জীবনের প্রতিবিম্ব

আগস্ট ৫, ২০১৭

যখন মন হারায় মাতৃভূমির মমতায়,গুন গুন গান বাজে মনের তানপুরায়; “গ্রামছাড়া ঐ রাঙা মাটির পথ, আমার মন ভুলায়রে-” তখন মনটা আরো বেশি হারানোর নেশায় বিহ্বল হয়ে যায়। মনে হয় জগৎ জীবনে এত কর্মযজ্ঞ, প্রতিযোগিতা, দৌড়ের পাল্লা, সিঁড়ি ভাঙ্গা,এ সবকিছু থেকে মনটা পালাতে চায়, কোথায় পালাতে চায় জানিনা তবে স্বস্তি চায়, মুক্তি চায়। মুক্তি কি?  কার মুক্তি কোথায় কে জানে ? কার যেন একটা কবিতার লাইন খুব মনে পড়ছে, দুঃখিত কবির নাম মনে করতে পারছিনা, এ এক বড় বিড়ম্বনা, তবে কবিতার লাইনটি বলি——

“মা যদি হয় রাজি

বড় হলে হব আমি খেয়া ঘাটের মাঝি”

মানুষের মনের প্রিয় কথাটিই তার মনে গেঁথে থাকে। তেমনি এ কথাটি আমার মনে গেঁথে আছে। মানুষের প্রিয়তা দিয়ে সে তার জগৎ সাজাতে চায়। কিন্তু চাওয়া আর পাওয়ার মধ্যে একটি স্তর আছে সেটি বাস্তবতা। যে কারণে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন,“যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই,যাহা পাই তাহা চাইনা,” বাস্তবতার চরিত্র এমনই। তবু চাওয়া পাওয়ার হিসাব মিলাতে মিলাতে আমরা জীবনের শেষ সীমায় চলে যাই। ছোটবেলায় খেয়াঘটের মাঝি হওয়ার সাধ আমাদের কোনোদিন মেটেনা।

জীবনযুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে সত্যি সত্যি যে লোকটি খেয়া ঘাটের মাঝি হয়ে আত্মপ্রকাশ করে সে একটি ব্যর্থ মানুষ হিসাবে সমাজে পরিচয় লাভ করে। তার কোনো সামাজিক অবস্থান নেই, ঝকঝকে পোষাকধারী মানুষের কাছে তার কোনো মর্যাদা নেই। বড় মানুষের দম্ভের কাছে সেই দরিদ্র মানুষটি কুর্নিশ  জানাতে থাকে অহরাত। সমাজে তাই কেবল বড় হওয়ার দৌড়ের পাল্লা, একজন অন্যজনকে অতিক্রম করে যাওয়ার ব্যাগ্রতা। কিন্তু মানুষ যখন শিশু থাকে সে তার পরিবেশের পাঠশালায় ঐসব মানুষকে অতি সহজেই আবিস্কার করে যারা দৌড়ের পাল্ল্লায় পিছে পড়ে গিয়ে দুর্ভাগ্যের কাছে আত্মসমর্পন করে ফেরিওয়ালা হয়েছে, খেয়াঘাটের মাঝি হয়েছে। যাদের জীবনে আর কোনো প্রতিযোগিতা অবশিষ্ট নেই। জীবনের সহজ জোয়ারে ভেসে বেড়ানো মানুষ। শৈশবে কোনো না কোনো সময় প্রায় সব শিশু ঐ সব মানুষের অনুকরনে অভিনয় করে। যেমন মাথায় কোনো একটি বস্তু তুলে দিয়ে সে ঘরময় ঘুরে ঘুরে টেনে টেনে বলে, দৈ-লাগবে -দৈ-? বা মুড়ি-লাগবে-মুড়ি-? মানে যেকোনো দ্রব্যের নাম, যা সবসময় তার কর্ণগোচর হয়। কারণ প্রতিদিন শিশুর কানে বাজে এসব ফেরিওয়ালাদের ডাক অথবা কখনও বড়দের সাথে বেড়াতে গিয়ে  কোনো এক খেয়াঘাটের মাঝিকে দেখে সে চঞ্চল হয়। মনে হয় কি আনন্দে জলের বুকে নৌকা ভাসিয়ে দিয়ে মাঝি কোথায় ভেসে যাচ্ছে! তাইতো সে ব্যাকুল হয় খেয়া ঘাটের মাঝি হওয়ার জন্যে, অথবা অভিনয় করে নিত্যদিনের ফেরিওয়ালার। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। এখানে সেই সরলতার সহজতার কোনো স্থান নেই। শিশুকে প্রথম প্রতিযোগিতার সম্মুখিন হতে হয় স্কুলের ভর্তি যুদ্ধে। সেই থেকে যুদ্ধ শুরু। যার  বাবার টাকার পুঁজি যত বেশি সে তত ভাল স্কুলে ভর্তি হতে পারে। প্রথম ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে তারপর বাংলা মিডিয়ামের সেরা স্কুলে, যা  মূলত প্রতিযোগিতায় সফলতা -বিফলতার সূচনালগ্ন। বাস্তবে  খেয়াঘাটের মাঝির বদলে সে বড় হয়ে একজন ডাক্তার,ইঞ্জিনিয়ার, হাই অফিসিয়াল অথবা ব্যাবসায়ী ইত্যাদি ইত্যাদি সিঁড়ি ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে শ্বাসরুদ্ধকর গতিতে গতিমান হয়ে পড়ে। কেউ কেউ পদার্পণ করে কর্পোরেট জগতে, কেউ হয়ে ওঠে দিনগোনা ছাপোষা সংগ্রামী; তখন ভেতরের সহজ মানুষটি মরে যায়। যে হারিয়ে গেল বা নেপথ্যে চলে গেল  তাকে আর  খোঁজও করেনা কখনো।  হঠাৎ কোনো এক কর্মহীন অথবা প্রতারিত মুহূর্তে সে যখন নিজেকে নিজের কাছে ফিরে পায় তখন মনে হয় তার ভিতরে একটি শিশু ছিল, সে খেয়া ঘাটের মাঝি হতে চেয়েছিল, আথবা দৈ ওয়ালা, মুড়িওয়ালা। যে সারাটাদিন মুক্ত পৃথিবীতে ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়বে আবার সকাল থেকে প্রকৃতির প্রানের টানে ছুটে চলবে। তখন মনে হয় খেয়াঘাটের মাঝিটি তার একটি প্রিয় মানুষ। তার একান্ত নিভৃতে যার জন্য একটা জায়গা আছে, যেখানে করো দৃষ্টি পড়েনি কোনোদিন এমন এক নিভৃতপুরী। সেই  জীবনটিতেও সুখ দুঃখের আন্দোলন আছে, বেঁচে থাকার চরম আগ্রহ আছে, আছে জীবন চলার বেগ। সেও জীবনের পথ পরিক্রমায় ব্যস্ত। যেন একদিন পৌঁছে যাবে সেথায়, যেখানে সফল   মানুষগুলির গোধূলি আর তাঁর গোধূলি একই সমান্তরালে  অবস্থান করছে। রবীন্দ্রনাথের সেই  কল্পনার মত–“ছেঁড়াছাতা রাজছত্র মিলে চলে গেছে একই বৈকুন্ঠের দিকে।”

একটি মনুষ অনন্তকাল বেঁচে থাকেনা, যা বেঁচে থাকে তা মানবতা। সবার জীবনে একটি নির্ধারিত সময় থাকে, যে সময়ে সে তার জীবন তরী বেয়ে বেয়ে ধেয়ে চলে যায় অন্য জীবনের উদ্দেশে। জীবনের নির্ধারিত পথটি পারি দিতে গিয়ে প্রতিটি মানুষের কি নিদারুন প্রচেষ্টা থাকে একজন সফল মানুষ হয়ে ওঠার। সফলতা বিনা ক্লেশে কারো কাছে ধরা দেয়না। অবিরাম কাজ করে যেতে যেতে সফলতা কারো কাছে ধরা দেয় আবার করো কাছে ধরা দেয়না। তবু আমরা আশা করে থাকি জীবনের শেষ মুহূর্তটি পর্যন্ত। আমরা জানিনা কার সফলতা কোথায়, কোন কাজ করলে কোন সফলতা আসবে। কেউ কেউ সারাটা জীবন পন্ডশ্রম করি আবার কেউ সঠিক পথে শ্রম ও মেধা দিয়ে সফলতা অর্জন করি। সফলতা বিফলতা মানব জীবনে একটি আপেক্ষিক বিষয়, জীবন জোয়ারে ভেসে যাওয়ার কতগুলি নির্ধারিত বেগ। কিন্তু এসব নির্ধারিত বেগের পেছনে যে আবেগ রয়েছে তা আত্মপ্রতিষ্ঠার। সেই আত্মপ্রতিষ্ঠার বৈচিত্রের মধ্যে ঘোরপাক খেতে খেতে জীবনের কোনো কোনো সময় মানুষ একদিন আবিস্কার করে সেই মানুষটিকে যে তার পাশে পাশে ছিল চিরদিন, যাকে নিয়ে সে কখনো গুরুত্বের সাথে ভাবেনি।

শৈশব থেকে যৌবন, যৌবন থেকে বার্ধক্য জীবনের এই ক্রমবিকাশের পালাবদলের পর্ব চলতে থাকে। মানুষ পরিবর্তনের ভিতর দিয়ে ক্রমাগত ছুটতে ছুটতে কখনো নিজেকে হারায়, কখনো মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারায়, কখনো চারিপাশের মানুষগুলিকে হারায়। এভাবে জীবনের অনেক পথ অতিক্রম করে নিজেকে নানাভাবে বিভিন্ন পর্যায়ে পৌঁছে দেয়। শৈশবের দিনগুলি হারিয়ে যায় যৌবনের উত্তাপে, নতুন সৃষ্টিতে, গতিতে, প্রতিষ্ঠায়। তারপর হয়ত কোনো একদিন প্রশ্ন জাগে কি করতে কি করা হয়ে গেল। একমুহূর্তে  জীবনের দাবি এসে স্পর্শ করে অন্তরকে। ইচ্ছে করে সকল ব্যস্ততা ছেড়ে চলে যেতে কোনো এক অবাস্তব জগতে। যেখানে প্রকৃতি আর মানুষ মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। জীবনের পুঞ্জিভূত মনীষাটুকু সেই অন্ত্যজের পাশে বসে তার হৃদয়ের স্পর্শ চায়। যে স্পর্শ একবার চেয়েছিল শৈশব।

মানুষের জীবন যুদ্ধের সফলতা আর বিফলতা এক হয়ে যদি একটি মানবগোষ্ঠী একটি মানব চরিত্রের রূপকার হয়ে বেঁচে থাকতে পারতো তাহলে বোধহয় মানবতার সাথে মনবতার ব্যবধান সৃষ্টির কৌশলটি মানুষ আর খুঁজে পেতনা। এ নিবিড় অনুভবটুকু মুক্তমনে ডানা মেলতে চায় সমস্ত বিশ্বজীবন জুড়ে। মূর্ত হয়ে ওঠে হৃদয়প্রান্তে সেই সহজ শৈশব, মনে হয় এতকাল পথে পথে ঘুরে আসা মনটি বোধহয় এজন্যেই পথ চলেছিল।

রোজানা নাসরীন

টরন্টো