ট্রাম্পের প্রভাবেই কি কানাডায়ও বিদ্বেষী বা ঘৃণাজনিত অপরাধের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে?
জুলাই ৮, ২০১৭
॥ খুরশিদ আলম ॥
কানাডায় যে কোন একটি ক্লিনিকে বা হাসপাতালে গিয়ে কেউ যদি চিৎকার করে দাবি করেন এই বলে যে, আমি একজন শ্বেতাঙ্গ ডাক্তারকে চাই। গায়ের চামরা কাল বা বাদামী এমন কোন ডাক্তার নয়। তাহলে ব্যাপারটি নিশ্চই চরম বিব্রতকর হয়ে দাড়াবে ঐ ক্লিনিক বা হাসপাতালের স্টাফ দের জন্য।
আসলে বিব্রতকর না বলে বরং বলা উচিৎ, চরম অপমানজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে এই ধরণের দাবী। আর এরকম একটি অপমানজনক ঘটনাই ঘটেছে গত ১৮ জুন মিসিসাগার একটি ক্লিনিকে যেখানে কোন শ্বেতাঙ্গ ডাক্তার নেই। এক শ্বেতাঙ্গ মহিলা অতি উচ্চ স্বরে ক্লিনিকের স্টাফদের কাছে দাবী করে বলছিলেন, তার ছেলের জন্য একজন শ্বেতাঙ্গ ডাক্তার চাই। তিনি বলছিলেন, ‘গায়ের রঙ বাদামী, দাতের রঙ বাদামী এমন কাউকে আমি দেখাতে চাই না আমার ছেলেকে।’
মহিলাকে যখন ক্লিনিকের পক্ষ থেকে জনানো হয় যে, কোন শ্বেতাঙ্গ ডাক্তার নেই তাদের ওখানে তখন মহিলা আরো ক্ষেপে যান এবং বলতে থাকেন, ‘কানাডায় একজন শ্বেতাঙ্গ হিসাবে আমার এখন নিজেকে নিজেই গুলি করা উচিৎ।’
ঐ মহিলা আরো বলেন, তিনি একজন ডাক্তারকে দেখিয়েছিলেন তার ছেলেকে। ছেলের বুকে ব্যাথার সমস্যা ছিল। কিন্তু কোন উপকার হয়নি। যে ডাক্তারকে দেখিয়েছিলেন সেই ডাক্তার ছিল অশ্বেতাঙ্গ। তাই তিনি একজন শ্বেতাঙ্গ ডাক্তার খুঁজছেন।
ক্লিনিকে উপস্থিত অন্যান্য রোগীরাও মহিলার এই আচরণে ক্ষুব্ধ হন এবং তাকে হাসপাতালে যেতে বলেন। উত্তরে মহিলা যা বলেন তাও ছিল অত্যন্ত অশোভন। তিনি বলেন, ‘আমি গিয়েছিলাম সেখানে। কিন্তু সেখানেওতো সব বাদামী ডাক্তার।’
ক্লিনিকে অপেক্ষমান একজন রোগী তার এই আচরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে মহিলা বলেন, ‘ আমি শ্বেতাঙ্গীনী বলে আমাকে আক্রমণ করছো?’
মহিলার এই অশোভন আচরণে ক্লিনিকে অপেক্ষমান অন্যান্য রোগীরাও প্রতিবাদী হয়ে উঠেন। এদেরই একজন এই মহিলার আপত্তিকর আচরণের ঘটনাটি সেলফোনে ভিডিও করেন যা পরের দিন সিবিসি টেলিভিশনে দেখানো হয়। ঘটনাটি মিডিয়াতে প্রচারিত হওয়ার পর এ নিয়ে শুরু হয় প্রতিবাদের ঝড়। ডাক্তারদের বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানানো হয়। নিন্দা জানান অন্টারিওর প্রিমিয়ার ক্যাথলিন উইন।
অন্টারিও মেডিক্যাল এসোসিয়েশন এর নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডাক্তার নাদিয়া আলম সিবিসি নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “এটি কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বড় ধরণের একটি সমস্যারই অংশ এটি।”
তিনি আরো বলেন, “এখানে অনেক ডাক্তার আছেন যারা ভিজিবল মাইনরিটি গ্র“পের সদস্য। আর এদের একটি বৃহৎ অংশই এরকম আচরণের শিকার হচ্ছেন। আমি নিজেও এর শিকার হয়েছি।”
নাদিয়া আলম বলেন, “এটি সত্যিই একটি হৃদয়ভঙ্গকারী ঘটনা। আপনি ভাবছেন আপনি কানাডিয়ান, কানাডা আপনার দেশ, আপনি এই দেশেরই একজন। কিন্তু কেউ যখন আপনার সঙ্গে ঐ মহিলার মত আচরণ করেন তখন নিশ্চিতভাবেই আপনার মনে হবে আপনি এই দেশে একজন অনাকাংক্ষিত ব্যক্তি।”
প্রিমিয়ার ক্যাথলিন উইন তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন, “আমি এই ঘটনায় খুবই বিস্মিত ও মর্মাহত হয়েছি। আমি ষ্পষ্টই বলতে চাই, এখানকার সমাজে এরকম আচরণের কোন সুযোগ নেই। এরকম বর্ণবাদী ও বিদ্বেষী আচরণ আমরা মেনে নিব না।”
ঘটনাটির ভিডিও করেছিলেন যে ব্যক্তি তার নাম হিতেশ ভরডওয়াজ। তিনি বলেন, “কানাডায় আমি নিজেও একজন ইমিগ্রেন্ট। আমি অত্যন্ত গর্ববোধ করি এই দেশে বাস করতে পেরে। কিন্তু ক্লিনিকে ঐ মহিলার আচরণ দেখে আমার বিশ্বাস হচ্ছে না আমি কি দেখলাম। বার বার ঘুড়ে ফিরে এই অশোভন আচরনের বিষয়টি আমার মাথায় আসছে। আমি খুবই মর্মাহত।”
আসলে মর্মাহত হওয়ারই মত একটি ঘটনা এটি। যারা এ ধরণের আচরণের শিকার হয়েছেন বা যারা চাক্ষুষ দেখেছেন কাউকে এ ধরণের আচরণের শিকার হতে তাদের মনের মধ্যে তা গভীর ক্ষত সৃষ্টি করতে পারে। স্মৃতিতে একটা কাল দাগ জীবনভর বয়ে বেড়াতে হবে তাদেরকে। বিশেষ করে এখানে যারা দৃশ্যমান সংখ্যালঘু তাদের কাছেতো অবশ্যই। আর এ ধরণের বর্ণবাদী ঘটনা সাম্প্রতিক সময়ে আরো বৃদ্ধি পেয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গত নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচিত হওয়ার পর। ডোনাল্ড ট্রাম্পের মত এরকম একজন চরম রক্ষণশীল, বর্ণবাদী ও অশোভন আচরণকারীর নির্বাচিত হওয়ার ঘটনাকে কানাডার রক্ষণশীল ও বর্ণবাদীরা নিজেদের বিজয় বলে ধরে নিয়েছেন। তারা ভাবতে শুরু করেছেন এ দেশে বর্ণবাদী আচরণ করা, অশোভন আচরণ করা তাদের বৈধ নাগরিক অধিকার। ডোনাল্ড ট্রাম্প যদি রাষ্ট্রিয়ভাবে বর্ণবাদী ও বিদ্বেষী আচরণ করতে পারেন তাহলে তার অনুসারীরা ব্যক্তি পর্যায়ে তা করতে পারবেন না কেন?
কানাডার সিবিসি নিউজ এর এক প্রতিবেদনেও প্রশ্ন করা হয় এই বলে যে, ট্রাম্পের প্রভাবেই কি কানাডায় বিদ্বেষী বা ঘৃণাজনিত অপরাধের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে? প্রতিবেদনে এই প্রশ্ন তোলার কারণ, সাম্প্রতিক কালে কানাডার বিভিন্ন অঞ্চলে বিশেষ করে যে সকল এলাকা ইমিগ্রেন্ট অধ্যুষিত সেই সকল এলাকায় বর্ণবাদী আচরণের শিকার হয়েছেন কিছু ব্যক্তি যা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ স্থানীয় ও জাতীয় পত্রপত্রিকা ও টিভিতে প্রকাশিত হয়েছে।
এরকম একটি বিদ্বেষী ঘটনা ঘটেছিল পাকিস্তানী বংশোদ্ভূত লিবারেল এমপি ইকরা খালিদ এর বেলায়। তিনি ফেডারেল পার্লামেন্টে এন্টি-ইসলামোফোবিয়া মোশন (প্রস্তাব) পেশ করেছিলেন। প্রস্তাবিত মোশনটি ছিল সবরকমের বর্ণবাদ এবং ধর্মীয় বৈষম্য দূরীকরণ এবং ইসলামোফোবিয়ার বিরুদ্ধে নিন্দা জানানোর জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান।
ঐ প্রস্তাব পেশ করায় তখন তাকে হত্যার হুমকী দিয়ে ইমেইল পাঠানো হয়েছিল। সিবিসি নিউজ জানা যায়, এমপি ইকরা খালিদ এন্টি-ইসলামোফোবিয়া প্রস্তাব পেশ করার পর বিদ্বেষী মেইলের প্লাবন দেখা দেয় তার ই-মেইলে। এর মধ্যে হত্যার হুমকীও ছিল। খালিদ ঐ সময় পার্লামেন্টে জানান, পঞ্চাশ হাজারেরও বেশী ইমেইল পেয়েছেন তিনি। তবে সবই বিদ্বেষী ইমেইল নয়। অধিকাংশ ইমেইলই তার সমর্থনে। ইউটিউবেও এমপি ইকরা খালেদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করে বলা হয়েছিল তিনি একজন জঙ্গী সমর্থক এবং নিদারুণ বিরক্তিকর ব্যক্তি। ঐ ভিডিওতে আরো বলা হয়, “আমি তোমাকে গুলি করার জন্য তাদেরকে সহায়তা করবো না। তবে আমি সেখানে উপস্থিত থাকবো মাটিতে পড়ে তুমি যখন কান্না করবে তার ভিডিও করার জন্য। হ্যা, আমি সেখানে উপস্থিত থাকবো আমার স্টোরী লেখার জন্য মুখভরা হাসি নিয়ে। হা হা হা। একজন এমপি গুলি খেয়েছেন কানাডিয়ান একজন দেশপ্রেমীর হাতে।”
পরে অবশ্য এন্টি ইসলামোফোবিয়া মোশনটি পার্লামেন্টে পাশ হয়।
এর আগে প্যারিসে সন্ত্রাসী হামলার পর টরন্টোর নিকটবর্তী পিটারবরো সিটিতে অবস্থিত আল সালাম মসজিদে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। একই সময়ে কানাডার মন্ট্রিয়লে এক মুখোশধারী যুবক প্রতি সপ্তাহে একজন করে মুসলমান বা আরবীয় ইমিগ্রেন্টকে হত্যা করবে এই মর্মে ইউটিউবে এক ভিডিও বার্তা ছড়িয়ে দেয়। যুবকটি দাবী করে সে একা নয়, তাকে সহায়তা করার জন্য আরো লোক আছে। পুলিশ অবশ্য তাকে গ্রেফতার করেছিল। তবে তার নাম প্রকাশ করা হয়নি। আর ইউটিউব থেকে ঐ ভিডিও বার্তাটিও অপসারণ করা হয়।
গ্রেফতারকৃত ঐ যুবকটি তার ভিডিও বার্তায় বলেছিল সে কুইবেকে বসবাসকারী মুসলিম অভিবাসীদের ব্যাপারে হতাশ। সরকার যদি এই মুসলিম অভিবাসীদের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ না করে তবে সে নিজেই এগিয়ে আসবে।
সিবিসি নিউজের আরেক খবরে বলা হয়, গত ১৭ ফেব্রুয়ারী ইসলাম বিরোধী বিভিন্ন প্রচারপত্র ও ব্যানার হাতে নিয়ে একদল লোক টরন্টোর ডাউনটাউনের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত একটি মসজিদের বাইরে সমবেত হয়ে ইসলাম নিষিদ্ধ করার দাবী জানান। এই সময় মসজিদের ভিতরে মুসল্লিগণ জুমার নামাজ আদায় করছিলেন।
ডানডাস ওয়েস্ট এবং ইউনিভার্সিটি এ্যাভিনিউর নিকটস্থ ‘মসজিদ টরন্টো’ এর সামনে বিক্ষোভকারীরা মাইক নিয়ে যখন উচ্চস্বরে ইসলাম নিষিদ্ধ করার দাবী জানিয়ে আসছিলেন তখন তা অনেক দূর থেকেও শুনা যাচ্ছিল। বিক্ষোভকারীরা মসজিদের প্রবেশ পথেও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে রেখেছিলেন যাতে কেউ ভিতরে প্রবেশ করতে না পারেন।
মসজিদ টরন্টো’তে নিয়মিত নামাজ পড়তে আসেন এমন একজন মুসল্লী মোহাম্মদ আবদি বলেন, “ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে টরন্টোতে এরকম প্রচন্ড বিক্ষোভ আগে দেখিনি। আমার ধারণা ছিল সাম্প্রতিক সময়ে মুসলিমদের প্রতি সহানুভূতি ও ইতিবাচক মনোভাব বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু আজকের ঘটনা দেখে আমি খুবই আহত হয়েছি।”
ঘটনার পর হোয়াইট হকসচাইল্ড নামের এক ইহুদী মহিলা বলেন, “এটি নিশ্চিতভাবেই বিব্রতকর একটি বিষয়। এই ঘটনা কানাডায় বেমানান। মানুষ হিসাবে আমাদের উচিৎ একে অপরকে সহযোগিতা করা।” হকসচাইল্ডের শিশু কন্যাও এই ঘটনায় মনক্ষুন্ন। তার অভিমত, “আমরা সবাই মানুষ। আমাদের একেকজনের গায়ের রং একেক রকম বলে আমরা বিভক্ত হয়ে থাকবো তা হতে পারে না।”
অবশ্য পাল্টা অভিযোগ রয়েছে মসজিদ টরন্টো’র বিরুদ্ধেও। গত বছর এই মসজিদের অভ্যন্তরে মসজিদের একজন কর্মী ইহুদী বিরোধী বক্তব্য রেখেছিলেন। পুলিশ কর্তৃপক্ষ সেই অভিযোগও তদন্ত করে দেখছে। মসজিদ কর্তৃপক্ষ অবশ্য কিছুদিন আগে এ জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে একটি বিবৃতি প্রকাশ করেন। তারা বলেন, ইহুদী সম্প্রদায়ে বিরুদ্ধে এ ধরণের বক্তব্য অপরাধমূলক। মসজিদের পক্ষ থেকে আরো বলা হয়, “আমরা যে কোন ধরণের বিদ্বেষ ও বর্ণবাদের নিন্দা জানাই। আমাদের নজরে এসেছে এই মসজিদের অভ্যন্তরে অনুপযুক্ত বক্তব্য রাখা হয়েছে যা ইহুদী সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে অবমাননাকর। এই ধরণের বক্তব্য অগ্রহণযোগ্য এবং তা মুসলিম এসোসিয়েশন অব কানাডা এবং একই সাথে গোটা মুসলিম সামাজের নীতি ও আদর্শেরও বিরোধী।”
কানাডায় বর্ণবাদী বা বিদ্বেষী আচরণের সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনাটি ঘটে এ বছর কুইবেক সিটিতে। গত ২৯ জানুয়ারী ইসলামিক কালচারাল সেন্টার অব কুইবেকে মাগরিব নামাজ আদায়কালে আলেকজান্ডার বিসোনেট নামের এক যুবক অতর্কিতে স্বয়ংক্রিয় বন্দুক হামলা চালান। বন্দুক হামলায় ঘটনাস্থলেই নিহত হন ৬ জন মুসল্লি। হামলার ঘটনায় আহত হন আরো ১৯ জন।
ঐ হামলার পর কানাডায় মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে নতুন করে আতঙ্ক বিরাজ করছে নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে। এ কথা বলেন হ্যালিফেক্সের সেন্টার ফর ইসলামিক ডেভলাপমেন্ট এর ইমাম জিয়া খান। তিনি বলেন, কমিউনিটির অনেকেই মনে করছেন এটি বর্ধিত সহিংসতার শুরু মাত্র। জিয়া খান আরো বলেন, সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায় এই ঘটনায় বিস্মিত এবং ভীত। তারা আগে থেকেই কিছুটা ভীতির মধ্যে ছিলেন। তিনি বলেন, ইতিপূর্বে হ্যালিফেক্সে তাদের মসজিদের দেয়ালে আপত্তিকর গ্রাফিটি (দেয়াল চিত্র) অংকন করা হয়েছে। তারা বিদ্বেষী ইমেইলও পেয়েছেন। স্থানীয় মুসলিমদেরকে কানাডা ছেড়ে চলে যাওয়ার কাথা বলা হয় ঐ সব ইমেইলে।
গত বছর জুন মাসে রমজান চলা কালে কুইবেক সিটির ইসলামিক সেন্টারের প্রধান দরজার সামনে কে বা করা শুকরের একটি কাটা মাথা র্যাপিং পেপার দিয়ে মুড়িয়ে রেখে যান। তাতে একটি স্টিকারও সংযুক্ত ছিল যাতে লেখা ছিল, Bon appétit যার ইংরেজী অর্থ হলো Enjoy your meal.. তার কিছুদিন পর ঐ এলাকায় একটি প্রচারপত্র বিলি করা হয় যাতে লেখা ছিল এই ইসলামিক সেন্টারটি জঙ্গীবাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত।
স্ট্যাটিস্টিকস কানাডার সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, ২০১৫ সালে পুলিশের কাছে রিপোর্ট করা হয়েছে মুসলমানদের বিরুদ্ধে এমন হামলার সংখ্যা আগের বছরের তুলনায় লাফিয়ে ৬০ শতাংশ বেড়েছে।
গত ১৩ জুন প্রকাশিত নতুন তথ্য-উপাত্তে দেখা গেছে, ২০১৫ সালে মুসলমানদের বিরুদ্ধে হামলার ১৫৯টি ঘটনা পুলিশের কাছে রিপোর্ট করা হয়েছে যা আগের বছর ছিলো ৯৯টি।
কানাডীয় মুসলিমদের জাতীয় কাউন্সিলের ভাইস-চেয়ারম্যান খালিদ এলগাজার ২০১৫ সালকে কানাডার মুসলমানদের জন্য একটি ‘কঠিন বর্ষ’ হিসাবে বর্ণনা করেন। এলগাজার বলেন, বিদ্বেষমূলক হামলার শিকার অনেক মুসলিমই হামলার ঘটনা পুলিশকে জানান না, কারণ তারা ভীত-শঙ্কিত থাকেন এই ভেবে যে পুলিশে জানালে তাদেরকে আরও হেনস্তা হতে হবে অথবা তারা ভাবেন যে, পুলিশ কোনও কার্যকর ব্যবস্থা নেবে না।
নতুন পরিসংখ্যানে দেখা গেছে যে, ইহুদি সম্প্রদায়ের লোকেদের ওপর হামলার ঘটনা ২০১৫ সালে কমে ১৭৮টিতে দাঁড়িয়েছে যা আগের বছর ছিলো ২১৩টি। উল্লেখ্য, কানাডায় ইহুদিরাই ছিলো সবচেয়ে বেশি হামলার শিকার হওয়া ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। সেন্টার ফর ইসরায়েল অ্যান্ড জিউস অ্যাফেয়ার্সের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শিমন কফলার ফোগেল যাকে খুবই “অশান্তিকর এবং স্পষ্ট” প্রবণতা বলে বর্ণনা করেন।
এদিকে কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর হামলার ঘটনাও কমেছে। তবে কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর হামলার ঘটনা এখনও এধরণের সব অপরাধের মধ্যে শতকরা হিসাবে সর্বোচ্চ। ২০১৫ সালে কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে ২২৪টি। এর ফলে সব ধরণের বিদ্বেষপ্রসূত অপরাধের ১৭ শতাংশই ছিলো কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর হামলার ঘটনা। এর আগের বছর এধরণের হামলা হয়েছিলো ২৩৮টি।
কানাডা একটি মাল্টিকালচারের দেশ। বহু বছর লেগেছে এখানে একটি সৌহার্দপূর্ন সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে। এ দেশে সকলের অধিকার সমান। বর্ণবাদের কোন স্থান নেই এখানে। ‘কানাডিয়ান চার্টার অব রাইটস এন্ড ফ্রিডম’ এ এই বিষয়টি সুষ্পষ্টভাবে বলা আছে। একে অস্বীকার বা অবহেলা করার কোন সুযোগ নেই।
কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, এক শ্রেণীর লোক এখানে বর্ণবাদী বৈষম্য সৃষ্টি করার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ফয়দা লুটার জন্য যা কানাডার চার্টার অব রাইটস এর পরিপন্থী।
কানাডিয়ানইমিগ্রেন্ট.সিএ’র এক খবরে বলা হয়, “সরকার বিভিন্ন মহল থেকে অবহিত হয় যে, এখানে সমতা প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা ও মূলধারায় অন্তর্ভূক্তির প্রচেষ্টা সত্যেও একটি গোষ্ঠি এখানকার আদিবাসী ও বিভিন্ন এথনিক সম্প্রদায়ের সাথে বাকী জনগোষ্ঠির মধ্যে বর্ণবাদী বৈষম্য তৈরীর চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে এবং তাকে আরো বিস্তৃতি ঘটানোর চেষ্টাও করে যাচ্ছে। ”
আমরা অবশ্য লক্ষ্য করেছি যে, অন্টারিওতে সিস্টেমিক রেসিজম বা বর্ণবাদকে নির্মূল করার জন্য সরকার তিন বছর মেয়াদী একটি কৌশল হাতে নিয়েছে। এখানকার আদিবাসী ও বিভিন্ন এথনিক সম্প্রদায় বর্ণবাদের কারণে যে সকল বাধার সম্মূখীন হচ্ছেন তা দূর করার লক্ষ্যে এই প্রচেষ্টা।
এই পরিকল্পনায় আছে সিস্টেমিক রেসিজম এর বিষয়টিকে চিহ্নিত করতে সহায়তা করা এবং তা নির্মূল করা। সরকারের এই পদক্ষেপ স্বীকৃতি দেয় যে, কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি বর্ণবাদ, আদিবাসীদের প্রতি বৈষম্য, ইসলামোফোবিয়া এবং ইহুদীসহ অন্যান্য সম্প্রদায়ের প্রতি বর্ণবাদী আচরণের অস্তিত্ব রয়েছে অন্টারিওতে। আর এই পরিস্থিতি এথনিক সম্প্রদায়ের সদস্যদের জন্য নির্ধারিত লক্ষ্যে পৌঁছানোর পথে একটি বাধা হিসাবে কাজ করে।
ইতিপূর্বে প্রকাশিত এক গবেষণা থেকে আমরা দেখেছি কানাডার প্রতি একাত্মতার শক্তিশালী অনুভূতি রয়েছে ব্যাপক সংখ্যক ইমিগ্রেন্টের। অর্থাৎ এরা কানাডাপ্রেমী। গত বছর ১৮ অক্টোবর প্রকাশিত স্ট্যাটিসটিক্স কানাডার গবেষণা পত্রে দেখা গেছে কানাডায় যারা ১৯৮০ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে প্রবেশ করেছেন তাদের মধ্যে শতকরা ৯৩ ভাগেরই কানাডার প্রতি খুবই শক্তিশালী বা শক্তিশালী অনুভূতি রয়েছে। ১৮২ টি দেশ থেকে আসা ৭০০৩ জন ইমিগ্রেন্টদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে এই বিষয়টি জানা গেছে।
কৌতুহলের বিষয় হলো, কানাডায় যেখানে ৮৩% মুসলমান নিজেদেরকে কানাডিয়ান ভেবে খুবই গর্ববোধ করেন সেখানে মাত্র ৭৩% অমুসলিম খুবই গর্ববোধ করেন নিজেদের কানাডিয়ান পরিচয় নিয়ে! এনভাইরনিকস ইন্সিটিউট এর এক জরীপে এই তথ্য উঠে এসেছে।
এ বছর ১ জুলাই কানাডার ১৫০তম জন্মবার্ষিকী। এই দিনকে সামনে রেখে বলতে চাই – আমরা যারা ইমিগ্রেন্ট, কানাডার প্রতি তাদের ভালবাসার কমতি নেই। কমতি নেই কানাডিয়ান হিসাবে গর্ববোধ করারও। ক্লিনিকে বা হাসপাতালে বাদামী অথবা কৃষ্ণাঙ্গ ডাক্তারগণ সবাই প্রথম অথবা দ্বিতীয় প্রজন্মের ইমিগ্রেন্ট। অন্যান্য আরো অনেক পেশায়ই আছেন এই ইমিগ্রেন্টরা। কানাডার আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে এদের অবদান কোনভাবেই খাট করে দেখার উপায় নেই। এরা আছেন বলেই আজকে কানাডার অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটছে দ্রুত। এই বিষয়টি রক্ষণশীল বর্ণবাদীদের মনে রাখা প্রয়োজন।
খুরশিদ আলম
সম্পাদক ও প্রকাশক
প্রবাসী কণ্ঠ