তোলপাড় করা ‘মি টু’ আন্দোলন : বছরের আলোচিত ঘটনা
নারকীয় নারী ধর্ষণ অনেক সময় সরকারী সমর্থনে, সমাজপতিদের সমর্থনেও হয়ে থাকে! কেউ কেউ একে ‘পবিত্র দায়িত্ব’ বলেও মনে করেন!
জানুয়ারী ৬, ২০১৮
॥ খুরশিদ আলম ॥
হলিউডের যে সকল নারী যৌন নির্যাতন ও হয়রানির তথ্য ফাঁস করেছেন তাদেরকে ২০১৭ সালের বর্ষসেরা ব্যক্তিত্বের সম্মাননায় ভূষিত করেছে বিখ্যাত মার্কিন সাময়িকী টাইম ম্যাগাজিন। বছরজুড়ে যে ব্যক্তি, গোষ্ঠি বা প্রতিষ্ঠান ব্যাপক প্রাধান্য বিস্তার করে (ভাল বা মন্দ) সংবাদের শিরোনাম হয় সাধারণত তাদের কপালেই জুটে এই সম্মাননাটি। গত বছর এই সম্মাননা পেয়েছিলেন মার্কিন ইতিহাসের এযাবতকালের সর্বাপেক্ষা বিতর্কিত ও নিন্দিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি এমনই একজন প্রেসিডেন্ট যার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকজন নারী যৌন হয়রানির অভিযোগও উত্থাপন করেছেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্টে নির্বাচিত হওয়ার পরই এই অভিযোগগুলো উত্থাপিত হয়। অথচ তিনি এখনো বহাল তবিয়তেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদ দখল করে আছেন। এই বিষয়টি নিয়ে ক্ষমতাসীন বা বিরোধী দলের কেউ কোন উচ্চবাচ্য করছেন না।
কিন্তু এই একই রকম অভিযোগের কারণে হলিউডের প্রযোজক হার্ভে ওয়েইনস্টেন চাকরীচ্যুত হয়েছেন, তার স্ত্রী তাকে ত্যাগ করেছেন, একাডেমী অব মোশন পিকচার আর্টস এ্যান্ড সায়েন্সের সদস্যপদ খুইয়েছেন তিনি। আর ‘মি টু’ আন্দোলন নুতন করে উজ্জীবিত হয়েছে এই হার্ভের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপনের পর থেকেই। এই আন্দোলন এখন আর হলিউডে সীমাবদ্ধ নেই, আমেরিকার সীমানা ছাড়িয়ে কানাডাসহ সারা বিশ্বেই ছড়িয়ে পরেছে।
হার্ভে ওয়েইনস্টেন হলিউডের একজন খুব গুরুত্বপূর্ন ব্যক্তি। তার বিরুদ্ধে যারা যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠিয়েছেন তাদের মধ্যে হলিউডের নামকরা অভিনেত্রী এ্যাঞ্জেলিনা জোলিও আছেন।
গত ১৩ নভেম্বর যৌন হয়রানির শিকার নারীদের প্রতি সমর্থন জানিয়ে বেশ বড়সড় মিছিলও বের করা হয়েছিল হলিউডে। বিবিসি’র খবরে বলা হয়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘হ্যাশট্যাগ মি টু’ প্রচারণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে এ মিছিলে যৌন হয়রানির শিকার নারীরা ছাড়াও আরো অনেকে অংশ নেন। মিছিলকারীদের একটি বড় অংশই নারী হলেও সেখানে কিছু পুরুষকেও দেখা গেছে।
যৌন হয়রানির শিকার নারীদের প্রতি সমর্থন জানিয়ে অনুরূপ মিছিল বের করা হয়েছিল টরন্টোতেও। গত ২ ডিসেম্বর টরন্টোর ডাউনটাউনে অবস্থিত অন্টারিও পার্লামেন্ট ভবনের সামনে থেকে শুরু হয়ে মিছিলটি নেথেন ফিলিপস স্কয়ারে এসে শেষ হয়। কয়েক হাজার নারী এতে অংশ নেন। কিছু সংখ্যক পুরুষও ছিলেন মিছিলে।
উল্লেখ্য যে, তারানা বুর্কে নামে এক কৃষ্ণাঙ্গ সামজকর্মী নারী ২০০৭ সালে যৌন নির্যাতনবিরোধী ‘মি টু’ আন্দোলন শুরু করেছিলেন। তখন এই আন্দোলন তেমন জোরালো হয়ে উঠতে পারেনি। কিন্তু এবার সেটি বিশ্বব্যাপী প্রচারণা পায়। এই হ্যাশট্যাগ মি টু-তে হাজার হাজার নারী জানিয়েছেন কি ভাবে তারা বিভিন্ন সময় যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। এমন কি কিছু সংখ্যক পুরুষও জানিয়েছেন তারা কি ভাবে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে এই বলে যে, যৌন হয়রানি মানুষ কেন করে? এ প্রশ্নের সহজ কোন উত্তর আছে কি?
আমরা দেখেছি পৃথিবীর প্রতিটি দেশেই নারীরা যৌন হয়রানি ও যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। এই হয়রানি থেকে, এই নির্যাতন থেকে বাদ যাচ্ছে না কন্যা শিশুরাও। এমন কি বালক শিশুরাও!
আদিযুগে, যখন নারী ও শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে তেমন কোন আইন ছিল না বা ঐ নির্যাতনকে যখন পুরুষ তার অধিকার বলে মনে করতো, সেই আমলের চিত্রটি কি ছিল?
ভয়াবহতো বটেই। আজকের যুগে আইন আছে, থানা পুলিশ আছে, বিচারালয় আছে। কিন্তু তারপরও যৌন হয়রানি বা নির্যাতন হচ্ছে। কানাডার কথাই ধরা যাক। এখানকার আইন শৃংখলা পরিস্থিতি পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশের তুলনায়ও উন্নত। কানাডা পৃথিবীর অন্যতম শান্তির দেশ হিসাবেও নির্বাচিত হয়েছে। Global Peace Index সম্প্রতি এই রিপোর্টটি (২০১৬) প্রকাশ করে। এখানকার মানুষজনও শিক্ষিত। সৌজন্যতা প্রকাশ, সৌহার্দ প্রকাশ, শিষ্টাচার প্রদর্শন, নম্রতা দেখানো, শালীনতা প্রকাশ ইত্যাদিতে কানাডা বরাবরই প্রথম সারির দেশ হিসাবে বিবেচিত বিশ্বে। কানাডার বর্তমান মন্ত্রীপরিষদের অর্ধেক সদস্যই নারী।
কিন্তু তারপরও আমরা দেখছি এই দেশটিতেও নারীর প্রতি যৌন হয়রানি ও যৌন নির্যাতন চলে আসছে। গত অক্টোবর মাসের ২০ ও ২১ তারিখে এ্যাবাকাস ডাটা’র পরিচালিত এক জরীপে দেখা যাচ্ছে কানাডার ৫৩% নারী অবাঞ্ছিত যৌন হয়রানি বা চাপ এর শিকার হচ্ছেন। আর শতকরা ১০ জনেরও বেশী পুরুষ এবং নারী বলেন তাদের কর্মস্থলে নারীদের যৌন হয়রানির শিকার হওয়া খুবই কমন বা সাধারণ বিষয়। এ্যাবাকাস ডাটা’র চেয়াম্যান ব্র“স এন্ডারসন বলেন, জরীপে উঠে আসা এই তথ্য খুবই আঘাত হানার মত। সংখ্যার হিসাবে বলা যায় কানাডায় ৮০ লক্ষ নরী যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন তাদের জীবনের কোন এক পর্যায়ে।
এই জরীপটি এমন সময় পরিচালিত হলো যখন হলিউডের বিখ্যাত প্রডিউসার হারভি ওয়ানস্টিনের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির বিস্ফোরক অভিযোগ আনেন বেশ কয়েকজন চলচ্চিত্র অভিনেত্রী। এই অভিনেত্রীদের কেউ কেউ এমন অভিযোগও করেন যে হারভি তাদেরকে যৌন নির্যাতনও করেছে। হারভি এই অপকর্ম প্রায় এক দশক ধরেই করে আসছিলেন।
জরীপে একটি প্রশ্ন ছিল- ‘সম্প্রতি হলিউডে অভিনেত্রীদের কেউ কেউ অভিযোগ করেছেন যে তারা যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। আপনি কি অবাঞ্ছিত যৌন হয়রানি বা চাপের শিকার হয়েছেন কখনো?’
এই প্রশ্নের উত্তরে জরীপে অংশগ্রহনকারী ৫% কানাডীয় নারী বলেছেন তারা অতি ঘনমাত্রায় অবাঞ্ছিত যৌন হায়রানির শিকার হয়েছেন। ৭% নারী বলেছেন তারা অবাঞ্ছিত যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন প্রায়ই। ৪১% নারী বলেছেন তারা অবাঞ্ছিত যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন মাঝেমধ্যে। আর ৪৬% নারী বলেছেন তারা কখনোই এরকম অবাঞ্ছিত পরিস্থিতির শিকার হননি।
কর্মস্থলে নারীগণ যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন কি না এই প্রশ্নও ছিল জরীপে অংশগ্রহণকারীদের প্রতি। এই প্রশ্ন নারী ও পুরুষ উভয়কেই করা হয়। এর উত্তরে তারা (১০% পুরুষ ও ১৪% নারী) বলেন কর্মস্থলে নারীদের প্রতি যৌন হয়রানি খুবই কমন বা সাধারণ বিষয়। ৪৪% উত্তরদাতা ( ৪৩% পুরুষ এবং ৪৪% নারী) বলেন, তাদের কর্মস্থলে এটি ঘটে তবে অনিয়মিতভাবে। আর ৪৪% উত্তরদাতা বলেন, তাদের কর্মস্থলে নারীদের প্রতি যৌন নির্যাতনের কোন ঘটনা ঘটেনি। এ্যাবাকাস ডাটা’র এই জরীপ রিপোর্টটি গত নভেম্বর মাসে সিবিসিতে প্রকাশিত হয়েছিল।
এদিকে, হাফিংটন পোস্টের এক রিপোর্টে বলা হয়, বেশিরভাগ ঘটনাই ঘটে বাড়িতে চেনা পরিবেশে এবং ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রে পরিবার-বন্ধু-বান্ধবরাই যৌন নির্যাতন করেন।
নারী নির্যাতনের চরম একটি পর্যায় হলো ধষর্ণ। আর এই ধর্ষণের তালিকায় নাকি শীর্ষ স্থান দখল করে আছে আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী ও বিশ্বের অন্যতম নামী ও দামী দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র!
২০১৫ সালে বিশ্বের কয়েকটি সংগঠন জঘন্য নারী নিগ্রহের ঘটনার শীর্ষে থাকা দেশগুলোর একটি তালিকা প্রকাশ করেছিল। সংগঠনগুলো হলো, ব্যুরো অব জাস্টিস স্ট্যাটিস্টিক্স, ন্যাশনাল ভায়োলেন্স এগেইন্সট উইমেন সার্ভার, কমিউনিটি অব ইনফরমেশন, এমপাওয়ারমেন্ট অ্যান্ড ট্রান্সপারেন্সি, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ন্যাশনাল ক্রাইম রিপোর্টস ব্যুরো এবং জাস্টিস ইন্সটিটিউট অব ব্রিটিশ কলাম্বিয়া। তারা তাদের সমীক্ষার মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী ধর্ষণের যে মাত্রা বিরাজ করছে সেটি তুলে ধরেছেন। ঐ সমীক্ষার বরাত দিয়ে দৈনিক ইত্তেফাক জানায়, “সারা বিশ্বে বেড়েই চলেছে ধর্ষণ আর নারী নিগ্রহের ঘটনা। নারীর সম্ভ্রম হরণের প্রবণতা বাংলাদেশের মতো দেশেও হচ্ছে। তবে পশ্চিমা দেশগুলোতে ধর্ষণের সংখ্যা উদ্বেগজনক। অবশ্য এই অপরাধ সবচে বেশি ঘটে যে ১০টি দেশে তার মধ্যে বাংলাদেশের নাম নেই। এই অপরাধ সংঘটনের ক্ষেত্রে শীর্ষে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ভারতের অবস্থান পাঁচ নম্বরে।”
যৌন নির্যাতনের আরেকটি কৌশল হলো, যৌনদাসী হিসাবে নারীদেরকে কাজ করতে বাধ্য করা। আশ্চর্যের বিষয় হলেও সত্যি যে, টরন্টোসহ অন্টারিও প্রভিন্সের বিভিন্ন অঞ্চলে হাজার হাজার তরুনীকে কৌশলে বা জোর করে বাধ্য করা হচ্ছে যৌনদাসী হিসাবে কাজ করার জন্য! অবাধ্য হলে এদের উপর নেমে আসে শারীরিক নির্যাতন। দিনে ১০ থেকে ১৫ জন খদ্দেরের কাছে শরীর বিক্রি করতে হয় হতভাগ্য এই তরুনীদের কাউকে কাউকে। এদের মধ্যে কারো কারো বয়স ১২ বছর! আর এই যৌনব্যবসা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে টরন্টোসহ গোটা প্রভিন্সজুড়ে! ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে টরন্টো স্টার এর এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে এমনি চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশিত হয়। আগের দিনের দাসদের মত হতভাগ্য এই তরুনীদের বেচা-কেনাও করা হয়।
যৌনদাসী হিসাবে এই মেয়েরা যা আয় করে তার সবটাই দালালদের পকেটে জমা হয়। আর সকলেরই ধারণা যে এই মেয়েদেরকে দেশের বাইরে থেকে উচ্চ বেতনের চাকরীর প্রলোভন দেখিয়ে আনা হয় নানান অবৈধ উপায় অবলম্বন করে। আর এখানে এনে তাদের পাসপোর্ট বা অন্যান্য কাজগপত্র আটক করা হয়। ভয় দেখানো হয়, কথার অবাধ্য হলে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই মেয়েদের প্রায় সকলেরই জন্ম কানাডায়! আইন-শৃংখলার আলোকজ্জ্বল এই শহররের একটি অন্ধকার দিক হলো যৌনদাসীদের এই বিষাদাচ্ছন্ন বন্দী জীবন।
ভাবতে আরো আবাক লাগে যে, নারীর উপর যৌন নির্যাতন বা সোজা কথায় নারী ধর্ষণ অনেক সময় সরকারী সমর্থন ও সহযোগিতাও হয়ে থাকে! আদিকাল থেকে শুরু করে বর্তমান ‘সভ্য জগতে’ও এই প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে! এবং কোন কোন ক্ষেত্রে ধর্মের দোহাই দিয়েও এই অপকর্ম করা হয়!
বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পাক হানাদার বাহিনী কর্তৃক প্রায় দুই লক্ষ নারী গণধর্ষণের শিকার হন। কেউ কেউ বলেন এই সংখ্যা আরো অনেক বেশী। আর এই নারকীয় ধর্ষণ সংগঠিত হয়েছিল তৎকালীন পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন সরকারের উস্কানি ও সমর্থনের মধ্য দিয়েই। অতি সম্প্রতি আমরা দেখলাম কি করে রোহিঙ্গা নারীরা মিয়ান্মারের সামরিক বাহিনীর সদস্যদের দ্বারা গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন। আরো আশ্চর্যের বিষয় হলো, এর পিছনে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী নারী অং সান সুচির মৌন সমর্থন!! একজন নারী হয়েও তিনি এই গণধর্ষণের বিরুদ্ধে টু শব্দটিও করেননি। মিয়ান্মারের নেত্রী সুচি এবং দেশটির সামরিক নেতৃবৃন্দের সম্মিলিত সমর্থনের মধ্য দিয়েই রাখাইনে সংগঠিত হয়েছে ব্যাপক আকারে এই গণধর্ষণের ঘটনা। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে মিয়ান্মারের রাখাইন প্রদেশ থেকে প্রায় ৬ লাখ রোহিঙ্গা শরনার্থী বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছেন। এদের মধ্যে বেশীরভাগই নারী ও শিশু। আর এই নারীদের মধ্যে যাদের বয়স কম তাদের প্রায় সকলেই শিকার হয়েছেন গণর্ধণের।
প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে শুরু করে বর্তমান যুগেও অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও গোষ্ঠিগত স্বার্থের কারণে মানুষে মানুষে যুদ্ধ-বিগ্রহ লেগেই আছে। এই হিংসা, বিদ্বেষ আর সঙ্ঘাত মানুষকে কেবলই পিছনের দিকে টেনে নিয়ে গেছে। আর বার বার তার বলি হয়েছেন নারী। তারা হয়েছেন ধর্ষিত। সাম্প্রতিককালে ধর্মের নাম করে মধ্যপ্রাচ্যে যে আইএস এর জন্ম হয়েছে, তারাও নারী ধর্ষণকে নিজেদের ‘পবিত্র দায়িত্ব’ বলেই মনে করছেন। এমনই এক আইএস জঙ্গীর নাম অমর হুসেইন। গত বছর কুর্দি নিরাপত্তা বাহিনীর হাতেধরা পড়ার পর ভালো মানুষ হওয়ার জন্য এখন জেলে বসে দিনভর কোরআন পড়লেও ইরাকের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ২০০’র বেশী নারীকে ধর্ষণের পরও তার মনে কোন পাপবোধ নেই বলে জানিয়েছেন তিনি নিজেই। তার কমান্ডার নাকি দলের সদস্যদেরকে ঢালাও ধর্ষণের অনুমতি দিয়েছিলেন। এরকম হাজারো ঘটনার নজীর তৈরী করেছে আইএস এবং এগুলোর প্রতি স্বীকৃতি রয়েছে আইএস এর শীর্ষস্থানীয় কর্তাব্যক্তিদের। অর্থাৎ নারী ধর্ষণ তাদের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় আদর্শের মধ্যেই পড়ে।
কোন কোন দেশে সমাজপতিরাও ধর্ষণকে অনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেন এবং পুরুষদেরকে সুযোগ করে দেন গণধর্ষণের। গত আগস্ট মাসে এরকমই একটি ঘটনা ঘটেছে পাকিস্তানে। ঐ দেশটির মুলতানের নিকটবর্তী মোজাফফরবাদে এক ১৭ বছর বয়সী তরুনীকে শাস্তি হিসাবে গণধর্ষিত হওয়ার রায় দেন স্থানীয় সমাজপতিরা।
কিন্তু তার অপরাধটা কি ছিল? আর অপরাধ যত গুরুতরই হোক না কেন, তার শাস্তি হিসাবে তাকে গণধর্ষণ করা হবে এই বর্বর আইন কি ভাবে উদ্ভব হলো?
সিএনএন এর খবরে বলা হয় ঐ তরুনীটির ভাই স্থানীয় এক তরুনীকে ধর্ষণ করেছিল। তার প্রতিশোধ হিসাবে শাস্তির এই রায়! অপরাধ করেছে ভাই আর তার শাস্তি পেতে হবে বোনকে! এবং সেই রায় গণধর্ষণের মাধ্যমে কার্যকরও হয়েছে! পুলিশ অবশ্য পরে ঘটনার সঙ্গে সম্পর্কিত ২২ জনকে গ্রেফতার করেছে।
পাকিস্তানে এরকম ঘটনার নজীর আরো অনেক আছে। অহরহই ঘটছে নারীর বিরুদ্ধে এরকম পৈশাচিক অপরাধ। মিডিয়ায় যে দু-একটি ঘটনা প্রকাশ পায় সেগুলোর ব্যাপারেই পুলিশ কিছুটা তৎপর হয়। বাকি ঘটনাগুলো বিচারহীন অবস্থায় থেকে যায়।
পাকিস্তানের মুক্তার মাই এর ঘটনার কথা হয়তো অনেকেরই মনে আছে। ২০০২ সালে ২৮ বছর বয়সী ঐ মুক্তার মাই এর বিরুদ্ধেও একই রকম এক রায় হয়েছিল এবং সেই রায় কার্যকর করা হয়েছিল প্রকাশ্যেই। তার ‘অপরাধ’ ছিল, তার ভাই স্থানীয় অন্য এক গোষ্ঠির এক নারীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল। মুক্তার মাই এর ঘটনাটি তখন সারা বিশ্বেই আলোরণ তুলেছিল। পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধেও তখন অভিযোগ উঠেছিল এই বলে যে, নারীর সম্ভ্রম ও নিরাপত্তা রক্ষায় দেশটি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছে না।
খবরের কাগজ খুললে আমরা প্রতিদিনই দেখতে পাই কর্মস্থলে, রাস্তা-ঘাটে, গণপরিবহনে, সভা-সমিতিতে, মেলায় এমনকি নিজ গৃহেও নারীদের কেউ কেউ শিকার হচ্ছেন যৌন হয়রানি ও নির্যাতনের। অনেক সময় খুব পরিচিতজনদের মধ্যেও কেউ কেউ এ কাজটি করে থাকেন। এমনকি আত্মীয়-বন্ধুদের মধ্যেও কেউ কেউ যৌন হয়রানি বা নির্যাতন করে থাকেন। এরকম অবস্থায় ঘটনাগুলো পরিবারের সম্মান রক্ষার খাতিরে চেপে যাওয়া হয় প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই। কিংবা যিনি পরিস্থিতির শিকার হলেন তিনি নিজেই লোকলজ্জার ভয়ে চুপ থাকেন। এই চুপ থাকাটা বা পরিবারের সম্মান রক্ষার খাতিরে ঘটনা চেপে যাওয়াটাও বিপজ্জনক। কারণ, তখন অত্যাচারী আরো সাহসী ও উৎসাহী হয়ে উঠেন। তার মধ্যে ধারণা জন্মে যে হয়রানি বা অত্যাচারের বিষয়টি গোপনই থেকে যাবে।
‘মি টু’ তে সোচ্চার হওয়া তাই আজ খুবই জরুরী হয়ে উঠেছে। লক্ষ্যনীয় যে, ‘মি টু, এর মাধ্যমে অনেকেই আজ সোচ্চার হয়ে উঠছেনও। এমনকি বাংলাদেশী নারীরাও। তারাও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ বিষয়ে কথা বলছেন। যেমন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক নাসরিন খন্দকার বলেন, মি টু ক্যাম্পেইন আমাদের সামনে স্পষ্ট করতে পারে যে, যৌন হয়রানি কতোটা ব্যাপক। তিনি আরও বলেন, ‘আমি সাক্ষ্য দিতে পারি যে, আমার পরিচিত প্রত্যেকটি নারী জীবনের কোনও না কোনও সময়ে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে। সাড়ে সাত বিলিয়ন মানুষের এই বিশ্বে যদি তিন বিলিয়ন মানুষ যৌন হয়রানির শিকার হয়ে থাকে, তাহলে নিঃসন্দেহে একে মানবতার বিরুদ্ধে সর্বকালের সবচেয়ে বড় রোগ হিসেবে বিবেচনা করা উচিত। আর সেই রোগের কারণ যখন যৌনবাদ, তখন তাকে যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর মহামারীর মতই মোকাবিলা করা দরকার, সেটি আমাদের কাছে স্পষ্ট হবে।’
বিশিষ্ট নৃত্যশিল্পী শামীম আরা নীপা তার স্ট্যাটাসে লিখেছেন, এই দেশের নারীরা যৌন নিপীড়ন ও বৈষম্যের শিকার হয়নি- এমন ঘটনা বিরল… আমিও সেই তালিকার বাইরে নই… সেটা স্বীকার করে নিয়ে এহেন পরিস্থিতি ও সামাজিক প্রেক্ষাপটের বিরুদ্ধে আমার অবস্থান স্পষ্ট…# Me_Too.
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গীতি আরা নাসরিন লিখেছেন, “আসুন বাংলায় বলি- ‘আমিও’ [ Me too]. এই দেশে কোনও নারী যদি বলেন, ‘তিনি কখনও কোনও ধরনের যৌন নিপীড়নের শিকার হননি, সেটা হবে একটা ডাহা মিথ্যা কথা। ‘আমি কখনো মিথ্যা বলি না’ বলার মতোই মিথ্যা।” – সূত্র- বাংলা ট্রিবিউন।
এ ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি মুখ খুলেছেন জনপ্রিয় বলিউড নায়িকা বিদ্যা বালান। সংবাদমাধ্যমকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, শিশু বয়সেই তাকে একবার যৌন হেনস্তার সম্মুখীন হতে হয়েছে। একদিন সকালে ফুল তুলতে গেলে আচমকাই এক ব্যক্তি তার শরীরে হাত দেন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওই ব্যক্তি তাকে নির্যাতন করে পালিয়ে যান। ঘটনার পর তিনি বাবা-মাকে সব ঘটনা খুলে বলেন। কিন্তু অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি বলে
জানান বিদ্যা। সাক্ষাৎকারে যৌন নির্যাতনকারীদের শাস্তির জোর দাবিও জানান বলিউডের অন্যতম এ জনপ্রিয় নায়িকা। তিনি আরো বলেন, যৌন হেনস্তার মুখে পড়লে কড়াভাবে তার প্রতিবাদ করতে হবে। হেনস্তা নিয়ে চুপ করে বসে থাকলে চলবে না। এ বিষয়ে পরিবারের সবাইকে জানাতে হবে এবং শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে দোষীর।
কয়েকদিন আগে স্থানীয় সিটিভি নিউজ এ দেখছিলাম আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এর বিরুদ্ধে যারা ইতিপূর্বে যৌন হয়রানির অভিযোগ এনেছিলেন, তাদের কয়েকজন এবার বিষয়টির ব্যাপারে কংগ্রেশনাল ইনভেস্টিগেশন এর আহ্বান জানিয়েছেন সংবাদ সম্মেলন করে। আমরা জানিনা মার্কিন কংগ্রেশ এই আহ্বানে কতটুকু সাড়া দিবে। না দেবার সম্ভাবনাই বেশী। কারণ, কংগ্রেসে ট্রাম্প এর দল রিপাবলিকানদের প্রভাব প্রতিপত্তি বেশী।
কিন্তু যে বিষয়টি এখানে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তা হলো, বিশ্বের সর্বাধিক ক্ষমতাধর ব্যক্তির বিরুদ্ধেও আজ যৌন হয়রানির অভিযোগ করতে পিছ পা হচ্ছেন না ভুক্তভুগিরা। আমরা মনে করি যৌন হয়রানি ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলার ব্যাপারে সবাইকে সাহস নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। মুখোশ উন্মোচন করে দিতে হবে ঐ সকল সাধু সেজে থাকা শয়তানদের যারা সুযোগ পেলেই দানব হয়ে উঠেন।
খুরশিদ আলম
সম্পাদক ও প্রকাশক
প্রবাসী কণ্ঠ