তাসের আড্ডা – ১২

নভেম্বর ৩, ২০১৭

শুজা রশীদ

রুমার শরীরটা ভালো ছিল না, সকাল থেকেই মাথা ধরেছে। কিন্তু তারপরও সে তাসের আড্ডা বন্ধ করল না। জানে ছেলেগুলো সারা সপ্তাহ বসে থাকে এক ঘরে বসে তাস নিয়ে ঘাটাঘাটি করবে আর গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে ঝগড়া ঝাটি করবে তাই। বাঁধা দিলে মন খারাপ করে। কিন্তু সে সাইদকে বার বার সাবধান করে দিয়েছে আজ যেন কোন অবস্থাতেই চীৎকার চেঁচামেচি না হয়। যদি কোন কারণে রুমার মাথা ব্যাথা বাড়ে তাহলে সবার কপালে দুঃখ আছে।

রুমার মেজাজ আছে। সবাই গলা নামিয়ে কথা বলছিল। লাল ভাই দেরীতে এসেছে। তার মেজাজ খারাপ হয়ে ছিল। সে এসেই তেঁতো গলায় বলে উঠল, “কুউবেকের কান্ডটা দেখেছেন? বিল ৬২ পাশ করে দিল! এ তো মুসলমানদের হেনেস্থা করার আরেকটা কায়দা। ফ্রেঞ্চরা হচ্ছে ঝামেলাবাজ। ফ্রান্সে বুরকিনি নিয়ে কি কান্ডটা করল। এখন কুইবেকে বোরখা নিয়ে শুরু করেছে।”

রনি ভ্রু কুঁচকে বলল, “কেন, বিল ৬২ তে খারাপটা কি দেখলেন? সব কিছুরই একটা সীমা থাকা উচিৎ। আমি তো যাদের সাথে কথা বলেছি অধিকাংশেরই ধারণা ইসলামে কোথাও এইরকম পুরো মুখ ঢাকার কোন বিধান নেই। মিশরের আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান অধ্যক্ষ পর্যন্ত বলছেন এটা অনইসলামিক এবং অপ্রয়োজনীয়।”

লাল ভাই মনে হয় এই জাতীয় বিরোধীতার সম্মুখীন হবে আশা করে নি।  তার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। “রনি ভাই, এটা কেমন কথা বললেন? যারা বোরখা পরে মুখ ঢেকে চলাফেরা করে তাদের কি হবে চিন্তা করেছেন?”

রনি নির্বিকার গলায় বলল, “কি আর হবে? তাদেরকে তো আর বোরখা পরতে মানা করা হচ্ছে না। শুধু সরকারী সার্ভিস নেবার সময় মুখ দেখাতে বলা হয়েছে। সবাই তো সেটাই করে। বোরখাধারীরা স্পেশিয়াল কেন হবে? আর সেখানকার সরকারী নিয়ম মেনে না চলতে পারলে কুইবেক ছেড়ে আমাদের ওন্টারিওতে চলে আসুক। আমরা তো আবার সব কিছুতেই খুব দরাজ দিল।  আমাদের জননেত্রী ক্যাথলিন ওয়েন ওন্টারিওর হাইড্রো নিয়ে তেলেসমাতি কান্ড করে ছাবিক্ষশ বিলিয়ন ডলার গচ্চা দিয়ে এখন খুব ইসলামের ঝান্ডাধারী হয়েছেন। ফাজলামী!”

জালাল হাসতে হাসতে বলল, “আপনি তো ক্যাথলিনের উপর বরাবরই ক্ষ্যাপা।”

“আমি একা ক্ষ্যাপা না। ওন্টারিওতে ওর জনপ্রিয়তা মাত্র ১৭% এর মত। কানাডার সব প্রিমিয়ারদের মধ্যে সবচেয়ে অজনপ্রিয়। এখন আবার খুব বিল ৬২ নিয়ে মেতেছে, যেন এই সব নিয়ে মাতামাতি করলে তার সব দোষ মাফ হয়ে যাবে।”

সাইদ বলল, “তার অবস্থাটা বোঝার চেষ্টা কর। সে হচ্ছে নিজে সমকামী, সংখ্যা লঘু। সেই হিসাবে তার তো বোরখাধারীদের সমর্থন করতেই হবে। তাছাড়া গতবার প্রগ্রেসিভ কনজারবেটিভরা যে ভুল করেছিল বিল ঈ – ২৪ নিয়ে, লিবারেলরা সেই ভুল আর করতে চায় না। মনে আছে, জনমতের মূল্য না দিয়ে ভোটে হারল টোরিরা।”

কবীর বলল, “যে কারণে এমনকি কনজারবেটিভ নেতা প্যাট্রিক ব্রাউনও এবার একেবারে কোমর বেঁধে নেমেছে সমর্থন করতে। কিন্তু বেচারা মনে হয় ধরতে পারে নি কি পাকের মধ্যে পড়তে যাচ্ছে। এই কেস আর বিল ঈ – ২৪ এক না। মুসলমানদের মধ্যেই এটা নিয়ে বিশাল দ্বিমত আছে।”

লাল ভাই করুন মুখে বলল, “আমার মা, খালারা সারা জীবন বোরখা পরে মুখ ঢেকে চলাফেরা করেছেন। তারা কি তবে ভুল করলেন? আপনারা কি করে এমন কথা বলতে পারেন?”

জিত বলল, “লাল ভাই, মন খারাপ করবেন না। এই বিল শুধু কোন এক ধর্মকে লক্ষ্য করে নয়, যদিও দেখে সেই রকমই মনে হতে পারে।  কিন্তু কোন একটা জাতী যদি তাদের স্বকীয়তাকে বজায় রাখতে চায় তাহলে তাদেরও তো সেই অধিকার আছে। তাই না?”

“কিন্তু আমাদেরও তো অধিকার আছে,” লাল ভাই বলল।

সাইদ বলল, “নিশ্চয় আছে। আমাদেরও তো চার্টার রাইট আছে স্বাধীনভাবে ধর্ম পালন করবার। সেই অধিকার রক্ষা করবার দায়িত্ব আমাদের ফেডারেল গভর্নমেন্টের। যে কারণে প্রথমে জাস্টিন ট্রুডো চুপ চাপ থাকলেও শেষে জনমতের চাপে মুখ খুলতে বাধ্য হয়েছে।”

রনি বলল, “কিন্তু আদতেই কি ফেডারেল গভর্নমেন্ট এ ব্যাপারে কিছু করতে পারবে? প্রয়োজন হলে কুইবেক কিন্তু চার্টারের সেকশন ৩৩ ইনভোক করতে পারে স্থানীয় নিয়ম নীতিকে সংরক্ষণ করবার জন্য। বেশি ঝামেলা করলে তারা হয়ত শেষ পর্যন্ত সেটারই স্মরনাপন্ন হবে।”

জালালের বাট করার পালা। সে তাস রেখে বলল, “আমি একটা প্রতিবেদন পড়ছিলাম কয়েক দিন আগে। সেখানে বাংলাদেশী কানাডিয়ান প্রফেসর রোখসানা নাজনীন যিনি মন্ট্রিয়লে থাকেন, তিনি কিন্তু জোর দিয়ে বলেছেন এই নিকাব কিংবা বোরখা কোন দেশের রীতিতে নেই। সামান্য যে গুটি কতক মহিলা এখানে সর্বাঙ্গ ঢেকে বোরখা পরেন তারা ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক মূলত কট্টরপন্থীদের ধ্যান ধারনাকে পাশ্চাত্যে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছেন।”

রনি বল্ল, “আমার মতে এটা নারী কিংবা ধর্মীয় স্বাধীনতা নয় বরং স্বেচ্ছায় পরাধীনতার শেকল পরা।”

জিত প্রসঙ্গ ঘোরানোর জন্য বলল, “আচ্ছা, এই আলাপ থাক। আমাদের বাংলাদেশের ক্রিকেট টিম দক্ষিন আফ্রিকায় গিয়ে এইরকম গো হারা কেন হারছে সেটা একটু ব্যাখ্যা করেন তো কেউ। কি ভেবেছিলাম, আর কি হল?”

রনি হতাশ ভঙ্গীতে মাথা দোলাল। “ব্যাখ্যা করার আর কি আছে? তারা বাংলাদেশের চেয়ে অনেক ভালো টিম। বিশেষ করে আমাদের বোলিং তাদের ব্যাটসম্যনদের জন্য মনে হল যেন দুধ ভাত! যাইহোক, আমাদের ছেলেরা তাদের সাধ্যমত খেলেছে। আমি তো ভালো করে ব্যাটই ধরতে পারি না। তারা তো দুনিয়ার শেঠ শেঠ বোলারদের বিরুদ্ধে খেলছে। দেশের মাটিতে তো ভালই করছে। বাইরে গেলে বোধহয় নার্ভাস হয়ে থাকে। কে বলতে পারে কি হয়?”

কবীর হাসতে লাগল। “রনি ভাই মনে হচ্ছে একেবারে হাল ছেড়ে দিয়েছেন। আগে তো একটু খারাপ খেল্লে একেবারে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠতেন।”

সাইদ বলল, “বাংলাদেশের খেলার যে রকম উত্থান পতন হয় তাতে টিমের ফ্যানদের জন্য মাথা ঠিক রাখা সহজ ব্যাপার না। আবেগের দিক দিয়ে চিন্তা করলে তারা একবার পাহাড়ে উঠছে, আরেকবার পাতালে নামছে- টাল সামলানো কঠিন। ভক্তদের ভক্তি কমে গেলে দোষারোপ করা যাবে না। বেশি আশা করে নিরাশ হলে বুক ভেঙে যায়।”

জালাল বলল, “ঠিক বলেছেন। আমি তো এখন ভয়ে আর খেলার খবরই নেই না। এই একটা খেলাতেই আমরা বিশ্ব মানের। সেটাতেও যদি গাড্ডু মারি তাহলে কি করে হবে?”

জিত বলল, “আমরাই বা কানাডায় থেকে বাংলাদেশ – বাংলাদেশ করি কেন?”

রনি হাতের তাসে চোখ রেখে বলল, “কানাডিয়ান বলে কি ক্রিকেটে বাংলাদেশ টিমকে সমর্থন করতে পারি না? তবে কানাডার সাথে বাংলাদেশের খেলা হলে আমি কিন্তু কানাডাকেই সমর্থন করব।”

লাল ভাই বলল, “আমি তখনও বাংলাদেশকেই সমর্থন করব। সারাটা জীবনতো সেখানেই কাটিয়ে এলাম। বাংলাদেশ হচ্ছে মাতৃভূমি।”

রনি বিরক্ত কন্ঠে বলল, “এই তো আপনার সমস্যা। থাকেন এক দেশে আর মন পড়ে থাকে আরেক দেশে।”

জিত হাসতে হাসতে বলল, “আজকে খামাখা আমরা লাল ভাইয়ের উপর পড়েছি।”

জালাল বলল, “লাল ভাই, এই সব কথা বার্তায় কিচ্ছু মনে করবেন না। আমরা ঠাট্টা করছি। আচ্ছা আইনস্টাইনের চিরকুট্টার কথা পড়েছেন? জাপানে ১৯২২ সালে এক রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়ে বেলবয়কে কাগজে লিখে দিয়েছিলেন। তার কাছে টিপস দেবার মত অর্থ ছিল না। দু’টা নোট লিখেছিলেন। একটা বিক্রী হয়েছে ১.৫৬ মিলিয়ন আমেরিকান ডলারে, অন্যটা দুই লাখ ডলারের বেশীতে। প্রথম নোটটাতে যা লেখা ছিল তার সারমর্ম করলে দাঁড়ায় ‘সর্বক্ষণ সাফল্যের পেছনে ছোটাছুটি না করে একটা শান্ত, সমাহিত জীবন যাপন করলে মানুষ অনেক বেশী সুখী হতে পারে’।”

সাইদ বলল, “কালেক্টররা যে কে কত দামে কি কিনবে সেটা আগে থেকে বোঝার কোন উপায় নেই। এমন একটা সাদা মাটা নোট এতো দাম দিয়ে কেনার কি কারণ কে জানে? নিলাম শুরু হয়েছিল মাত্র ২ হাজার আমেরিকান ডলার দিয়ে।”

কবির বলল, “ভ্যান গঘের কথাই ধরুন না। বেঁচে থাকতে তার একটা মাত্র ছবি সে বিক্রী করতে পেরেছিল। আর এখন তার পেয়িন্টিংস মিলিয়ন-মিলিয়ন ডলারে বিক্রী হয়।”

জিত বলল, “আমাদের মধ্যেই কে কখন বিখ্যাত হয়ে যায় কে বলতে পারে। সবার কাছ থেকে একটা করে দস্তখত নিয়ে রাখতে হবে। আচ্ছা আইনস্টাইন রাখেন। একটা জোক পেলাম গতকাল। বলি। দেখি আপনাদের পছন্দ হয় কিনা।

“পিটারের জন্মদিন। কিন্তু তার স্ত্রী, পুত্র, কন্যা কেউ সকালে উঠে তাকে কিছুই বলল না। সে মন খারাপ করে অফিসে গেল। তার সুন্দরী সেক্রেটারী তাকে দেখেই

বলল, ‘শুভ জন্মদিন বস। ’

পিটারের মন কিছুটা ভালো হল।

যাক অন্তত একজন তো মনে রেখেছে। দুপুরে লাঞ্চের সময় সেক্রেটারি বল্ল, ‘বস, আজকে তোমার জন্মদিন উপলক্ষ্যে বাইরে খেতে গেলে কেমন হয়? শুধু আমরা দু জনে।’

পিটার রাজী হয়ে গেল। দু’ জনে একটা রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ করে ফেরার পথে সেক্রেটারী বল্ল, ‘বস, আমার বাসা তো কাছেই। চল তোমাকে কফি খাওয়াবো।’ পিটার একটু দ্বিধা দ্বন্দ্ব করে রাজী হয়ে গেল।

বাসায় গিয়ে পিটারকে লিভিংরুমে বসিয়ে সেক্রেটারী বলল, ‘বস, আমি বেডরুমে গিয়ে কাপড়টা পালটে আসছি।’ পিটারের বুকের মধ্যে ধুকপুক করছে। পরিস্থিতি এই দিকে গড়াবে সে ঠিক ধারণা করে নি। সে ঘামতে ঘামতে বলল, ‘ঠিক আছে।’

দুই মিনিট পরেই সেক্রেটারী বিশাল এক কেক হাতে তার বেডরুম থেকে বেরিয়ে এলো, তার পেছনে পিটারের স্ত্রী, পুত্র, কন্যা। সবাই বাইরে বেরিয়ে এসে একযোগে চীৎকার করে উঠল, ‘সারপ্রাইজ! শুভ জন্মদিন!’

পিটার জামা কাপড় খুলে আন্ডারওয়ার পরে বসে ছিল। সে জমে গেল।”

সুজা রশীদ

কথা সাহিত্যিক, টরন্টো