তাসের আড্ডা – ৭

জুন ১০, ২০১৭

শুজা রশীদ

রমজানের ঠিক আগের শনিবারে সবাইকে বাসায় দাওয়াত দিল বেলা। সোজাসাপ্টা বলে দিয়েছে সারা রোজায় সে কাউকে বলতে টলতে পারবে না। রোজা রেখে কুটুমগিরি করা তার পোষায় না। বিশেষ করে রনির মত একটা ভবঘুরের সাথে সংসার করতে হচ্ছে, হাড় বদমাশ, বাসার একটা কাজ করে না। ইত্যাদি ইত্যাদি। কবির, জালাল এবং জিত আগে চলে এসেছিল, তাস খেলবার লোভেই। কিন্তু বাসায় ঢোকা অবধি তাদের কান ভারী করছে বেলা। সারাদিন রান্না বান্না করে তার মেজাজ খারাপ। রনি একটা কুটো পর্যন্ত নাড়ায়নি। আজ রাতে সে যদি তাস খলতে বসে তাহলে এস্পার ওস্পার হয়ে যাবে। রনি বউয়ের মেজাজ দেখে আগেই কোথাও কেটে পড়েছিল। বেলা ছেলেদের উপর রাগ ঝেড়ে মেয়েদের সাথে ভেতরের ঘরে গিয়ে বসে আড্ডা দেয়া শুরু করতে সে ম্যাজিকের মত এসে হাজির হয়ে গেল। তাস, কাগজ, কলম সব রেডী। সাইদ এবং লাল ভাই এখনও আসে নি। সুতরাং রনি না খেল্লে খেলা হবে না। মেয়েদের আড্ডা থেকে ছেলেদেরকে লিভিংরূমে দেখা যায় না। সুতরাং রনি একটা চান্স নিয়ে বসে গেল। ধরা খেলে বেলা সবার সামনে বেইজ্জতী করতে পারে, কিন্তু খেলাধুলার জন্য একটু আধটু আত্মাভিমান বিসর্জন দেয়াটা গুরুতর কোন সমস্যা নয়।

বার দুই – তিন হাত খেলা চলার পরই সাইদ এবং লাল ভাই প্রায় একই সাথে এসে হাজির হল। বেল শুনে বেলাকে ছুটে আসতে দেখে সোফার পেছনে গা ঢাকা দিল রনি। যেঁচে পড়ে বেইজ্জতী হবার কি প্রয়োজন? ছেলদের মধ্যে খুব হাসাহাসি হচ্ছে দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়েছে বেলা। “রনি এখনও আসে নি! কত বড় বজ্জাত দেখেছেন? মানুষ জন দাওয়াত দিয়ে উধাও!”

রুমা এবং আলেয়া ভেতরের ঘরে চলে গেল বেলার সঙ্গী হয়ে। সাইদকে খেলার আসন ছেড়ে দিল রনি। যার বাসায় দাওয়াত রেওয়াজ হচ্ছে তার আত্মোৎসর্গ করার। সাইদ আর কবির জোট পাকাল, জালাল গেল জিতের সাথে। জালাল সাধারণত খেলার ব্যাপারে অসম্ভব উৎসাহী। কিন্তু আজকে তাকে কিঞ্চিত অন্যমনস্ক মনে হল। ভুল করে হার্টসের খেলায় স্পেড এবং স্পেডের খেলায় ক্লাবস দেবার পর বিরক্ত হয়ে সাইদ বলল, “ঘটনা কি জালাল? তোমার মন কোথায় আজকে?”

“মন খুবই খারাপ ভাই,”জালাল বিষন্ন গলায় বলল। “পর পর ক’দিন দুনিয়ায় কি খুন খারাবীটা না গেল। ম্যনচেস্টারে গানের অনুষ্ঠানে টেরোরিস্ট এটাক, মিশরে বাসে গুলী করে নিরীহ খ্রীষ্টানদের হত্যা, পোর্টল্যান্ডে ট্রেনে দু’জন মারা গেল – সব মিলিয়ে মনটা ভালো নেই। চারদিকে এতো অকারণ হত্যাযজ্ঞ চললে নিজেকে অপরাধী মনে হয়।”

সাইদ বলল, “এসব তো চলবেই। মানুষ কোন না কোন একটা ছুতা বের করে একজন আরেকজনকে মারবে – এটাই হচ্ছে সত্য। মন খারাপ করে কোন লাভ নেই।”

রনি বলল, “জালাল ভাইয়ের মনের অবস্থা আমি বুঝতে পারছি। এই ধরণের ঘটনা পর পর ঘটতে থাকলে মনের উপর একটা চাপ পড়েই। ট্রেনের ব্যাপারটাই ধরেন না। এই জাতীয় ঘটনা তো আমাদের যে কারো হতে পারে। আমরাও অনেকেই ট্রেনে যাতায়াত করি। নানা পদের মানুষ আছে। আমি সর্বাঙ্গ ঢাকা মহিলাদেরকেও চলাফেরা করতে দেখেছি। ঐ ব্যাটার মত কেউ যদি আপনার চোখের সামনে তাকে উল্টো পালটা কথা বলে হয়রানি করতে শুরু করে, আপনি কি চুপচাপ থাকবেন?”

জিত বলল, “ঐ পরিস্থিতিতে না পড়লে কি করব বলা কঠিন। বিশেষ করে পোর্টল্যান্ডের এই ঘটনার পর মানুষ জন অনেক সতর্ক হয়ে যাবে।”

সাইদ বলল, “এই লোকটা তার কয়েক দিন আগেই Alt-righ পন্থী একটা গ্রুপের মিটিংয়ে গিয়েছিল বেসবল ব্যাট হাতে নিয়ে, সেখানে সে নাজি স্যালুট দিয়েছে, বর্ণবৈষম্যবাদী কথা বার্তা বলেছে। যেদিন খুনগুলো করেছে সেদিনই এক কালো মহিলাকে লক্ষ্য করে বোতল ছুড়ে মেরেছে। এই রকম একটা নাট কেস পথে ঘাটে ঘুর বেড়াচ্ছে আর পুলিশ কিছুই কেন করল না সেটা ভেবেই আমি অবাক হচ্ছি। পুলিশ যদি আগেই যথাযথ ব্যবস্থা নিত তাহলে এই রকম একটা রক্তাক্ত পরিস্থিতির সৃষ্টিই হত না। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে চারদিকে এখন এমন নাজুক রাজনৈতিক পরিস্থিতি যে পুলিশও হয়ত না পারলে কাউকে এরেস্ট করতে চায় না। আরেকটা ভিডিওতে দেখলাম এক পঙ্গু সৈনিক এক পোর্টোরিকান যুবককে তার মায়ের সাথে স্প্যানীশ বলতে শুনে বাজে মন্তব্য করেছে। তাকে ক্ষমা চাইতে বলায় উল্টো মেজাজ দেখাচ্ছে। কতখানি মূর্খ আর উদ্ধত হলে মানুষ এইরকম ব্যবহার করতে পারে!”

জিত বলল, “আমি দেখেছি ভিডিওটা। মা ইংরেজী বলতে পারে না তাই তার সাথে স্প্যানিশে কথা বলছিল। এটা নিয়ে এতো ক্ষেপে যাওয়ার কি হল?”

জালাল বলল, “সাদারা মনে হয় এখন ডিফেন্সিভ হয়ে উঠছে। এবং বেস্ট ডিফেন্স হচ্ছে অফেন্স, এটা জানেন তো?”

রনি বলল, “সব সাদারা না। পোর্টল্যান্ডে যে দু’জন রুখে দাঁড়িয়ে নিজেদের জীবন দিল, দু’জনাই সাদা। যে ছেলেটা হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে যুঝছে, সেও সাদা। যারা এই জাতীয় হিংসাত্বক কাজকর্ম করছে তারা নিজেরাই হচ্ছে হারু পার্টি। দোষারোপ করার কেউ নেই। তাই যে কোন ছুতা পেলেই অন্যের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে।”

লাল ভাই বলল, “ভাই, আপনাদের ভাবীকে তো এখন আমি কোথাও একা যেতে দিতে ভয় পাই। কে কি বলবে, কে কি করবে, কোন ঠিক আছে? হিজাব পরে। কি সময় আসলো ভাই।  ধর্মে বিশ্বাস করে কেউ যদি মাথা ঢাকে তাতে অন্যের কি অসুবিধা? “

সাইদ বলল, “উত্তম প্রশ্ন! এর পেছনে অনেক কারণ আছে। তবে মোদ্দা কথা হচ্ছে, আমরা যা করি, পরি, বলি সব মিলিয়েই অন্যরা আমাদেরকে বিচার করে। আমরাও অন্যদের ক্ষেত্রে একই কাজই করি। যে কারণে হিজাব পরা কোন মহিলাকে দেখলেই যার জ্ঞান গম্যি কম সে ভাবতে পারে এই মহিলা হয় কট্টরপন্থী নয়ত পুরুষ শাষিত সমাজের ধর্মীয় অনুশাসনের শিকার। কেউ যে নিজ ইচ্ছায় এমনটা করতে পারে অনেকের কাছেই সেটা বোধগম্য নাও হতে পারে। অজ্ঞতাই হচ্ছে মূল সমস্যা। আর এটা শুধু হিজাবের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়।”

কবির বলল, “একটা ঘটনা বলি। ক’দিন আগে আমার লতা গেছে সুপার মার্কেটে বাজার করত। ক্যাশিয়ারের সামনে লাইনে দাঁড়িয়েছে। এক সাদা মহিলা অল্প কয়েকটা জিনিষ নিয়ে ওর পেছনে দাঁড়াল। লতা ভালো মনে তাকে ওর সামনে যেতে বলল। ওর কাছে শপিং কার্ট ভর্তি জিনিষ পত্র। অনেক সময় লাগবে। মহিলা ওর সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে রাজনৈতিক বিষয়ে আলাপ জুড়ে দিল। সে ট্রাম্পের সমর্থক। এক পর্যায়ে মুসলিমদের সম্বন্ধে যাচ্ছে তাই বলতে শুরু করল। হিজাবের প্রসঙ্গও তুলল। বিরক্ত হয়ে লতা শেষ পর্যন্ত বলেই বসল, ‘তুমি যে মুসলমানদের এতো খারাপ বলছ, আমি কিন্তু মুসলমান। আমিই কিন্তু তোমাকে আমার সামনে যেতে দিয়েছি। আমি স্বার্থপর, বদমাশ হলে সেটা কখনই করতাম না।’  সেই মহিলা তখন কি বলে জানেনে? সে উলটা লতাকে জেরা করতে শুরু করল সে হিজাব কেন পরে না। আরে, পরলেও দোষ, না পরলেও দোষ? এতো শাখের করাত!”

জিত হাসতে হাসতে বলল, “ভাই, যারে দেখতে নারি তার চলন বাঁকা। যাই করেন আর বলেন, সব কিছুই মন্দ হয়ে যাবে। বেস্ট হচ্ছ কিছুই না বলা। এই যে ট্রেনে যে হত্যাযজ্ঞ হল, মেয়ে দুজন তো সেখান থেকে সরে গিয়েছিল। কেউ যদি ব্যাটাকে কিছু না বলত তাহলে সে হয়ত আপন মনে গজ গজ করতে করতে এক সময় থেমে যেত।”

সাইদ বলল, “সেখানেই তো সমস্যা। প্রথমত, জানার কোন উপায় নেই সে সত্যিই থেমে যেত না মেয়ে দুজনকে অনুসরণ করত। দ্বিতীয়ত, চোখের সামনে একটা অন্যায় হতে দেখলে সবার পক্ষে চুপ করে থাকাটা সম্ভব হয় না। বিশেষ করে পোর্টল্যান্ডের মত জায়গায় যেখানে ডেমোক্রাটরা সবসময়ই শক্তিশালী। সেখানে এমন একটা দল পর্যনন্ত আছে যাদের নাম হচ্ছ এন্টিফা , এন্টাই ফ্যাসিস্ট এর শর্ট। যদিও হোয়াইট সুপ্রিমিস্ট এবং অল্ট রাইট পন্থীরাও বেশ সোচ্চার। কিন্তু পোর্টল্যান্ডের মত শহরে এই জাতীয় ঘটনা ঘটার কথা নয়।”

মনযোগ দিয়ে না খেলায় ভালো কার্ড নিয়ে কল করেও শ’ দুই শর্ট হয়ে গেল জালালের। সে মুখ ব্যাজার করে বলল, “ধ্যাৎ, বাজে খেলা হয়ে গেল।”

কবির বলল, “এভাবেই চালিয়ে যান, জালাল ভাই। আপনার লস, আমার গেইন।”

জালাল গম্ভীর মুখে বলল, “এইসব তাস খেলায় হার জিত নিয়ে আমি মোটেই মন খারাপ করি না। পৃথিবীতে আরোও কত বড় বড় ব্যাপার ঘটছে খবর রাখ? ট্রাম্পের কথাই ধর। আমার তো মনে হচ্ছে রাশিয়া স্ক্যান্ডালই ওর পতনের মূল হবে।  প্রথম ফ্লিন, তারপর নিজের জামাই কুশনার – ওদের এতো রাশিয়া প্রীতির কারণ কি? “

রনি মুখ বাঁকিয়ে বলল, “এরা হচ্ছে পুটিন আর ওর সাংগ পাংগদের খেলনা। যদিও প্রেসিডেন্ট সাহেব তো মনে হয় নিজেকে আইন্সটাইন মনে করেন, কিন্তু বাস্তবে পুটিনের কাছে সে যে একটা আধ

পাগলা, মোটা বুদ্ধির মানুষ সেটা বুঝতে বেশীক্ষণ দেরী হয় না। যে কারণে রাশিয়ানরা এখন আমেরিকানদের কান্ডকারখানা দেখে হাসাহাসি করছে।”

সাইদের বাট। সে মাত্র হাতে তাস নিয়ে শাফল করতে শুরু করেছিল তখনই খবারের ডাক এলো। বেলা স্বয়ং এলো। রনিকে দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকাল। “কোথায় ছিলে এতক্ষণ? দরকারের সময় পাওয়া যায় না তোমাকে। তুমি কি এই বাড়ীর গেস্ট?”

রনি নিরীহ কন্ঠে বলল, “রেসিডেন্ট গেস্ট।“

“ফাজলামী করার জায়গা পাও না! সবাইকে নিয়ে খেতে এসো।” তারপর সে সবার নাম ধরে ডেকে ডেকে খেতে আসার জন্য অনুরোধ করল। কারো মন খারাপ হোক সেটা সে হতে দিতে চায় না। রনির ক্ষুধা লেগেছিল, সে সবার আগে গিয়ে প্লে­ট হাতে তুলে নিল। বেলা তাকে লাইনের পেছনে পাঠিয়ে দিল। “হোস্ট সবার পরে খায়। এইগুলা শিখ।”

ভাবীরা তাকে নিয়ে কিছু চটুল মন্তব্য করল। রনি এইসবে অভ্যাস্ত। সে নির্বিকার গলায় বলল, “এই সবই হচ্ছে ফেক নিউজ। বেলা আমাকে ছোট

করবার জন্য সবাইকে বলে আমি বাসার কোন কাজ করি না। গেস্টের মত থাকি। কমপ্লি­ট ফেক। কি প্রমাণ আছে? ভিডিও? ফেক, সবই ফেক। ছেলে মেয়েরা দেখেছে? কি দেখতে কি দেখেছে। এইসব কথা কেউ বিশ্বাস করবেন না। আমি খুবই পরিশ্রমী গৃহকর্তা। কর্ত্রী যাই বলুক।”

বেলা মুখ বাঁকিয়ে বলল, “সারা দিন ট্রাম্পের বদনাম করতে করতে নিজেই ট্রাম্প হয়ে যাচ্ছে।”

এক পশলা হাসি হল। রনি অপমানিত বোধ করল। “আরে না! ছিঃ ছিঃ! এইরকম অবক্ষয় আমার যেন কখন না হয়।”

রুমা খোঁচা দিয়ে বলল, “আপনার শুধু বড় বড় কথা। নিজে তো ঠিকই কনজার্ভেটিভদের সাপোর্ট করেন। কাউকে দেখিনি ইমিগ্রান্ট হয়ে কনজার্ভেটিভদের সাপোর্ট করে। ওরা সারাক্ষণ ইমিগ্রান্টদের পেছনে লেগে আছে।”

“রুমা ভাবী, ঘোড়াকে পোষ মানাতে হলে তার শরীরে লাগাম দিতে হয়। সেই লাগাম হচ্ছে বিরোধী দল। লাগামহীন ঘোড়া কাজের চেয়ে অপকর্মই বেশী করে।”

“আপনাদের নতুন নেতাকে কেমন মনে হচ্ছে?” কবির জানতে চাইল।

শ্রাগ করল রনি। “নামওতো শুনি নাই। তবে আমি নামে মাত্র সমর্থক। পার্টি সম্বন্ধে খুব একটা জ্ঞান রাখি না। কিন্তু অন্তত কেভিন ব্যাপারীর চেয়ে অনেক ভালো হয়েছে।”

লাল ভাই বলল, “তার নামটা কিভাবে উচ্চারণ হবে সেটাইতো ঠিক বুঝতে পারছি না।”

রনি বলল, “শিয়ার। এন্ড্রু শিয়ার। ঝ এর পর প আর য দেখে ঘাবড়ে যাবেন না। আচ্ছা, এইবার রাজনীতি বাদ দেন, খাওয়ায় মনযোগ দেয়া যাক।”

আলেয়া গলা বাড়িয়ে বলল, “রনি ভাই, আপনি নাকি বলেছেন কানাডিয়ান ভ্যালু টেস্ট নেয়াটা দরকার। এইরকম একটা বাজে কথা কি করে বললেন?”

রনি লাল ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে চোখ পাকাল। “আমি এই কথা কখন বললাম? আমি বলেছি ঐরকম কিছু একটা করা দরকার। ম্যানচেস্টারে এরিয়ানা গ্রান্ডের কন্সার্টে যে টেররিসট ছেলেটা নিজেকে উড়িয়ে দিল আর এতোগুলো নির্দোষ মানুষকে মারল, তার পারিবারিক ইতিহাসটা একবার ভেবে দেখুন ভাবী। তার বাবা ছিল আল-কায়েদার সাথে জড়িত লিবিয়ান ইসলামিক ফাইটিং গ্রুপের মেম্বার। এক দশক সে ব্রিটেনে ছিল, কিন্তু তার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গী কিন্তু পরিবর্তন হয় নি। এবং খবর পড়ে যা মনে হল তার সব ছেলেরাই কম বেশী বাবার দৃষ্টিভঙ্গীর সাথে পরিচিত এবং হয়ত সমর্থনও করে। এই ব্যাপারটাই আমি বোঝানোর চেষ্টা করছিলাম। সন্তানদের উপর পিতা মাতার অনেক প্রভাব থাকে। কেউ যদি চায় তাহলে নিজের কট্টর দৃষ্টিভঙ্গী খুব সহজেই সন্তানদের মধ্যে সংক্রামিত করতে পারে। তার মানে কি বুঝতে পারছেন? সারা পৃথিবীর সমস্যা আমাদের সমাজে এসে ঢুকবে, আমাদের সন্তানেরা ম্যানচেস্টারের হত্যাযজ্ঞের মত অকারণে হত্যার শিকার হবে।”

আলেয়া বলল, “কিন্তু টেররিস্ট তো শুধু মানুষ না, দেশও হতে পারে। আমেরিকা, রাশিয়া, ফ্রান্স এরা ইরাক, সিরিয়ায় বম্বিং করে যখন সাধারণ মানুষ মারছে, বাচ্চাদের মারছে তখন? আর, শুধু বাবা-মা সন্তানদের কট্টরপন্থী করে তুলছে, সেটা মোটেই মানছি না। ছেলেমেয়েদের তো চোখ আছে। ওরা কি দেখছে না এসব?”

রনি উত্তর দেবার আগেই সাইদ বলল, “আলেয়া, প্রতিটা নিরীহ মানুষের মৃত্যু যে বয়েসেরই হোক, দুঃখজনক। কোন সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ সেটা চায় না। কিন্তু প্ল­্যান করে একদল কন্সার্টগামী ছেলেমেয়েদেরকে টার্গেট করা আর ক্ষুদ্র একদল কট্টরপন্থী মুসলিম নামধারী দলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে ভুল জায়গায় বম্ব মেরে কিছু মানুষের মৃত্যুর কারণ হওয়া এক কথা নয়, বিশেষ করে যখন শত্রুপক্ষ ইচ্ছা করে সাধারণ মানুষ জনের মাঝখানে গিয়ে অবস্থান নেয়। আমি বলছি না এইভাবে বম্বিং করে যাওয়াটা ঠিক, কিন্তু দু’টা এক জিনিষ নয়।”

বেলা বলল, “আমারও সেটাই কথা। যদি বোম মারলে শত্রুর চেয়ে সাধারণ মানুষ বেশী মারা যায় তাহলে বোম মারাটা তো ঠিক না। দরকার হয় সৈন্য নিয়ে মুখোমুখি যুদ্ধে যাও।”

সাইদ বলল, “সেটাইতো ইরাকীরা করছে মসুলে। কিন্তু লক্ষ লক্ষ মানুষের শহরে কোনরকম জানমালের ক্ষয়ক্ষতি ছাড়া কিছুই করা সম্ভব হয় না। পদে পদে বুবি ট্র্যাপ। সাধারণ মানুষেরা মারা যাচ্ছে। আবার উভয় পক্ষই সুযোগ পেলেই অন্য পক্ষের সমর্থকদেরকে বর্বরের মত হত্যা করছে।”

প্রমীলা একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বলল, “মনে হয় মানুষের জীবন যেন কত ফেলনা! কোন দাম নেই। ইচ্ছে হল মেরে দিল।”

কয়েক মুহূর্তের নীরবতা হঠাৎ করেই পরিবেশটাকে গ্রাস করল। বেলা নীরবতা ভেঙে বলল, “থাক, এইসব আলাপ। মন খারাপ হয়ে যায়। খান সবাই। অনেক কষ্ট করে রান্না করেছি।”

জিত বলল, “কৌতুক হচ্ছে পরিবেশ হাল্কা করার সবচেয়ে মোক্ষম অস্ত্র। একটা জোক বলি। এক বন্ধু পাঠিয়েছে। এক যুবক এক সন্ন্যাসীর কাছে গিয়ে বল্ল,‘বাবা, আপনার কাছে আমার তিনটা প্রশ্ন আছে। অনুমতি দেন তো করে ফেলি।’ সন্ন্যাসী সম্মতি সুচক মাথা নাড়লেন এবং যুবকটি একে একে তার তিনটি প্রশ্ন পেশ করল। প্রথম প্রশ্ন, একদিন যখন মরে যেতেই হবে তখন সবাই চিরকাল বাঁচতে চায় কেন? দ্বিতীয় প্রশ্ন, অর্থ এবং সম্পত্তি মানুষ সঙ্গে নিয়ে যেতে পারে না তারপরও সেগুলোকে মানুষ কেন নিজের জীবন দিয়ে রক্ষা করে? তৃতীয় প্রশ্ন, মানুষ মানুষকে না ভালোবেসে এমন হিংসা দ্বেষে কেন মেত ওঠে? সন্ন্যাসী মন দিয়ে প্রশ্নগুলো শুনলেন। তারপর পকেট থেকে একটা দেশলাইয়ের বাক্স বের করে ভেতর থেক তিনটা কাঠি বের করলেন। দুটা কাঠি মাটিতে ছুড়ে ফেলে দিলেন এবং তিন নম্বর কাঠিটাকে একটা ধারালো ছুরি দিয়ে লম্বালম্বি কেটে দুই টুকরা করলেন। এবার তার একটা টুকরা হাতে নিয়ে মাথার বারুদটা আংগুল দিয়ে খুচিয়ে ফেলে দিলেন। তারপর দাঁত দিয়ে চেপে অন্য দিকটা একটু চোখা করে নিলেন। এবার সেই সরু দিকটা দিয়ে মনযোগ দিয়ে কান খোঁচাতে খোঁচাতে বললেন, ‘আমি জানি না।’

শুজা রশীদ

টরন্টো