টরন্টোতে তরুণদের জন্যে সাহিত্য উদ্যোগ
অক্টোবর ৭, ২০১৭
তাসমিনা খান
বেঙ্গলি লিটারারি রিসোর্স সেন্টার বা সংক্ষেপে ‘বিএলআরসি’ বর্তমানে কানাডার, বিশেষ করে টরন্টোর, সাহিত্যাঙ্গনে একটি পরিচিত শব্দ। কিন্তু শুধু পরিচিত শব্দ হয়েই থেমে থাকেনি বিএলআরসির পদচারণা। উপরন্তু বিএলআরসি এগিয়ে চলেছে দুর্দম্য গতিতে, নিশ্চিত লক্ষ্যে। বিএলআরসি আজ আর একা নয়, গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে এসেছে অনেকদূর। এর সাথী হয়ে আছে কানাডার নানান প্রান্তে অবস্থিত অসংখ্য সাহিত্যানুরাগী বাঙ্গালি ব্যক্তিবর্গ।
পরিসংখ্যান মতে কানাডাতে বর্তমানে বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবাংলা থেকে আগত ন্যূনতম একলক্ষ বাঙ্গালির বাস। কর্মসংস্থান, উন্নত জীবনযাপন, নিশ্চিত ও নিরাপদ জীবনযাত্রা, কিংবা বাচ্চাদের আলোকিত ভবিষ্যৎ যেটাই হোক না কেন তাঁদের এই অভিবাসী জীবন বেছে নেয়ার কারণ। কিন্তু একটি দিকে সবারই ভীষণ মিল, আর তা হলো মনে-প্রাণে আমরা সবাই বাঙ্গালি। বাংলা আমাদের সবারই মনের ভাষা, মুখের ভাষা, এমনকি স্বপ্নও দেখি আমরা বাংলায়। বাস্তবতার তাগিদে রোজ ইংরেজি ভাষায় কথোপকথন চালিয়ে গেলেও, দিনশেষে রাতটি আসে বাংলা ভাষায় সমাপ্তি নিয়ে। বাড়ি ফিরে সবাই আমরা বলতে চাই, শুনতে চাই, মাতৃভাষা বাংলা। এছাড়া যেন তৃপ্তি মেলে না কিছুতেই।
কিন্তু সবাই মনে একথা ভাবলেও বিএলআরসি আজ আর মনের ভাবনার মাঝে থেমে নেই। ঘরে ফিরে প্রিয় সন্তানের মুখে শুনতে চাই আমরা বাংলা কথা। যখন সন্তানেরা বিমুখ করে বাংলা বলতে, বাংলা পড়তে, তখনি মনটা বিমর্ষ হয়ে পরে। তাইতো বিএলআরসি-র এই যাত্রা। একটির পর একটি করে নানান প্রকল্প হাতে নিয়ে তা বাস্তবায়নের জন্য উন্মুখ হয়ে আছে বিএলআরসি। বর্তমানে বিএলআরসি-র সাথে সংযুক্ত আছে বহু সহস্র বাঙ্গালি। তাঁদের সবার একটিই ভাবনা; ‘দ্বিতীয় প্রজন্ম’কে আস্বাদন করাতে হবে বাংলা সাহিত্যের রস’। স্বীয় রস, গুণ, মাধুর্যে অভিজাত বাংলার কথা, সাহিত্য, মূল্যবোধ, ইতিহাস ও সংস্কৃতি জানাতে হবে আমাদের দ্বিতীয় প্রজন্মকে। পরিচিত করতে হবে তাদেরকে বাংলা সাহিত্যের গৌরব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশের সাথে। শুধু এঁদের সম্পর্কেই নয়, আজকের তরুণেরা জানবে ও গর্ব বোধ করবে এপারবাংলা-ওপারবাংলার যতো গুণিজন আছেন সবার সম্পর্কে।
কিন্তু আজকের সন্তানেরা বাস্তবতার সাগরে ভাসতে ভাসতে আজ তীরহারা। অনেকেই বাংলা বলতে কিছুটা পারলেও পড়তে পারে না একেবারেই। তাই বলে তারা কি বাংলা সাহিত্যের অমিয় সুধা থেকে বঞ্চিত হবে? তা যেন না হতে হয়। বিএলআরসি তাই অতি শীঘ্রই শুরু করতে যাচ্ছে ‘Presenting Bengali Literature in English’ নামক প্রকল্প।
প্রায় এক বছরব্যাপী এই প্রকল্পটি প্রধানত তরুণ-তরুণীদের জন্যে। বয়স-সীমা রাখা হয়েছে ১৪ থেকে ৩০। প্রকল্পের বৈশিষ্ট্য হল এখানে আমরা বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ বইগুলোকে ইংরেজিতে পড়ার সুযোগ করে দিব তরুণবয়সী পাঠককে। যারা বাংলা পড়তে পারে না, তাদের ক্ষেত্রে ভাষা না জানবার ফলে সমৃদ্ধ বাংলা সাহিত্যের রস আস্বাদন করতে না পারার দুঃখটা ঘুচে যাবে অচিরেই। এমনকি হয়তোবা একদিন আসবে, যেদিন এদের কাছে শুনে বাংলা সাহিত্যের ইংরেজি অনুবাদ পড়বে এদেরই ভিনভাষী বন্ধুরা। তারাও ক্রমে ক্রমে জানবে, কেন সেকালে রবীন্দ্রনাথ হতে পেরেছিলেন ‘বিশ্বকবি’, কী সুধা জড়িয়ে রয়েছে বাংলা গানে, বাংলা ভাষায়, বাংলা সাহিত্যে।
প্রকল্পটি শুরু হবে এ বছরের ১৮ নভেম্বর। শুরুতেই বিএলআরসি বিনামূল্যে তরুণদের মধ্যে সরবরাহ করবে বাংলা সাহিত্যের প্রতীকবাহী প্রায় তিন-চারশ বই। এসব বই বাংলা সাহিত্যের প্রতিনিধিত্বশীল প্রকাশনা। কিন্তু ইংরেজিতে অনূদিত। প্রকল্পে আগ্রহী তরুণ মাত্রই বিএলআরসি থেকে প্রতি মাসে দুখানা করে বই নিতে পারবে পড়বার জন্য। পরের মাসে আগের বইদুটো ফেরত দিয়ে নতুন বই নেবার সুযোগও থাকবে। সারা বছর ধরে তারা বইগুলো পড়বে। বছরশেষে বইগুলো নিয়ে লিখবে, কথা বলবে। শ্রেষ্ঠ তিনটি লেখার জন্যে থাকবে পুরস্কারের ব্যবস্থাও। প্রকল্প শেষ হবে ২০১৮ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর। শেষদিনের অনুষ্ঠানে আমরা শুনবো বাংলা সাহিত্য নিয়ে আমাদের তরুণ প্রজন্মের কথা। আমরা স্বপ্ন দেখি একসময় হয়তো তারাও হয়ে উঠবে বাংলা সাহিত্যের এক একজন নক্ষত্র।
স্বপ্ন দেখতে বাঁধা কোথায়? কিন্তু অর্থ অনেক সময়ই স্বপ্ন দেখায় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। আমাদের অনেক আনন্দ যে ওই বাধা দূর হয়েছে। বিএলআরসি-র স্বপ্নের কথা জেনে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন আমেরিকার মিশিগান অভিবাসী আরেক বাঙালি। দার্শনিক, চিকিৎসক, সমাজসেবক ড. দেবাশিস মৃধা সহাস্য বদনে এগিয়ে এসেছেন। বাংলা ভাষা-সাহিত্য এবং বাঙালি সংস্কৃতি প্রতি প্রীতিবান এই
কৃতীজনের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা জানাই।
ব্যক্তিগতভাবে আমি অনেক আনন্দিত যে টরন্টোতে বাংলা সাহিত্যকেন্দ্রিক এমন একটি উদ্যোগের সাথে আমি প্রত্যক্ষভাবে জড়িত হতে পেরেছি। বিএলআরসি-র পরিচালক মুক্তচিন্তক আকবর হোসেনের নেতৃত্বে আমাদের টিমে অন্য আরও যে তরুণেরা আমাদের সাথে কাজ করবেন তাঁর হলেন: সুচনা দাস বাঁধন, অদিতি ফৌজিয়া, সুইটি রায়, মো. আজওয়াদ কবীর, হাসিব খান, মেরিলিন পাণ্ডে এবং আরও অনেকে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি প্রকল্পের সংবাদ যখন পত্র-পত্রিকায় ও সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশ পাবে আরও বিরাট সংখ্যক তরুণ-তরুণী এগিয়ে আসবে সহযোগিতা করতে।
আমরা স্বপ্ন দেখি, এগিয়ে যাবার স্বপ্ন, সাথে বাংলা সাহিত্যকে এগিয়ে নিয়ে যাবার স্বপ্ন প্রজন্ম-প্রজন্মান্তরে। হয়তো একদিন টরন্টোতে অবস্থানরত সকল বাঙ্গালি সন্তান বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে জানবে, গৌরব বোধ করবে। হয়তো তাদের গৌরবের কথা শুনে কোন এক অবাঙ্গালি বন্ধুও রস আস্বাদন করবে বাংলা সাহিত্যের। এভাবে একদিন হয়তো সহস্র থেকে অযুত, লক্ষ, নিযুত, কোটিতে গিয়ে ঠেকবে কানাডাতে অবস্থিত বাংলা সাহিত্য পাঠকের সংখ্যা। এটাই আমাদের স্বপ্ন, এ স্বপ্ন পূরণেই পাশে চাইছি আপনাদের সকলকে আমাদের পাশে, আমাদের সাথে, একাত্ম হয়ে নিবিড়ভাবে বাংলা সাহিত্যের প্রচার, প্রসার ও অগ্রযাত্রার পথে সাথী হতে। স্বাগত সকলকে বিএলআরসি-র প্রকল্প ‘ Presenting Bengali Literature in English’ তে।
তাসমিনা খান, টরন্টো।