তাসের আড্ডা – ৯
আগস্ট ৫, ২০১৭
এই সপ্তাহে তাসের আড্ডা নিয়ে সমস্যা দেখা দিয়েছে। রুমা ভাবী সবাইকে দাওয়াত দিয়েছে। সমস্যা দাওয়াত নিয়ে নয়, রুমা ভাবী তার কয়েকজন মুরুব্বিকেও আসতে বলেছেন। তাদের সামনে অসভ্যের মত তাস – ফাস খেলা চলবে না। সে সবাইকে আগে থেকেই সতর্ক করে দিয়েছে। প্রতি সপ্তাহেইতো খেলা – ফেলা চলছে। একটা সপ্তাহ না খেললে কি দুনিয়া অশূদ্ধ হবে?
মুরুব্বিদেরকে দেখে মনে হল তাস তো তুচ্ছ, তাদের সামনে গাঞ্জার আড্ডা বসালেও তাদের কোন আপত্তি থাকবে না। কিন্তু রুমাকে সেই কথা কে বোঝাবে? ব্যাজার মুখে লিভিংরুমে বসে বসে কিছুক্ষণ খাজুইরা আলাপ হল। জমছে না। রুমা থমথমে পরিবেশ দেখে চা কফি দিয়ে গেল। পরিবেশ আরোও নীরব হয়ে গেল। রুমা পরিস্থিতি সামাল দেবার জন্য ঘোষণা দিল, আজ ছেলে মেয়েরা এক সাথে আড্ডা দেবে। আধুনিক কালে নারী পুরুষের পৃথক ঘরে বসার রীতি একেবারেই মানায় না। ইত্যাদি ইত্যাদি। সে সব মহিলাদেরকে তুলে লিভিংরুমে নিয়ে এলো।
ভুল হল। এমনিতেই তেঁতে ছিল তাসাড়ুরা। এই সুযোগ তারা ছাড়ল না। আক্রমণটা প্রথমএলো রনির কাছ থেকে। “বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত সমাজের মেয়েদেরকে বাইরে থেকে দেখে বোঝার কোন উপায় নেই তারা কত নিষ্ঠুর হতে পারে।”
বেলা স্বামীর এই কটূক্তি শুনে হাসবে না কাঁদবে ভাবছে। মহিলারা থমথমে মুখে রনির দিকে তাকিয়ে আছে। এই জাতীয় একটা উক্তি করবার পেছনে তার হঠাৎ কি কারণ হয়েছে বোঝার চেষ্টা করছে।
সাইদ পরিস্থিতি সামাল দেবার জন্য হাল্কা গলায় বলল, “ও বোধহয় আদুরীর কথা বলছে। পড়নি তোমরা? এগারো বছরের ছোট মেয়ে। বাসায় কাজ করত। গৃহকর্ত্রী তাকে এমন অত্যাচার করেছিল যে সে প্রায় মরতে বসেছিল। তাকে ডাস্টবিন থেকে উদ্ধার করা হয়। মারা গেছে ভবে ফেলে দিয়েছিল।”
রুমা তীব্র কন্ঠে প্রতিবাদ করল। “সবাইকে একই ধাঁচে বিচার করাটা ঠিক নয়। রনি ভাই, এটা আপনার খুব অন্যায়।”
রনি বলল, “আমার দেখা অধিকাংশ বাংলাদেশী মহিলারা তাদের কাজের মানুষদের সাথে সারক্ষণ খিটমিট করত। অনেকেই অল্প বয়স্ক ছেলেমেয়েদেরকে নিয়ে আসত গ্রামের গরীব বাবা মায়ের কাছ থেকে। তাদেরকে মার-ধোর করা, নানাভাবে হেনেস্থা করা একটা নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। এবং এই ব্যাপারে সম্পূর্ণ দোষ হচ্ছে গৃহকর্ত্রীদের। আপনারা মেয়েরা সুযোগ পেলে একবারে হিটলার হয়ে যান।”
প্রমিলা বলল, “তখনই বলেছিলাম খেলতে দিন। এখন কেমন আমাদেরকে হিটলারের মত একটা খুনীর সাথে তুলনা করছে।”
জিত নীচু গলায় বলল, “একেবারে ভুল বলে নি। আপনারা সবাই একই ধাঁচে গড়া তা বলছি না, কিন্তু আমিও দেখেছি খুব ভদ্র স্বভাবের মহিলারাও কাজের মানুষদের সাথে খুবই খারাপ ব্যবহার করেন। সামান্য ব্যাপার নিয়ে তুলকালাম কাণ্ড বাঁধিয়ে দেন। না দেখলে বিশ্বাস করা কষ্ট যে তারা এমন নিষ্টুর হতে পারেন।”
কবীর বলল, “আর সারাক্ষণ কাজের মানুষ নাই, কাজের মানুষ নাই করে এখানেও আমাদের পুরুষদের জীবন অতিষ্ট করে দিচ্ছে।”
বেলা বলল , “তার কারণ আপনারা তো কিছুই করেন না। সব কিছু তো আমাদেরকেই করতে হয়। মেয়েরা অফিস আদালত করছে আবার বাড়ি ফিরে রাজ্যের মানুষের জন্য ভোজনের ব্যবস্থা করছে। আপনাদের মত তাস খেলে আর ফালতু আলাপ করে সময় নষ্ট করলে সবাই সাধুর মত ব্যবহার করতে পারে।”
সাইদ প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য বলল, “আরে, শুধু মহিলাদেরকে দোষারোপ করছ কেন? যে দেশের যেমন রীতি। বাংলাদেশের এক কূটনীতিককে কয়েক দিন আগেই নিউ ইয়র্কে এরেস্ট করা হয়েছিল কাজের মানুষকে স্বল্প বেতনে অত্যধিক পরিশ্রম করানোর জন্য। ২০১৪ তে ভারতীয় মহিলা ডেপুটি কাউন্সেলরকেও একই অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। ভারত তাকে সরিয়ে নিয়ে যায়। আমদের যেহেতু অনেক গরীব মানুষ আছে, তাদের মাথায় কাঠাল ভাঙতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। এই আলাপ থাক। আদুরী এখন ভালো আছে। তার গৃহ কর্ত্রীর শাস্তি হয়েছে।”
রনি নাছোড়বান্দার মত বলল, “আগে মহিলাদেরকে তাদের দোষ স্বীকার করতে বলেন। এক আদুরীকে আমরা তাদের হাত থেকে বাঁচাতে পেরেছি, কিন্তু আরোও কত আদুরী ধুঁকে ধুঁকে মরছে কে জানে।”
বেলা তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলল, “আরে, খামাখা আমাদের পেছনে লেগেছ কেন? এই দেশে আমরাই তো তোমাদের কামের বেটি হয়ে আছি।”
রুমা এই কথায় ভরসা পেয়ে বলল, “একেবারে ঠিক কথা বলেছ।”
রনি ব্যাজার মুখে আরোও কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, জামাল তার মুখ চেপে ধরে বলল, “থাক ভাই, এবার আমরা বিষয়বস্তু পরিবর্তন করে চিকনগুনিয়াতে চলে যাই। কি আজব রোগ। যেমন তার নাম, তেমন তার কাম। গিটে গিটে ব্যাথা হয়ে থাকে। আমার বড় ভাইয়ের পরিবারের সবার হয়েছে। বাড়ী ভর্তি সবাই নাকি ব্যাথায় কাতরাচ্ছে!”
লাল ভাই দ্রুত যোগ করল, “আমার শালীরও হয়েছে। সে গত এক মাস ধরে ভুগছে। কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। এলোপ্যাথি, হোমিওপ্যাথি, কবিরাজী, টোটকা-তাবিজ- সব বৃথা।”
জিত বলল, “চিকনগুনিয়ার কথাই যখন উঠল তখন এই বিজ্ঞাপনটা না দেখালেই নয়। এক বন্ধু পাঠিয়েছে বাংলাদেশ থেকে।”
বিজ্ঞাপন দেখে হাসির হল্লা উঠল। জালাল বলল, “বিজ্ঞাপনের কথাই যখন উঠল- কয়েক দিন আগে এখানকার এক ইংরেজী কাগজে পড়লাম ভারতীয় বাবা মায়েরা নাকি তাদের ছেলেদেরকে কানাডায় বিয়ে করিয়ে পাঠানোর জন্য একেবারে উঠে পরে লেগেছে। তারা কানাডায় উচ্চশিক্ষার্থে আসছে এবং আসবার আগে বিয়ে করে স্বামীসহ আসতে আগ্রহী এমন মেয়েদের দৃষ্টি আকর্ষণ করবার চেষ্টা করছে। একটা উদাহরণ দেখেন। “
জিত বলল, “আমার এক বন্ধু এই জাতীয় আরেকটা বিজ্ঞাপন আমাকে পাঠিয়েছে। সাচ্চা না বানোয়াট বলতে পারবো না, তবে মজার।”
খুব হাসাহাসি হল সেটা নিয়ে। দেখা গেল মহিলারা এই জাতীয় বিষয়বস্তুতেই বেশী আগ্রহী। এক পর্যায়ে ওমর খাদেরকে নিয়ে আলাপ শুরু হলো। কানাডার কি তাকে এতোগুলো টাকা দেয়া এবং সেই সাথে ক্ষমা চাওয়া উচিৎ হল? একজন টেররিস্ট যদি এভাবে পুরষ্কৃত হয় তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ কি হবে? এই আলাপ বেশীক্ষন চলল না। কেউ তার সমর্থনে, কেউ বিপক্ষে চলে যাওয়ায় বেশ জোর তর্কাতর্কির সৃষ্টি হতে দেখে সাইদ দ্রুত প্রসঙ্গ পালটে ফেলল। কুইবেকে মুসলিমদের নিয়ে যে ভয় ভীতি আছে সেটা নিয়ে কিছুক্ষন আলাপ চলল। কুইবেক সিটির কাছাকাছি একটা ছোট শহরে একটা মুসলিম কবরখানা তৈরী করবার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল কিন্তু স্থানীয়রা ভোট দিয়ে সেটা বন্ধ করে দিয়েছে। কুইবেকের হেমিংফোর্ডে এক পার্কে মুসলিমরা দল বেঁধে জামাতে নামাজ পড়ছিল। সেটা নিয়ে অনেক বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। অনেকেই পছন্দ করে নি। ভেবেছে এটা বেআইনি। কিন্তু পরে জানা গেছে উপস্থিত মুসলমানেরা কর্তৃপক্ষের যথাযথ অনুমতি নিয়েই নামাজ পড়েছিল।
দেখা গেল সেটা নিয়েও দ্বিমত আছে। যত্র তত্র জামাতে নামাজ পড়াটা কতখানি সঙ্গত নিয়ে সেটা নিয়ে প্রশ্ন উঠল। সব ধর্মীয় মানুষেরাই যদি যেখানে সেখানে দল বেঁধে প্রার্থনা করতে লেগে যায় তাহলে সেটা কি আমাদের কাছেও গ্রহণযোগ্য হবে?
এটা নিয়ে বেশী শোরগোল শুরু হবার আগে রুমা সবাইকে থামিয়ে দিল। “ব্যাস ব্যাস, ঝগড়া ঝাটি চলবে না আজকে। খাবার দেব এক্ষুনী। জিত দা, কোন কৌতুক টৌতুক থাকলে বলে সবার ক্ষুধাটা বাড়িয়ে দিন। তাস খেলতে দেই নি দেখে যা ক্ষেপেছেন আপনারা!”
জিত বলল, “কৌতুক নিশ্চয় আছে। এটাও এক বন্ধু পাঠিয়েছে। এক ভদ্রমহিলা গেছে পেট শপে। একটা খুব সুন্দর কাকাতুয়া দেখে তার ভীষণ পছন্দ হল। দাম মাত্র ৫০ ডলার। ‘এতো সস্তা কেন?’ সে দোকানীকে জিজ্ঞেস করল।
দোকানী বলল, ‘এই পাখীটা কলগার্লদের সাথে একই বাসায় থাকত। মাঝে মাঝে খুব অভদ্র কথাবার্তা বলে।’
ভদ্রমহিলা একটু চিন্তা ভাবনা করে পাখীটাকে কিনেই ফেলল। বাসায় নিয়ে গিয়ে খাঁচা সহ তাকে সদর দরজার সামনে ঝুলিয়ে দেয়া হল। পাখীটা কিছুক্ষন নীরবে চারদিক দেখে বলল, “নতুন বাসা, নতুন ম্যাডাম’।
ভদ্রমহিলা মনে মনে একটু ক্ষুন্ন হলেও স্বীকার করল, যতখানি খারাপ হবে ভেবেছিল ততখানি খারাপ না। কিছুক্ষন পর তার দুই যুবতী মেয়ে বাসায় ফিরল। পাখীটা তাদেরকে দেখে বলল, ‘নতুন আমদানি!’
তারা তিনজনই একটু মনক্ষুন্ন হলেও এটা নিয়ে বেশী রাগ করল না। একটু পরে ভদ্রমহিলার স্বামী সুব্রামুনিয়াম কাজ থেকে বাসায় ফিরতে পাখীটা তাকে দেখেই তারস্বরে বলল, ‘কি খবর সুব্রামুনিয়াম!’”
শুজা রশীদ, টরন্টো।