নস্টালজিক প্যাঁচাল

ফেব্রুয়ারি ১০, ২০১৬

ওয়ালিউর রহমান

অনেক বছর আগে যখন ঢাকার প্রায় প্রতিটি কাঁচা বাজারে নিয়মিত যাতায়ত ছিল, তখনকার কথা বলছি। পকেট প্রায়শই চৈত্রের খরায় আক্রান্ত থাকলেও রুচিখানি আল্লাহপাক দিয়েছিলেন একেবারে জমিদারী স্টাইলের। তারই জের হিসাবে বাজারের সবচেয়ে তাজা আর মৌসুমের নতুন উঠা আলু-শিম-টমেটো থেকে শুরু করে দামি শাক শব্জি আর জীয়ল মাছ, কবুতরের বাচ্চা ইত্যাদি খরিদ করার প্রতি ছিল দুর্বার আকর্ষন। যেটাই কিনতাম আর যতটুকুই কিনতাম সেটাই হতে হতো বাজারের সেরাটা।

ঐ সময়টা এমনি এক সময় ছিল যখন কাজে অকাজে সারা ঢাকা শহর ঘুরে বেড়ানো ছিল অনেকটা নেশার মতো। মিনিবাসে চিড়া চ্যাপ্টা হওয়ার মাঝে হতাশা মিশ্রিত বিরক্তি বোধ থাকলেও কেমন যেনো বিনিসূতার দুর্বার আকর্ষন বোধ করতাম বারবার চড়ার। অবশ্য তখনকার সময়ে ১% এরও কম ঢাকাবাসীর সামর্থ ছিল প্রাইভেট কারের বিলাসী ধোয়া উড়ানোর। সে সময় বেবীট্যাক্সীই ছিল কিছুটা সচ্ছল সকল বিত্তের মানুষের নিরাপদ বিশ্বস্ত বাহন। সে কারনেই অনেকটা অনন্যোপায় হয়েই জাম ঝুমা হবার পরেও পরবর্তীতে বারম্বার সেই পরিস্থিতির মুখোমুখি হবার প্রানশক্তি অটুট থাকতো। তাইতো এত বিরম্বনার পরেও ঘরে ফেরার পথে কখনো কাওরান বাজারে নেমে পরতাম অথবা কখনো পরিকল্পনা করে দূরের ঠাটারী বাজার, কাপ্তান বাজার কিংবা চকবাজারে চলে যেতাম কেনাকাটা ও দেখার মানসে।

যে সময়ের কথা বলছি, সেই আশির দশকের শুরুর দিকের কথা। পড়াশুনার পাশাপাশি একটি অফিসে এন্ট্রি লেভেলের টেম্পরারী জব করার প্রেক্ষিতে যৎসামান্য কিছু অর্থ কড়ির সংযোগ ঘটা শুরু হয়। এরই প্রেক্ষিতে বাজার পরিদর্শনের কার্যকরি মাত্রা বেড়ে যেতে থাকলো। যতটা না কিনতাম তারচেয়ে বেশি দেখে দেখে চোখের সাথে জিহ্বার একটা অলিখিত সমঝোতা করে তৃপ্তির সমাপ্তি ঘটাতাম। তবে যখনই পকেটের বড় ধরনের স্বাস্থ্যোন্নয়ন ঘটতো তখনই একটা অদ্ভুত খেয়ালের ঘোরে মশগুল হয়ে একদম ভোররাতের দিকে চলে যেতাম সোয়ারিঘাটে মনস্টার সাইজের মাছ দেখার মানসে। মনে মনে অবশ্য খানিকটা আশা বেঁধে রাখতাম যদি পছন্দসই পেয়ে যাই আর পকেটে কুলায়, তাহলে হয়তো মওকা বুঝে কিনে ফেলতেও পারি। কিন্তু প্রায় দিনই কেনা হয়ে উঠতো না। যাদের একেবারে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আছে তারা ছাড়া কেউ আন্দাজই করতে পারবে না ভোরবেলা সোয়ারিঘাটের মাছের আড়তে কি বিশাল সাইজের রুই, কাতলা, মৃগেল, পাঙ্গাস সহ বাংলাদেশের প্রায় সব প্রজাতির মাছের সমারোহ ঘটে থাকে।

অনেকদিনের টার্গেটের পর একদিন ভোর রাতে সোয়ারিঘাটে গিয়ে জবরদস্ত এক কান্ড করে বসি। কাউকে কিছু না বলে আমার পরিচিত একজনকে সাথে নিয়ে ২২ কেজি ওজনের সার্কের মত সাইজের এক পাঙ্গাস মাছ ২৫০০ টাকায় কিনে ফেলি। যে সময়ের ঘটনা এটি সে আমলে ২৫০০ টাকা একজন যুগ্মসচিব পর্যায়ের অফিসারদের একমাসের বেতনের সমপরিমান ছিল প্রায়। বৈষয়িক বুদ্ধিতে তীক্ষ্নতা ছিলনা বলেই শুধুমাত্র মাছটির বিশালত্বের কাছে আমার সকল বোধশক্তি বাঁধা রেখে লোভের লিকলিকে জিহ্বাটিকে জয়ী করে দিয়ে বেবীট্যাক্সীতে করে আস্ত মাছটি বাসায় নিয়ে আসি। এরপর আমাদের বাসার সবার প্রতিক্রিয়া ছিল অভূতপূর্ব! মাছের বিশালত্ব দেখে প্রাথমিক ভীমড়ি খাওয়া, এরপর এটির আকার এবং আয়তন নিয়ে সবার সম্মিলিত বিষ্মিত পর্যালোচনা এবং সকল উচ্ছাস অনুভূতি প্রকাশের পর যখন বাস্তব অবস্থানে ফেরত আসে তখন চলে আমার উপর রাম ধোলাইয়ের পালা। আমার অর্বাচীন নির্বুদ্ধিতার খেসারতে বিরাট অংকের আর্থিক গচ্ছা যাবার প্রায়োগিক বিচ্ছেদের জন্যে অবিরাম আফসোসের ভৎর্সনা বর্ষণ। আমি অবশ্য মাছটি কেনার সময়েই এই দৃশ্যটির চিত্রপট আগে ভাগেই কল্পনা করে রেখেছিলাম। তাই বাস্তবে যখন এটি পেলাম আমার মনে তেমন কোন প্রতিক্রিয়াই হলো না। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে দৈত্যাকৃতির মাছটিকে কিভাবে কেটে পরিষ্কার করা যেতে পারে সে ব্যাপারে সবার দৃস্টি আকর্ষনের চেস্টা করি। এতে ফলও হয়। সবার ভাবনাকে এক কেন্দ্রিক অবস্থানে এনে কাটা কুটা করে পরিষ্কার করার আপাত সমস্যাকে সমাধানের প্রতি সহ্নিবেশিত করতে সমর্থ হই। অবশ্য আমিই কাঠের গড়, গরু জবাইয়ের ছুরি আর মাংস কাটার চাপাতি যোগার করে এনে দুই তিনজনের সহায়তায় বেশ কয়েক ঘন্টার নিরলস প্রচেষ্টায় টুকরা টুকরা করে ফেলি।

যাহোক, এভাবে যখন বাজারগুলো ঘুরে ফিরে দেখতাম তখন তার সাথে সাথে আরো একটি বিষয় লক্ষ্য করতাম। সেটি হচ্ছে সাধারন বাজারের পাশাপাশি সেই বাজারের বাইরে ফুটপাথ জুড়ে বসতো বাসী এবং প্রায় ফেলে দেওয়া শাক শব্জি থেকে শুরু করে শুকিয়ে চিমটা হয়ে যাওয়া আদা, রসুন, পেঁয়াজ সহ সব ধরনের সামগ্রী। চটের ছালা পেতে ছোট ছোট ভাগা বসিয়ে বিক্রি করতো। এদের বেশিরভাগ ক্রেতাই থাকতো বস্তির অনগ্রসর অতি নিম্ন আয়ের লোকজন। দামের পার্থক্যও থাকতো আকাশ পাতাল সদৃশ। এদের পাশ দিয়ে অসংখ্যবার আসা যাওয়া করলেও প্রচ্ছন্ন ঊন্নাসিকতার মানসিকতায় ভাল করে ফিরেও তাকাতাম না।

পরিশেষে একটি মজার কাহিনি বলে শেষ করছি লিখাটি। বেশ কয়েকদিন আগে কাঁচা বাজার করতে যাই একটি জায়েন্ট সুপার স্টোরে। কেনাকাটা করার এক পর্যায়ে পেয়াজের সেকশনে এসে চোখ আটকে গেলো। হরেক রকমের বাহারী সাইজ আর রঙ্গের পেঁয়াজের সমাহার। রেগুলার পেঁয়াজগুলো সাধারনত ১০ পাউন্ড ও ২০ পাউন্ডের জালি ব্যাগে করে বিক্রি করা হয়। সোনালী রঙের পেঁয়াজ থেকে লাল রঙের পেঁয়াজ কিছুটা বেশি হয়ে থাকে। সেটাও ১০ পাউন্ডের ব্যাগে খুব বেশি হলে ২ ডলার হবে। স্বাদে তেমন কোন পার্থক্য থাকে না বিধায় বেশির ভাগ লোকই সোনালী পেঁয়াজ কিনে থাকে। সেখানে দেখতে পাই তখন ১০ পাউন্ডের একটি সোনালী পেঁয়াজের ব্যাগের দাম ২ ডলার। এর পাশেই ছোট একটি বাক্সে রাখা ছোট আকৃতির পেয়াজ। এটা দেখে আমার দৃষ্টিতে সেই কাওরান বাজারের ফুটপাতে ছালার চটে বিছানো কুড়িয়ে যোগার করা চিমটা হয়ে যাওয়া সেই পেঁয়াজগুলোর মতো মনে হলো। তাচ্ছিল্য ভরা দৃস্টি দিয়ে যখন চলে যাচ্ছিলাম তখনই এর দামের দিকে তাকিয়ে চক্ষু আমার ফ্রীজ হয়ে যাবার অবস্থা। অবাক বিষ্ময়ে দেখি এই পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে প্রতি পাউন্ড ৪ ডলার করে! যেখানে ফ্রেস এবং আকর্ষনীয় সাইজের সোনালী পেঁয়াজ ১০ পাউন্ড বিক্রি হচ্ছে ২ ডলারে। এটার দিকে তাকিয়ে কতক্ষন হাসলাম আর মনে মনে বলতে লাগলাম, পাগলামীরও তো একটা সীমারেখা আছে! এরা তো দেখি পাগলামীকে শিল্পের পর্যায় ছেড়ে অসীমের পর্যায়ে নিয়ে গেছে! আর তারই প্রতিক্রিয়ায় আমার পাগল মন গেয়ে উঠে:

কত রঙ্গ জানো রে মানুষ
কত রঙ্গ ঢালো,
আমার দেশের ফেলনা জিনিষ
তোমার লাগে ভালো।


ওয়ালিউর রহমান
টরন্টো
waliur97@yahoo.ca