নির্দিষ্ট কোন ধর্ম বা এথনিক সম্প্রদায়ের জন্য পৃথক আবাসিক প্রকল্প বা ভবন নির্মানের পরিকল্পনা কতটা যৌক্তিক?

জানুয়ারী ৭, ২০১৭

খুরশিদ আলম ॥

মন্ট্রিয়লে মুসলমানদের জন্য পৃথক একটি হাউজিং প্রজেক্ট নির্মানের প্রস্তাব পেশ করে বেশ বেকায়দায় পড়ে গিয়েছিলেন খ্রীস্টান ধর্ম থেকে ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান হওয়া মিশরীয় বংশোদ্ভূত নাবিল ওয়ার্দা নামের এক ব্যক্তি। কুইবেক প্রভিন্সের অধিবাসীরা প্রস্তাবিত ঐ হাউজিং প্রজেক্টের তীব্র নিন্দা জানিয়েছিলেন। নিন্দা জানিয়েছিলেন কুইবেক প্রভিন্সের প্রিমিয়ার ফিলিপ কুইলান্দ। ফলে একরকম বিপদে পড়েই প্রস্তাবিত ঐ প্রজেক্টটি নিয়ে আর সামনে এগুননি নাবিল ওয়ার্দা।

উল্লেখ্য যে, কানাডায় মুসলমানদের জন্য পৃথক আবাসন প্রকল্পের প্রস্তাব এটাই প্রথম নয়। ইতিপূর্বে টরন্টোর উত্তরে ভন সিটিতেও এরকম প্রস্তাব উঠেছিল এবং মন্ট্রিয়লের মত সেখানেও প্রতিবাদের ঝড় শুরু হয়েছিল। সৃষ্টি হয়েছিল উত্তপ্ত বিতর্কের। ঘটনাটি ঘটেছিল ২০১৪ সালের শুরুতে। সে সময় শত শত এলাকাবাসী  সমবেত হয়েছিলেন প্রস্তাবিত ঐ প্রকল্পের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার জন্য। পরবর্তীতে ভন সিটি কাউন্সিল মুসলমানদের জন্য প্রস্তাবিত ঐ কন্ডো ও টাউন হাউজ নির্মানের আবেদনটি সর্বসম্মতিক্রমে নাকচ করে দেয়।

এদিকে টরন্টোর ৩০০১ ফিঞ্চ এভিনিউতে অবস্থিত শুধুমাত্র মুসলমানদের জন্য সাবসিডাইজড একটি এপার্টমেন্ট ভবন নিয়েও বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছিল গত বছর। তবে টরন্টোর সিটি কাউন্সিলের পক্ষ থেকে তখন জানানো হয়, এটি কারো মনাবাধিকার লংঘন করে না। টরন্টোর ট্রিনিটি/স্পাডাইনা রাইডিং (২০) এর সিটি কাউন্সিলর জো ক্রিসী এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, “আমরা চাই লোকজন তাদের জন্য উপযুক্ত সাংস্কৃতিক পরিবেশে বাস করুক। আহমেদীয় মুসলমানদের জন্য আলাদা ভবন করাটা অনুচিত কিছু হয়নি বা এটি কোন পক্ষপাতিত্বও নয়। ”

উল্লেখ্য যে, ফিঞ্চ এভিনিউতে অবস্থিত এই ১৬ তলা আধুনিক ভবনটিতে রয়েছে ১৭৬ টি এপার্টমেন্ট। নামাজের জন্যও রয়েছে আলাদা রুম যেখানে ২৫০ জন এক সঙ্গে নামাজে দাড়াতে পারেন। এটি আহমেদীয় মুসলমানদের জন্য নির্ধারিত। ভবনটির নামকরণ করা হয়েছে ‘আহমেদীয়া এবদি অব পিস’।

এখন প্রশ্ন হলো, মন্ট্রিয়ল, ভেঙ্গুভার বা টরন্টোর মত মাল্টিকালচারাল সিটিতে নির্দিষ্ট কোন ধর্মসম্প্রদায় বা এথনিক সম্প্রদায়ের জন্য পৃথক আবাসিক এলাকা বা ভবন নির্মানের পরিকল্পনা বা উদ্যোগ কতটা যৌক্তিক বা উচিৎ? যদি এই প্রবণতা চলতে থাকে তবে অদূর ভবিষ্যতে বা দূর ভবিষ্যতে এর ফলাফল কি দাড়াতে পারে? এর ভাল দিকটা কি অথবা এর মন্দ দিকটাই বা কি?

আজকে টরন্টো বা এর আশপাশ এলাকায় যদি শুধুমাত্র শ্বেতাঙ্গদের জন্য আলাদা কোন আবাসিক এলাকা বা ভবন গড়ে তোলার প্রস্তাব দেয়া হয় বা সত্যি সত্যি যদি তা বাস্তবে রূপ নেয় তবে পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নিবে?

মনে পড়ে দক্ষিণ আফ্রিকার কথা? খুব বেশীদিন আগের কথা তো নয়। নেলসন মেন্ডেলা ক্ষমতায় আসার আগে সেখানে মূল শহরে কৃষ্ণাঙ্গদের প্রবেশাধিকার ছিল নিষিদ্ধ। অথচ দেশটাতো কৃষ্ণাঙ্গদেরই। ভারত বর্ষ যখন ইংরেজদের শাসনে ছিল তখন সেখানেও কিছু কিছু স্থানে ভারতীয়দের প্রবেশ ছিল নিয়ন্ত্রিত। কানাডা ও আমেরিকায়ও একসময় এই জাতীয় বর্ণবাদী আইন বলবৎ ছিল। বর্ণবাদের চূড়ান্ত ও কুৎসিত রূপ হলো এই জাতীয় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। সেই নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার দিকে আমরা আবার এগিয়ে যাচ্ছি না তো?

আজ থেকে ৭০ বছর আগের একটি ঘটনা। ভাইয়লা ডেসমন্ড নামের একজন কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা নভাস্কোশিয়ার নিউ গ্লাসগোতে রসল্যান্ড থিয়েটারে একদিন মুভি দেখতে গিয়েছিলেন। তখন তাঁকে বলা হয় তিনি যেহেতু কৃষ্ণাঙ্গ তাই তিনি মেইন ফ্লোরের কোন আসনে বসে মুভি দেখতে পারবেন না। তাঁকে বসতে হবে বেলকনির কোন আসনে।

কানাডায় বর্ণবাদ তখনো প্রকাশ্যভাবেই বিদ্যমান ছিল। কিন্তু তবু ভাইয়লা ডেসমন্ড বিষয়টিকে সহজভাবে মেনে নিতে পারেননি। তিনি প্রতিবাদী হয়ে উঠেন এবং বেলকনির আসনে না গিয়ে মেইন ফ্লোরের আসনেই গিয়ে বসেন যে স্থানটি শ্বেতাঙ্গদের জন্য সংরক্ষিত ছিল। পুলিশ এসে তাঁকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। পরে তাঁকে আদালতে নেয়া হলে বিচারক ডেসমন্ডকে ২০ ডলার জরিমানা করেন এবং আদালতের খরচ বাবদ আরো ৬ ডলার জরিমানা করেন।

অবশ্য তাঁর মৃত্যুর প্রায় ৪৫ বছর পর তাঁকে মরণোত্তর ক্ষমা প্রদান করা হয়। ২০১০ সালে নভাস্কোশিয়ার তৎকালীন লেফটেনেন্ট গভর্নর মেয়ান ফ্রান্সিস এই ক্ষমার ঘোষণা দেন এবং ঐ একই সময় নভাস্কোশিয়ার তখনকার প্রিমিয়ার ডেরেল ডেক্সটার সরকারীভাবে ভাইয়লা ডেসমন্ড এর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করেন। আগামী ২০১৮ সালে আমরা দেখবো তার প্রতিকৃতি ছাপা হবে কানাডিয়ান ডলারে।

ভাইয়লা ডেসমন্ডের প্রতি সেদিন যে বর্ণবাদী আচরণ করা হয়েছিল, আজকের কানাডায় এইরকম বর্ণবাদের কথা কেউ কল্পনাও করতে পারেন না। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে কানাডায় কোন কোন এথনিক গোষ্ঠি বা ধর্ম সম্প্রদায় আলাদা থাকার জন্য যে রকম উৎসাহী হয়ে উঠছেন তাতে সেই উগ্র বর্ণবাদ কি আবারো ফিরে আসতে পারে?

অবশ্য প্রশ্ন উঠতে পারে যে, কানাডায় কোন কোন এথনিক বা ধর্ম সম্প্রদায় কর্তৃক আলাদা এলাকায় থাকার নজীর তো বহু দশক ধরেই আছে। টরন্টোর কথাই ধরা যাক। এখানে ইহুদীরা একত্রে থাকার জন্য একটি নির্দিষ্ট এলাকাকে বেছে নেন বহু বছর আগেই। ডাউনটাউনের কুইন থেকে কলেজ স্ট্রিট এবং ইয়ং থেকে ইউনিভার্সিটি এভিনিউ পর্যন্ত এলাকায় ইহুদীদের বসবাস বেশী লক্ষ্য করা যায়। চাইনিজদের উপস্থিতি বেশী লক্ষ্য করা যায় এলিজাবেথ থেকে হেজারম্যান স্ট্রিট পর্যন্ত। গ্রীকদের উপস্থিতি সবচেয়ে বেশী লক্ষ্য করা যায় ড্যানফোর্থ এলাকায়। ইটালীয়দের উপস্থিতি কলেজ স্ট্রিটে। ফিলিপিনোরা বেশীর ভাগ বাস করেন উইলসন এভিনিউ এবং ব্যথার্স্ট স্ট্রিট এলাকায়। ভারতীয়রা ব্রাম্পটন এলাকায়। আর বাংলাদেশীরা বেশীর ভাগ বাস করেন টরন্টোর ড্যানফোর্থ ও ভিক্টোরিয়া পার্ক এলাকায়। কিছু আছেন ডাউনটাউনের ডানডাস ও পার্লামেন্ট এলাকায়।

তাহলে মুসলমানরা থাকার জন্য আলাদা একটি এলাকা বা ভবন বেছে নিতে চাইলে সমস্যা কোথায়? তাছাড়া সিটি অব টরন্টোও এ বিষয়ে কোন আপত্তি করছে না। যার ফলশ্রুতিতে টরন্টোর ফিঞ্চ এভিনিউতে গড়ে উঠেছে আহমেদীয়া মুসলমানদের জন্য ১৬ তলার পৃথক একটি আধুনিক ভবন। অন্যদিকে টরন্টোর ৭৩০ পেপ এভিনিউতে অবস্থিত ম্যাকক্লিনটক ম্যানর ভবনটি খ্রিস্টান ধর্মালম্বী সিনিয়রদের জন্য সংরক্ষিত। ৬২ টি এপার্টমেন্ট রয়েছে এই ভবনে। ২০০২ সালে টরন্টো সিটি কাউন্সিলের গৃহীত এক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরবর্তীতে আটটি ভবন এরকম বিশেষ গ্রুপের সদস্যদের জন্য বরাদ্ধ বা সংরক্ষিত করা হয় যার মধ্যে আছে মেসিডোনিয়ান, চাইনিজ, লুথিয়ানিয়ান এবং গ্রীক সম্প্রদায়।

তাহলে কি বলা যায় কোন কোন এথনিক বা ধর্ম সম্প্রদায় যদি তাদের পছন্দমত এলাকাভিত্তিক বসতি গড়ে তুলতে চান বা আলাদা ভবন নির্মান করতে চান তাতে সমস্যা হওয়ার কথা নয়? আর যদি সমস্যা না হয় তবে মুসলমানদের বেলায় আপত্তি কেন তোলা হচ্ছে?

এর একটি কারণ হতে পারে ৯/১১ এর ঘটনা এবং তৎপরবর্তী তালেবান, আল-কায়দা, আইএস ইত্যাদি জঙ্গীবাদী সংগঠনের উত্থান এবং সেই সাথে কানাডায় হোমগ্রোন টেররিস্টদের উত্থান। এই জঙ্গীবাদের উত্থানের পিছনে মূলত আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের তেল রাজনীতিই মূখ্য ভূমিকা পালন করেছে।

কানাডায় মুসলমানদের ব্যাপারে ভীতি সৃষ্টি হওয়ার পিছনে এখানকার রক্ষণশীল রাজনীতিকদের সংকীর্ণ আচরণও কমবেশী দায়ী। কানাডীয় ভোটারদের মন জয় করার জন্য তারা এই জঙ্গীবাদ ইস্যুকে কাজে লাগিয়ে এখানে মুসলমানদের সম্পর্কে একটি ভীতি তৈরী করার চেষ্টা ইতিপূর্বে করেছেন এবং এখনো করছেন যার আরেক নাম ইসলামোফোবিয়া। এ কারণে কানাডায় মুসলমানদের সম্পর্কে একটা ভীতি কাজ করছে সাধারণ মানুষের মধ্যে। তাছাড়া ইতিমধ্যে কানাডার মাটিতে কয়েকদফা জঙ্গীবাদী হামলার ঘটনা ঘটেছেও। গ্রেফতার করা হয়েছে বেশ কয়েকজন মুসলমান ব্যক্তিকে জঙ্গী সংশ্লিষ্টতার কারণে। এসকল কারণে কানাডায় মুসলমানদের প্রতি ভীতি তৈরী করা রক্ষণশীল দলের রাজনীতিকদের পক্ষে সহজ হয়েছে।

স্ট্যাটিসটিক্স কানাডার এক হিসাবে দেখা যায় কানাডায় মুসলমান ধর্মীয় সম্প্রদায়ের লোকেরা আগের তুলনায় অধিক হারে ঘৃণা ও বিদ্বেষপ্রসূত অপরাধের শিকার হচ্ছেন। তবে অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের লোকদের প্রতি এই ঘৃণা ও বিদ্বেষপ্রসূত অপরাধের মাত্রা হ্রাস পেয়েছে। প্রকাশিত ঐ রিপোর্টে দেখা যায় ২০১৩ সালে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ৬৫ টি ঘৃণা ও বিদ্বেষপ্রসূত অপরাধের ঘটনা ঘটেছে। আর ২০১২ সালে এরকম ঘটনা ঘটেছে ৪৫ টি।

কানাডায় বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের লোকদের প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষপ্রসূত যে অপরাধের ঘটনা ঘটে থাকে সেগুলো বিচার বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় মুসলমান সম্প্রদায়ের লোকদের রিরুদ্ধে অপরাধ বেশী মাত্রায় (৩৩%) সহিংস হয়ে থাকে। আর এই মাত্রা মুসলমান মহিলাদের বেলায় আরো বেশী (৪৭%)। কারণ হিসেবে বলা হয়, মুসলমান মহিলারা ঘরের বাইরে হিজাব ও বোরখা ব্যবহার করে বিধায় তারা খুব সহজেই চিহ্নিত হয় এবং আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিনত হন।

হাফিংটন পোস্ট এ প্রকাশিত এক প্রবন্ধে আবু বকর কাশিম একটি জরীপ রিপোর্টের কথা উল্লেখ করে বলেন, “কানাডার অর্ধেকেরও বেশী লোক মনে করেন মুসলমানদেরকে বিশ্বাস করা যায় না। তারা আরো মনে করেন, মুসলমানদের এই অবস্থার জন্য তারা নিজেরাই দায়ী। ঐ জরীপে আরো দেখা যায় কুইবেকের ৭০% ফারাসী ভাষাভাষীর লোকেরা মুসলমানদেরকে বিশ্বাস করেন না। অপরদিকে কানাডার অন্যান্য অঞ্চলের ৪৩% ইংরেজী ভাষাভাষীর লোকেরাও মুসলমানদেরকে বিশ্বাস করেন না। আর মুসলমানদের এই পরিনতির জন্য কারা দায়ী এমন প্রশ্নের উত্তরে ৪২% কানাডিয়ান মনে করেন, এ জন্য মুসলমানদের কর্মকান্ডই দায়ী।”

কানাডায় এই যদি হয় মুসলমানদের অবস্থা তবে সেই ক্ষেত্রে তারা যদি আলাদা কোন এলাকায় বসতি গড়ে তুলতে চান তবে প্রতিবাদের ঝড় যে উঠবে সেটাইতো স্বাভাবিক।

তবে শুধু মুসলমানদের ক্ষেত্রেই যে এইরকম প্রতিবাদ উঠছে তা কিন্তু নয়। দেখা গেছে টরন্টোর পার্শ্ববর্তী শহর ব্রাম্পটনে ভারতীয়দের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়াতেও অনেকের চক্ষুশূল হয়ে দাড়িয়েছেন তারা। ২০১৪ সালে ব্রাম্পটন এলাকায় একটি প্রচারপত্র বিলি করা হয়েছিল যার শিরোনাম ছিল “The Changing Face of Brampton” । ব্রাম্পটনের পরিবর্তনশীল চেহারা শিরোনামের ওই প্রচারপত্রে শ্বেতাঙ্গ নাগরিকদের একটি গ্রুপ ছবির নিচে দক্ষিণ এশীয় লোকেদের একটি ছবি ছাপানো হয়েছে যাতে অনেকেই পাগড়ি পরা রয়েছেন। প্রচারপত্রে আলাদা তীরচিহ্ন দিয়ে তাতে লেখা হয়েছে, ‘‘এই অবস্থা’’ থেকে ‘‘এই অবস্থা’’, ‘‘এটাই কি আপনি সত্যিকার অর্থে চান?’’

ইমিগ্রেশন ওয়াচ নামের একটি গ্রুপ কর্তৃক বিলি করা প্রচারপত্রটি হাতে পাওয়ার পর ব্রাম্পটনের ভারতীয় সম্প্রদায় ক্ষোভে ফেটে পড়েছিলেন। ২০১৫ সালের মার্চ মাসে আরেকটি প্রচারপত্র বিলি করা হয় ব্রাম্পটন এলাকায়। ওতে ব্রাম্পটনে শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠি হ্রাস পাওয়ার ঘটনাকে ‘ white genocide ’ হিসাবে উল্লেখ করা হয়।

প্রথম যে প্রচারপত্রটি বিলি করা হয়েছিল সেটি নিয়ে মূলধারার রাজনীতিতকদের মধ্যেও অসন্তোষ দেখা দিয়েছিল এবং তারা সকলেই এটিকে বর্ণবাদী প্রচারণা হিসাবেই বিবেচনা করেছিলেন। কিন্তু ব্রাম্পটনের পিল পুলিশের বক্তব্য ছিল অন্যরকম। তারা বলেন, এই প্রচারপত্র বিলি করার ঘটনায় কোনরকম আইন লংঘন হয়নি। পীল পুলিশের কনস্টেবল লিলিয়ান ফিট্জপ্যাট্রিক সেই সময় বলেন, ‘‘অফিসাররা বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করেছেন। এতে কোনরকম অপরাধমূলক তৎপরতা ছিলো বলে প্রমাণিত হয়নি। কোনরকম হুমকিও ছিলো না। প্রচারপত্রে কোনরকম অপরাধমূলক কাজের ইঙ্গিত ছিলো না। সুতরাং আমাদেরও এ নিয়ে কিছু করার নেই।’’

তবে পুলিশ কোন পদক্ষেপ না নিলেও ওন্টারিওর প্রভিন্সিয়াল পার্লামেন্টে সব দলের সদস্যরা একত্রে প্রচারপত্রটির নিন্দা জানিয়েছিলেন। নিউ ডেমোক্রেট নেতা আন্দ্রে হরওয়ার্থ পার্লামেন্টে দাড়িয়ে সেদিন বলেছিলেন, ‘‘গত সপ্তাহে ব্রাম্পটনের ঘরে ঘরে যে বর্ণবাদী প্রচারপত্র বিলি করা হয়েছে সেটি ছিলো প্রতিটি অন্টারিওবাসীর ওপর আঘাতস্বরূপ। ঘৃণার জঘন্য চেহারা যখন প্রকাশ পেয়ে যায় তখন আমাদেরকে অবশ্যই অটুট সংহতির মাধ্যমে তার মোকাবিলা করতে হবে এবং আমাদের বন্ধনের শক্তিমত্তা দেখিয়ে দিতে হবে। আজ আমরা সবাই শিখ।’’

২০১১ সালের আদমশুমারীর হিসাব অনুযায়ী ব্রাম্পটনে ভিজিবল মাইনরিটির সংখ্যা ছিল মোট জনসংখ্যার প্রায় ৬৭%। বর্তমানে ব্রাম্পটনের ৪০% অধিবাসীই সাউথ এশিয়ান এবং এদের মধ্যে প্রায় ২০% শিখ সম্প্রদায়ের অন্তর্ভূক্ত।

মিসিসাগার মল্টন শিখ হ্যারিটেজ মিউজিয়ামের নির্বাহী পরিচালক প্রদীপ নাগ্রা বলেন, “টরন্টোতে ইহুদী সম্প্রদায় একটি নির্দিষ্ট এলাকায় বাস করেন। ইটালিয়ানদেরও রয়েছে একটি এলাকা। কিন্তু দোষ শুধু বাদামী চামড়ার লোক হলেই? এটি বর্ণবাদ ছাড়া আর কি?”

টরন্টোর বাইরে দুটি এলাকাকে ঘেটো (বস্তি) এলাকা হিসাবে চিহ্নিত করার প্রবণতা দেখা যায় অনেকের মধ্যে। এলাকা দুটি হলো, ব্রাম্পটন এবং স্কারবরো। এই দুটি এলাকায়ই এশীয় এথনিক সম্প্রদায়ের লোকদের বাস রয়েছে।

তাহলে দেখা যাচ্ছে বিদ্বেষ শুধু মুসলমানদের বিরুদ্ধেই নয়। মুসলমানরা যেমন আলাদা একটি পরিবেশে থাকতে চান তেমন আলাদা পারিবেশে বহু বছর আগে থেকেই ইহুদী ধর্ম সম্প্রদায়, গ্রীক, ইটালিয়ান ও চাইনিজ এথনিক সম্প্রদায় বাস করে আসছেন। কিন্তু এদের বিরুদ্ধে কারো কোন নালিশ ছিল না। নালিশ শুরু হলো যখন মুসলমান ধর্ম সম্প্রদায় অন্যান্যদের মত আলাদা একটি নেইবারহুড গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখতে লাগলেন তখন থেকেই। ব্রাম্পটনে শিখ সম্প্রদায় এবং অন্যান্য এশিয় বংশোদ্ভূতরা যখন একটি বিশাল আকারের নেইবারহুড ইতিমধ্যে গড়ে তুলেছেন তখন তার বিরুদ্ধেও বিষোদগার করা শুরু হয়।

এখানে একটি বিষয়  বিশেষভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে। কানাডার কুইবেক প্রভিন্সটি কিন্তু গড়ে উঠেছে প্রধানত ফরাসী ভাষাভাষীদের নিয়ে। ফরাসীরাও একটি এথনিক সম্প্রদায় এই দেশটিতে। তারা যদি কুইবেকের মত এত বড় একটি প্রভিন্সকেই (আকৃতিতে সবচেয়ে বড় প্রভিন্স কানাডায়) বেছে নিতে পারে নিজেদের এথনিক সম্প্রদায়ের বসতি গড়ে তোলার জন্য তবে অন্যান্য সংখ্যালঘু এথনিক সম্প্রদায়ের ব্যাপারে তাদের আপত্তি উঠে কেন? তাছাড়া কুইবেকের ফরাসী ভাষাভাসীরাতো থেকে থেকেই কানাডা থেকে আলাদা হয়ে যাওয়ারও হুমকী দিচ্ছে। গণভোটও করে যাচ্ছে।

উল্লেখ্য যে, ২০১৫ সালের আগস্ট মাসে প্রকাশিত এক গবেষণা পত্রে দেখা গেছে কানাডার বড় বড় শহরগুলোর যে সকল স্থানে নির্দিষ্ট কোন একটি এথনিক কমিউনিটির এনক্লেভ বা ছিটমহল গড়ে উঠছে সেখানে প্রকৃতপক্ষে কালচারাল ডাইভারসিটিই বৃদ্ধিই পাচ্ছে বিচ্ছিন্নতার পরিবর্তে। গবেষণায় দেখা গেছে এইসব ছিটমহলেও নির্দিষ্ট এথনিক গ্রুপের প্রতিনিধিত্ব গড়ে ১৫% এর বেশী নয়। মন্ট্রিয়ল ভিত্তিক থিং ট্যাংক সংগঠন ‘ইনস্টিটিউট ফর রিসার্স অন পাবলিক পলিসি’র গবেষণায় এই তথ্যই উঠে এসেছে।

টরন্টো স্টারের ইমিগ্রেশন রিপোর্টার নিকোলাস কিয়াং উক্ত গবেষণা প্রতিবেদনের সূত্র উল্লেখ করে এক প্রতিবেদনে জানান, প্রকাশিত ঐ গবেষণা পত্রে আশ্চর্যজনভাবে যে বিষয়টি লক্ষ্য করা গেছে তা হলো, বড় বড় শহরের এই সকল ছিটমহলে যে সকল ভিজিবল মাইনরিটি বাস করছেন তাদের মধ্যে শহরের অন্যান্য অঞ্চলে বসবাসকারীদের তুলনায় দারিদ্রতা মোকাবেলা করার সম্ভাবনা কম।

গবেষণা পত্রে বলা হয়, বড় বড় শহরের দ্রুত গড়ে উঠা এই ছিটমহলগুলো কানাডার প্রতি কোন হুমকী নয়। বরং এগুলোকে একটি সুযোগ এবং প্রতিযোগিতা হিসাবেই বিবেচনা যেতে পারে। যারা ভাবছেন এই ছিটমহলগুলো মনোকালচারাল বা কোন একটি একক সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে গড়ে উঠছে, তারা আসলে নিশ্চিতভাবেই ভুল করছেন। কারণ, দেখা গেছে মন্ট্রিয়ল শহরের ছিটমহলগুলো শহরের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় অনেক বেশী মাত্রায় মাল্টিকালচারাল বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। ভেঙ্গুভার আর টরন্টোর চিত্রও একই রকম।

ইনস্টিটিউট ফর রিসার্স অন পাবলিক পলিসি’র গবেষণা প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, সার্বিকভাবে গ্রেটার টরন্টো এরিয়াতে ৩ মিলিয়ন লোক বাস করেন শ্বেতাঙ্গ অধ্যুষিত এলাকায়। ১ মিলিয়ন লোক বাস করেন মিশ্র ও ভিজিবল মাইনরিটি অধ্যুষিত এলাকায়

এবং ১.৪ মিলিয়ন লোক বাস করেন বিভিন্ন ছিটমহলে। ছিটমহলগুলোর অবস্থান প্রধানত স্কারবরো, মিসিসাগা, মার্কহাম এবং ব্রাম্পটনে। আর এসকল স্থানগুলো কোন একটি একক এথনিক কমিউনিটি দ্বারা প্রভাবান্বিত নয়।

বিভিন্ন এথনিক গ্রুপের মধ্যে দেখা গেছে, আরব ও কৃষ্ণাঙ্গরা সাধারণত মিশ্র ভিজিবল মাইনরিটি অধ্যুষিত এলাকায় থাকতে পছন্দ করেন। অন্যদিকে সাউথ এশিয়ান ও চাইনিজদের মধ্যে দেখা গেছে তারা নিজেদের ছিটমহলে থাকতে বেশী পছন্দ করেন।

তবে গবেষণা পত্রে দেখা গেছে, ইউরোপের বিভিন্ন শহরে অবস্থিত ইমিগ্রেন্টদের বিভিন্ন ছিটমহলগুলো অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় যেমন গভীরভাবে সমস্যাযুক্ত, অর্থনৈতিকভাবে নির্যাতিত বা বঞ্চিত, কানাডার ক্ষেত্রে তা নয়।

ইমিগ্রেন্টদের একটি স্বাভাবিক প্রবণতা হলো অগ্রজদেরকে অনুসরণ করা। অর্থাৎ আগে যারা এসেছেন তাদের কাছাকাছি থাকার চেষ্টা লক্ষ্য করা যায় পরে যারা আসেন তাদের মধ্যে। এবং এভাবেই গড়ে উঠে ইমিগ্রেন্টদের একেকটি পছন্দের এলাকা। যেমনটি আমরা লক্ষ্য করেছি গ্রেটার টরন্টো এলাকায় ইহুদী, গ্রীক, ইটালী ও ভারতীয়সহ অন্যান্য সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে। বাংলাদেশীরাও এর বাইরে নন। যদিও সংখ্যার দিক থেকে তারা অন্যান্য এথনিক গ্রুপের চেয়ে অনেক ছোট এবং কানাডার মাটিতে পা ফেলার ক্ষেত্রে তারা একেবারেই নবীন অন্যান্যদের তুলনায়।

প্রবাসে ইমিগ্রেন্টদের জন্য এক সাথে একই এলাকায় থাকার সুবিধা অনেক। কানাডায় যখন কোন ইমিগ্রেন্ট প্রথম আসেন তখন এয়ারপোর্ট থেকেই ইমিগ্রেশন কর্মকর্তারা তাদের পরামর্শ দেন তাদের নিজস্ব এথনিক গ্রুপের কাছাকাছি গিয়ে উঠার জন্য। এতে করে চাকরীর সন্ধানে কমিউনিটির লোকদের সহযোগিতা পাওয়া সহজ হয়, সুবিধাজনক স্থানে বাসা খুঁজে বের করা যায়, নিজেদের ও ছেলে-মেয়েদের জন্য সমবয়সী বন্ধু খুঁজে পাওয়া যায়, দেশী গ্রোসারীর সুবিধাসহ আরো অনেক ক্ষেত্রেই সুবিধা পাওয়া যায় কমিউনিটির লোকদের কাছাকাছি থাকতে পারলে। এই সুবিধাগুলো অন্য সম্প্রদায় বিশেষ করে ইউরোপীয় সম্প্রদায়ের কাছে এশিয় সম্প্রদায়ের লোকেরা সাধারণত আশা করতে পারেন না। অথবা মুসলমান সম্প্রদায়ের লোকেরা ইহুদী সম্প্রদায়ের কাছে আশা করতে পারেন না। কারণ, ভাষা, সাংস্কৃতিক ও বিশ্বাসের দূরত্বটা অনেক বেশী। ভাষার দূরত্বটা হয়তো চেষ্টা করলে কমিয়ে আনা যায় বা কাটিয়ে উঠা যায় কিন্তু সংস্কৃতি ও বিশ্বাসের দূরত্বটা কমানো যায় না। উভয় সম্প্রদায়ের কাছেই কথাটা সত্য।

একজন ইউরোপীয়ান অন্য একজন ইউরোপীয়ানের সঙ্গে যতটা সহজে মিশতে পারবেন একজন এশিয় বা আফ্রিকান প্রতিবেশীর সঙ্গে ততটা সহজে মিশতে পারবেন না। তদ্রুপ একজন এশিয় বা আফ্রিকানও ইউরোপীয়ানদের সঙ্গে মিশতে পারবেন না যতটা সহজে তারা নিজেদের সম্প্রদায়ের লোকদের সঙ্গে মিশতে পারবেন। কথাটা প্রথম প্রজন্মের ইমিগ্রেন্টদের জন্য কঠিন সত্য। তবে দ্বিতীয় বা তৃতীয় প্রজন্মের বেলায় নয়। তাদের ক্ষেত্রে ভাষার দূরত্ব থাকে না এবং সাংস্কৃতিক দূরত্বও বহুলাংশে কমে যায়। আর বিশ্বাস? সেটাও কয়েক প্রজন্ম পরে অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে দেখা গেছে গ্রীক এলাকার তৃতীয় বা চতুর্থ প্রজন্মের লোকেরা ক্রমশ সিটির অন্যান্য অঞ্চলে স্থানান্তরিত হয়েছেন। এ কারণে অতীতে গ্রীক এলাকার যে চেহারা ছিল বর্তমানে তা নেই। অনেকটাই ম্রিয়মান। তাদের এলাকার ব্যপ্তিও কমে আসছে দিন দিন। আজকে ব্রাম্পটনের যে চেহারা, কয়েক প্রজন্ম পরে সেই চেহারা না থাকারই কথা। এটাই স্বাভাবিক।

তাই আজকে ইমিগ্রেন্টদের মধ্যে যারা একটা নিজস্ব এলাকা গড়ে তুলতে চাইছেন তাদেরকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করার কোন কারণ নেই। সময়ের বিবর্তনে একদিন তাদের এই বলয় আপনা থেকেই ভেঙ্গে যাবে অথবা ছোট হয়ে আসবে।

ইনস্টিটিউট ফর রিসার্স অন পাবলিক পলিসি’র গবেষণা প্রতিবেদনেও কানাডিয়ানদেরকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে, “ইমিগ্রেন্টদের ছিটমহলগুলো বৈপরীত্য বা ভিন্নতা বা বিভেদমূলক কিছু এমনটি ভাবার প্রয়োজন নেই অর্থনৈতিক বা সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোন থেকে।

খুরশিদ আলম

সম্পাদক ও প্রকাশক

প্রবাসী কণ্ঠ