ছিন্ন মূল

নভেম্বর ৫, ২০১৬

জয়ব্রত

বাঙালি বাংলাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে আজ পৃথিবীর আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পরেছে। আমরা যারা নানাবিধ কারণে আজ প্রবাসী হয়েছি, ফেলে এসেছি শৈশব কৈশোর তরুন বয়সের সৃতি বিজড়িত বিভিন্ন অতীত। মা মাটি আর শেকড়ের টানে এখনও ছুটে প্রবাসী মানুষ প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশে। প্রবাসের যান্ত্রিক জীবনযাত্রা থেকে কিছুক্ষণের জন্য হাফ ছেঁড়ে বেঁচে জীবনী শক্তি পুনঃরুদ্ধার করতে সবুজ শ্যামল প্রকৃতির কাছে ফিরে যায় মানুষ। বুক ভরে মাটির গন্ধ নিয়ে আর নদীর খোলা বাতাস গায়ে লাগিয়ে কিংবা জনসমুদ্রে হারিয়ে গিয়েও যে প্রশান্তি পাওয়া যায় তা এত সাজানো গুছানো পরিপাটি ছিমছাম পরবাসে থেকেও খুঁজে পাওয়া যায় না। আমরা যারা বিদেশে থাকি কিংবা থাকতে হয় তারা অনেকটা স্বার্থপরের মত বেঁচে থাকি। মন পরে থাকে জন্মভুমিতে আর শরীর নিয়ে বসবাস করি পরবাসে।

অচেনাকে জানতে চিনতে কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে হয়, আস্তে আস্তে আচেনা আজানা পরিচিত প্রিয় আপন হয়ে উঠে। মেনে নেওয়া আর মানিয়ে নেওয়া মানুষের জীবনের ধর্ম, কি ছিলাম কি হয়েছি হতাশ হলেও হাল ছাড়িনি। মচকে গেলেও ভেঙ্গে পড়িনি। সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিবেশে, ভিন্ন আবহাওয়া, ভিন্ন জীবনযাত্রায় আস্তে আস্তে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছি। জন্মছিলাম প্রচন্ড গ্রীষ্ম প্রধান দেশে, এসে পরলাম চরম শীত প্রধান দেশে। প্লাস ৩৫ এর দেশ থেকে মাইনাস ৩৫ তাপমাত্রার এত বিশাল তারতম্য শরীর ও মন মেনে নিয়েছে অবলীলায়। তুষারপাত তুষারঝড় বরফবৃষ্টি সহ দীর্ঘ শীত মৌসুমের নানা প্রভাবও আস্তে আস্তে সহনীয় অভ্যস্ত হয়ে গেছে। “শরীরের নাম মহাশয় যাহা সওয়াবেন তাহাই সয়”প্রবাদ বাক্যটি মনে হয় মিথ্যে নয়। নিজেকে এতটা বদলে নেওয়া কি করে সম্ভব হল। নিজেকে বদলে ফেলা কি আসলেই এত সহজ!

আমরা প্রবাসী তবে প্রবাসী শব্দটিকে একটু ভেঙ্গে পরিষ্কার করে বলতে হয়,  প্রবাসী দুরকম স্থায়ী ও অস্থায়ী। নির্দিষ্ট সময় সীমার মধ্যে চাকুরী করতে দেশ ছেড়ে বিদেশে থাকলে একে অস্থায়ী প্রবাস জীবন বলা যায়। আর যারা দেশের বাইরে চাকুরী করেন এবং অভিবাসী হিসাবে সেই দেশের নাগরিকত্ব গ্রহন করেন, অনির্দিষ্ট সময় দেশের বাইরে বিদেশেই কেটে যায়- তাদের স্থায়ী প্রবাসী বা ছিন্নমূল মানুষ মনে হয় বলা যায়। “ছিন্নমূল”শব্দটি কেন এখানে  ব্যবহার করলাম তার একটি কারণও আছে, মূল থেকে বিছিন্ন যা তাকেই নিশ্চয় ছিন্নমূল বলে মনে হয়। আমরা যারা দীর্ঘদিন দেশের বাইরে বসবাস করছি, পরবাসেই বসতবাড়ি চাকুরি নিয়ে সংসার সমুদ্রে ডুবে থাকি। মাঝে মধ্যে কিংবা হটাৎ প্রবাস থেকে দেশে অতিথির মত বেড়াতে যাই, এরা কি ছিন্নমূল নয়! মূল থেকে ছিন্ন, যাদের অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ সঠিক করে বলা যায় না, কোথায় ছিলাম কোথায় এলাম কোথায় থাকবো আগামীতে সঠিক করে বলা মুশকিল। অনেকটা যাযাবরের মত জীবন যাপন।

জন্মভূমি ছেড়ে বিদেশের মাটিতে পাড়ি দিয়ে আস্তে আস্তে পরবাসী জীবন গ্রহণ করে সম্পূর্ণ প্রবাসী হয়ে আমরা কে কিভাবে আছি কেমন আছি, উন্নত নিরাপদ আধুনিক জীবনে প্রবাসীদের প্রথম প্রজন্মরা কেমন করবে। কতটুকু সফল হবে ছিন্নমূল বাবা মায়ের স্বপ্ন। উত্তর অনেক অনেক কঠিন। নতুন প্রজন্মদের অনেকেই ভাল করছে, আবার অনেকে এখানে এসে হতাশ কিংবা ভেঙ্গে পড়েছে, আশানুরূপ তেমন কিছুই করতে পারছে না। অনেক আশা অনেক স্বপ্ন বুকে নিয়ে মানুষ বিদেশে পাড়ি জমায় জন্মভূমির মায়া ত্যেগ করে। সমাজের সর্বস্তরের মানুষ দীর্ঘদিন আগে থেকে বিদেশে পাড়ি জমাতে শুরু করে, আজ থেকে খুব সম্ভবত বছর ৩০ বা ৪০ বছর আগে ইউরোপ কানাডা আমেরিকাতে বাংলাদেশীদের প্রথম আগমন ঘটে বলে জানা যায়। বিদেশে আমার ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা কিংবা অজ্ঞতা যাই বলিনা কেন, ভাল মন্দ উত্থান পতন সব মিলিয়ে কেটেছে দিনগুলি। কি কঠিন কি করুন ধাপে ধাপে এগিয়ে চলেছি আমরা আগামীর পথে। তাই প্রবাসীদের সংগ্রামী জীবনের কিছুটা চিত্র এখানে তুলে ধরার চেষ্টা করলাম।

প্রতিটি মানুষকে এখানে দিনে কিংবা রাতে কাজ করতে হয়। কাজের পরেও কাজের শেষ নেই, নেই কোন অন্ত! নেই কোন সীমা। কাজ করলে শারীরিক কষ্ট সহ্য করতে হয় আর কাজ না থাকলে বা না করলে মানসিক দুর্ভাবনার কষ্ট সহ্য করতে হয়। কোন কোন সময় এক সাথে শারীরিক ও মানসিক কষ্টও সহ্য করতে হয় অনেককে। এখানে দুজন মানুষের উপর পরিবারের সবকিছু নির্ভর। পিতা মাতা সন্তান, ছোট বা বড় যে সাইজ হোক পরিবারের, কাজ আর কাজ- বাজার করা বাজার গুছানো রান্নার আয়োজন, হাড়িপাতিল ও বাসন পেয়ালা ধুয়া মুছা, ঘর পরিষ্কার করা, কাপড় ধোঁয়া, বাচ্চাকে স্কুলে পাঠানো ফেরত আনা, এক কথায় সব কাজ এখানে নিজ হাতেই করতে হয়। এর কোন ব্যতিক্রম নেই। সংসার মঞ্চে একজন মানুষ কত ভিন্ন ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হয়, এখানে না আসলে কেউ অনুধাবন করতে পারবেনা। প্রবাসে এমনই এক একাকীত্বের জীবন আমাদের। বলা যয় এক ধরনের মানবেতর জীবন যাপন আমাদের। তবুও বুক বেঁধে আশায় থাকা একটু সুখের জন্য। যদি আমাদের এত কষ্টকর জীবনের অবসান ঘটিয়ে আশার আলো নিয়ে আসতে পারে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। বাচ্চাদের পড়াশুনার চাপ বড় হওয়ার সাথে সাথে বাড়তে থাকে। রীতিমত হিমশিম খেতে হয় পিতামাতাকে বাচ্চাকে বড় করে তুলতে, মানুষের মত মানুষ করে তুলতে। নিয়মনীতি, শৃঙ্খলা আর আইনের কঠিন বেড়াজালে শান্তিতে থাকলেও খুব একটা সুখে নেই আমরা। অধিকাংশ অভিবাসীরা এখানে এসে হতাশ। কারণ, মনের মত পান না অনেকেই, সাধারণ শ্রমিকের মত করতে হয় কঠিন কাজ। স্বদেশ থেকে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে এসে অনেককেই দেখা গেছে মনের মত কাজ না পেয়ে হতাশায় ভুগছেন।

বিশ্বব্যাপী উষ্ণতা বাড়লেও দিন দিন কানাডায় ঠান্ডা বেড়ে চলেছে, ৪ মৌসুমের স্থলে মূলত এখন শীত আর গ্রীষ্ম ২ মৌসুমের প্রভাবটাই বেশি, স্প্রিং আর ফল প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে। ১ ফুট ২ ফুট উঁচু তুষারপাত ঘটতে দেখা গেছে। এই শীত মৌসুমেই পার্শ্ববর্তী আমেরিকার বাফেলো শহরে ৫ ফুট পর্যন্ত তুষারপাত! প্রকৃতির প্রভাব জীবজগতের প্রাত্যহিক জীবনে বিরাট প্রভাব বিস্তার করে, গবেষণায় দেখা গেছে গ্রীষ্ম থেকে শীতে মানুষ অধিক হতাশা বোধ করে। ঘরবাড়ি হীন মানুষদের প্রচন্ড ঠান্ডার মধ্যে মারা যেতেও শুনেছি এখানে। অত্যধিক শীতের কারণে মানুষ হয়ে পরে অনেকটা গৃহবন্দী। এখানে হরতাল অবরোধ নেই, তবুও আমরা সহজে ঘর ছেড়ে বাইরে বেরুতে পারিনা শীতের সময়। তাপমাত্রা কখনো  মাইনাস ৩৫ ডিগ্রিতে নেমে যায়, বৈরী আবহাওয়া আমাদের অনেকটা অবরুদ্ধ করে ফেলে শীতের সময়।

যাইহোক প্রকৃতির প্রভাব মানুষের শরীর, মনকে প্রভাবিত করবে এটাই স্বাভাবিক। সাম্প্রতিক সময়ে কানাডা সহ নর্থ আমেরিকায় রেকর্ড গড়েছে মাইনাস ঠান্ডা আর তুষারপাত এর কারনে। বিশ্বজুড়ে উষ্ণতা বাড়লেও নর্থ আমেরিকার আবহাওয়া উল্টো পথে চলছে, অতীতে যা ঘটেনি। শুধু নতুন অভিবাসীদের মতামত নয় এখানে বসবাসকারী আতি প্রাচীন নাগরিকদেরও একই ধারনা, বর্তমানের প্রকৃতি আবহাওয়া তুষার যুগের কথা মনে করিয়ে দেয়।

নিজের অতীত মানুষ ভুলতে পারেনা, বর্তমান নিয়ে সুন্দর আর ভালোভাবে বেঁচে থাকতে কে না চায়। তবে তার জন্য অনেক মূল্য দিতে হয়। উন্নত আধুনিক দেশে থেকেও এতো অনুযোগ অভিযোগ করলে কে তা মেনে নিবে? বাস্তবতা আর স্বপ্নের মধ্যে যে অনেক ফারাক! দেশে থাকতে স্বপ্নের দেশ কানাডা আর বর্তমানের আবাস কানাডা এক নয়। একজন অভিবাসী হিসাবে আমি যা দেখেছি বুজেছি তাই লিপিবদ্দ করে দিলাম পাঠকের উদ্দেশে। অনেকেই আমার সংগে একমত সহমত পোষণ করবেন আবার অনেকেই ভিন্নমত প্রকাশ করবেন। প্রত্যাশার সংগে প্রাপ্তির বিস্তর ফারাক হলে মেনে নেবো কেন? প্রবাস জীবনকে দূর থেকে মধুর দেখালেও অভিবাসীদের জীবন মোটেও এতটা মধুর বা সুখকর নয়। এক হাতে যখন আগনিত কাজের চাপ পরে, খুব হিসেব করে বুঝেশুনে সামলে চলতে হয় প্রতিটি দিন প্রতিটি সপ্তাহ প্রতিটি মাস, বছর শেষে হিসাব জমা দিতে হয় খাজনা পাতির গ্যাঁড়াকলে। পরিবারের দুজন ফুলটাইম কাজ করেও বছর শেষে সঞ্চয় তেমন কিছুই নেই, ওয়েলফেয়ার, চাইল্ড বেনিফিট ইত্যাদি সুযোগ সুবিধা থাকা সত্ত্বেও নানা ধরনের বিল পরিশোধ করতে করতেই হিমশিম খেতে হয়। তখন হতাশা আর আক্ষেপ করা ছাড়া করার কি আছে।

তবে হরেক রকমের টানা পোড়েনের মধ্যেও অনেক ভাল কিছু আছে, বুদ্ধি করে চললে

হিসেব করে চললে এক সময় লক্ষে পৌঁছানো সম্ভব উত্তরণ সম্ভব তার উদাহরণও আছে অভিবাসীদের মধ্যে। অনেকেই পরিশ্রমের সাথে বুদ্ধি জুড়ে দিয়ে বর্তমানে বেশ ভাল আছেন সুখে আছেন শান্তিতে আছেন। কথায় বলে না শুধু হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করলে জীবনে সফলতা আসে না, হয়তো টিকে থাকা সম্ভব। অভিবাসীদের

ছিন্নমূল জীবন যাত্রায় অনেক যন্ত্রণা বঞ্চনা সহ্য করতে হয়, নিজেরা যেমন হাজারো সমস্যা মোকাবেলা করেন তাদের সন্তানদেরও নানা টানাপোড়েনের মধ্যে বেড়ে উঠতে হয়। ঘরে একধরনের ভাষা, বিদ্যালয়ে আরেক ধরনের ভাষা, ভাষাগত সমস্যা ছাড়া আছে ভিন্ন সংস্কৃতি ভিন্ন মানসিকতার মানুষ। উন্নত স্বাধীন মুক্ত চিন্তার দেশ ভাল মন্দ দুই ধরনের রাস্তাই খোলা। অভিভাবক হিসাবে অতি সাবধানে পথ চলতে হয় এখানে, এদেশে সন্তানকে শাসন করতে হয় অনেক বুঝে শুনে, সঠিক পথ প্রদর্শন করতে ভুল হলে হারে হারে তার মাশুল গুনতেও হয়। দেশের মত কড়া শাসনের বেড়াজালে বিদেশের মাটিতে সন্তানদের লালন পালন করা সম্ভব হয় না, নানা কারনে। আছে কঠোর আইনি জটিলতা- তাই একজন অভিভাবক হিসাবে যথেষ্ট সচেতন ও যতœবান  হতে হয় সন্তানকে মানুষ করে গড়ে তুলতে।

আস্তে আস্তে গড়ে উঠেছে এখানে বাঙ্গালী পারা, বাংলাদেশী পন্যের দোকানপাট, খাওয়ার দোকান, দেশী ফল শাঁক-সবজি, রান্নার মসলা, মিঠা পানির মাছ, দেশী মিষ্টি পিঠা কিনা পাওয়া যায় এখন দেশী গ্রসারি গুলোতে। সবই গড়ে তুলেছে গড়ে উঠেছে বাংলাদেশী প্রবাসী মানুষদের জন্য সকলের জন্য। বাংলা পত্রিকা ম্যাগাজিন প্রকাশিত হচ্ছে,  চায়ের আড্ডাও বসে দেশীয় আমেজে। গড়ে উঠেছে মসজিদ মন্দির, ঈদ পূজা পার্বণ অনুষ্ঠিত হয় যথারীতি, সামাজিক আঞ্চলিক সংগঠন সবই আছে, নাচের গানের অনুষ্ঠান পিকনিক কোন কিছুর কমতি নেই আজকাল। পরিশেষে ছিন্নমুল মানুষ হলেও এদেশে আমাদের শেকড় বা মূলটাকে গেথে নিতে পারলেই দুঃখ ঘুচবে। কিন্তু তার জন্য অনেক সময় এবং অনেক চড়াই উৎরাই পেড়িয়ে আসতে হবে আমাদের। যাযাবর, নির্বাসিত কিংবা ছিন্নমূল যে সংজ্ঞাই হোক, আমাদের আগামী প্রজন্ম আমাদের মত এই দুটানায় থাকবে না, প্রকৃত পক্ষেই মন এবং শরীর একত্রিত করে প্রবাসকেই আপন আবাস হিসাবে গড়ে তুলবে বলেই আমাদের বিশ্বাস। প্রবাস জীবন আজ আমাদের আবাস।

জয়ব্রত, টরন্টো।

Joydeb71@gmail.com