তাসের আড্ডা – ১১

অক্টোবর ৭, ২০১৭

শুজা রশীদ

লাল ভাই নিজে তাস ফাস না খেল্লেও অন্যের খেলা দেখেই তার এতো আনন্দ যে সে এই শনিবার সাইদের বাসা থেকে তার বাসায় তুলে নিয়ে এলো তাসের আড্ডা। আলেয়া আপত্তি করায় স্ত্রীকে কথা দিতে হয়েছে সমস্ত আয়োজন সে করবে, আলেয়ার কুটোটিও নাড়তে হবে না। বাসা ওলোট পালোট হলেও সে সব গুছিয়ে দেবে। লাল ভাই কাজের মানুষ। আলেয়া জানে। সে আর বাগড়া বাধায় নি, বরং তাসাড়ুদের স্ত্রীদেরকেও আমন্ত্রণ জানিয়ে দিয়েছে। অধিকাংশেরই ছেলে মেয়েরা এখন তাদের টিন এজ ধাপে, তারা কেউই আর কোথাও যেতে চায় না। এক দিক দিয়ে ভালোই হয়। ঝুট ঝামেলা ছাড়াই চুটিয়ে আড্ডা দেয়া যায়। সকলেরই বাচ্চাদের প্রতি মায়া মহব্বত ষোল আনার জায়গায় আঠারো আনা, কিন্তু আর কত? আসবি না? আসিস না।

ড্রয়িংরুমে চেয়ার টেবিল পাতিয়ে রেখেছিল লাল ভাই। চানাচুর মুড়ি মাখিয়ে রেডী। খেতে খেতে খেলা শুরু হল। মেয়েরা ভেতরের ঘরে হৈ চৈ করে কি সব আলাপ করছে। করুক। জ্বালাতে না এলেই হল।

খেলার শূরুতেই জালালের বাটা। বাটতে গিয়ে বার দুয়েক ভুল ভাল করে সে ইস্তফা দিয়ে সাইদের হাতে তাস ধরিয়ে দিয়েছে। “ভাই, মন মেজাজ ভালো নাই। আপনি করেন।”

লাল ভাই তৎক্ষনাত বলল, “ভাই, মাসাজ লাগলে বইলেন। আপনারা আমার অতিথি। যা চাইবেন তাই পাইবেন।”

রনি বলল, “মাসাজ পরে। আগে শুনি জালাল ভাইয়ের সমস্যা কি?”

জালাল মুখে অমাবস্যা নিয়ে বলল, “ভাই, আপনাদের কথা জানি না কিন্তু এই রোহিঙ্গাদের দুরাবস্থা দেখে আমার মন এতো খারাপ হয়েছে যে নিজেকে সারাক্ষণ দোষী মনে হয়। পাঁচ লাখ মানুষ – ছোট ছোট বাচ্চারা – কি অমানবেতর জীবন যাপন করছে। নিজেদের দেশ থেকে লাথি মেরে তাড়িয়ে দিল তাদেরকে আর সারা পৃথিবী চুপচাপ দেখছে। সাইদ ভাই, আপনি তো জ্ঞানী গুনী মানুষ। বলেন তো, এসব কি হচ্ছে?”

সাইদ তাস বাট করতে করতে বলল, “রোহিঙ্গাদেরকে তাড়িয়ে দেবার পরিকল্পনা মায়ানমার সরকারের বহুদিন ধরেই। ১৯৮২ সালে সামরিক জান্তারা যখন ন্যাশানালিটি আইন করে তখন থেকেই এই পরিকল্পনার কার্যকারিতা শুরু হয়।  মায়ানমারের নাগরিক হতে হলে হয় কোন একটা আদিবাসী গ্রুপের সদস্য হতে হবে, নইলে নাগরিকের সন্তান হতে হবে, নতুবা ১৮২৩ সালের আগে থেকে মায়ানমারে বসবাস করছে এমন কারো বংশোদ্ভুত হতে হবে। রোহিঙ্গাদেরকে কোন গ্রুপেই না ফেলে তাদের অধিকাংশকেই বেআইনি বলে সনাক্ত করা হয়। অত্যাচারিত হতে হতে পিঠ ঠেকে গেছে ওদের। ফলে তৈরী হয়েছে ‘আরসা’ – আরাকান রোহিঙ্গা স্যাল্ভেশন আর্মি। এখন মায়ানমারের সরকার তাদের ছুতো ধরে সবাইকে তাড়ানোর একটা সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে গেছে।”

রনি বলল, “আগস্টের পঁচিশ তারিখে ‘আরসা’ পুলিশ স্টেশনে হামলা চালিয়ে দশ-বারো জন পুলিশ এবং একজন আর্মিকে মেরে ছিল। তার পরেই এবারের এই সরকারী হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়। কি লাভ হয়েছে? আমার তো মনে হয় ‘আরসা’ রোহিঙ্গাদের জন্য পরিস্থিতি হাজার গুন খারাপ করে দিয়েছে।”

কবির বলল, “কিন্তু রনি ভাই, বছরের পর বছর ধরে যদি একটা জনগোষ্ঠীকে এতো ছোট করে রাখা হয় যে তাদের সামনে আর কোন পথ খোলা না থাকে তাহলে এমনটা তো হবেই।”

রনি বলল, “কিন্তু ক্ষতিটা কাদের বেশী হল? আমার তো মনে হয় আরসা’র এই জাতীয় আক্রমণ একেবারেই ভেবে চিন্তে করা না। কি ভেবেছিল ওরা? কয়েকজন পুলিশকে মারলে সমস্যা সমাধান হয় যাবে? অর্ধেক মিলিয়ন রোহিঙ্গাদেরকে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে বাংলাদেশে এসে ঠাই নিতে হয়েছে এখন। বুঝলাম বাংলাদেশ সরকার যথাযথ চেষ্টা করে যাচ্ছে তাদের তাৎক্ষনিক প্রয়োজন মেটাতে। কিন্তু এভাবে কত দিন চলবে?”

লাল ভাই বলল, “কেন, ওরা না বলছে রোহিঙ্গাদেরকে ফেরত নেবে?”

রনি মুখ বাকিয়ে বলল, “এভাবেই চলছে কত বছর। এবারই তো প্রথম না। কত জন সত্যি সত্যি ফিরে যেতে চাইবে কিংবা পারবে সেটাই দেখার বিষয়।”

আলাপের ফাঁকে ফাকেই ডাকাডাকি হল। ডাক নিল জালাল। তার হাত ভালো এসেছে। কিন্তু খেলতে গিয়েও সে ভুল করল। গেম হল না। তার পার্টনার জিত। সে হাসতে হাসতে বলল, “নাহ, জালাল ভাইয়ের মন আসলেই খারাপ হয়েছে। সব কিছুই গুলিয়ে যাচ্ছে। ভাই, দুনিয়ায় এরকম চলতেই থাকবে।”

জালাল বলল, “চলতেই থাকবে বলে কি আমরা কিছু করব না?”

“কেন করবেন না?” জিত হাসি মুখে বলল। “আমরা যে যেখানে আছি সেখানকার সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারি রোহিঙ্গাদের সমর্থন করবার জন্য। মায়ানমার সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে। অনেকেই টাকা পয়সা তুলে পাঠাচ্ছে শরনার্থীদেরকে।”

রনি বলল, “এটা বিশাল একটা সমস্যা। সামান্য কিছু টাকা পয়সা পাঠিয়ে কোন কাজ হবে না। সিরিয়াস রাজনৈতিক সমস্যা। ক্ষমতাশালী দেশগুলো যদি প্রত্যক্ষভাবে চাপ সৃষ্টি না করে তাহলে রোহিঙ্গাদের নিপীড়নের কখন শেষ হবে না। মাঝখান দিয়ে বাংলাদেশ পড়বে সমস্যায়। ইতিমধ্যেই কথা উঠেছে বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গারা আরসা-তে যোগ দিচ্ছে। দেবে না? করবে টা কি? কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের জন্য আরেকটা রাজনৈতিক সমস্যা তৈরী করবে সেটা। বিরাট একটা ঝামেলা পাকিয়ে উঠছে।”

লাল ভাই বলল, “আমার তো মনে হয় কেউ ফিরবে না। শেষ পর্যন্ত সব বাংলাদেশেই থেকে যাবে। এই মায়ানমারের সরকার অনেক বজ্জাত। এরা শুধু সবাইকে ঠান্ডা করবার জন্য বলছে ফিরিয়ে নেবে। এদেরকে বিশ্বাস করা যায় না।”

এক পর্যায়ে রোহিঙ্গাদের নিয়ে আলাপে ক্ষান্তি আসে। ওরা সবাই জানে এই সমস্যার সমাধান সহজ নয়। কয়েক হাত নীরবে খেলা হল। কবির রনিকে ক্ষেপানোর জন্য গাজার প্রসঙ্গ তুলল। “রনি ভাই, জাস্টিন ট্রুডো তো গাঞ্জা লিগাল করেই দিল। আগামী বছর প্য়লা জুলাই আমরা একটা গাজার পার্টি বসাই চলেন। ভাবীদেরকেও আমন্ত্রণ জানানো হবে। এক সার্ভেতে জানা গেছে গাঞ্জা দোকানে পাওয়া যাবে শুনে এখন ৫০ ভাগ কানাডিয়ানদের একটু টানার বাসনা হয়েছে।”

বেলা এবং রুমা তাদের হই চইয়ের মধ্যেও ঠিকই শুনল। তারা এক যোগে ধমকে উঠল, “কোন নেশা ফেসা চলবে না।”

বেলা বলল, “এতো সেবনের ইচ্ছে হলে নাংগা সন্ন্যাসী হয়ে বটতলায় গিয়ে বসে বসে দিন ভর টানো গিয়ে।”

ছেলেরা হা হা করে হাসল মন খুলে। রনি বলল, “ভেবো না। তোমাদেরকে নিয়েই টানবো।”

কিছুক্ষণ তাই নিয়ে দুই পক্ষে খোচাখুচি চলল। সেটা থামতে সাইদ বলল, “ঐসব গাজা ফাজা রাখো। বাংলাদেশে যেমন ইয়াবার কারসাজী চলছে, এখানে এখন চলছে ফেন্টানিল। প্রায় প্রতিদিন মানুষ মরছে এই জিনিষ খেয়ে। ২০১৬ তে নাকি প্রায় তিন হাজার মানুষ মরেছে এই বস্তু সেবন করে।”

জালাল বলল, “আমিও কয়েক দিন ধরে শুনছি। কি এটা?”

সাইদ বলল, “এক ধরণের ব্যাথা নাশক ওষুধ। মরফিনের চেয়ে অনেক বেশী শক্তিশালী। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এটা বেয়াইনীভাবে মাদক দ্রব্য হিসাবে বিক্রি হয়। এখন আবার এর সাথে হেরোইন মিশিয়ে বিক্রী করা হয়। ডোজ বেশী হয়ে মারা যাচ্ছে নেশগ্রস্থরা। আর এই বেআইনি চালান আসছে চীন থেকে। সাধারণ খামের মধ্যে ভরে সেখান থেকে ক্রেতার ঠিকানায় পাঠিয়ে দিচ্ছে। ‘ডার্ক ওয়েব’ এ গিয়ে অর্ডার দেয়া যায়।”

লাল ভাই বলল, “ডার্ক ওয়েবটা আবার কি?”

কবির বলল, “আমাদের ওয়েবের আরেকটা অংশ। কিন্তু ঐ সাইটগুলোতে সবাই যেতে পারে না। বিশেষ পারমিশন লাগে। সাদা বাংলায় চোরাই ওয়েব সাইট।”

রনি বলল, “চীনের মানুষ জন যেমন স্মার্ট তেমনই হারামী। যত ভগি যগি সব এরাই বের করে। ভুয়া প্লাস্টিকের চাল, ভুয়া আস্ত ডিম এমন আরোও কত কি কারখানায় বসে বসে বানিয়ে গোপনে বাজারে ছাড়ছে। দেখে বুঝবেনও না। এখন কানাডায় এই বিষ ছড়াচ্ছে!”

জিত বলল, “জীবন কত প্রিয় আমাদের কাছে।  আর এই নেশাখোররা কিভাবে আকারণে নিজেদের জীবন বিসর্জন দিচ্ছে। ভাবলেই মনটা খারাপ হয়ে যায়।”

সাইদ বলল, “আর বেশী মন খারাপ করতে হবে না। আমারিকার ট্রাম্প পাগলা আর উত্তর কোরিয়ার কিম জং-আনের মধ্যে যে রকম রশি টানাটানি চলছে, তাতে যদি মিসাইল ছোড়াছুড়ি শুরু হয় তাহলে নিজেদের জীবন নিয়েই টানাটানি পড়ে যাবে।”

জালাল বলল, “কেন, আমাদের সাথে তো উত্তর কোরিয়ার কিছু হয় নাই। আমাদেরকে কেন বোমা মারবে?”

রনি বলল, “মারতে হবে না। ব্যাটাদের মিসাইল কোন মুল্লুকে গিয়ে পড়বে তার কোন ঠিক ঠিকানা আছে মনে হয়? হোয়াইট হাউজে মারতে গিয়ে দেখা যাবে আমার মাথায় ফেলে দিয়েছে। উল্লুক্কা পাঠঠা কি যে বানাচ্ছে ওখানে, ওই জানে। বড় সমস্যা হচ্ছে আমাদের কোন এন্টাই মিসাইল ব্যবস্থা নেই। আমেরিকার এন্টাই মিসাইল প্রোগ্রামেও আমরা যোগ দেই নি।”

কবির বলল, “মিসাইল যদি সত্যি সত্যিই কখন ছোড়াছুড়ি শুরু হয় তাহলে কি আর আমেরিকা একটা ছেড়ে আরেকটাকে ফেলাবে? কোনটা ঠিক কোথায় পড়বে, ওরাই বা নিশ্চিত হয়ে জানছে কি করে?”

জিত হাসতে হাসতে বলল, “সেটাই আমাদের ভরসা। আচ্ছা, কিম আর ট্রাম্পের কথাই যখন উঠল তখন একটা জোক বলি। এক সংবাদ সম্মেলনে কিম জং-আন ঘোষণা দিল যে উত্তর কোরিয়া আগামী দশ বছরের মধ্যে সূর্যে মানুষ পাঠাবে।

একজন রিপোর্টার বলল, ‘স্যার, কিন্তু সূর্যে তো ভীষণ গরম। সেখানে মানুষ নামবে কি করে?’

কিছুক্ষণের পীড়াদায়ক নীরবতার পর কিম শান্ত কন্ঠে বলল, ‘আমরা রাতে ল্যান্ড করব।’

এই কথা শূনে উপস্থিত সবাই করতালিতে ফেটে পড়ল।

হোয়াইট হাউজে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার দল বল নিয়ে টেলিভিশনে কিমের সংবাদ সম্মেলন দেখছে। কিমের শেষ কথাটা শুনে ট্রাম্প মুখ বাকিয়ে বলল, ‘কত বড় গর্দভ ব্যাটা! আরে, রাতে কি সূর্য থাকে!’

শুজা রশীদ, কথা সাহিত্যিক

টরন্টো