নিগৃহীত এক মায়ের গল্প
জানুয়ারী ২৩, ২০১৬
মনিস রফিক
[বাংলাদেশ সেন্টার এন্ড কমিউনিটি সার্ভিসেস (বিসিসিএস) টরন্টোতে বসবাসরত বাংলাদেশি কমিউনিটি সদস্যদের মধ্যে এল্ডার এবিউজ সম্পর্কিত সচেনতা বৃদ্ধির লক্ষে একটি প্রকল্পের কাজে হাত দিয়েছে। তারই ৮ম অংশ আজকের এই প্রবন্ধ। বিসিসিএস এভাবে আরও ২টি প্রবন্ধ ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ করবে। সবাইকে প্রবন্ধগুলো পড়ার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি।]
টরন্টোর বাতাসে তখনো শীতের আমেজের কোনো ছোঁয়া লাগেনি। হেমন্তের বাতাস কেবল পাতা ঝরা মৃদু ঝাঁকুনি দিয়ে জানিয়ে দিচ্ছে লাল-কমলা আর সবুজের দিন আর বেশী দিন নেই। খুব সকাল হলেই অর্থাৎ সূর্য ওঠার অনেক আগেই একটা শান্ত নরম বাতাস শরীরে সামান্য একটু কাঁপুনি এনে দেয়। তবে এ কাঁপুনি এক মোহময় ভালো লাগার শিহরণ আনে। সকালেউঠা আমার সবচেয়ে অপছন্দের বিষয়, কিন্তু কোন এক দিন কোন এক অপ্রত্যাশিত কাজে সকালে উঠে টরন্টোর হেমন্তের এই অপূর্ব ভালো লাগা সকালের প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। টরন্টোর বাংলা পাড়ার একেবারে মূল জায়গায় ডেন্টনিয়া পার্ক। এই পার্কের পাশেই এক বাড়ীর এক সেমি বেইজমেন্টে আমার বসবাস। সেই হেমন্তের সকালের প্রেমে পড়ে তার পরের প্রত্যেক সকালই হয়ে উঠেছিল আমার কাছে অপরূপ এক এক মুহূর্ত। আমি নিজের মত করেই সকাল সকাল উঠে গোটা পার্কটা কখনো হেঁটে আবার কখনো দৌড়ে পার হতাম। পার্কের ছোট ছোট সবুজ লিকলিকিয়ে বেড়ে উঠা ঘাসে পা ফেলে যখন আমি আমার মত হৈমন্তিক সকালের ঘ্রাণ নিতাম তখন মনে হতো প্রকৃতির এই মোহময় ভালোবাসার স্পর্শ যারা কখনো অনুভব করেনি তাদের পক্ষেই সম্ভব ঘুমকাতুরে হয়ে বিছানায় শুয়ে থাকা।
ডেন্টনিয়া পার্কের পূর্ব দিকে যে বসার ষ্টিলের বেঞ্চ পাতা আছে সেই বেঞ্চে প্রথম দিন থেকেই দেখেছি এক বাংলাদেশী মহিলাকে চুপচাপ বসে ফ্যালফ্যালভাবে কখনো আকাশ আবার কখনো ঘাসের দিকে মলিনভাবে তাকিয়ে থাকতে।প্রথম প্রথম আমার মনে হয়েছিল আমার মতই তিনি হৈমন্তের সকাল উপভোগ করছেন। প্রায় প্রতিদিনই সামনাসামনি দেখা হলে একটা সালাম দিতাম। ওকে দেখে কেনো যেনো আমার মায়ের কথা মনে পড়ে যেতো। মাঠের অপর পার থেকে যখন তার দিকে তাকাতাম তখন কেনো যেনো আমার মনে হতো আমার মা ওখানে বসে আছেন, যেমন করে বসে থাকতেন আমার ছোটবেলায় আমার রাজশাহীর বাড়ীর সামনের খোলা মাঠটায়। ছোট্ট দূরন্ত আমাকে মা তখন খোলা মাঠটাই ছেড়ে দিয়ে আমার প্রতিটি হেঁটে চলা বা দৌড়ানোর পদক্ষেপ খেয়াল করতেন আর আমি মাঠে ছুটোছুটি করে বিশ্ব জয় করে আমার মায়ের কোলে এসে ঝাঁপিয়ে পড়তাম। অদ্ভুত সুন্দর মায়ের কোলের সেই উষ্ণতা!
আমি হয়তো সকালে উঠা বন্ধ করে আবার পূর্বের মত সেই ঘুমকাতুরে হয়ে বিছানার মধ্যেই পড়ে থাকতাম, কিন্তু কেনো যেনো সকাল হলেই বিছানা ছেড়ে মাঠে যাওয়ার এক অদৃশ্য তাড়া অনুভব করতে লাগলাম। আমি কিছুদিনের মধ্যেই লক্ষ্য করলাম আমার এই তাগিদের অনুভব হৈমন্তিক সকাল নয়, বরং মাঠের পশ্চিম পাশের বেঞ্চে বসে থাকা সেই ভদ্রমহিলা। আমার মনে হতে লাগলো তাকে এক নজর দেখে আমি আমার মাতৃ-দর্শনের স্বাদ কিছুটা হলেও মেটাতে পারছি। এ ভিতরের টানটা অন্যরকম। মা আমার কাছে যে এত বড় কোনো সম্পদ, তা মায়ের কাছ থেকে এত লক্ষ যোজন দূরে না থাকলে আমি কোনোদিন এর সামান্যটুকুও বুঝতে পারতাম না।
প্রতিদিন সকালে আমার হৈমন্তিক পার্ক ভ্রমণ আর মাতৃদর্শন ভালোভাবেই এগুচ্ছিলো। কিন্তু একদিন সকালে সেই বেঞ্চিতে তাকে দেখলাম না। কেনো যেন আমার হ্রদয়টা মোচড় দিয়ে উঠলো, আমি নিজে নিজের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলাম। আমার মনে হলো আমি আমার অতি আপনজনকে হারিয়ে ফেলেছি। সেই দিনটা আমার ক্লাস এবং কাজে আমি কোনো মন বসাতে পারলাম না। আমার মধ্যে কেমন একটা উৎকণ্ঠা কাজ করতে লাগলো। তার পরের দিনও তাকে পেলাম না। আমার বুকটা কিছুটা ধড়পড় করতে লাগলো। আসলে ‘ধড়পড়’ শব্দটায় এখানে প্রযোজ্য। আমি নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করতে লাগলাম আমার এমন অদ্ভুত সব অনুভূতি কেনো হচ্ছে? অথচ তার সাথেতো আমার কখনো কোনো কথা হয়নি। আর আমি জানিও না তিনি কোথায় থাকেন। শুধু মনে হয়েছে তিনি ক্রিসেন্ট টাউনের কোনো এক বিল্ডিং এ থাকেন।
ক্লাসে প্রফেসর মওরা বসকম আমাদেরকে আলজেইমার এবং অন্যান্য ডিমেনশিয়া পড়ান। বিভিন্ন ধরনের ডিমেনশিয়ার শুরু, মধ্য ও শেষ ভাগের যেসব লক্ষণ এবং এগুলোতে আক্রান্ত বয়স্কদের কিভাবে সেবা দেয়া উচিত সেগুলো ভাবলেই আশ্চর্য হতে হয়। আমাদের বাংলাদেশের প্রায় সব মানুষেরই এসব রোগ সম্পর্কে সামান্য ধরনের ধারণা নেই। অথচ ষাটোর্ধো প্রায় সত্তর ভাগ মানুষই এসব রোগে আক্রান্ত হতে পারে। আমাদের অস্বাভাবিক মৃত্যু না হলেতো আমাদের সবাইকে বার্ধক্যের স্বাদ নিতে হবে, আর বার্ধক্য যে কত নির্মম তা বার্ধক্যে অচল হয়ে যাওয়া যৌবন সাম্রাজ্যের কোনো শক্তিধর সেনাপতির দিকে তাকালেই বুঝতে পারা যায়।
আমার ছোটবেলায় আমার কয়েকজন নায়কের একজন ছিলেন রোনাল্ড রিগান। আমি যখন স্কুলে পড়ি তখন রিগান আমেরিকার প্রেসিডেন্ট। আমি টেলিভিশন আর পেপারে তার ছবি দেখি আর তার দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকি। এমনকি পেপারে তার ছবি দেখলেই সেটা কেটে আমার বিশেষ এলবামে সাজিয়ে রাখতাম। পরে যখন ওয়েষ্টার্ন মুভিতে তার অভিনীত কাউবয় নায়কের ছবিগুলো দেখলাম তখন তার শৌর্য ও বীরত্বের প্রকাশ আমাকে শুধু অভিভূতই করতো, আমার সেই নায়ক শেষ বয়সে যখন আলজাইমারে আক্রান্ত হলেন তখন তিনি এক অচল অসহায় শিশু হয়ে গেলেন। ২০০৪ সালে রোনাল্ড রিগান যখন মারা গেলেন, তখন তার ছবি দেখে কেউ সামান্যটুকু অনুধাবন করতে পারেনি এই ব্যক্তিই একসময় হলিউড, আমেরিকা তথা গোটা বিশ্বকে কাঁপিয়েছিলেন। বার্ধক্য বড়ই নিষ্ঠুর এক সময়! আমাদের কারো মুক্তি নেই জীবনের এই নির্মম সময়-স্তর থেকে!
১৯০১ সালে জার্মানীর ফ্রাঙ্কফুটের এক এসেইলামের ৫১ বছরের অগাস্ত দেতারের রোগ কোনো ডাক্তার ধরতে পারছিলেন না। দেতারের স্মৃতিশক্তি ধীরে ধীরে লোপ পাচ্ছিল। তার হাত কাঁপত অস্বাভাবিকভাবে আর নিজের শারীরিক কর্মকাণ্ডের উপর সে নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারছিল না। অদ্ভুত এক অসুখ অগাস্ত দেতারের ব্যক্তিগত আর পারিবারিক জীবনকে দূর্বিসহ করে তুলতে লাগলো। আশেপাশের অনেকেই তাকে অবজ্ঞা করতে লাগলো, এমনকি অনেকেই বলাবলি করতে লাগলো, দেতারের কিছুই হয়নি, সে যা করছে তা সবই ইচ্ছা করে। আসলে সবাই বলতে চাইছিল যে দেতার কাজ করার ভয়ে অসুখের ভান করে থাকছে। সেদিন দেতারের বিষয়টা নজরে এসেছিল জার্মানীর প্রখ্যাত সাইকিয়াট্রিষ্ট ও নিওরোলজিষ্ট ডক্টর আলিয়েশ আলজাইমারের। ডক্টর আলজাইমারই প্রথম মানুষকে ভালোভাবে জানালেন আমাদের বয়স বাড়লে মস্তিষ্কের বিভিন্ন নিউরণের ক্ষয়ে যাওয়ায় কি কি ধরনের সব অসুখ হতে পারে। উন্নত বিশ্বের মানুষেরা তাদের বয়স্কদের বিষয়ে বর্তমানে অনেক বেশি যত্নবান। তারা অনেক বেশি সচেতন বয়স বাড়ার সাথে সাথে মানুষের কি কি ধরনের সব অসুখ হতে পারে এবং কিভাবে আক্রান্তদের সাথে ব্যবহার করা উচিৎ। অথচ আলজেইমার রোগ আবিস্কারের সময় একশ বছর পেরিয়ে গেলেও বাংলাদেশের মানুষেরা এর সামান্যটুকু ধারনা ধারণ করে না।
ডেন্টনিয়া পার্কের ষ্টিলের বেঞ্চিতে বসে থাকা সেই ভদ্র মহিলাকে আমার বেশ কিছু দিন দেখা হয়নি। এর মধ্যে হৈমন্তের সেই সুন্দর সকাল আস্তে আস্তে ফুরিয়ে গিয়ে শীতের পদধ্বনির শব্দ শুনছিলাম। ক্লাসের জন্য খুব সকালেই বের হতে হতো। ক্লাসে গিয়ে প্রফেসর মলি মারাক, ষ্টোনবার্গ, পামেলা গুচি বা মওরা বসকন এর বায়োলজি অব এজিং, রেষ্টোরেটিভ কেয়ার, থিয়োরিপ্যাথিক ইন্টারভেনশন বা বিভিন্ন ধরনের ডিমেনশিয়া বিষয়ক লেকচারগুলো যখন মন দিয়ে শুনি তখন আমার ভিতরটা হু হু করে কেঁদে উঠে এই ভেবে যে আমরা আমাদের বৃদ্ধ বাবা-মা বা আশেপাশের বয়স্ক মানুষদের ব্যাপারে কত বেশী উদাসীন, আর আমরা এসব বৃদ্ধ-শিশুদের মনোবেদনা সামান্যটুকুও আঁচ করতে পারি না।
আমার ভালোলাগা আর ভালোবাসার প্রফেসরদের ক্লাসে মনযোগী ছাত্র হওয়ার জন্য প্রতিদিন সকালে রুম থেকে বের হয়ে ডেন্টনিয়া পার্ক ছুঁয়ে ভিক্টোরিয়া পার্ক সাবওয়েতে উঠতে হয়। একদিন ক্লাসে যাওয়ার পথে ডেন্টনিয়া পার্কের ষ্টীলের বেঞ্চিটা পেরুতেই বুকের ভিতরটা আনন্দে চমকিয়ে উঠেছিল। মাতৃ অনুভূতি পাওয়া সেই ভদ্রমহিলা সেই বেঞ্চিতে। আমি সাবওয়ের দিক থেকে মোড় ঘুড়িয়ে একেবারে সেই বেঞ্চির সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমার সালাম পেয়ে তিনি মুখটা আলতো করে ওপরে তুলতেই আমি চমকিয়ে গেলাম। তার কপালে একটা কালো দাগ। আমি নিশ্চিত সেটা কোনো আঘাতের চিহ্ন। আমি তার পাশে বসলাম। সরাসরি কোনো প্রশ্ন না করে তার সাথে গল্প করার মত করে কথা শুরু করলাম। আমি কথা শুরুর আগেই তিনি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে আমাকে বলতে লাগলেন, ‘বাবা, আমাকে কোনোভাবে দেশে পাঠাতে পারবে?’ আমার খটকা লাগলো। এক নিমিষেই আমার মা’কে খোঁজার সেই প্রবল অনুভূতি কোথায় যেন উবে গেল। আমি কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা হয়ে গেলাম। সেই সকালে ক্লাসের তাড়া ভুলে গিয়ে সেই ভদ্রমহিলার কাছে অপরাধী পুত্রের মত তার মনোবেদনার কথা শুনতে লাগলাম।
বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের এক ছোট্ট জেলা শহরে তার বেড়ে উঠা। বিয়ে হয়েছিল একই শহরের এক স্কুল শিক্ষকের সাথে। পাঁচ সন্তানকে একেবারে ছোট রেখে তার স্বামী মারা যান। তারপর শুরু হয় তার সংগ্রামের জীবন। সামান্য ফসলী জমির আয় আর নিজের সেলাই থেকে উপার্জন করা অর্থে তিনি মানুষ করতে থাকেন তার পাঁচ সন্তানকে। সন্তানদের মধ্যে সবচেয়ে মেধাবী ছিল তার এই সন্তান যার আশ্রয় থেকে এখন তিনি পালিয়ে বাঁচতে চাচ্ছেন।
তিনি বলে যেতে লাগলেন, এই ছেলে যখন ঢাকায় ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তো তখন কিভাবে পরিবারের সবাই তার দিকে তাকিয়ে থাকতো, তার লেখাপড়ার যেন কোনো রকম অসুবিধা না হয়, সেজন্য অন্যসব ভাইবোনেরা তাদের সবটুকু উজাড় করে তাকে দিতে কার্পণ্য করতো না। সেই ছেলে পড়াশুনা শেষ করে চাকরী করলো, বিয়ে করলো তারপর কয়েক বছর পর কানাডায় পাড়ি জমালো। ছোট্ট শহরে তার এই ছেলের কথা মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছিল। সবাই তাকে বলতো তিনি একজন সত্যিকারে সফল মা। মানুষের কাছে যখন তিনি তার প্রাণাধিক প্রিয় পুত্রকে নিয়ে এমন কথা শুনতেন তখন গর্বে তার মাথা উঁচু হয়ে উঠতো। তার বারবার মনে হতো তার দীর্ঘদিনের কষ্ট আর পরিশ্রমকে সার্থক করে দিয়েছে তার এই ইঞ্জিনিয়ার পুত্র।
তিন বছর আগে তার এই ইঞ্জিনিয়ার পুত্র তাকে দেশ থেকে এখানে আনে। অন্য ছেলেমেয়ে আর নাতিনাতনিদের ছেড়ে তার এখানে আসতে প্রথম প্রথম মন টানেনি, কিন্তু যখন দেখলো যে তার ছেলে ও ছেলে বউ খুব জোরাজুরি করছে তখন তিনি ভাবলেন, তারা তার দীর্ঘ কষ্ট আর সংগ্রামের জীবন থেকে একটু মুক্তি দিয়ে তাকে সুন্দর এক জীবন উপহার দিতে চাচ্ছে। সেইসাথে তারও ইচ্ছে করেছিল, ইঞ্জিনিয়ার ছেলের সাথেতো তার বেশী সময় কাটানো হয়নি, এখন যদি সেই ছেলেকে একটু বেশী সময় কাছে পাওয়া যায়। আর তার মনের ভিতর একটা বাসনা কাজ করছিল, ছবির মত যে দেশে তার ছেলেটা থাকে সেই দেশটা একবার গিয়ে দেখে আসবেন ।
কানাডায় এসে তার সেই স্বপ্নের মৃত্যু হয়েছে, স্বপ্নভঙ্গ কাকে বলে তা এখন তিনি বুঝেন। কানাডায় এসেই তিনি বুঝতে পারলেন, মাতৃসেবার জন্য তাকে এখানে আনা হয়নি। কানাডায় আনা হয়েছে তাকে তার ছেলের ছেলেমেয়েদের দেখাশুনা করা, ঘরদোর পরিস্কার করা আর রান্নাবান্নার কাজ করার জন্য। ভদ্রমহিলা কথাগুলো বলতে বলতে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন। তিনি আরো জানালেন, তাকে কখনো অন্যদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয় না। তার সাথে তার ছেলে আর ছেলে বউ যেভাবে ব্যবহার করে তাতে মনে হয় তিনি ঐ বাড়ির চাকরানি ছাড়া অন্যকিছু নন।
আমি তার কপালের কালো দাগের কারণ জানতে চাইলাম। এবার তিনি আবার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন। তিনি জানালেন, তিনি এখন প্রায় সবকিছু ভুলে যান আর কোনো কাজ করতে লাগলে প্রায়ই তার হাতটা কাঁপতে থাকে। কয়েকদিন আগে ছুটির দিনে তার তিন বছরের নাতিকে ঠিক সময়ে খাবার দিতে ভুলে যাওয়ায় তার বউমা তাকে বকাঝকা শুরু করে দেয়। তখন ভয়ে তিনি দ্রুত তার নাতির খাবার তৈরী করে তাকে খাওয়াতে যাচ্ছিল, কিন্তু যেহেতু তার হাত কাঁপে, সেজন্য দ্রুত কাজ করতে গিয়ে তার হাত থেকে প্লেটটা মেঝেতে পড়ে গিয়ে ভেঙ্গে যায়। এতে তার বউমা তাকে গালাগালি করতে করতে ধাক্কা দিয়ে মেঝেতে ফেলে দেয়। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম সেই সময় তার ছেলে বাড়ীতে ছিলো কিনা। তিনি জানিয়েছিলেন, ছেলে বাড়ীতেই ছিল, সে তার সাথে তার বউয়ের মতই আচরণ করে আর বাচ্চাকে সময়মত না খাওয়ানোর জন্য বকাঝকা করে।ভদ্রমহিলা কিছুক্ষণ থেমে আবার বলতে থাকেন, তারা বলে আমি নাকি কোনো কাজ করতে চাই না, আর আমি নাকি ইচ্ছা করেই জিনিসপত্র হাত থেকে ফেলে দিই। কিন্তু বাবা আমিতো আমার ছেলে আর নাতিনাতনির জন্য আমার সব দিয়ে কাজ করতে চাই, কিন্তু আমার শরীরটাতো এখন ভালো যায় না, আমার মাথা ঝিমঝিম করে, আমার হাত কাঁপে, আমি সবকিছু ভুলে যাই। মলিনভাবে ভদ্রমহিলা কথাগুলো বলতে বলতে কিছুটা শান্ত আর ঋজু হয়ে বসলেন, তিনি শান্ত হয়ে শুধু বললেন, বয়স হলে মানুষ বড় অসহায় হয়ে যায় বাবা! আমার নাতিনাতনির সামনে আমার ছেলে আমার সাথে যে আচরণ করে আমার ভয় হয় তা তারা শিখে ফেলতে পারে, ফলে তারাওতো তাদের বাবা-মা’র সাথে ভবিষ্যতে ওমন ব্যবহার করবে। কিন্ত আমিতো কখনো ভাবতে পারি না আমার ছেলে বুড়ো বয়সে তার ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে এমন ব্যবহার পাবে যা আমি আমার ছেলের কাছ থেকে পাচ্ছি। আমি আমার ছেলেটাকে যে অনেক বেশী ভালোবাসি। এ কথা বলে ভদ্রমহিলা অঝোরে কাঁদতে লাগলেন। আমি তাকে শান্ত করে জানতে চাইলাম, তাহলে আপনি আপনার এই ছেলেকে ছেড়ে দেশে যেতে চাইছেন কেনো? তিনি কান্না থামিয়ে মুখ নিচু করেই বললেন, জানি না বাবা, আমি ছেলেকেও ছাড়তে পারিনা, আবার এখানে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে।
মমতাময়ী মাকে সেই ডেন্টনিয়া পার্কের ষ্টীলের বেঞ্চিতে রেখেই সেইদিন আমি ক্লাসের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিলাম। আমি জানি তার পক্ষ হয়ে তার ছেলে বা ছেলের বউয়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর শক্তি বা ক্ষমতা আমার নেই।আর আমি দাঁড়াবোই বা কোন মায়ের পক্ষ নিয়ে, যে মা তার ছেলে আর ছেলে বউয়ের ব্যবহারের কষ্টের চেয়ে বেশী কষ্ট পান তার অত্যাচারী ও অকৃতজ্ঞ ছেলের ভবিষ্যত-সুখ চিন্তায়! আমি অনুধাবন করতে পারি, সেই ভদ্রমহিলা কোনো এক ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত আর এ ব্যাপারে তার যত্ন না নিলে এটা আস্তে আস্তে কঠিন এক পর্যায়ে যাবে যার ফলে তিনি স্বাভাবিকভাবে সব কাজকর্ম করতে ব্যর্থ হবেন। আর এই ব্যর্থতায় তিনি প্রতিনিয়ত তার সন্তানদের কাছে অপমানিত হবেন।
আমি হয়তো আমার প্রফেসরদের লেকচার শুনে বার্ধক্য সম্পর্কে আরো জানবো। জানবো কিভাবে তাদের সুন্দর রাখা যায় বা তাদের সুন্দর রাখার জন্য কোন অবস্থায় তাদের সাথে কিভাবে ব্যবহার করা যায়। অথবা আমি হয়তো ‘এল্ডার এবিউজ’ নিয়ে মানুষকে সচেতন করবো, কিন্তু আমাদের নিজেদের ঘরে যে মমতাময়ী মায়েরা প্রতিনিয়ত নিগৃহীত হন, তা আমরা রুখবো কেমন করে?