তাসের আড্ডা

ডিসেম্বর ১০, ২০১৬

শুজা রশীদ

দরজা খুলে কবিরকে দেখেই রুমা চোখ ছোট ছোট করে ফেলল। “আজ শনিবার নাকি? এতো তাড়াতাড়ি সময় চলে যায়!”
রুমা সাইদ ভাইয়ের স্ত্রী। সম্পর্কে বড় ভাবী। রক্তের সম্পর্ক নয় কিন্তু দীর্ঘদিন মেলামেশার পর এখন আত্মীয়স্বজনের মতই হয়ে গেছে। রুমা তার বড় ভাবীগিরি ফলাতে কখন পিছপা হয় না। দরজা থেকে সরে দাঁড়িয়ে কবিরকে বেসমেন্টে যাবার পথ করে দিল সে। “যাও। ভালো তাসের আড্ডা বসিয়েছ তোমরা। নীচে গিয়ে তোমার সাইদ ভাইকে বলবে আজকে কোন চা নাস্তা হবে না। খেতে চাইলে নিজে এসে বানিয়ে নিয়ে যায় যেন।”
কবির মিষ্টি এক টুকরা হাসি দিয়ে তর তর করে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে যায়। রুমা ভাবীকে ক্ষেপানোর চেয়ে খারাপ আর কিছু হতে পারে না। প্রতি শনিবার রাতে তাদের যে তাসের আড্ডা বসে সাইদ ভাইয়ের বাসায়, তিনি ক্ষেপে গেলে তার বারোটা বাজবে। আড্ডায় যারা আসে তারা সবাই এই ধ্রুব সত্যটা জানে এবং সবাই অসম্ভব সতর্কতার সাথে রুমা ভাবীর সাথে আলাপ করে থাকে। কোন কথায় তার মন ক্ষুন্ন হবে কে বলতে পারে? সাইদ ভাই বলেন, বোবার শত্রু নাই। কথা যত কম বলতে পারো তত ভালো। অবশ্য তিনি নিজে স্ত্রীর অনুপস্থিতিতে একেবারে বাক্যবাগিশ বনে যান। তাকে ছাড়া তাসের আড্ডা জমে না। প্রধানত সেই কারণেই তার বাসাতেই আড্ডার সুত্রপাত।
কবিরকে দেখে হৈ চৈ করে উঠল জালাল। “আরে কবির মিয়া, তুমি আজকে এতো দেরী করলা ক্যান? তোমার সাথে না খেল্লে তো আমি জিততে পারি না।”
সাইদের বেসমেন্ট ফিনিশড। একটা রুম, বাথরুম সহ মাঝারী আকারের একটা লিভিংরুম। সেখানেই চৌকোনা টেবিল পেতে চারদিকে গদিমোড়া চেয়ার বসিয়ে তাদের সাপ্তাহিক তাসের আড্ডা চলে। পাঁচ ছয়জন নিয়মিত আসেন। মাঝে মাঝে তাদের দু’ একজন তাসাড়ু বন্ধু বান্ধব আগ্রহী হয়ে যোগ দেন। এই গ্রুপে কবির সবার ছোট। চল্লি­শ হলেও এখানে এলে নিজেকে তার বালক বালক মনে হয়। সাইদ ষাটের কাছাকাছি। জালাল মাঝ পঞ্চাশ। রনি নিয়মিত খেলোয়াড়দের একজন- পঞ্চাশ। জিত সাইদের প্রতিবেশি। সে পঞ্চাশের মত। আর আছে লাল ভাই। সেও এই এলাকাতেই থাকে। তার বয়েস জিজ্ঞেস করলে সে নানা টাল বাহানা করে কিন্তু সবাই মোটামুটিভাবে ধরেই নিয়েছে মাঝ পঞ্চাশের নিচে হবে না। লাল ভাই আসে আড্ডা দিতে। তার ভাষ্য অনুযায়ী সে সারা জীবনে তাস ছুঁয়ে দেখেনি।
সাধারণত সাইদ আর রনি একদলে খেলে, জালাল আর জিত বিপরীতে। চারজনের বেশী হলে কিছুক্ষণ পর পর পার্টনার পালটিয়ে সবাইকে খেলার সুযোগ দেয়া হয়। তারা অকশন ব্রিজ খেলে। কবির চেষ্টা করেছে কন্ট্রাক্ট ব্রিজ চালু করার কিন্তু জালাল এবং জিত অকশন ব্রিজেই বেশি স্বস্তি বোধ করে। তাদেরকে শেখানোর চেষ্টা করে ব্যার্থ হয়ে বাকীরা অকশন ব্রিজেই আটকে গেছে। যেহেতু খেলা এবং গাল গল্প দুটোই উদ্দ্যেশ্য, সেহেতু কেউ কি খেলা হচ্ছে সেটা নিয়ে তত মাথা ঘামায় না।
সাইদ কবিরকে লক্ষ্য করে বলল, “ট্রাফিক ছিল নাকি?”
কবির পিকারিং থাকে। সেখান থেকে ড্রাইভ করে স্কারবোরতে সাইদের বাসায় তাস খেলতে আসে। মিনিট পঁচিশের ড্রাইভ কিন্তু মাঝে মাঝে ভীড়ে পড়ে যেতে হয়।
সে মাথা নেড়ে বলল, “না, সাইদ ভাই। বাসায় একটু কাজ ছিল। কারা জিতছে আজকে?”

লাল ভাই তার স্বভাব সুলভ রসিকতা করে বলল, “আমেরিকায় জিতল ট্রাম্প, আর এখানে আজকে জিতছে জালাল ভাই।”
জালাল ছদ্ম রাগ দেখিয়ে বলল, “আমারে আপনি ঐ বেক্কলটার সাথে এক গ্রুপে ফালাইয়া দিলেন? আমি কি জিতি না?”
কবির বিশাল একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বলল, “আমেরিকার ইলেকশনের আলাপ উঠলেও ভাই আমার বুক ফেটে যায়। ছিঃ ছিঃ! আমেরিকানদের কি মাথায় বুদ্ধি সুদ্ধি কিছু নাই? এইরকম একটা লম্পটকে তারা কি মনে করে ভোটে পাশ করিয়ে দিল?”
রনি আমেরিকার ভোটের আগে ভয়ানক ট্রাম্প বিরোধি ছিল। সে তিক্ত হাসি দিয়ে মাথা নেড়ে বলল, “এটা তো ভোট হয় নাই। হয়েছে আমেরিকার শ্বেতাংগদের মর্যাদার লড়াই। ইমিগ্রানটদের সাথে প্রতিযোগিতায় হারতে হারতে বেচারীদের আর যাবার জায়গা নাই। এবার তারা জোট বেধেছে হোয়াইট সুপ্রিমেসি দেখানোর জন্য। কিন্তু এই সব ভগি যগি করে কোন লাভ হবে না। ট্রাম্প তো ভোট পাবার জন্য যা ইচ্ছা তাই বলে বসে আছে। করার সময় দেখা যাবে কি আন্ডাটা করে। দেশটাকে ডোবাবে শালা!”
সাইদ বলল, “মানছি, ব্যাটা একটা লম্পট। বাপের টাকায় ব্যবসা শুরু করেছিল, ব্যাঙ্করাপ্সি করে বড়লোক হয়েছে, কারো প্রতি কোন সম্মান বোধ নেই। কিন্তু তার পরও সে জিতেছে কারণ হিলারিও কিন্তু খুব একটা সাধু নয়। ওর ইমেইল সমস্যা, ক্লিন্টন ফউন্ডেশনে প্রশ্নব্যঞ্জক ডোনেশান নেয়া ছাড়াও সে বরাবরই ওয়াল স্ট্রিটের কোটিপতিদের সাথে হাত মিলিয়ে চলেছে। এইবারের ভোটে সাধারণ মানুষ একটু ভিন্ন কিছু চেয়েছে। সেটা সে দিতে পারে নি। বার্নি স্যান্ডার্স হয়ত জিততে পারত ট্রাম্পের বিরুদ্ধে।”
রনি মুখ বাকিয়ে বলল, “তার সমর্থকরাই তো এই হারার জন্য দায়ী। তারা দল বেঁধে ভোট দিয়েছে থার্ড পার্টিকে। এর কোন মানে আছে? এখন চার বছর ধরে এই হনুমানটাকে দেখতে হবে। মুখটা কেমন করে রাখে দেখেছেন? তাকালেই আমার শরীর জ্বলতে থাকে।”
লাল ভাই ধার্মিক মানুষ। সে বলল, “কত বড় বদমায়েশ। বলে মুসিøমদের আসা বন্ধ করে দেবে। আল্ল­াহর গজব পড়বে তোর উপর। টিকতে পারবে না। আমি বলে রাখলাম।”
জিত এতক্ষন চুপচাপ শুনছিল। সে বলল, “আমি সাইদ ভাইকে মাত্র বলছিলাম, ট্রাম্পকে তো অধিকাংশ রিপাব্লিকানরাই চায় নি। সে যদি বেশী বাড়াবাড়ি করার চেষ্টা করে তাহলে তারাই হয়ত তাকে ইম্পিচ করে পেন্সকে বসাবে। অন্তত পক্ষে প্রফেসর এলান লিক্টম্যান সেই রকমই ভবিষ্যতবানী করেছে। সে বলছে, মানুষ ঝট করে বদলায় না। ট্রাম্প সারা জীবন হুড়াহুড়ি করে কাজ করেছে এবং আইন কানুন যতখানি সম্ভব এড়িয়ে চলবার চেষ্টা করেছে। প্রেসিডেন্ট হবার পর বেশী লাফ ঝাপ শুরু করলে কত ধানে কত চাল টের পাবে।”
রনি বিরক্ত কন্ঠে বলল, “ব্যাটা একটা বাক্য ভালো করে বলতে পারে না, খুব প্রেসিডেন্ট হয়েছে। মনটা ভাই এখনও খারাপ হয়ে আছে আমার।”
জালাল হেসে ফেলল। “আরে রনি ভাই, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নিয়ে আপনার এতো মাথা ব্যাথা কেন? ওরা গরু ছাগল যাকে ইচ্ছা পাশ করাক না। আমাদের কি? আমরাতো কানাডায়। যদিও সে নাফটা এবং টিপিপি নিয়ে টানাটানি করবে বলেছে, কিন্তু আমার মনে হয় না করবে।”
সাইদ চিন্তিত ভাবে মাথা দোলাল। “বলা যায় না। হয়ত নাফটা ভেঙ্গে দিয়ে কানাডা এবং মেক্সিকোর সাথে আলাদা আলাদা কন্ট্রাক্ট করবে। আমাদের সাথে তো বিশাল ব্যাবসা। প্রতিদিন মনে হয় এক বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি আমদানি-রফতানি হয়। ঝট করে কিছু করা খুব বিপদজনক। ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপও টিকবে কিনা সন্দেহ আছে।”
জালালের এবার হাত ভালো পড়েছে। সে আলাপ বন্ধ করে খেলাটা চালু করবার চেষ্টা করল। “সাইদ ভাই, আপনার কল। আমাদের একটা গেম আছে। এবার এটা গেম হয়ে যাবে। বোনাস পাবো। আমদানি-রফতানির আলাপে একটু পরে আসছি।”
রনি চোখ গোল গোল করে তাকাল। “জালাল ভাই, আপনার পার্টনারকে হাতটা একেবারে দেখিয়েই দেন। গেম হবে বলে দিলে আর বলার বাকী থাকে কি?”
জিত হেসে ফেলল। “আরে, জালাল ভাইয়ের কথা রাখেন, দাদা। উনি দশ পয়েন্টের হাত নিয়েও একই কথা বলেন। পরে দেখা যায় শর্ট খেয়ে ভর্তা হয়ে যাচ্ছেন।”
জালাল হাসতে হাসতে বলল, “বারে বারে কি ঘুঘু ধান খায় না।”
সাইদ মুচকি হেসে পাশ দিলেন। “ঠিক আছে, এবার তোমরাই ডাকো। আমাদের মনে হয় না কোন কল হবে।”
জালাল এক নো ট্রাম্প ডেকে কল নিয়ে নিল। আর কেউ ডাকল না। জিত হাত টেবিলে সাজিয়ে দিয়ে বল্ল, “ট্রাম্প যে কি করবে সেটা এখনও কিছু বলা যাচ্ছে না। ভালো যে আমাদের ট্রুডো বাবু খুব সাবধানে কথা বার্তা বলেছে। অন্তত পক্ষে তার সাথে কোন ব্যাক্তিগত শত্রুতা তৈরী হয় নি ট্রাম্পের।”
সাইদ বলল, “কিছু যে করবে না, সেটা হলপ করে বলা যায় না। আমাদের লাম্বার ইন্ডাস্ট্রি বিলিয়ন ডলারের ইন্ডাস্ট্রি। আমাদের তেলও অধিকাংশই যায় আমেরিকাতে। অবশ্য কিস্টোন পাইপলাইন হয়ত অনুমোদন পাবে। সেটা আমাদের
জন্য ভালো। কিন্তু আবার আমেরিকাতেই হয়ত এতো শেল তেল তোলা হবে যে আমাদের তেলের বাজারও সেখানে ছোট হয়ে যেতে পারে। অনেক রকমের সম্ভাবনা আছে। দেখা যাক, পানি কোন দিকে গড়ায়।”
জালাল দ্রুত খেলছে। বোঝা যাচ্ছে হাত অসম্ভব ভালো। তাকে বিশেষ চিন্তা করতে হচ্ছে না। সে হঠাৎ বলল, “প্রফেসর ইউনুসের কথা ভেবে আমার একটু খারাপ লাগছে। হিলারি জিতলে তার বেশ সুবিধা হত। সরকার তাকে যেভাবে হেনেস্থা করে যাচ্ছে তাতে বেচারীর নাভিশ্বাস ওঠার মত অবস্থা। ক্লিন্টনরা তার বড় বন্ধু। ক্ষমতায় এলে নিশ্চয় একটা সুরাহা করত।”
সাইদ বলল, “উনি ভালোই আছেন। গ্রামীন ব্যাঙ্ক আমেরিকা নিয়ে ব্যাস্ত আছেন। আর আমাদের সরকারের কথা বলছ? হাসিনা তো লম্ফ ঝম্প দিয়ে ট্রাম্পকে শুধু কংগ্রাচুলেশনই দেননি, একেবারে আমন্ত্রণ জানিয়ে বসে আছেন। বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট করেন নি।”
জালাল বলল, “হাসিনা কাজটা ঠিকই করেছেন। বাংলাদেশের জন্য হিলারিই বা কি আর ট্রাম্পই বা কি। তাই না? প্রফেসর ইউইনুস অযথা আর্মির সাথে হাত মিলিয়ে রাজনীতিতে নেমে একেবারে মান ইজ্জত খুইয়েছেন। বেচারা!”
সাইদ বলল, “ভালো কথা তুলেছ। হিলারি তার ফাউন্ডেশনের জন্য ইউনুসের কাছ থেকে পর্যন্ত মিলিয়ন ডলারের উপর নিয়েছে। ফাউন্ডেশন অনেক ভালো ভালো কাজ করে, কিন্তু যারা সেখানে অবারিতভাবে টাকা ঢেলেছে, তাদের কোন উদ্দেশ্য নেই সেটা বিশ্বাস করা কষ্ট। মানুষ এগুলো লক্ষ্য করেছে। ওই ইমেইল আর ফাউন্ডেশনই ডুবিয়েছে হিলারিকে।”
জালাল বলল, “বলেন কি? প্রফেসর ইউনুসের কাছ থেকেও ক্লিনটনরা ডোনেশন নিয়েছে?”
“তারা তাকে সমর্থন করছে, কিছু একটা দিয়ে তাদের ঋন তো শোধ করতে হবে, নাকি?”
জিত বলল, “একজন নোবেল বিজয়ী মানুষ। কেমন অপমানটাই না হল? কি দরকার ছিল রাজনীতিতে নামার?”
রনি বলল, “এক আলাপ থেকে আরেক আলাপে চলে যাচ্ছি, কিন্তু না বলে পারছি না। গরীব মানুষকে ২০-২৫% সুদে ঋন দেয়া, সেই ঋন শোধ করতে না পারলে জানাজা পর্যন্ত পড়তে না দেয়া, ঘরের জিনিষপত্র নিয়ে যাওয়া – কেচো খুড়তে সাপ বেরিয়ে আসছিল।”
কবির বলল, “কিন্তু রনি ভাই, ঐরকম না করলে তো সে একটা টাকাও তুলতে পারত না। গ্রামীন ব্যাঙ্ক কি ভাবে চলত? প্রায় এক কোটি মানুষ, অধিকাংশই মহিলারা, ঋন নিয়ে নানা ধরণের ছোট ছোট ব্যবসা করছে, কত মানুষের কাজ হয়েছে, সেই সবের হিসাব রাখেন?”
“জানি, কিন্তু গরীব মানুষের কি সত্যিকারের কোন উপকার হচ্ছে?”
“নিশ্চয় কিছু উপকার হচ্ছে নইলে সারা পৃথিবীতে মাইক্রোক্রেডিট এবং মাইক্রোফাইন্যান্সের এমন জয় জয়কার কেন হবে?”
জালাল পাঁচ কার্ড বাকী থাকতেই হাত ফেলে দিল। “সব আমার।”
সাইদ এবং রনিও হাত ফেলে দিল। “যাও, সব নিয়ে যাও।” সাইদ বলল। “আমার হাতে দুই পয়েন্ট ছিল। তোমাদের হাতেই তো তেত্রিশ পয়েন্ট। আরো আগেই কেন হাত ফেলে দাও নি?”
জালাল বিশাল একটা গেম দিয়ে আত্মতৃপ্তি বোধ করছে। হাসি ঢাকার চেষ্টা করল না সে। “সাবধানের মার নেই, বোঝেন না? একটা ফিনেস করতে হয়েছে নইলে লিটিল সø­াম হয়ে যেত। এই যে দাদা, পয়েন্টগুলো ভালো করে লেখেন। কোন ভাবে আরেকটা গেম করতে পারলে অনেক এগিয়ে যাব।”
জিত পয়েন্ট লিখতে লিখতে বলল, “এখনই এগিয়ে আছি। আজকে সাইদ ভাই আর রনি ভাইকে নাকানি চুবানি খাইয়ে ছাড়ছি!”
কবির আলাপের মোড় ঘুরিয়ে বলল, “ট্রাম্প কি মনে হয় ভোটের সময় যা যা বলেছে, সব করার চেষ্টা করবে?”
সাইদ মাথা নাড়ল। “আরে না। ও কি গাধা? ভোট নেবার জন্য গাধার পালকে এটা সেটা বলে বুঝিয়ে দিয়েছে। তাই বলে সব অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে হবে নাকি? তবে হ্যাঁ, কিছু কিছু হয়ত করবার চেষ্টা করবে। মেক্সিকোর সীমান্তে বেড়া ফেড়া খানিকটা হয়ত দেবে। পাসপোর্ট, ভিসা দেবার ব্যবস্থায় কিছুটা পরিবর্তন হতে পারে। কিছু মুসলিমদের হয়ত খানিকটা হেনেস্থা হতে পারে। কিন্তু বিরাট কিছু হবে বলে মনে হয় না।”
জিত বলল, “ঐ জোকটা শুনেছেন তো? পৃথিবীর সব বড় বড় নেতারা এক আস্তাবলে জড় হয়েছে। আস্তাবলের ভেতরে রয়েছে অনেক গাধা আর একটা ঘোড়া। নেতাদের কাজ হচ্ছে ভেতরে গিয়ে ঘোড়াটাকে খুঁজে বের করা। কেউ পারল না। হিলারিও না। সবশেষে গেল ট্রাম্প। মুহুর্ত পরেই সে ঘোড়া নিয়ে বেরিয়ে এল। তাকে যখন প্রশ্ন করা হল সে হেসে বলল, “আমি ভেতরে গিয়ে বললাম – আমেরিকাকে আমি আবার গ্রেট বানিয়ে দেব। আমার কথা শুনে সবাই হাত তালি দিল শুধু এই ব্যাটা দেয় নি।”
সবাই হাসল। রনি বলল, “ব্যাটারা আসলেই গাধার দল। এমনকি কালোরা পর্যন্ত ১০% কম ভোট দিয়েছে এবার। হিস্পানিকরাও অনেককেই ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছে। এবার যখন যাঁতা দিয়ে পিষবে তখন টের পাবে।”
জিত তাস বাট করতে করতে বলল, “কালোরা কেন ভোট দিল না? ওবামাকে যেভাবে ভোট দিয়েছিল, সেই রকম ভোট দিলে তো হিলারি নির্ঘাত জিতে যেত।”
রনি শ্রাগ করল। “কে জানে। হয়ত ভেবেছে যেই আসুক তাদের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হবে না। ‘ব্ল­্যাক লাইফ ম্যাটার’ করে দুনিয়া অন্ধকার করে দিল আর ভোট দেবার সময় খুঁজে পাওয়া যায় না। আজব!”
রুমাকে সিড়ির গোড়ায় দেখা গেল। “কি, চা টা কিছু দেব নাকি?”
কবির বলল, “ভাবী, আপনি না বললেন কিচ্ছু দেবেন না।”
সাইদ হাসল। “তার বাসায় এসে তোমরা চা না খেয়ে যাবে সেতো হতে পারে না।”
রুমা মুখ ঝামটা দিল, “থাক, আর তেলাতে হবে না। একজন এসে নিয়ে যাও।”
কবির তার পিছু পিছু গেল। এই জাতীয় ফুট ফরমাস তাকেই করতে হয়। লাল ভাইও তার পিছু পিছু এলো। সে উপস্থিত থাকলে সাধারণত আর কাউকে কিছু করবার সুযোগ দেয় না। পরহিতকর কাজে তার চেয়ে আগ্রহী বোধহয় আর কেউ নেই। রুমা শুধু চা নয়, বেশ কিছু খাবার দাবারও ধরিয়ে দিল। মুড়ি চানাচুর মাখা থেকে শুরু করে লাড্ডু পর্যন্ত। তারা দু’জন যখন নীচে ফিরে এলো ততক্ষণে জালালরা আরেকটা গেম দিয়ে বোনাস নিয়ে ফেলেছে। জালালের মুখের হাসি আর ফুরায় না। সে কবিরকে তার সদ্য শেষ হওয়া গেমের বিস্তারিত বর্ণনা দেয়া শুরু করল।
“ধুর, কোন কার্ডই আসছে না,” রনি টেবিলের অন্য দিক থেকে বিরক্ত কন্ঠে বলল। “ট্রাম্প ব্যাটা জেতার পর থেকে আমার কার্ড আসাও বন্ধ হয়ে গেছে।”
সাইদ প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বলল, “আরে, তুমি সামান্য কার্ড নয়ে মাথা ঘামাচ্ছ, ইন্ডিয়ায় যে মানুষের কোটি কোটি টাকা কাগজ হয়ে গেল, তাদের মনের মধ্যে কি হচ্ছে ভেবে দেখেছ? মোদি একটা জব্বর কাজ করেছে!”
সবাই বুঝল সাইদ ইন্ডিয়ার পাচশ এবং এক হাজার টাকার নোট বাতিল করবার কথা বলছে।
জালাল কৌতুহলি হয়ে বলল, “যাদের কাছে অনেক নোট আছে, ওরা কি করবে?”
“কি আর করবে? যদি বদমায়েশির টাকা হয় তাহলে চেপে যাবে। কে যাবে স্টেটমেন্ট দিতে। তবে সব টাকা তো আর মার যাব না। কিছু টাকার তো হিসাব দিতে পারবে।”
কবির বলল, “শুনলাম অনেকেই নাকি চুরির টাকা গরীবদেরকে ঋণ হিসাবে দিচ্ছে। ব্যাঙ্কে গিয়ে নোট পালটে আনার পর অর্ধেকটা ফেরত দিতে হবে।”
“যার কাছে কোটি কোটি চোরাই টাকা আছে, ঐ সব করে তার পোষাবে না,” সাইদ বলল। “ঐ টাকা গার্বেজে ফেলে দেয়া ছাড়া তার আর কোন উপায় নেই। চমৎকার উদ্যোগ। আমাদের দেশেও বার দুয়েক করা হয়েছিল। আমার তো ভয় হচ্ছে মোদিকে আবার মেরে টেরে ফেলে কিনা। অনেকের সাংঘাতিক আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।”
সাইদের তাস বাটার পালা। সে বাটতে ব্যাস্ত হয়ে গেল। রনি বলল, “ভালো করে বাটেন তো। বার বার খারাপ কার্ড কেন আসবে?”
জিত ঘড়ি দেখল। “আমাকে আধ ঘন্টার মধ্যে যেতে হবে। আপনাদের বউদি নইলে আমার ঘাড় ভাঙবে। তার নাকি শীতকালে একা একা বাসায় থাকতে খারাপ লাগে।”
“একা কেন হবে? বাচ্চারা কোথায়?” লাল ভাই নীরবতা ভাঙল।
“তারা তো টিন এজার। হয় ল্যাপটপে নয়ত সেল ফোনে খেলা করছে। বাবা মায়ের
সাথে কাটানোর মত তাদের সময় আছে? বাচ্চারা যতই বড় হচ্ছে, প্রমিলা যেন ততই একাকী হয়ে যাচ্ছে।”
সাইদ বলল, “আরে, সাথে করে নিয়ে আসবে। কত দিন তো বলেছি।”
“আনতে চাইলেই কি আর আসে। আমরা তো চল বললেই পা বাড়িয়ে দেই। মেয়েরা দশট জিনিষ চিন্তা করে। যাবো? যাওয়া ঠিক হবে? রুমা ভাবী কি ভাব্বে? মাথায় এতো চিন্তা নিয়ে তারা যে কি করে ঘুমায়?”
রনি হা হা করে হাসল। “দাদা, একেবারে ঠিক কথা বলেছেন। আমার বৌটাকেও আমি আনতে চাই। ছেলে মেয়েরা তো আর অত ছোট নয় যে বাসায় একা রেখে আসা যাবে না। কিন্তু এক হাজার একটা চিন্তা করে।”
সাইদ গলা নামিয়ে বলল, “এই জন্যেই তারা হল গৃহ কর্ত্রি আর আমরা হলাম কামের ব্যাটা।”
বেশ একটা হাসির হল্লা উঠল। জালাল হাসি থামিয়ে বলল, “গাল গল্প রেখে খেলায় মনযোগ দেয়া যাক। তের ডিল খেলা হতে এখনও ছয় ডিল বাকী। আধা ঘন্টায় হয়ে যাবে। রনি ভাই, ডিল করেন। কবির, আমার জায়গায় খেল কিছুক্ষন।”
কবির আপত্তি করল না। রনি বাট করছে। জিত বলল, “একটা জোক বলি। ট্রেন স্টেশনে অনেক মানুষ ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছে। হঠাৎ ঘোষনা দেয়া হল, একটা ট্রেন লাইনচ্যুত হয়ে প্ল­াটফর্মের উপর উঠে আসবে। এই খবর শুনে প্ল­াটফর্মের উপর দাঁড়িয়ে থাকা সব প্যাসেনজাররা ট্রেন লাইনের উপর গিয়ে দাঁড়াল। দুর্ভাগ্যবশতঃ ট্রেন শেষ পর্যন্ত প্ল­াটফরমে উঠল না এবং লাইনের উপর দাঁড়িয়ে থাকা সবাইকে চাঁপা দিল। পরে দেখা গেল একজন লোক প্ল­াটফর্মের উপর দাঁড়িয়ে আছে, যে বেঁচে গেছে। তাকে যখন জিজ্ঞেস করা হল সে কি করে বুঝল ট্রেন প্লাটফর্মে উঠবে না, সে ব্যাজার মুখে বলল, “আমি তো ট্রেন লাইনের উপরেই দাড়িয়েছিলাম, আত্মহত্যা করব বলে। যখন শুনলাম ট্রেন প্ল­াটফর্মে উঠে যাবে তখন সবাই নীচে নামে আর আমি উপরে উঠে আসি, যাতে ট্রেনের নীচে চাঁপা পড়তে পারি। কপালটাই খারাপ।”
(চলবে)

শুজা রশীদ
গল্পকার ও ঔপন্যাসিক
টরন্টো