাদের জন্য সতর্ক হবার এখনই সময়।

কিন্তু প্রশ্নটা হলো, বাঙ্গালী কমিউনিটিতে বৃদ্ধাশ্রম বানানোর এই উদ্যোগটা নিবে কে বা কারা? আমার মনে হয়, এই উদ্যোগ নেয়ার দায়িত্বটা কমিউনিটির সকলেরই। এককভাবে কারো কিছু করার উপায় নেই। কমিউনিটিতে যে সকল সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানসমূহ রয়েছে তারা হয়তো এ ক্ষেত্রে সাংগঠনিক ভূমিকা পালন করতে পারেন। তবে এগিয়ে আসতে হবে কমিউনিটির প্রতিটি সদস্যকেই।  নয়তো শুরুতে যে আশংকার কথা বলছিলাম হয়তো সেই অবস্থারই মুখমুখি হতে হবে আমাদের প্রায় সকলের। সেই সময়টা হবে বেদনাদায়ক, কষ্টকর, মর্মভেদী এবং মানসিক ভাবে যন্ত্রণা দায়ক।

খুরশিদ আলম

সম্পাদক ও প্রকাশক

প্রবাসী কন্ঠ