তাসের আড্ডা – ৮

জুলাই ৮, ২০১৭

শুজা রশীদ

পয়লা জুলাই, কানাডার ১৫০ তম জন্মবার্ষিকী। সেই উপলক্ষ্যে জালাল তার বাসায় সবাইকে দাওয়াত দিয়েছে। দিনটা শনিবারে পড়ায় সোনায় সোহাগা হয়েছে। তাদের তাস খেলার আড্ডা আজ জালালের বাসাতেই বসেছে। ইলা, জালালের স্ত্রী, প্রচুর রান্না বান্না করেছে। মহিলারা শাড়ী পরে এসেছে, মেয়েরা সালোয়ার কামিজ। রনি অবাক হয়ে বলেছে, “ঘটনা কি? পয়লা জুলাইতে এমন ঘটা করে শাড়ী- টাড়ী পরার কি কারণ?”

কোন মোক্ষম উত্তর পাওয়া গেল না। মহিলারা নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়া চাওয়ি করে তাকে ধমক দিয়ে পুরুষ মহলে পাঠিয়ে দিল। তার এতো খবরে দরকার কি? আড্ডায় যোগ দিতে জালাল বলল, “আরে ভাই, কানাডার জন্মদিন। একটা উৎসবের ব্যাপার না! সেই জন্যেই একটু সাজ গোজ হয়েছে। এটার মধ্যে ভালো বই মন্দ তো কিছু নেই।”

জিত বলল, “আজকে বাইরে অনেক অনুষ্ঠান হচ্ছে। সবাই মিলে কোথাও গেলে হত।”

সাইদ বলল, “যে ভীড় থাকে! কোথাও গিয়ে শান্তি নাই। আগে যেতাম। এখন ভীড় ভাট্টার কথা মনে হলে আর বাসা থেকে বের হতে ইচ্ছা হয় না।”

কবির বলল, “এটা কিন্তু কানাডার আধা জন্মদিন। ১৮৬৭ সালের পয়লা জুলাইতে শুধু মাত্র ওন্টারিও, কুইবেক, নোভা স্কশীয়া আর নিউ বার্নসউইক এক জোট হয়েছিল। সত্যিকার অর্থে কানাডার বয়েস মাত্র আঠার বছর কারণ কানাডার দশটা প্রভিন্স আর তিনটা টেরিটরি হয়েছে ১৯৯৯ সালে।”

রনি বলল, “আরে একশ’ পঞ্চাশ শুনতেই তো বেশী ভালো লাগে। নিজেদেরকে পোক্ত পোক্ত লাগে।”

সাইদ তাস বাট করতে করতে বলল, “আরে পোক্ত-অপোক্ত কি! পরিচয় হচ্ছে গুণে, বয়েসে না। দেশ হিসাবে কানাডা খুব একটা মন্দ করে নি। সারা দুনিয়া যে আমাদেরকে অল্প বিস্তর সম্মানের চোখে দেখে সেটাই বড় কথা।”

লাল ভাই এক গাল হাসি দিয়ে বলল, “ট্রাম্প মিয়া আমারিকার মাথা যত নামাচ্ছে, আমাদের মাথা ততই উঠছে।”

ট্রাম্পের নাম উঠতেই রনি মুখ বাঁকিয়ে বলল, “ইতরের অবশেষ! আমেরিকার প্রেসিডেন্টদের মনে হয় কাজ কর্ম বেশী নাই। বসে বসে সারাদিন টুইট করতেছে। আবোল তাবোল কান্ড কারখানা। সি. এন.এন. এর সাথে কুস্তি লড়ছে! পুরা দেশটার মাথা কাঁটা যাচ্ছে।”

জিত বলল, “গোল্ল্লায় যাক ওরা। আমেরিকার অর্ধেক মানুষ এই অপগন্ডটাকে সমর্থন করছে ভাবতেই আমার শরীর ছমছম করে ওঠে। পরিকল্পনা করেছিলাম এই বছর আমেরিকা বেড়াতে যাবো। কিন্তু এখন যেতে ভয়ই করছে। বর্ডারে নাকি ট্রাম্পকে নিয়ে প্রশ্ন করে। মিথ্যে বলতে তো পারব না, শেষে আবার কি সমস্যায় পড়ে যাবো।”

জালাল কি ডাকবে তাই নিয়ে খুব সমস্যায় আছে। তার হাতে রাজ্যের হার্টস পড়েছে কিন্তু রাজা, রাণী, টেক্কা কোনটাই নেই। সে খুব বিপদে পড়ে গেছে। তাকে ভাবুক দৃষ্টিতে নিজ হাতের তাসের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে রনি বিরক্ত কন্ঠে বলল, “ভাই, দিবা স্বপ্ন দেখছেন নাকি? রাত তো পার হয়ে যাচ্ছে।”

জালাল এক হাত উঁচিয়ে তাকে ধৈর্য ধারন করবার সংকেত দিল। তার দৃষ্টি হাতের তাসে অনড়। রনি একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে শ্রাগ করে বিষয়বস্তু পালটাল। “কানাডার মাথা প্রতি ঋনের হার যে রেকর্ড ভাঙতে চলেছে, শুনেছেন তো আপনারা?”

জালাল দ্রুত বলল, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি পড়ছিলাম সে দিন…”

রনি গম্ভীর কন্ঠে বলল, “জালাল ভাই, আগে কল তারপর কথা।”

সাইদ বলল, “হ্যাঁ, প্রাইভেট সেক্টরের ঋণের হার উন্নত দেশগুলোর মধ্যে আমাদের এখানেই সবচেয়ে দ্রুত গতিতে বাড়ছে। যার অর্থ হচ্ছে যারা ঋণ নিচ্ছে, কোন কারণে তারা যদি কোন সমস্যায় পড়ে যায় – কাজকর্ম চলে যায় কিংবা আয় কমে যায়, তাহলে একটা বড়সড় অর্থনৈতিক সমস্যা দেখা দিতে পারে।”

কবির বলল, “ঋণের বোঝা তো নাকি এক ট্রিলিয়ন ডলার পার হয়ে গেছে! এতো ঋণ নিচ্ছে কারা? সব কি মর্টগেজের জন্য? ইদানীং যে হারে বাড়ীর দাম বেড়েছে তাতে মানুষের আরোও বেশি বেশি করে ঋণ নেয়া ছাড়া উপায় কি?”

সাইদ বলল, “শুধু মর্টগেজের জন্য না, কর্পোরেশনগুলোও প্রচুর ঋণ নেয়। সেই ঋণের একটা সিংহভাগ যায় আবার ঘুরে ফিরে সেই রিয়েল স্টেটে। যার অর্থ, আমাদের অর্থনীতি বাড়ি ঘরের উপর অসম্ভব রকমের নির্ভর হয়ে পড়ছে। বাড়ির দাম যদি এমন অকল্পনীয় হারে বাড়তে থাকে তাহলে আমাদের খবর আছে।”

রনি বলল, “ওন্টারিও আর ব্রিটিশ কলাম্বিয়া বিদেশী ক্রেতাদের উপর ট্যাক্স বসানোর পর কিছু কাজ তো হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। গ্রেটার টরন্টো এরিয়াতে তো বাড়ির দাম কিছু কমেছে।”

জিত বলল, “বাড়ীর দাম কতটুকু কমেছে সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ তবে বাড়ি বিক্রী বেশ কমেছে। অনেকেই বসে আছে, ভাবছে দাম হয়তো শিঘ্রীই কমবে।”

জালাল শেষ পর্যন্ত হার্টসই ডাকল। রনি স্পেড ডেকে কল নিয়ে সহজেই গেম করে ফেলল। জালাল ক্ষুব্ধ কন্ঠে বলল, “আপনার হাতে এতো ভালো হাত আগে বলেন নাই কেন? খামাখা এতো চিন্তা করলাম। মাথা ধরে গেছে।”

এক পশলা হাসি হল। জিতের শাফল করবার পালা।

লাল ভাই বরাবরের মত সবার জন্য বিশাল এক থালা ভর্তি করে এপেটাইজার নিয়ে এসেছে। টেবিলের এক পাশে সেটা নামিয়ে রেখে সে বলল, “একটা কথা এই মাত্র মনে পড়ল। সৌদি আরবের মোতাউইনদের কথা তো নিশ্চয় শুনেছেন। তাদের আরেক নাম হচ্ছে ধর্ম পুলিশ। মেয়েদের পোষাক আষাক ধর্মীয় মোতাবেক না হলে তারা হস্তক্ষেপ করে। অনেক তিক্ত কাহিণী শুনেছি তাদেরকে নিয়ে। কিন্তু কানাডায় যে ঐরকম ঘটনা ঘটতে পারে এইটা বিশ্বাস করতে পারেন?”

জিত বলল, “দাদা, উইনিপেগের ঘটনাটার কথা বলছেন?”

“ঠিক ধরেছেন। এক মহিলা খুব খাটো একটা হাফ প্যান্টের উপর গেঞ্জী পরে গিয়েছিল মলে। এক সিকিউরিটী গার্ড তাকে মল থেকে বের করে দেয় অশালীন পোষাক পরবার জন্য। পরে অবশ্য সেই গার্ডের চাকরী গেছে। কিন্তু আমার কাছে মনে হয়েছে এটা অন্যায় হয়েছে। একটা প্রকাশ্য স্থানে ড্রেস কোড থাকাটা তো দরকার, তাই না? কত ধরণের মানুষ জন সেখানে থাকে…”

রনি বলল, “অশালীনতা- একটা রিলেটিভ শব্দ। একজনের কাছে যা স্বাভাবিক সেটাই আরেক জনের কাছে অশালীন হতে পারে। খবরটা আমিও দেখেছি। মহিলার কাছে মলের জেনারেল ম্যানেজার নিজে গিয়ে মাফ চেয়েছে।”

লাল ভাই বলল, “তার মানে কি আমাদের এই সমাজে কোন শালীনতার নিয়ম কানুন থাকবে না? আমরা পরিবার পরিজন নিয়ে নানা জায়গায় যাই। অন্যের নগ্নতা দেখার তো আমাদের দরকার নাই। কিছু একটা নিয়ম নীতি তো থাকা দরকার।”

সাইদ বলল, “লাল ভাই, কানাডায় ন্যুডীটি ল’ আছে। ঐ কানুনে বলে পাবলিক কিংবা প্রাইভেট প্রপার্টিতে উপযুক্ত কারণ ছাড়া নগ্নতা বেআইনি। আবার নগ্নতা মানে এই না যে একেবারে উলঙ্গ থাকতে হবে। মোটের উপর অশালীণ হলেই হল। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আশালীনতার সংজ্ঞা কি? পরিষ্কার করে কোথাও লেখা নেই। কোর্টে গেলে জাজের মতামতের উপরেই নির্ভর করবে।”

কবির হঠাৎ বলল, “অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাচ্ছে কিন্তু পাকিস্থানে যে এক নষড়মমবৎ কে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছে নষধংঢ়যবসু’র জন্য, দেখেছেন আপনারা? চিন্তা করা যায়? ধর্মের দোহাই দিয়ে আর কত স্বেচ্ছাচারীতা করা সম্ভব? তাও আবার এন্টাই টেররিজম কোর্ট তাকে দোষী সাব্যস্ত করে এই শাস্তি দিয়েছে। কি জন্য? সে ফেসবুকে নাকি নবীর নামে কি পোস্ট করেছে। কাজটা হয়ত ভুল হতে পারে, অনেকের ধর্মীয় চেতনায় আঘাত হেনে থাকতে পারে, কিন্তু একজন স্বাধীন মানুষ হিসাবে তইমুর রেজার কি কোন অধিকার নেই? তাকে বিচার করবার অধিকার যদি কারো থেকেই থাকে সেটা কি শুধু আল্ল্লাহরই নয়?”

সাইদ মৃদু গলায় বলল, “পাকিস্থান হচ্ছে একটা অদ্ভুত জায়গা। সেখানে সরকার এক দিকে বড় বড় কথা বলে, অন্যদিকে আবার নিজেদের আসন পোক্ত রাখবার জন্য সংখ্যা গরিষ্ঠ জনগন যা করলে খুশি হবে তারা নির্বিকারে সেটাই করে। সেই কারণেই ঐ দেশে এখনও একটার পর একটা অনার কিলিং হয়। নানা অজুহাতে নিজ পরিবারের হাতে খুন হয় অসহায় মেয়েরা, এমনকি ছেলেরাও।”

রনি বলল, “মধ্য যুগে ইউরোপে ক্যাথলিক চার্চও এই জাতীয় কর্মকান্ড করত। ধর্মীয় চেতনায় আঘাত হানতে পারে এমন কিছু করা কিংবা বলা মানেই ছিল ক্ষমাহীন অপরাধ। কোপার্নিকাসের কথা নিশ্চয় মনে আছে। সেই প্রথম বলেছিল পৃথিবীকে

ঘিরে সব কিছু ঘোরে না। বরং পৃথিবী ঘোরে সুর্যকে ঘিরে। তাকে ভয় দেখিয়ে চুপ করিয়ে দেয়া হয়েছিল।  কিন্তু পরবর্তিতে গিওরডানো ব্রুনোকে একই কারণে পুড়িয়ে মারা হয় কারণ সে ভয় পেয়ে পিছিয়ে যেতে রাজী হয় নি। এমনকি তার জিভ বেঁধে দেয়া হয় যেন সে উপস্থিত দর্শকদেরকে লক্ষ্য করে কিছু বলতেও না পারে। মাত্র ৪০০ বছর আগের ঘটনা। আজ আমরা জানি তাদের ধারণাই সত্য ছিল। কিন্তু তখন সেই সত্য স্বীকার করবার কিংবা বুঝবার ক্ষমতা হয় শাসকদের ছিল না কিংবা তারা উদ্দেশ্যপ্রনোদিত হয়েই প্রথাগত জ্ঞানের বাইরে গিয়ে কোন ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতিতে পড়তে চায় নি। কিন্তু সত্যের সবচেয়ে বড় গুণ হচ্ছে, সে একসময় বেরিয়ে আসবেই। হয়ত অনেক মানুষের জীবন বিসর্জন দিতে হয়, কিন্তু সত্য লুকিয়ে রাখা যায় না। ঘুরিয়ে বললে, যা মিথ্যা তাকে ধামা চাঁপা দেবার দরকার হয় না। তা কালের স্রোতে এমনিতেই হারিয়ে যায়। জোর করে, নিয়ম করে, মানুষের স্বাধীনতা এবং স্বকীয়তাকে হরণ করে তাকে ধ্বংশ করবার দরকার হয় না।”

সাইদ বলল, “গ্যালিলিওরও হয়ত একই পরিণতি হত যদি না সে চার্চের কথা মেনে নিয়ে নিজের মতবাদ থেকে সরে না দাঁড়াত।”

জালাল মাথা নেড়ে বলল, “এই জন্যেই আমাদের সবার ইতিহাস জানা উচিৎ। ইতিহাসের ঘটনাগুলো যেন বার বার একই ভাবে নানান জায়গায় নানা পরিস্থিতিতে ঘটে।”

জিত বলল, “আলাপটা মনে হচ্ছে খুব কঠিন দিকে চলে যাচ্ছে। দেখি একটা জোক বলে আমাদের আড্ডার পরিবেশটাকে একটু সহজ করা যায় কিনা। সর্দারজী জোক। এক সর্দারজী ব্যবসায়ে লোকসান খেয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে গিয়ে শেষ পর্যন্ত খোদার কাছে গিয়ে করুন কন্ঠে কাকুতি মিনতি শুরু করল – হে খোদা, আমারতো সব গেছে। একবার তুমি মুখ তুলে চাও। আমাকে একটা লটারি জিতিয়ে দাও। তাহলে আমি আবার নিজের জীবনটাকে দাঁড় করাতে পারব।

“লটারির পর লটারি হয়ে গেল কিন্তু সর্দারজী কিছুই জিতল না। মাস খানেক পর সে ভয়ানক রেগে গিয়ে  আক্ষেপ করতে লাগল – খোদা, তোমার কাছে একটা জিনিষ চেয়েছিলাম, তাও তুমি দিলে না। এতো নিষ্ঠূর কেন তুমি? নিজের সৃষ্টির প্রতি কি তোমার কোন মায়া মহব্বৎ নেই? এতো কিছু কর, আর আমাকে একটা লটারী জিতিয়ে দিলে না!

“এই পর্যায়ে আসমান ফাঁক হয়ে গেল এবং গায়েবী মেসেজ এলো – সর্দারজী, লটারিতে জিততে হলে আগে টিকিটতো কিনতে হবে!”

শুজা রশীদ

কলামিস্ট ও গল্পকার

টরন্টো