কানাডিয়ান বনাম মুসলিম : তরুন বয়সী মুসলিম কানাডিয়ানরা মুসলিম পরিচয়কেই প্রাধান্য দিচ্ছে বেশী

জুন ১৪, ২০১৬

সানিফা নাসের

লায়া ভেহবানী নিজেকে কতটা কানাডিয়ান ভাবেন সে নিয়ে তার মনে কখনোই কোন প্রশ্নের উদয় হয়নি। কিন্তু সম্প্রতি ভেঙ্গুভার এয়ারপোর্টের একটি ঘটনার কারণে বিষয়টি নিয়ে তিনি চিন্তিত।

৩১ বছর বয়সী ভেহবানী ব্রিটিশ কলম্বিয়ার সাইমন ফ্রেসার ইউনিভার্সিটির একজন লেকচারার। জন্ম তার ইরানে। তিনি যখন কানাডায় আসেন তখন তারা বয়স মাত্র ১৩। কিছুদিন আগে তিনি যখন ইরান সফর শেষে বাড়ি ফিরছিলেন তখন ভেঙ্গুভার বিমানবন্দরে বর্ডার সার্ভিসের লোকজন তাকে লাইন থেকে আলাদা স্থানে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। তারা তার ধর্ম সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করেন এবং কেন তিনি ঘনঘন ইরান যান তাও জানতে চান। একপর্যায়ে একজন কর্মকর্তা ভেহবানীর কাছে জানতে চান তিনি নিজেকে কতটা কানাডিয়ান ভাবেন।

প্রশ্নটি শুনে ভেহবানী যথেষ্ট বিস্মিত হন। তখন তিনি ঐ বর্ডার সার্ভিসের কর্মকর্তার কাছে জানতে চান কেন তিনি তাকে এই জাতীয় প্রশ্ন করছেন। ভেহবানী আরো জানতে চান এই বলে যে, মাথায় হেজাব বা ওড়না জরানো নেই এমন কাউকে কি এই প্রশ্ন করবেন আপনি?

ভেঙ্গুভার এয়ারপোর্টে ভেহবানী’র অভিজ্ঞতার বিষয়টি আসলে বিস্ময়কর কিছু নয়। কারণ এরকম অভিজ্ঞতার শিকার হচ্ছেন আরো অনেক কানাডিয়ান তরুণ তাদের দৈনন্দিন জীবনে। “তরুনরা যতই নিজেদেরকে কানাডিয়ান ভাবুক, সরকারী কোন কোন কর্মকর্তা মুসলিমদের সঙ্গে এমন ব্যবহারই করে থাকেন এবং এই ব্যবহার যে বার্তাটি দেয় তা হলো, ‘না, তুমি আমাদের কেউ নও’।”

উল্লেখ্য যে, সম্প্রতি প্রকাশিত এনভাইরনিক্স ইনস্টিটিউট কর্তৃক পরিচালিত এক জরীপ থেকে জানা যায় যে কানাডায় সিংহভাগ তরুন বয়সী মুসলিম নিজেকে প্রথমে একজন মুসলিম ভাবেন এবং এর পর ভাবেন কানাডিয়ান হিসাবে।

জরীপে অংশগ্রহণকারী তরুন মুসলিমরা জানান কানাডায় তাদের কাছে ধর্মীয় পরিচয় এবং কানাডীয় পরিচয় দুটোই গুরুত্বপূর্ণ। তবে এর মধ্যে ৬১% তরুণ মুসলিম মনে করেন মুসলিম পরিচয়টাই তাদের কাছে প্রথম গুরুত্বপূর্ণ। ৬% বলেন কানাডীয় পরিচয় তাদের কাছে বেশী গুরুত্বপূর্ণ। অপরদিকে ২৬% তরুন কানাডীয় মুসলীম মনে করেন উভয় পরিচয়ই তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।

গত ২০১৫ সালের নভেম্বর থেকে শুরু করে এবছর জানুয়ারী পর্যন্ত ৬০০ মুসলিম কানাডিয়ানের উপর পরিচালিত এক জরীপ থেকে এই তথ্য পাওয়া গেছে। জরীপটি চালিয়েছে এনভাইরনিকস ইন্সিটিউট নামের একটি সংস্থা। এই সংস্থাটি দশ বছর আগেও এরকম একটি জরীপ চালিয়েছিল। এবারের জরীপ তারই ফলোআপ।

তবে সাইমন ফ্রেসার ইউনিভার্সিটির লেকচারার ভেহবানী’র অভিজ্ঞতার সঙ্গে জরীপে অংশগ্রহণকারীদের প্রায় এক চতুর্থাংশের অভিজ্ঞতার মিল রয়েছে। দেখা গেছে জরীপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ২৬% বৈষম্যে শিকার হয়েছেন ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে যাদের বয়স ১৮ থেকে ৩৪ এর মধ্যে। আর ২৪% বৈষম্যের শিকার হয়েছেন তাদের কলচারাল বা এথনিক ব্যাকগ্রাউন্ডের কারণে।

এনভাইরনিক্স ইনস্টিটিউট কর্তৃক পরিচালিত জরীপে অংশগ্রহনকারীদের প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৮ জনই বলেন তারা কানাডিয়ান হিসাবে ‘খুবই গর্বিত’। কিন্তু যখন প্রশ্ন করা হয় তাদের প্রথম পরিচয় কোনটি – মুসলিম না কানাডিয়ান? এই প্রশ্নের উত্তরে তরুন কানাডিয়ান মুসলিমদের জবাব ছিল- প্রথমে তারা মুসলিম এবং পরে কানাডিয়ান। যাদের জন্ম কানাডায় তাদের জবাবও ছিল তারা প্রথমে মুসলিম পরে কানাডিয়ান।

টরন্টো নিবাসী আজিজা কানজী নামের এক আইন বিশেষজ্ঞ বলেন, মুসলিম বিধায় কানাডায় সর্বক্ষণ নজরদারীতে থাকাটা সত্যিকার ভাবেই একটা বাজে অভিজ্ঞতার বিষয়। তিনি আরো বলেন, কানাডায় মুসলিম তরুনেরা প্রায়ই একটি চাপের মধ্যে থাকেন ব্যাখ্যা প্রদান করার জন্য যখন কোন স্থানে কোন জঙ্গী হামলা চলে ইসলামের নাম করে।

জরীপে ইতি টানা হয় এই বলে যে, ৯১১ এর উদ্বেগ কমে আসলেও ইমিগ্রেন্টদের কালচারাল ইন্টিগ্রেশন নিয়ে জনতার উদ্বেগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর মুসলিম জনগোষ্ঠির প্রতি সন্দেহ না থাকলেও অন্তত তাদেরকে নিয়ে একটা অস্বস্তির ভাব কিছু লোকের মধ্যে থেকেই যাবে।

ক্যালগারীর একজন বিজনেস কনসালটেন্ট রহমতউল্লাহ সিদ্দিক বলেন,“আমরা দেখে আসছি বিশেষ কিছু চরমপন্থী দল তাদের জঙ্গীবাদী কার্যক্রম চালিয়ে আসছে এবং এটি করতে গিয়ে তারা আমাদের ধর্মকে ব্যবহার করছে যা সত্যিকার অর্থেই দুর্নাম সৃষ্টি করেছে”।

ওকভিলের বাসিন্দা ২৭ বছর বয়সী আছিয়া মোস্তাকিম বলেন, কানাডায় আমরা যেটা অনুভব করি তা হলো, ইসলামের নাম করে যে সকল জঙ্গীবাদী কার্যক্রম চলে আসছে সেগুলোর বিচারেই আমাদেরকে মূল্যায়ন করা হয়। পাশাপাশি এটিও সত্যি যে, পৃথিবীর কোন কোন অঞ্চলে একদল মানুষ আছেন যারা নিজেদেরকে মুসলিম হিসাবে পরিচয় দেন এবং এই পরিচয় নিয়েই তারা ভয়ংকরসব জঙ্গীবাদী কাজ করে বেড়ান। আর কিছু কিছু কানাডিয়ানও আছেন যারা এই সকল দেখেই আমাদের সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছান।

ইউনিভার্সিটি অব টরন্টোর পলিটিক্যাল সায়েন্স এর লেকচারার ক্যাথেরীন বুলক বলেন, মুসলিম নামধারী জঙ্গীদের হামলার পর কানাডার তরুন মুসলিমরা বিষয়টি ব্যাখ্যা দানের জন্য চাপের মধ্যে থাকেন এবং ফলশ্রুতিতে কেউ কেউ নিজেদেরকে ইসলাম ধর্মের মতবাদ থেকে সরিয়ে নেন। আবার কেউ কেউ ইসলাম ধর্মের মতবাদকে আরো বেশী করে আকড়ে ধরে রাখার চেষ্টা করেন।

ক্যাথেরীন বুলক এনভাইরনিকস এর জরীপ কার্যের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। তিনি আরো বলেন, জরীপের নম্বর প্রকৃত অবস্থার সবটা তুলে ধরেনি। তিনি বলেন, অনেক মুসলিম তরুন হতাশ এ ব্যাপারে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, এই মন্তব্য আমি আমার নিজের গবেষণা থেকে করছি। জরীপ রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে নয়। কানাডার মুসলিম তরুনেরা অনুভব করেন যে তাদের কানাডিয়ান পরিচয় প্রশ্নবিদ্ধ করে রাখা হয়েছে। অবস্থাটা এমন হয়েছে যেন তাদের নাগরিকত্ব সরকারের খেয়াল খুশীর উপর নির্ভরশীল হয়ে আছে। আজকের দিনে কানাডায় মুসলিম পরিচয় মানেই সে নজরদারীতে আছে।

উভয় পরিচয়ই গর্ব করার মত

অনেক তরুন কানাডিয়ান মুসলিম মনে করেন কোথায় তার মুসলিম পরিচয় শেষ হলো এবং কোথায় শুরু হলো তার কানাডিয়ান পরিচয় – এটি একটি অর্থহীন বিতর্ক। মন্ট্রিয়লে জন্ম নেয়া মুসলিম তরুন ২৫ বছর বয়সী আর্ডেন মালিক এর কোন কারণ খুঁজে পান না কেন তাকে এই পরিচয় বেছে নিতে হবে। আরেকজন ছাত্র রহমতুল্লাহ সিদ্দিকীও বলেন, এই দুই পরিচয়ের মধ্যে আমি কোন বিরোধ দেখি না। আমি এই দুই পরিচয়েই গর্ববোধ করি।

এনভাইরনিকস এর জরীপে যারা অংশ নিয়েছেন তারা বলেন, মুসলিম এবং কানাডিয়ান এ দুটি পরিচয়ই তাদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সার্বকভাবে ৮৪% মুসলিম বলেন ধর্ম অধিক গুরুত্বপূর্ণ আর ৮১% মুসলিম বলেন কানাডার জাতীয়তা।

জরীপে আরো দেখা গেছে, যুবক বয়সী মুসলমানদের মধ্যে নিয়মিত ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। তারা বয়স্ক মুসলমানদের তুলনায় নিজেদের মুসলিম পরিচয়ের ব্যাপারে বেশী অনুরক্ত। তারা বৈষম্যের ব্যাপারে বেশী উদ্বিগ্ন এবং হতাশাগ্রস্তও। যাদের মধ্যে এই প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে তারা নিয়মিতই মসজিদে যাওয়া আসা করেন সম্ভবত।

তরুন মুসলিমদের চেয়ে যে সকল বয়স্ক মুসলিম (ষাটোর্ধ) বেশী হারে নিজেদের কানাডিয়ান পরিচয়কে অধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকেন সংখ্যায় তারা তরুনদের চেয়ে দ্বিগুন বেশী। আর এই বয়স্ক মুসলিমদের প্রায় সবারই জন্ম কানাডার বাইরে। ব্যাপারটি এ কারণেও হতে পারে যে, এই বয়স্ক মুসলিম কানাডিয়ানদেরকে তাদের ছেড়ে আসা দেশে অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখমুখি হয়েছিল।

জরীপে আরো দেখা যায় কানাডায় ৮৩% মুসলমান নিজেদেরকে কানাডিয়ান ভেবে খুবই গর্ববোধ করেন। ২০০৬ সালের তুলনায় এই গর্ববোধের অনুভূতি বৃদ্ধি পেয়েছে ১০%। আর কৌতুহলের বিষয় হলো, অমুসলিম জনগোষ্ঠির মধ্যে এই অনুভূতি মুসলমানদের তুলনা কম। ৭৩% অমুসলিম খুবই গর্ববোধ করেন নিজেদের কানাডিয়ান পরিচয় নিয়ে।

টরন্টোর অধিবাসী আইন বিশেষজ্ঞ আজিজা কানজী বলেন, কানাডার মুসলিম তরুনরা নিজেদেরকে প্রথমে মুসলিম ও পরে কানাডিয়ান ভাবার পিছনে কারণটা হলো, তারা এখানে যথেষ্ট শক্ত অবস্থানে আছেন। তাদের জন্ম বা বেড়ে উঠা এই দেশটিতে। তারা তাদের অধিকার ও স্বাধীনতা বিষয়ে সম্যকভাবে ওয়াকিবহাল। তারা এই সমাজে শুধু ইসলামোফোবিয়াই নয় অন্যান্য সম্প্রদায় যেমন কৃষ্ণাঙ্গ ও আদিবাসীদের প্রতি যে বর্ণবাদ ও বৈষম্য চলে আসছে সে ব্যাপারেও সজাগ ও সোচ্চার। আর এরই ধারাবাহিকতায় তারা বলতে পারছেন যে, “না আমি নীরবে মেনে নিতে পারবো না আমার মুসলিম পরিচয়কে পাশে রেখে কানাডিয়ান পরিচয়কে বেশী প্রাধান্য দেওয়ার দাবীকে।”

ফিরে আসা যাক সেই ব্রিটিশ কলম্বিয়ার সাইমন ফ্রেসার ইউনিভার্সিটির লেকচারার লায়া ভেহবানীর প্রসঙ্গে যিনি ভেঙ্গুভার এয়ারপোর্টে নাজেহাল হয়েছিলন বর্ডার সার্ভিসের কর্মকর্তাদের হাতে। তিনি বলেন আমার মুসলিম পরিচয়কে ত্যাগ করার যে মানসিক চাপ রয়েছে তার বিরুদ্ধে দাড়াতে গিয়ে আমাকে অধিকহারে মনোযোগী হতে হয়েছে কানাডিয়ান আইন ও রাজনীতি সম্পর্কে। আমাকে জানতে হয়েছে এখানকার আইন কি বলে এবং রাজনীতি আসলে কি চায়। এর ফলাফল যা হয়েছে তা হলো আমি এখন অধিকমাত্রায় একজন সচেতন কানাডিয়ান সিটিজেন হয়ে গেছি। বস্তুত পক্ষে আমরা যখন আমাদের সম্পর্কে বেশী করে জানবো, তখন আমরা এও জানবো যে আমাদের সমাজ কি চায় এবং কিসের পক্ষে। এবং এর মাধ্যমে আসলে আমরা তরুন মুসলিমরা আরো বেশী করে কানাডিয়ান হয়ে উঠেছি।

সৈজন্যে : সিবিসি নিউজ