তাসের আড্ডা – ১৩

ডিসেম্বর ১, ২০১৭

শুজা রশীদ

আগের শনিবার আড্ডার সময় তাসাড়ুরা দূর্ঘটনাবশতঃ রুমার একটা কাঁচের ফুলদানী ভেঙে ফেলায় মহা ক্ষাপ্পা হয়ে রুমা অনির্দিষ্টকালের জন্য তার বাসায় তাসের আড্ডা বন্ধ ঘোষণা করেছে। লাল ভাই দুই হাত বাড়িয়ে সবাইকে তার বাসায় আহবান করেছিল কিন্তু শেষ পর্যন্ত রনির বাসাতেই সবাই জমায়েত হল। রুমাও এলো সাইদের সাথে। জালালের স্ত্রী ইলা এবং কবীরের স্ত্রী লতাও চলে এসেছে। শুধু প্রমীলা আসে নি। তার কি একটা কাজ পড়ে গেছে। মহিলারা দল বেঁধে বাইরে গেল, কোন কাপড়ের দোকানে যাবে, সেখান থেকে মুভি দেখে খেয়ে-দেয়ে বাসায় ফিরবে। বাচ্চারা বাসায়। তাদের জন্য এক হাঁড়ি লাজানিয়া রান্না করা হয়েছে। পুরুষদেরকে বলা হয়েছে নিজেদের ব্যবস্থা নিজেরাই করে নিতে। রনি মুখ বাঁকিয়েছে। এটা কোন সমস্যা হল? পিজা এবং উইংগস আছে কেন?

খেলার শূরুতেই জালাল বলল, “সাইদ ভাই, প্যারাডাইজ পেপার নিয়ে কিছু বলেন। আমরা মধ্যবিত্তরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে সরকারকে ট্যাক্স গুনছি আর ওদিকে বড় বড় কর্পরেশন আর ধনী মানুষরা দিব্যি টাকা পয়সা দূরে কোথাও কোন ট্যাক্স হেভেনে সরিয়ে কম ট্যাক্স দিচ্ছে। লিক না হলে তো আমরা জানতেও পারতাম না কত পরিচিত মুখ রয়েছে সেই দলে। নাইক, এপল, ফেসবুক এমনকি আমাদের কুইনও! স্টেফেন ব্রনফম্যান, লিবারেল পার্টির প্রধান ফান্ড রাইজার পর্যন্ত সেই লিস্টে। ট্রুডো যে এতো বড় বড় কথা বল, এখন কি বলবে?”

সাইদ মৃদু হেসে বললেন, “কিছুই বলবে না। বলার কি আছে? এটা তো সম্পূর্ণ লিগাল। এরা কেউ কানাডার কোন নিয়ম ভাঙ্গেনি। আইনসঙ্গতভাবে ট্যাক্স কম দেবার কৌশল খাটিয়েছে। তাতে দোষের কি আছে?”

লাল ভাই বলল, “বলেন কি? এটাতে কোন দোষের কিছু হয় নাই?”

জিত বলল, “আমাদের দেশের ট্যাক্সেশনের যে নিয়ম কানুন আছে তাতে এটা অনুমোদিত। সমস্যা হচ্ছে আপনি আমি যা ইনকাম করি তা বাসা পর্যন্ত আনার আগেই শেষ হয়ে যায়, সাগরের ওপারে পাঠাব কি?”

জালাল বলল, “তা দাদা ঠিকই বলেছেন। আপনাদের কথা জানি না, আমার তো ফুটো পকেট। আচ্ছা, সাইদ ভাই, এই ট্যাক্স হেভেনের ব্যাপারটা আমাকে একটু বুঝিয়ে বলেন তো। এটা লিগাল হয় কি করে?”

সাইদ বলল, “জানোইতো ট্যাক্স হেভেন হচ্ছে এমন কোন দেশ যেখানে ট্যাক্স কম। কেম্যান আইল্যান্ড তাদের একটা। সাধারণত ঐ দেশগুলোতে ট্যাক্স সংক্রান্ত নিয়ম কানুনও কম। কোন কানাডিয়ান বিজনেস বা ব্যাক্তি লিগালি সেখানে গিয়ে ফরেইন এসেটের জন্য একটা ট্রাস্ট গঠন করতে পারে। সেই ট্রাস্টের কোন সিদ্ধান্ত যদি কানাডায় বসে না করা হয় তাহলে তার উপর কোন ট্যাক্সও কানাডাকে দিতে হয় না। যে কারনে প্যারাডাইজ পেপারে তিন হাজার মানুষ এবং প্রতিষ্ঠানের নাম থাকলেও তাদের কারো বিরুদ্ধেই কোন আইনসংগত ব্যাবস্থা নেয়া হবে কিনা সন্দেহ।”

রনি বল্ল, “আরে বাদ দেন এইসব ট্যাক্সে ফ্যাক্সের আলাপ। সব এমনভাবে নিয়ম করে রেখেছে যে যার টাকা আছে তারই যেন সুবিধা হয়। বরং আমাদের দুই কমেডিয়ানকে নিয়ে আলাপ করা যাক। ভাড় ট্রাম্প এবং বলদ কিম জং-আন। দু জনে মিলিয়ে পুরো পৃথিবী মাতিয়ে রেখেছে। ট্রাম্প যখন সাউথ কোরিয়াতে গেল তখন কি কথা চালাচালি হয়েছিল খেয়াল করেছেন তো?”

কবীর হাসতে হাসতে বলল, “এটা কি মিস করা যায়?”

লাল ভাই বলল, “আমি তো মিস করেছি। কি হয়েছে বলেন তো?”

কবীর বলল, “কিম জং-আন ট্রাম্পকে বলেছে বুড়া। আর ট্রাম্প তার শোধ নেবার জন্য ওকে বলেছে বেঁটে এবং মোটা।”

জিত বলল, “সরাসরি বলে নি। বলেছে, আমাকে বুড়া বলার কারণ কি? আমি তো ওকে বেঁটে বা মোটা বলছি না।”

সাইদ হাসতে হাসতে বলল, “ঝগড়া করতে করতে এখন মনে হয় ট্রাম্প কথা শিখে গেছে।”

দুই তিন হাত মনযোগ দিয়ে খেলা হল। এক পর্যায়ে রনি বাট করতে করতে বলল, “শূনেছেন তো, এঞ্জেলিনা জলি যে বাংলাদেশে যাচ্ছে রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতি দেখবার জন্য।”

জিত বলল, “হাতি ঘোড়া গেল তল মশা বলে কত জল। কেউ তো কোন সমাধান দিতে পারছে না। সে গিয়েই বা আর কি করবে??”

রনি বলল, “ওর ভালোই প্রভাব আছে। হয়ত সমাস্যার সমাধান করতে পারবে না কিন্তু যে সব রোহিঙ্গা মহিলারা নির্যাতিত হয়েছে মিয়ান্মার আর্মির হাতে তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে পারবে, বাংলাদেশেও তাদের চিকিৎসা দরকার, শিশুদের যথাযথ খাবার, পানি দরকার – করার তো অনেক কিছু আছে। সেলিব্রিটিরা এলে সারা পৃথিবীর মানুষ সাধারণত লক্ষ্য করে।”

রাতে খাবারের সময় হয়েছে। বাচ্চারা হই চই করে লাজানিয়া খেল। রনি পিজা অর্ডার দিল। আসতে আধা ঘন্টা লাগবে।

লাল ভাই মন খারাপ করে বলল, “রোহিঙ্গাদের কথা ভাবেন। সব কিছু হারিয়ে কি দুর্বিপাকের মধ্যে আছে ওরা। আর আমরা এখানে আনন্দ ফুর্তি করছি, পিজা খাচ্ছি। মনে খুব খারাপ লাগে।”

রনি বলল, “খারাপ লাগলে খেয়েন না। আপনার ভাগটা আমিই খেয়ে নেব।”

সবাই হাসল। হাসি থামতে রনি বলল, “লাল ভাই, মনে কিছু নিয়েন না। ওরা কষ্টে আছে বলে তো পৃথিবী থেমে থাকবে না। আমরা আমাদের সাধ্য মত ওদেরকে সাহায্য করবার চেষ্টা করতে থাকব। এখানে সরকারের সাথে একজোট হয়ে আন্তর্জাতিকভাবে চাপ সৃষ্টি করতে হবে। আমেরিকা তো এখনও এটাকে এথনিক ক্লিনজিং বলে স্বীকার করে নি। সেক্রেটারি অব স্টেট রেক্স টিলারসন বলছে অর্থনৈতিক অবরোধ করে কোন লাভ হবে না। হয়ত মিয়ান্মারের সাথে রাজনৈতিকভাবে কোন একটা বোঝা পড়ায় আসতে হবে। সেটা কবে কিভাবে হবে কে বলতে পারে?”

কবীর বলল, “মিয়ান্মারের আর্মি হচ্ছে বজ্জাতের বজ্জাত। এরা খুব সহজে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেবে না।”

পিজা আসতে বাচ্চারা আবার হই চই করে এসে হাজির হল। রনি প্রয়োজনের চেয়ে বেশীই অর্ডার দিয়েছিল। সবার হয়েও কিছু থেকে গেল। এটা তার রোববারের লাঞ্চ।

খেতে খেতেই আলাপ চলে গেল ওয়ার্ল্ড কাপ ফুটবলে।

জালাল বলল, “ইটালী ওয়ার্ল্ড কাপে যেতে পারে নি ভাবাই যায় না। কি করে এমনটা হল? সুইডেনের সাথে হেরে গেল?”

সাইদ বলল, “দুটা খেলা খেলেছে, একটা গোল দিতে পারে নি। সুইডেন প্রথম খেলায় এক গোল দিয়ে মোট গোলে জিতে গেল। পরের খেলায় তো ইটালীর কাছেই বল ৭৫ ভাগ সময় ছিল। তার পরও কোন গোল দিতে পারে নাই। ডিজাপয়েন্টিং। আমি আবার সব সময় ইটালীর সমর্থক।”

রনি বলল, “ভাই, আরেকটু হলে আর্জেন্টিনাই তো বাদ হয়ে যাচ্ছিল। মেসি ওয়ার্ল্ড কাপে খেলছে না আমি চিন্তাই করতে পারি না। বেচারা একটা ওয়ার্ল্ড কাপ জিততে পারল না। দেখা যাক এবার কি হয়। এতো ভালো একটা খেলোয়াড় ওয়ার্ল্ড কাপ নি জিতেই চলে যাবে! ম্যারাডোনার কথা মনে আছে? ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে হাত দিয়ে গোল করে খেলা জিতিয়ে নিয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত চ্যাম্পিয়ন হল।”

এখানে সেই খেলা সবাই দেখেছে। এক পশলা হাসি হল। ১৯৮৬ সালের ওয়ার্ল্ড কাপের খেলা। কবীর সেলফোনে সার্চ করল ‘ম্যারাডোনা হ্যান্ড গোল’, সাথে সাথে ভিডিও চলে এলো। সে বলল, “আমি তখন বছর ছয় সাতের। আমারও মনে আছে।”

সে সবাইকে দেখাল ভিডিওটা।

জিত বলল, “আচ্ছা, ফুটবলের কথাই যখন উঠল তখন একটা কৌতুক বলেই ফেলি।

“ব্রিটিশ জোক। দুই বন্ধু ফুটবলের সিজন টিকিট কেটেছে। ম্যাঞ্চেস্টারের সমর্থক। দুজনে মিলে প্রত্যেকটা  খেলা দেখতে যায়। সব সময় দেখে ওদের পাশের সিটটা (K37) ফাঁকাই থাকে। ওদের একটু খারাপই লাগে। সিজন টিকিট পাওয়া কষ্ট। একটা সিট ফাঁকা পড়ে আছে। তাদের আরেক বন্ধু সেটা কিনতে পারে। তাহলে তিন জনে মিলে মজা করে খেলা দেখা যাবে। ওরা টিকিট অফিসে গিয়ে খোঁজ নিল। তারা জানাল টিকিট বিক্রী হয়ে গেছে।

“ক্রিসমাসে পরের দিন  খেলা দেখতে গিয়ে তারা অবাক হয়ে দেখল এক লোক K37 সীটে বসে আছে।

এক বন্ধু কৌতূহলী হয়ে জানতে চাইল, “ঘটনা কি ভাই? তুমি এতো টাকা দিয়ে সিজেন টিকিট কেটে সারা বছর খেলা দেখলে না কেন? জানো কত মানুষ এই টিকিটটা পেলে খুশী হত?”

লোকটা মুখ ব্যাজার করে বলল, “ভাই, আর বল না। আমার বউ বছরের প্রথমে এই সিজেন টিকিট কিনে লুকিয়ে রেখে দিয়েছে আমাকে ক্রিসমাসের সময় সারপ্রাইজ গিফট দেবে তাই।”

শুজা রশীদ

কথা সাহিত্যিক, টরন্টো

www.shujarasheed.com