কানাডায় হালাল ফুড বিতর্ক

মে ৮, ২০১৬

খুরশিদ আলম ॥

কানাডায় হালাল ফুড নিয়ে আবারো বিতর্ক  শুরু হয়েছে। এই বিকর্ত শুরু হয় কানাডিয়ান ফুড ইন্সপেকশন এজেন্সি (CFIA) কর্তৃক একটি নতুন আইন প্রবর্তনের পর। গত ৪ এপ্রিল থেকে কার্যকরী ঐ আইনে বলা হয় কানাডায় কোন খাদ্যদ্রব্যের প্যাকেটের গায়ে হালাল শব্দটি সংযুক্ত করতে হলে কে বা কারা হালালের সার্টিফিকেট প্রদান করেছেন তাদের নামও লেখা থাকতে হবে। নতুন এই আইন প্রবর্তনের আগে হালাল সার্টিফিকেট প্রদানকারী ব্যক্তি বা সংস্থার নাম থাকা বা না থাকার বিষয়ে কোন বাধ্যবাধকতা ছিল না।

তবে CFIA তাদের নতুন প্রবর্তিত আইনে এ কথা জানায়নি কে বা কারা হালাল সার্টিফিকেট প্রদানের বৈধ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান। তাছাড়া CFIA হালাল সার্টিফিটেক প্রদানকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের উপর কোন নজরদারীও করে না। বিষয়টি তারা ছেড়ে দিয়েছে কানাডায় বসবাসরত মুসলিম কমিউনিটির সদস্যদের উপর। তবে বাজারে বিক্রি হচ্ছে এমন কোন হালাল ফুড সম্পর্কে কারো কোন সন্দেহ বা অভিযোগ থাকলে তারা নালিশ আকারে সেটি CFIA কর্তৃপক্ষকে জানাতে পারেন।

উল্লেখ্য যে, কানাডায় হালাল এর নাম করে যে সকল খাদ্য বিশেষ করে মাংস বাজারে বিক্রি হচ্ছে তা প্রকৃতপক্ষে কতটা হালাল সেই বিতর্ক যেমন রয়েছে, তেমনি বিতর্ক রয়েছে যারা হালাল সার্টিফিকেট প্রদান করে থাকেন তাদের কারো কারো গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও। বিতর্কের শেষ এখানেই নয়। মেশিনে পশু বা মুরগী জবাই করা হালাল কি না সে নিয়েও মুসলিম ধর্মীয় গুরুরা আজ পর্যন্ত কোন চুড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেননি। CFIA কর্তৃক প্রবর্তিত নতুন আইন এই বিতর্কসমূহকে নতুন করে আবারো সবার সামনে নিয়ে এসেছে।

সমস্যা হচ্ছে, কানাডায় কোন জাতীয় তত্ত্বাবধায়ক কমিটি নেই যারা হালাল সার্টিফিকেট প্রদানকারীদের যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা দেখে তাদেরকে স্বীকৃতি দিবেন। বর্তমানে হালাল সার্টিফিকেট প্রদানকারী যে কয়টি সংগঠন বা সংস্থা রয়েছে তারা প্রত্যেকেই দাবী করেন তাদের প্রদত্ত সার্টিফিটেকই বিশুদ্ধ বা খাঁটি। কিন্তু কৌতুহলদ্দীপক বিষয় হলো, সার্টিফিকেট প্রদানকারী এই সংগঠন বা সংস্থাগুলোর অনেকেই একজন আরেকজনকে স্বীকৃতি দেন না। অর্থাৎ সংস্থা ‘এ’ বলে বেড়ায় যে সংস্থা ‘বি’ এর সর্টিফিকেট বিশুদ্ধ বা খাঁটি নয়। অপর দিকে সংস্থা ‘বি’ও বলে বেড়ায় যে সংস্থা ‘এ’ এর সার্টিফিকেট বিশুদ্ধ বা খাঁটি নয়।

কানাডায় এই বিতর্ক চলে আসছে দীর্ঘদিন ধরেই। CFIA কর্তৃক নতুন আইন প্রবর্তিত  হওয়াতে এখন আশংকা দেখা দিয়েছে এই ভেবে যে, হালাল সিলের সঙ্গে নিজেদের নাম যুক্ত করে যে কেউই দাবী করে বসতে পারেন যে তারা হালাল সার্টিফিকেট প্রদানের বৈধ প্রতিষ্ঠান। কারণ, এখানে সার্টিফিকেট প্রদানকারীদের বৈধতা বা যোগ্যতা যাচাই করার জন্য সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য কোন একক জাতীয় প্রতিষ্ঠান নেই। উল্লেখ্য যে, কানাডায় বর্তমানে এক ডজনেরও বেশী হালাল সার্টিফিকেট প্রদানের প্রতিষ্ঠান রয়েছে।

টরন্টোতে জন্মগ্রহণকারী ও বড় হওয়া মুসলিম পন্ডিত শেখ ওমর সুবেদার সম্প্রতি সিবিসিতে প্রদত্ত এক সাক্ষাৎকারে বলেন, নতুন এই আইন প্রবর্তন সত্বেও হালাল সার্টিফিকেট প্রদানের ক্ষেত্রে যথেষ্ট অনিয়ম করার সুযোগ রয়েছে। তবে ভাল দিকটি হলো এই যে, এখন অন্তত প্রশ্ন তোলা যাবে এই বলে যে, কে এই সার্টিফিকেট প্রদানকারী এবং কি তাদের শর্তসমূহ।

শেখ ওমর সুবেদার ব্রাম্পটনের জামে মক্কা মসজিদের ইমাম এবং ‘দি হালাল মনিটরিং অথরিটির সাধারণ সম্পাদক। গ্লোব এন্ড মেইলের কাছে দেওয়া অন্য এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, আমি মনে করিনা নতুন এই আইন কোন বড় ধরণের পরিবর্তন আনবে।

উল্লেখ্য যে ওমর সুবেদার ইতিপূর্বে নিজেই একবার টরন্টো অঞ্চলে অবস্থিত কয়েকটি ফুড প্লান্টে পর্যবেক্ষণ চালিয়েছিলেন হালাল পরিস্থিতি দেখার জন্য। তিনি সে সময় যে চিত্রটি দেখতে পান তা মোটেও সুখকর ছিল না। পর্যবেক্ষণে তিনি দেখতে পান অনেক প্লান্টেই হালাল ফুড প্রসেসিং এর জন্য যে নির্ধারিত মান বা নিয়ম কানুন রয়েছে তা অনুসরণ করা হয় না। হালাল ফুড এবং যে গুলো হালাল ফুড নয় সেগুলো একত্রেই রাখা হয় কোন কোন প্লান্টে। কোন কোন প্লান্টের কর্র্মীগণ পশু জবাই করার সময় ইসলামী নিয়ম সঠিকভাবে অনুসরণ করেন না। প্রায়ই তারা গল্পগুজবে মেতে উঠেন।

সরকারী হিসাবে কানাডায় বর্তমানে হালাল ফুডের মার্কেট রয়েছে এক বিলিয়ন ডলারেরও বেশী। বিশাল অংকের এই হালাল ফুডের মার্কেট নিয়ে কোন কোন ক্ষেত্রে জালিয়াতি বা প্রতারণা হচ্ছে এ কথাও সাবাই জানেন। অর্থাৎ হালাল নয় এমন পণ্যকেও হালাল বলে চালিয়ে দিচ্ছেন কোন কোন ফুড প্রসেসিং প্রতিষ্ঠানের মালিক। আর এই প্রতারণার মাধ্যমে বাড়তি অর্থ আদায় করে নিচ্ছেন তারা গ্রাহকদের কাছে থেকে। বিষয়টি নিয়ে গত ২০১০ সালের অক্টোবর মাসে টরন্টোতে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ঐ বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন কানাডার মুসলিম নেতৃবৃন্দের প্রতিনিধিসহ স্থানীয় ফুড ইন্ডাস্ট্রির প্রতিনিধি ও সরকারী প্রতিনিধিগণ। তারা সকলেই আশংকা প্রকাশ করেন এই বলে যে, ক্রমবৃদ্ধিমান এই হালাল ফুডের মার্কেট নিয়ে একশ্রেণীর ব্যবসায়ী জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে গ্রাহকদের ঠকাচ্ছেন। ঐ বৈঠকেরই ফলাফল CFIA কর্তৃক প্রণীত আজকের এই নতুন আইন।

কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, নতুন এই আইন সত্যিকার অর্থে কতটা সহায়তা করবে হালাল ফুডের নিশ্চয়তা প্রদানের ক্ষেত্রে? CFIA তো বলেই খালাস যে হালাল ফুডের প্যাকেটের গায়ে লিখতে হবে কে বা কারা হালালের সার্টিফিকেট প্রদান করেছেন। কিন্তু তাতেই কি নিশ্চিত হওয়া যাবে যে দোকানের তাকে সাজিয়ে রাখা খাবারগুলো সত্যিকার অর্থেই হালাল? হালাল শব্দটির সঙ্গে আরো দুটি লাইন যোগ করে হালাল সার্টিফিকেট প্রদানকারীর নাম যোগ করার জন্য বাড়তি কোন খরচ হওয়ার কথা নয়  হালাল ফুড প্রস্তুতকারী বা প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানের পক্ষে। সুতরাং তারা এটি বিনা বাক্য ব্যয়েই করে নিবেন।

কানাডায় হালাল ফুড এর ব্যবসা খুব বেশীদিনের পুরানো নয়। অতীতে মুসলমানদের সংখ্যা এই দেশটিতে তেমন উল্লেখযোগ্য ছিল না। ফলে এই ব্যবসাও তেমন প্রসার লাভ করেনি। কিন্তু সাম্প্রতিককালে বিশেষ করে গত দুই বা তিন দশকে মুসলমান ইমিগ্রেন্ট সংখ্যা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে কানাডায়। আর তার সাথে পাল্লা দিয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে হালাল পন্যের ব্যবসাও। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, বর্তমানে কানাডায় হালাল ফুডের ব্যবসা হয় বছরে এক বিলিয়ন ডলারেরও বেশী। ফলে এর সঙ্গে বিরাট অংকের লাভও জড়িত। বিষয়টি নজরে এসেছে কানাডার মূলধারার ব্যবসায়ীদেরও। সে কারণে তারাও এর দিকে নজর দিয়েছেন। মেট্রো, নো ফ্রিলস, ওয়ালমার্টের মত বড় বড় গ্রোসারী স্টোরগুলোতেও অনেকদিন ধরেই হালাল পণ্য রাখা শুরু হয়েছে। কোন কোন মেইনস্ট্রিম গ্রোসারীতে হালাল পণ্যের জন্য আলাদা সেকশনও খোলা হয়েছে। চাইনিজ সুপারমার্কেটগুলোতেও এখন হালাল মাংস বিক্রি হয়। কোন কোনটিতে আবার আলাদা সেকশন খোলা হয়েছে যেগুলো পরিচালনা করেন মুসলমানগণ। কিন্তু এই সকল গ্রোসারীতে সাপ্লাইকৃত মাংস কতটুকু হালাল না হারাম সেই বিষয়টি গোসারী কর্তৃপক্ষের পক্ষে নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। তাছাড়া অমুসলিম মালিকানাধিন গ্রোসারী বা ফুড প্রসেসিং সেন্টারে প্রস্তুতকারী হালাল ফুড মুসলিম ক্রেতাদের জন্য হালাল নয় সেরকম কথাও বলা আছে ধর্ম বিষয়ক গ্রন্থে।

ধর্ম বিষয়ক গ্রন্থে আরো বলা আছে – “ধারাল ছুরি দিয়ে ‘বিসমিল্লাহ আল্লাহু আকবর’ বলে গলা কাটতে হবে। … জবাই করার সময় যদি কেউ ইচ্ছে করে বিসমিল্লাহ না পড়েন, সে ক্ষেত্রে পশুটি মরা লাশ হিসাবে গণ্য হবে এবং হারাম হয়ে যাবে। অবশ্য ভুল করে না পড়ে থাকলে কোন সমস্যা নেই। ভোতা ছুরি দিয়েও জবাই করা যাবে না। এতে জবাই মাকরূহ হয়ে যাবে। পশুকে কষ্ট দেওয়া শরীয়তে নিষেধ আছে। মুরগী জবাই করার সময় যদি ভুলক্রমে গলা আলাদা হয়ে যায় তবে মুরগী খাওয়া দুরস্ত। গলা সম্পূর্ণ কেটে দেওয়া মাকরূহ।”

ধর্ম বিষয়ক গ্রন্থে আরো বলা আছে “বিসমিল্লাহ বলে যে কোন মুসলমানের জবাই করা পশু হালাল। এমনকি নাপাক অবস্থায় জবাই করলেও তা হালাল হিসাবেই গণ্য হবে। তবে অমুসলিম কারোর হাতে জবাই করা পশু হারাম। কোন বিধর্মীর দোকান হতে মাংস কিনে খাওয়া জায়েজ নয়। এমনকি উক্ত দোকানের মালিক বা কর্মচারী যদি দাবী করেন যে, মুসলমান দ্বারা জবাই করা হয়েছে, তবু তা জায়েজ নয়। তবে জবাইয়ের সময় হতে বিক্রয় পর্যন্ত কোন মুসলমান যদি বিষয়টি সর্বক্ষণ লক্ষ্য রাখেন বা তদারকী করে থাকেন, এক মিনিটের জন্যও অদৃশ্য না হয়ে থাকেন এবং সেই মুসলমান যদি বলেন পশুটি মুসলমানের হাতে জবাই করা এবং জবাই থেকে শুরু করে বিক্রয় পর্যন্ত আমি এর তদারকীতে ছিলাম তবে সে মাংস খাওয়া জায়েজ হবে।”

হালাল মাংসের নিয়ম কানুন সম্পর্কে উপরে যে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে তা নেওয়া হয়েছে বেহেশতী জেওর নামক গ্রন্থ থেকে। গ্রন্থটিতে লেখক হিসাবে যার নাম রয়েছে তিনি হলেন, হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী চিশতী (রাঃ)। গ্রন্থটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন ঢাকার জামেয়া কোরআনিয়ার প্রাক্তন অধ্যক্ষ্য হযরত মাওলানা শামছুল হক (রা) ফরিদপুরী।

এখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠতে পারে, উপরে উল্লেখিত নিয়ম অনুযায়ী কানাডার শতকরা কয়টি ফার্মে এবং গ্রোসারীতে সত্যিকার অর্থে  হালাল মাংস বিক্রি হচ্ছে? মূলধারার গ্রোসারীগুলোর রেফ্রিজারেটর বা কুলারে যে হালাল মাংস রাখা হয় সেটি তো কোন মুসলমান স্টাফ সার্বক্ষণিক তদারকী করেন না। তাছাড়া ফার্ম থেকে যে ডেলিভারী ম্যান মাংস দিয়ে যান তিনি তো অন্যধর্মের কেউ হতে পারেন। অন্যদিকে যে সব ফার্ম থেকে মাংস সাপ্লাই দেওয়া হয় সেই সব ফার্মের কজন মালিক মুসলমান?

হালাল মাংস নিয়ে সমস্যা আরো আছে। আমরা জানি কানাডার বড় বড় ফার্মগুলোতে মুরগী জবাই করা হয় মেশিনে। যে প্রক্রিয়ায় সেখানে মুরগী জবাই করা হয় তাতে কিছু কিছু মুরগীর গলা আলাদা হয়ে যায়। কিন্তু আমরা জেনেছি, মুরগী জবাই করার সময় যদি ভুলক্রমে গলা সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে যায় তবে সেই মুরগী খাওয়া দুরস্ত। গলা সম্পূর্ণ কেটে দেওয়া মাকরূহ। তাছাড়া মেশিনে অতি দ্রুত (মিনিটে ১৪০ টি এবং ঘন্টায় ৮৪০০ টি) মুরগী জবাই করা হয় বলে প্রতিটি মুরগীর বেলায় ‘বিসমিল্লাহ আল্লাহু আকবর’ বলা সম্ভব হয়ে উঠেনা। এটা কোন মানুষের পক্ষেই সম্ভব নয়। সে ক্ষেত্রে ঐ সব মুরগীর মাংস কতটা হালাল?

হালাল মাংস নিয়ে কানাডায় বিতর্কের শেষ নেই। কেউ কেউ বলেন, মেশিনে পশু বা পক্ষী জবাই করা হলে তা আর হালাল থাকে না। হাতে না কাটলে তা হারাম হয়ে যায়। এর বিরোধী পক্ষ বলেন, নিয়ম মেনে অর্থাৎ মুসলমান কর্মচারী দিয়ে জবাই করার আগে ‘বিসমিল্লাহ আল্লাহু আকবর’ বলে মেশিনে জবাই করলে তা হালাল বলেই গণ্য হবে। তাদের যুক্তি হলো, প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে জবাই করার পদ্ধতিও পরিবর্তন করা যেতে পারে।

এখন কানাডার সাধারণ মুসলমান ক্রেতারা কার কথায় বিশ্বাস করবেন? মেশিনে জবাই বনাম হাতে জবাই বিতর্কের একটি বাস্তব উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে এখানে। টরন্টোতে ‘আল সাফা হালাল’ নামের একটি মিট কোম্পানীর মালিক ‘ইসনা’র কাছ থেকে হালাল সার্টিফিকেট নিত। এই মিট কোম্পানীর মালিক মুসলমান নন। মেশিনে পশু বা পক্ষী জবাই করা হালাল নয় এই বিতর্ক শুরু হলে বেশ কিছু অভিযোগ পায় প্রতিষ্ঠানটি তার গ্রাহকদের কাছ থেকে। গ্রাহকগণ অভিযোগ করে বলেন, আল সাফা হালাল যে প্রক্রিয়ায় (মেশিনে) পশু বা মুরগী জবাই করছে তা বৈধ নয়। এই পরিস্থিতিতে গ্রাহক ধরে রাখার জন্য প্রতিষ্ঠানটি হাতে জবাই করা মাংস সাপ্লাই করার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু বাধ সাধে ইসনা। হাতে জবাই করা হলে ইসনা হালাল সার্টিফিকেট দিবে না বলে জানিয়ে দেয়। এই অভিযোগ আল সাফা’র। তবে ইসনার বক্তব্য ছিল অন্যরকম। তারা বলে, আল সাফা মুরগী জবাই করার জন্য শ্রমিকদের কম বেতন দিতে চায় বলে তারা সর্টিফিকেট দিতে অস্বীকৃতি জানায়। এরকম অভিযোগ পাল্টা অভিযোগ কিছুদিন চলতে থাকে ইসনা ও আল সাফা’র মধ্যে। পরবর্তীতে আল সাফা  গ্রাহকদের সন্তুষ্টি রক্ষার জন্য হাতে জবাই করা মুরগীই সাপ্লাই দিতে থাকে। আর হালাল সার্টিফিকেটের জন্য ইসনার পরিবর্তে ইসলামিক ফুড এন্ড নিউট্রিশন কাউন্সিল অব আমেরিকা’র সাথে চুক্তিতে আবদ্ধ হয়।

আগেই উল্লেখ করেছি, হালাল ফুড নিয়ে বিতর্ক শুধু কানাডায়ই নয়, পাশ্চাত্যের আরো অনেক দেশেই চলছে একই অবস্থা। এই দেশগুলোর মধ্যে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়সহ আরো বেশ কয়েকটি দেশ। আর বিতর্ক শুরু হওয়ার আরেকটি কারণ, সত্যিকার ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী ঢুকে গেছে হালাল ফুডের ব্যবসায়। এই অসাধু ব্যবসায়ীদের কাছে লাভটাই মূখ্য। মানুষের ধর্মবিশ্বাসের প্রতি কোন শ্রদ্ধাবোধ নেই এদের। যারা নীতি ও আদর্শ বজায় রেখে এবং মানুষের ধর্ম ও বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে হালাল ফুডের ব্যবসা করে আসছেন তারা এই অসাধু ব্যবসায়ীদের কার্যকলাপের কারণে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সাধারণ ক্রেতারাও।

বর্তমানে কানাডায় প্রায় দশ লাখ মুসলমান বাস করেন। আগামী ২০ বছরে এই সংখ্যা ৩০ লাখে দাঁড়াতে পারে বলে ফোরাম অন রিলিজিয়ন এন্ড পাবলিক লাইফ এর এক জরীপ রিপোর্ট থেকে জানা যায়। এ থেকেই অনুমান করা যেতে পারে হালাল ব্যবসায় অসাধু ব্যবসায়ীরা কেন ঝাঁপিয়ে পড়েছেন।

স্ট্যাটিসটিক্স কানাডার হিসাব থেকে দেখা যায়, কানাডার মুসলিম পরিবারগুলো সপ্তাহে প্রায় ৩১ ডলার ব্যয় করেন হালাল মাংস ক্রয়ের জন্য যা মূলধারার পরিবারের চেয়ে প্রায় দ্বিগুন বেশী। তবে কানাডায় সব মুসলমানই হালাল ফুড ক্রয় করেন না। যারা হালাল মাংস ক্রয় করেন তারা মাংসের মূল্য বিবেচনায় আনেন না। দাম একটু বেশী দিতে হলেও তারা হালাল মাংসই ক্রয় করে থাকেন। কিন্তু মনে একটি সন্দেহ থেকেই যায় ক্রেতাদের। কারণ, হালাল মনে করে যে মাংস তারা গ্রোসারী থেকে ক্রয় করছেন তা যে শতভাগ হালাল তার গ্যারান্টি কে দিবে? এক পক্ষ বলছেন, মেশিনে জবাই করা পশু বা পক্ষীর মাংস হালাল নয়। অপর পক্ষ বলছেন মেশিনে জবাই করা পশু বা পক্ষীর মাংস হালাল। অন্যদিকে এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী হালাল নয় এমন মাংসের প্যাকেটে হালাল সিলের স্টিকার লাগিয়ে দেদার প্রতারণা করে যাচ্ছেন ক্রেতাদের সঙ্গে।

কোন নিয়ন্ত্রণ নেই এই অসাধু ব্যবসায়ীদের উপর।

ইতিপূর্বে এরকম একটি পরিস্থিতিতে যুক্তরাজ্যের  ইসলামিক সোসাইটির ইমাম আজমল মাসরুর বলেন, হালাল মাংস ক্রয় বা ভক্ষণের ক্ষেত্রে  ক্রেতার পক্ষে সম্ভব নয় প্রতিবার তা পরীক্ষা করে দেখা। তিনি বলেন, বিক্রেতা যদি বলেন এই মাংস হালাল, তবে ক্রেতার জন্য সেটাই পর্যাপ্ত। তিনি অবশ্য স্পষ্ট করে বলেননি মেশিনে জবাই করা পশু বা পক্ষীর মাংস হালাল নাকি হারাম।

পাশ্চাত্যর দেশসমূহের মধ্যে ফ্রান্সে মুসলমানদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশী। ২০১৪ সালের হিসাব মতে সে দেশটিতে ৬.১৩ মিলিয়ন মুসলমান বাস করেন। (সূত্র : http://www.muslimpopulation.com/Europe/।) আর হালাল মাংস নিয়ে জালিয়াতিও সম্ভবত সেই দেশটিতেই বেশী হয়। ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের নানটেরী উপশহরের একটি হালাল সুপারমার্কেটের সত্ত্বাধিকারী রশিদ বাখলাক ইতিপূর্বে বিবিসির এক সাংবাদিককে বলেন, ফ্রান্সে নকল হালাল মাংসের রমরমা ব্যবসা চলছে। তাঁর মতে বাজারে যে সব মাংস বিক্রি হচ্ছে হালাল নামে তার শতকরা ৮০ ভাগই ভুয়া। তার ঐ বক্তব্যের পক্ষে কি প্রমাণ আছে তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্যারিসের বাইরে একটি হোলসেল মার্কেটে তিনি নিজে দেখেছেন লোকজন সিল-ছাপ্পর নিয়ে বসে আছেন যারা অর্থের বিনিময়ে যে কোন প্রডাক্টের গায়ে  হালাল সিল মেরে দেওয়ার জন্য প্রস্তুত। প্রতি কিলোতে এরা ১৫ সেন্ট করে দাবী করেন সিল মারার জন্য।

প্যারিসের অনেক মুসলমানই মনে করেন রশিদের বক্তব্য সত্য। আর ফ্রন্সের মতো কানাডায় হালাল মাংসের ব্যবসা নিয়ে জালিয়াতি সেরকম ব্যাপক মাত্রায় না হলেও একেবারে কমও নয়। আর সে কারণেই কানাডার মুসলিম নেতৃবৃন্দের প্রতিনিধিসহ স্থানীয় ফুড ইন্ডাস্ট্রির প্রতিনিধি ও সরকারী প্রতিনিধিগণ গত ২০১০ এক বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করার জন্য। বৈঠকে তারা সকলেই একমত হন যে, একশ্রেণীর ব্যবসায়ী জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে গ্রাহকদের ঠকাচ্ছেন।

কিন্তু জালিয়াতি রোধে কোন কার্যকরী পদক্ষেপ এখনো আমাদের চোখে পড়েনি। তার কারণ হতে পারে এই যে, বিষয়টি অতি জটিল। আর যেহেতু হলাল ফুড একটি ধর্মীয় ইস্যু তাই সরকারের পক্ষে এ বিষয়ে তেমন করারও কিছু নেই। তাছাড়া হাতে জবাই ও মেশিনে জবাই নিয়ে খোদ মুসলমানদের মধ্যেই রয়েছে পক্ষ বিপক্ষ যার কোন সমাধান এইমূহুর্তে দেখা যাচ্ছে না।

মোট কথা পাশ্চাতের সবকটি দেশেই মুসলমানদের মধ্যে রয়েছে হালাল ফুড নিয়ে বিতর্ক। আর এই বিতর্ক শুরু করেছেন মুসলমানরাই।

প্রবাসে মুসলমানদের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেই সাথে বৃদ্ধি পাচ্ছে হালাল ফুডের ব্যবসাও। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে কোনটি হালাল আর কোনটি হারাম এই বিতর্কও দিনে দিনে আরো বৃদ্ধি পাবে। আমাদের বিশ্বাস, হালাল ফুড নিয়ে যে বিতর্ক ও সন্দেহ দেখা দিয়েছে সে বিষয়ে কোন সমাধানে পৌঁছাতে হলে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য কয়েকজন ধর্মবিশেষজ্ঞের সমন্বয়ে একটি জাতীয় কমিটি করা যেতে পারে যারা আলোচনা ও পর্যালোচনার মাধ্যমে নির্ধারণ করবেন জবাই করার কোন পদ্ধতি প্রকৃত অর্থে ধর্মসম্মত। হালাল সার্টিফিকেট প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা যাচাই করে এই জাতীয় কমিটিই স্বীকৃতি দিতে পারেন কে যোগ্য আর কে অযোগ্য। তাহলেই আমাদের মনে হয় হালাল বিতর্কের অবসান ঘটতে পারে এবং ক্রেতাদের সন্দেহও দূর হতে পারে।

খুরশিদ আলম

সম্পাদক ও প্রকাশক

প্রবাসী কন্ঠ