তাসের আড্ডা – ৫

এপ্রিল ৫, ২০১৭

শুজা রশীদ

এই শনিবার জিতের বাসায় সবার দাওয়াত। রাতে। জিতের স্ত্রী প্রমীলা পই পই করে সবাইকে বলেছে বিকালে আসতে, সে চা নাস্তা দেবে। আড্ডা ফাড্ডা দিয়ে রাত নটার দিকে ডিনার। কিন্তু বরাবরের মতই সবাই এলো আটটায়। সে ছেলেদেরকে লক্ষ্য করে চোখ মটকাল। “প্রতি শনিবার বিকেল হতেই তাস খেলার নাম করে উধাও হয়ে যান। আজ তাড়াতাড়ি আসতে বললাম, কোন খবর নেই।”

রনি বিরক্ত কন্ঠে বলল, “ভাবী, খামাখা আমাদেরকে কেন দোষারোপ করছেন? আপনার বান্ধবীরাই তো দেরী করে। আমি সেই কখন থেকে বলছি, চল, চল, আর বেগম সাহেবা বাড়ী ঝাড় মোছ করছেন। তার নাকি ময়লা বাসা রেখে কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না। ফাজলামীর জায়গা পায় না!”

বেলা চোখ কটমট করে বলল, “সারা বাসা তো গু করে রেখে দাও। আবার গলা উচিয়ে নালিশ করছ? প্রমিলা, ওদেরকে অন্য কোথাও চালান করে দাও তো। তাস ফাস খেলুক আর হাউ কাউ করুক, আমাদেরকে না জ্বালালেই হল।”

প্রমীলা হাসতে হাসতে বলল, “আমাকে কিচ্ছু করতে হবে না। দাদাবাবু আগেই সব গুছিয়ে রেখেছে নীচতলায়।”

বেলা হাত নাচিয়ে রনিকে বলল, “যাও, ফোট। বেশী চেঁচামেচি করবে না। ঘরে বসে বসে হাতী ঘোড়া মারছে। বীর পালোয়ান!”

রনি মুখ কুঁচকে জিতকে অনুসরণ করে নীচে চলে গেল। অল্পক্ষনের মধ্যেই তাদের তাস খেলা শুরু হয়ে গেল।  আজ কারোরই ভালো হাত পড়ছে না। দুই তিন হাত খেলার পরও কোন গেম টেম হল না। সাইদ বলল, “ভালো করে বাট কর দেখি। এইরকম বাজে তাস পেলে খেলা হয় নাকি?”

জালালের বাট। সে বার চারেক তাস শাফল করল। কবির বলল, “এতো তাস ঘাটালে কিন্তু হাতও আসবে আজগুবী।”

রনি হঠাত বলল, “আচ্ছা, লিবারেলদের কান্ডকারখানাটা খেয়াল করেছেন আপনারা? হাইড্রো নিয়ে যা শুরু করেছে এরা, সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। ”

লাল ভাই একেবারে লুফে নিল বিষয়টা। “ঠিক বলেছেন। হাইড্রো বিল কি রকম বেড়েছে চিন্তা করেছেন? এখন বলছে বিশ পঁচিশ পার্সেন্ট কমাবে। কিছু হল এটা? অর্ধেক হওয়া দরকার। বিল দিতে দিতে তো ফকির হয়ে গেলাম।”

রনি বিরক্ত হয়ে বলল, “আরে লাল ভাই, আপনি আছেন আপনার বিলের চিন্তায়। ক্যাথলিনের ধোকাবাজী টা ধরতে পারলেন না? যেই দেখেছে তার জনপ্রিয়তা ধুলায় লুটোপুটি খাচ্ছে অমনি লেগে গেছে ধান্দাবাজী করে মানুষের মন জয় করতে। এই বিল কমানোর জন্য সে কি করেছে সেটা বুঝতে পারছেন? নিউক্লিয়ার রিএক্টর, পাওয়ার প্ল­ান্ট, উইন্ড টারবাইনের উপর যে মর্টগেজ আছে সেটা রিফাইনান্স করেছে। ফলে আগামী বিশ বছরে প্রতি বছর দেড় বিলিয়ন ডলার সরকারকে কম দিতে হবে পেমেন্ট হিসাবে, কিন্তু সুদ তো ঠিকই গুনতে হবে। যার অর্থ যে টাকাটা আমরা এখন দিতাম, আমাদের ছেলেমেয়েরা তার চেয়ে বেশী দেবে। কত বড় ধুরন্ধর চিন্তা করেছেন? এই পলিটিসিইয়ানরা আমাদের কি মনে করে? গাধা?”

জিত বলল, “কাজ তো হয়েছে কিছু। সার্ভেতে দেখা গেছে আগে যারা ক্যাথলিনের নাম শুনতে পারতো না, বিল কমবে শুনে তাদের মধ্যে অনেকে এখন একটু ঠান্ডা হয়েছে। কত সহজ আমাদেরকে জয় করা। মাসে বড় জোর চল্লিশ – পঞ্চাশ ডলার বাঁচবে।”

লালা ভাই নীচু গলায় বলল, “ঐটাই বা কম কি?”

সাইদ বলল, “এটাইতো রাজনীতির খেলা। এধারকা মাল ওধার। মানুষ জন গাধা নয়। সবাই কম বেশী বোঝে, কিন্তু চিন্তা ভাবনাটা হচ্ছে- আপাতত এই ঝড়টা তো পার হোক, পরেরটা পরে।”

কবির বলল, “কিন্তু ভাই, এটা আমার কাছেও ভালো লাগে নি। এ তো মানুষের চোখে ধুলা দেয়া। আসল সমস্যার সমাধান না করে আবোল তাবোল বুঝিয়ে দেয়া। কিছু বললেই তো শুরু করে লেকচার দেয়া। গ্রীন এনার্জি – খরচ তো একটু বেশী হবেই। এটা কোন কথা হল?”

সাইদ বলল, “এটা একটা জটিল সমস্যা। ওন্টারিও সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী সংস্থাগুলোর সাথে লম্বা চুক্তি করেছে, কিন্তু আমাদের বিদ্যুৎ ব্যবহার কমেই যাচ্ছে। কিন্তু ব্যাবহার কম হচ্ছে বলে বিল কমছে না কারণ অবকাঠামো তৈরীর দোহাই দিয়ে সবার বিলের সাথে একটা অংশ যোগ করা হচ্ছে। যে কারণে যে সারা মাসে একবারের জন্যও বিদ্যুৎ ব্যবহার করেনি তারও শ’ ডলারের উপর সার্ভিস চার্জ আসছে। তার সাথে যোগ হয়েছে স্মার্ট মিটার। ব্যাস্ত সময়ে বিদ্যুৎ ব্যবহার করলে বেশি দিতে হবে। এবং, শুনতে খারাপ লাগতে পারে কিন্তু ওন্টারিও পাওয়ার জেনারেশনের উচ্চ পদস্থ কর্মচারীদের বেতন-ফেতন নিয়েও অনেকের প্রশ্ন আছে। সব মিলিয়ে একটা জগা খিচুরী, সাধারণ মানুষ নিজের পকেটের পয়সা দিয়ে সরকারের অদক্ষতার মাসুল দিচ্ছে।”

জালাল বলল, “এদের কথা বার্তা শুনলে মনে হয় বিলিয়ন ডলার যেন কোন ব্যাপারই না। কিন্তু আমার কাছে তো পঞ্চাশ ডলারও অনেক। বিল দিতে দিতে হাতে ফোস্কা পড়ে যাচ্ছে।”

জালাল ধীরে সুস্থে কার্ড বাট করছিল। রনি বলল, “জালাল ভাই, আপনার হাতে মনে হচ্ছে সত্যিই ফোস্কা পড়েছে। যেভাবে বাট করছেন, রাত তো পার হয়ে যাবে।”

জালালের গতি বাড়ল না। “তাড়াতাড়ি দিতে গেলে আবার ভুল হয়ে যাবে।”

লাল ভাই ঝট করে উপরে গিয়ে এক গামলা বাদাম নিয়ে হাজির হল। “মুখে খাবার না থাকলে আড্ডা জমে না। আর কিছু নিয়ে আসব? পানি? কোক? কফি? ”

জিত আজকে খেলছে না। তাদের অলিখিত নিয়ম হচ্ছে যার বাসায় দাওয়াত থাকে সে খেলে না। তার দায়িত্ব সবাইকে খেদমত করা। আজ রনির সাথে কবির খেলছে। জিত হাসতে হাসতে বলল, “লাল ভাই, বাড়ী আমার আর খেদমত করছেন আপনি। লজ্জায় ফেলে দিলেন তো।“

“না ভাই লজ্জা পাইয়েন না,” লাল ভাই এক গাল হাসি নিয়ে বলল। “ আমার আবার এইসব করতে ভালো লাগে। আল্ল­াহ খুশী হয়। ছোয়াব পাওয়া যায়। বেহেশতে যাইতে পারব।”

রনি বলল, “যেখানেই যান আমেরিকায় যাইয়েন না। শুনেছেন তো ঘটনাটা। মানপ্রিত কুনারের ঘটনাটা শুনেন নাই? কানাডিয়ান মেয়ে, ভারতীয় বংশোদ্ভুত। দুই সাদা বান্ধবীকে নিয়ে কুইবেক-ভারমন্টের বর্ডার দিয়ে আমেরিকায় ঢোকার চেষ্টা করছিল। কানাডীয়ান পাসপোর্ট ছিল। শুধু তাকে ঢুকতে দেয় নাই। পাচ-ছয় ঘন্টা জেরা করে বলেছে ঢুকতে হলে ভিসা নিতে হবে। আমেরিকান এম্ব্যাসি বলছে, কানাডিয়ানদের তো ভিসা লাগে না। কারবারটা বোঝেন এইবার। আপনার যে রকম লম্বা চওড়া দাড়ি এবং যেমন আরবীয় লেবাস পরে ভ্রমণ করেন, আপনাকে দুই দিন ধরে জেরা করবে।”

লাল ভাই জিভ কাটল। “আমারে দেইখা কি পাগল মনে হয় আপনার? কানাডায় ভালো আছি। কোন দুঃখে আমেরিকা যাবো? শুনছেন না,  ট্রাম্প তো ওবামা কেয়ার সরাইতে গিয়ে নিজেই কাত হয়ে পড়ছে! কি যে খুশী হয়েছি!”

সাইদ বলল, “গতকাল এটা জানার পর, আমার রাতে ঘুম পর্যন্ত ভালো হয়েছে। ওদের মেডিকেল কেয়ার সিস্টেম নিয়ে আমার কোন মাথা ব্যাথা নেই কিন্তু গাড়োল ট্রাম্প যে হেনেস্থা হয়েছে এটা জেনে এতো ভালো লেগেছে যে ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। এতোকাল প্রাইভেট কম্পানী চালিয়ে এসেছে, ঘুঘু দেখেছে ফাঁদ দেখেনি। এবার ব্যাটা টের পাবে, প্রেসিডেন্ট হওয়া মানে দেশের রাজা হওয়া না।”

কবির বলল, “ওবামার এফর্ডএবল কেয়ার এক্টে বেশ কিছু সমস্যা আছে কিন্তু সেগুলো ঠিক না করে খামাখা নতুন একটা ভগিজগি সিস্টেম প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছিল, নিজের পার্টির লোকেরাই সবাই চায় না।”

জালালের তাস বাটা শেষ হয়েছে। সে নিজের তাস তুলতে তুলতে বলল, “আচ্ছা, দুই সিস্টেমের মধ্যে আসল পার্থক্যটা কি?”

সাইদ বলল, “বেশী জটিলতায় না গিয়ে এটা বলা যায় যে, এফর্ডএবল কেয়ারে গরীবের উপকার বেশী হবে। আমেরিকান কেয়ারে মিডল ক্লাশের উপকার হবে কিন্তু গরীব মানুষ ইন্সুরেন্স কিনতে পারবে না যেহেতু রাষ্ট্র যে ভর্তুকি দিচ্ছে সেটা অনেক কমে যাবে। যে কারণে কংগ্রেশনাল বাজেট অফিস ধারণা করেছিল আগামী দশ বছরে নতুন নিয়মের আওতায় চব্বিশ মিলিয়ন মানুষের কোন হেলথ কেয়ার থাকবে না। মোদ্দা কথা হল, সবাইকে যদি মেডিকেল ইন্সুরেন্স দিতে হয় তাহলে কারো কাছ থেকে নিতে হবে, কাউকে দিতে হবে। পল রায়ান আর ট্রাম্পের আমেরিকান হেলথ কেয়ার সিস্টেমে সবাইকে ইন্সুরেন্স কিনতে হবে না।”

জিত বলল, “চব্বিশ মিলিয়ন কম মানুষের ইন্সুরেন্স থাকবে এটা হজম করা কষ্ট। রিপাবলিকানরা যারা সমর্থন করে নি তারা এই কারণেই পিছিয়ে গেছে। দেখা যেত বয়েসী মানুষদের প্রিমিয়াম হয়ে যেত আকাশচুম্বী। গরীব এলাকায় অনেকেই ইচ্ছে থাকলেও সামর্থ না থাকায় ইন্সুরেন্স কিনত না। তারপর আবার মেডিকেইডেরও পরিবর্তন হত।”

সাইদ বলল, “একেই বলে শাখের করাত। যেদিকে যায় সেদিকেই কাটে। বিল বেশী নমনীয় হলে একদল রিপাবলিকানরা বেঁকে বসছে, আবার বেশী কঠিন হলে আরেক দল বেঁকে বসছে। কেউ নিজের জায়গা ছেড়ে নড়বে না। ট্রাম্প মিয়া ভেবেছিল হাঁক ডাক দিয়ে সবাইকে কিছু একটা বুঝিয়ে বিল পাস করিয়ে ফেলবে। আরে, এতো সোজা!”

রনি বল্ল,”তবে একটা ভালো

দিক বলতেই হবে, ওদের গণতন্ত্র আসলেই কাজ করছে। পার্টির সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে বলেই সব বিল পাশ হয়ে যাবে তা কিন্তু হচ্ছে না। ট্রাম্পজী বললেন আর সবাই জ্বি জ্বি করতে করতে একই কাতারে দাঁড়িয়ে গেল, তা কিন্তু হল না। সেখান থেলে কিছু শিক্ষা নেবার আছে।”

লাল ভাই বলল, “ঠিকই বলছেন, ভাই। এই জন্যেই তো এতো হৈ হট্টগোল হলেও দেশটা কিন্তু ঠিকই টিকে আছে। তবে সত্যি কথা বলি, আজকাল কিন্তু বেগম সাহেবাকে নিয়ে এখানে সেখানে যেতে একটু ভয়ই লগে। মাথায় হিজাব পরে। আমরা কানাডা নিয়ে এতো গর্ব করি, এখানেও তো কত বদমাশ আছে। আমেরিকার হাওয়া এখানেও বেশ ভালোই লেগেছে।”

জিত বলল, “তাতো একটু লাগবেই। কিন্তু অবস্থা তত খারাপ নয় এখানে। এমনকি আমেরিকার কথাই ভাবুন না। কানসাসের এক বারে ভারতীয় একটা লোককে এক ব্যাটা শ্বেতাঙ্গ ভবঘুরে গুলী করে মারল – সেটা তো নিশ্চয় জানেন। গুলী করার আগে ঐ বদমাশ যখন ভারতীয় লোক দুজনকে গালাগালি করছিল তখন আরেকজন শ্বেতাঙ্গ তার প্রতিবাদ করেছিল। গুলী বন্ধ হবার পর সেই লোকটাই খুনীটাকে তাড়া করে। ভেবেছিল তার বিন্দুকে আর গুলী নেই। কিন্তু একটা ছিল। লোকটা বেঁচে গেছে কিন্তু আমার পয়েন্ট হল  শুধু একদিক দেখলেই তো হবে না। দুদিকেই দেখতে হবে।”

লাল ভাই মাথা দোলাল। “ঠিকই বলছেন। যেমন মন্দ মানুষ আছে, তেমনই অনেক ভালো মানুষ আছে। সবাইকে মন্দ বলা ঠিক না।”

এবার কল শুরু হল। জালালের হাত খুবই খারাপ। সে মুখ ব্যাজার করে পাশ দিয়ে গেল। কিন্তু সাইদ একাই রনি এবং জিতের স্পেডের বিরুদ্ধে ক্লাবস নিয়ে লড়াই করে ছয়ে গিয়ে কল নিল।

“আমার হাত কিন্তু গার্বেজ। এইবার কত শর্ট খাবেন কে জানে?” জালাল তিক্ত গলায় বলল।

সাইদকে খুব একটা উদ্বিগ্ন মনে হল না। “তোমার হাতে যদি ক্লাবসের রাজাটা থাকে তাহলেই হবে। না থাকলেও অসুবিধা নেই, একটা ফিনেস করবার চেষ্টা করতে হবে।”

দেখা গেল জালালের হাতে যে গুনে গুনে তিনখানা পয়েন্ট আছে, ক্লাবসের রাজার বদৌলতেই। ছয়ের খেলা দিব্যি হয়ে গেল। জালালের মুখে হাসি ধরে না। “জানতাম এবার আমরা গেম দেব। হাত দেখেই মনে হচ্ছিল।”

রনির বাট। কার্ড শাফল করতে করতে সে বলল, “ট্রাম্পের ট্যাক্স ড্রামা নিয়ে কেউ দেখি কিছু বললেন না। সাইদ ভাই, দেখেছেন তো না?”

সাইদ মুখ বাকিয়ে বল্ল,”ওদেরই কেউ ইচ্ছে করে এটা ফাঁস করেছে। আমার কোন সন্দেহ নেই। হঠাৎ করে ১৯৯৫ এর ট্যাক্স রিটার্নের কয়েকটা পাতা বেরিয়ে আসবে এটা হতেই পারে না।”

জালাল বলল, “কিন্তু দেখে তো মনে হল অনেক টাকাই দিয়েছে ট্যাক্স হিসাবে। ১৫৩ মিলিয়ন আয় করেছিল। ৩৬-৩৭ মিলিয়ন দিয়েছিল ফেডারেল ট্যাক্স। সেটাতো অনেক।”

রনি বলল, “আপনি তো আসল কেরি ক্যাচারটাই ধরতে পারেন নাই। সে হিসেব মত ট্যাক্স দিয়েছিল ৫ মিলিয়নের কিছু বেশী। বাকী যে ৩১ মিলিয়ন দিয়েছিল সেটা বাধ্য হয়ে দিতে হয়েছিল – অল্টারনেটিভ মিনিমাম ট্যাক্স হিসাবে। ঐটা যদি না থাকত, তাহলে সে যা ট্যাক্স দিত, তার রেট হত যে ৩৩ হাজার আয় করে তার সমান। ট্রাম্প বহুকাল ধরেই এই ট্যাক্সের বিরোধীতা করে আসছে। ভোটের আগে তার একটা প্রতিজ্ঞা ছিল এই ট্যাক্স বন্ধ করে দেয়া। বড় বড় কথা বলে কিন্তু আসলে তার একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে কোটিপতিদের সাহায্য করা।”

সাইদ বলল, “এটাই তো ধনতন্ত্রের সমস্যা। যার কাছে অর্থ আছে, সে ছলে বলে কৌশলে যত ধরণের সুযোগ নিতে পারে নেবে, এবং যত কম টাকা দিতে পারে দেবে। তাবৎ উকিল, একাউনটেন্ট নিয়ে এসে এমন একটা জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে যে সরকারের জন্য সব কিছু চেক করা অসম্ভব কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। সেই জন্যই ১৯৬৯ সালে ওদের সরকার এই অল্টারনেটিভ মিনিমাম ট্যাক্স ব্যবস্থা চালু করে। কারন সব কোটিপতিরা এটা সেটা দেখিয়ে কোন ফেডারেল ট্যাক্স দিচ্ছিল না।”

রনির বাট শেষ হয়েছে। জালাল কার্ড দেখেই বলল, “ওয়ান নো ট্রাম্প!”

কবির প্রতিবাদ করল, “আপনি কল দিচ্ছেন কেন? কল তো সাইদ ভাইয়ের।”

সাইদ হাসতে হাসতে বলল, “যাক, আমার পার্টনারের হাতে তাহলে ভালো কার্ড আছে। নিশ্চিন্তে কল দেয়া যাবে।”

রনি বলল,“জালাল ভাই, আপনি এটা ইচ্ছে করে করেছেন।”

জালাল তীব্র গলায় অস্বীকার করল। খেলা তারাই নিল – এক নো ট্রাম্পেই। গেম টেম কিছুই হল না। সাইদের বাট। জালাল বলল, “আচ্ছা, এই ডীপ স্টেট নিয়ে তো অনেক কিছু শুনছি। সাইদ ভাই, একটু ভালো করে ব্যাখ্যা করেন তো।”

সাইদ বলল, “ডিপ স্টেট বলতে বোঝায় সরকারী অনুমোদনের বাইরে সিকিউরিটি ফোর্সগুলো একত্র হয়ে নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করবার জন্য যখন একজোট হয়ে নানা ধরণের বেআইনী কাজ কর্ম করে। প্রথমে তুরস্কে টার্মটা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এর শিকার যে কেউ হতে পারে। যারা ঐ গ্রুপের স্বার্থের বাইরে কাজ করবে তারাই তাদের কোপানলে পড়বে। ইদানীং ট্রাম্প এবং তার সমর্থকরা এটা নিয়ে খুব হৈ চৈ করছে। তাদের ধারণা এই সরকারকে ছোট করবার জন্য পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে কোন একটা গোষ্ঠী কল কাঠি নাড়ছে। সরকার যেন ব্যার্থ হয় সেই চেষ্টা করছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত তার কোন প্রমাণ পাওয়া যায় নি। সবই তাদের উর্বর মস্তিষ্কের কল্পনা।”

উপরে সিঁড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে রুমা। সে গলা বাড়িয়ে খোঁচা দিয়ে বলল, “এই যে কাক তাড়ুয়ার  দল, বকবকানি বন্ধ করে উপরে এসো। খাওয়া দেয়া হয়েছে।”

রনি আজকে একেবারেই ভালো হাত পায়নি। সে ঝট করে উঠে দাঁড়াল। “চলেন, ক্ষুধা লেগেছে।”

লাল ভাই হাসতে হাসতে বলল, “রনি ভাইয়ের আজকে মুড অফ। হাত খারাপ যাচ্ছে।”

সবাই উঠল। দেখতে দেখতে রাত দশটা বেজে গেছে।  সবাই পার্টিতে আসতেই এতো দেরী করে। পট লাক। সবাই একাধিক আইটেম আনায় হুলস্থুল অবস্থা হয়েছে। খাবারে খাবারে ছয়লাব। রনিকে গম্ভীর দেখেই বেলা টিপ্পনী কাটল, “এই রে, সাহেব আজকেও হারছে। সাইদ ভাই, কত করে বলেছি বেচারীকে মাঝে মাঝে একটু জিতিয়ে দেবেন।”

রনি ভ্রু কুঁচকে বলল, “আরে, তুমি তাস খেলার কি বোঝ? আমি মোটেই হারছি না।”

প্রমীলা হাসতে হাসতে বলল, “বেলা, তুমি কেন খামাখা তার পেছনে লেগেছ?”

রুমা বেলার সাথে যোগ দিল। “বেশ করেছ, বেলা। এই ছেলেগুলো আমাকে জ্বালিয়ে মারে। শনিবার হল আর আমার বাসায় সব গ্যাঁট মেরে বসে গেল। হৈ চৈ, খাওয়া দাওয়া, ঝগড়া ঝাঁটি …”

কবীর মনক্ষুন্ন হয়ে বলল, “রুমা ভাবী, আপনার বাসাতো আমরা গুছিয়ে রেখে আসি। কোন ময়লা ট্য়লা করি না।”

রুমা মুখ ঝামটা দিল, “না, তা করবে কেন? তোমরা পোলাপাইনেরও অধম। চলে যাবার পর আমার এক ঘন্টা লাগে সব গোছাতে।”

লাল ভাই দুই হাত তুলে বলল, “আপনি এই পোলাপাইনগুলারে একটা জায়গা দিছেন। আল্ল­াহ আপনার ভালো করবে!”

সবাই হাসল। রুমা ছদ্ম কোপে মুখ বাঁকাল। “লাল ভাই! আপনি যে কেন ওদের দলে ভিড়েছেন?”

খাবার নিয়ে ছেলেরা গিয়ে বসল লিভিংরুমে, মেয়েরা ফ্যামিলি রুমে। বাচ্চাদেরকে বসানো হয়েছে টেবিল চেয়ারে, যেন সারা বাড়ীময় খাবার ছড়ানোর সুযোগ না পায়।

খেতে খেতে কবীর বলল, “আপনারা কেউ বিষয়টা পড়েছেন কিনা জানি না, কিন্তু আমার কাছে খুব ইন্টারেস্টিং মনে হল। এক দল বিশেষজ্ঞরা বলছে, জিসাস হয়ত আদৌ সশরীরে কখনই ছিলেন না। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, গবেষণা করতে গিয়ে তারা দেখেছে অনেক জাতীরই জেসাসের মত ত্রাণকর্তার পৌরাণিক কাহিণী আছে। সেই সব কাহিনীতে জিসাসের মতই তাদের ত্রাণকর্তাকে হত্যা করা হয়েছে এবং তার পুনর্জন্মের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। লেখক গবেষোক টিমোথী ফ্রিকের ভাষ্য অনুযায়ী জিসাসের চরিত্র নাকি প্রথম সেঞ্চুরির ইহুদীদের বানানো। বাইবেলের বাইরে নাকি এমন কোন বিশ্বাসযোগ্য সুত্র নেই যা ব্যবহার করে জিসাসের অস্তিত্ব প্রমাণ করা যায়।”

জালাল অবাক হয়ে বলল, “বলেন কি? খ্রীস্টানরা ক্ষেপে যায় নি এসব কথা শুনে?”

রনি বল্ল, “ওরা মানসিক ভাবে অনেক পরিণত। কেউ একটা কিছু বলল আর রে রে হয়ে মারকুটে হয়ে তেড়ে গেলাম – সেই মনভাব ওদের নেই। কিন্তু ঐ লেখাটা আমিও পড়েছি। সবাই তার সাথে এক মত নয়। তার বিপক্ষেও অসংখ্য গবেষক, চিন্তাবিদ আছেন।”

সাইদ বলল, “ফ্রিকের লেখা আমি পড়েছি। শোন, কথা হচ্ছে মানুষটা বড় না তার শিক্ষাটা বড়? কেউ বলতে পারে, প্রকৃত মানুষটাই যদি না থেকে থাকা তাহলে তার নামে যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে তার গুরুত্বও থাকে না। আবার তার বিপক্ষেও বলা যায়। শিক্ষাটাই প্রধান, শিক্ষক নয়। সত্য হয়ত দু’টার মাঝামাঝি। কিন্তু কথা হল, বিশ্বাসটাই বড়। যে বিশ্বাস করে কিংবা করতে চায়, তার কাছে এইসব গবেষনা মূল্যহীন।”

কবির কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই মহিলাদের পক্ষ থেকে তার ডাক এলো।  অনেকদিন সবাই মিলে কোথাও বেড়াতে যাওয়া হয়নি। এইসব ব্যপার সাধারণত কবিরই সামলায়। একটু পরেই গ্রীষ্মে দল বেঁধে কোথায় যাওয়া হবে তাই নিয়ে খুব হৈ চৈ শুরু হয়ে গেল।

রনি বিরক্ত গলায় বলল, “এই মেয়েগুলো এতো হৈ চৈ করতে পারে! শান্তিতে একটু কথাবার্তা বলা যায় না।”

লাল ভাই খোঁচা দিয়ে বলল, “ভাবী সাহেবা আজকে আপনার মেজাজটা সত্যিই খিচড়ে দিয়েছে।”

খাবার পর মহিলারা জিতকে ধরল জোক বলার জন্য। জিত বলল, “একটা ছোট জোক বলি। আমার বন্ধু ট্রাম্পকে নিয়ে। সে একদিন খুব মন খারাপ করে তার বন্ধুদেরকে বলছে, ‘এই দেশের মানুষ খুবই খারাপ। তারা সবাইকে একই পাল্ল­ায় বিচার করে না’। জনৈক বন্ধু বলল, ‘কেন? তা কেন?’ ট্রাম্প বলল, ‘দেখ, মিশেল ওবামা যখন ফার্স্ট লেডী হবার পর বক্তৃতা দিল, তখন তার কথা শুনে সবাই খুব বাহ বাহ দিয়েছিল। কিন্তু সেই একই বক্তৃতা যখন আমার বউ দিল,  তখন চারদিকে ঢি ঢি পড়ে গেল। অসভ্য!’”