কানাডায় সংখ্যালঘুদের সর্বাপেক্ষা বড় ভয় হেটক্রাইম বাস্তবে পরিনত হচ্ছে

জানুয়ারী ৭, ২০১৭

ছায়দা ব্রেঙ্কার

কানাডা ও আমেরিকায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলো হেট ক্রাইমের লক্ষ্যবস্তুতে পরিনত হচ্ছে, হুমকীর শিকার হচ্ছে ধর্মান্ধদের কর্তৃক। আর এর মাধ্যমে আমাদের সমাজ ভীতিকরভাবে সংযোগ বিচ্ছিন্নতায় ভুগছে। তারপরও সংখ্যালঘুরা মিডিয়ায় ক্রোধের শিকার হচ্ছেন সামালোচকদের হাতে। আমরা এই অবস্থায় পৌঁছালাম কি করে?

যে কোন অনলাইন নিউজের কমেন্ট সেকশনে গেলেই দেখা যাবে লোকজন সংখ্যালঘুদের ব্যাপারে অসহিষ্ণুতা সম্পর্কিত খবর বা প্রতিবেদনের প্রতি নিজেদের মানসিক গ্লানি প্রকাশ করছে।

অনেকে ছদ্মনামে নয়, প্রকাশ্যেই তাদের মত প্রকাশ করছেন। কিছুদিন আগে অন্টারিওর মার্কহামে অবস্থিত স্যার উইলফ্রিড লরিয়ার স্কুলের প্রিন্সিপাল মিসেস গাডা সাধাকা তার ফেসবুকে মুসলিম বিরোধী কিছু মন্তব্য পোষ্ট প্রকাশ করেছিলেন। ঐ পোস্টগুলো নিয়ে বেশ বিতর্ক শুরু হয়েছিল। পরে অবশ্য তিনি ঐ পোস্টগুলোর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং বিতর্ক এড়াতে সাময়িকভাবে ছুটি নেন। কিন্তু টরন্টো সানের কলামিস্ট তারেক ফাত্তা এই বিষয়টিকে মোটেও আমলে নেননি। বরং তিনি এটাকে ‘ডাইনী খোঁজা’ বলে উল্লেখ করেন। আমেরিকার নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচত হওয়ার পর নব্য নাতসি বা ফ্যাশিবাদীদের উত্থান ঘটতে পারে এরকম একটি আশংকার কথা সিএনএন এর রাজনৈতিক ভাষ্যকার ভেন জোনস প্রকাশ করার পর টরন্টো সানের কলামিস্ট জো ওয়ার্মিংটন তাচ্ছিল্যভরে মন্তব্য করেন এই বলে যে, এটি পরাজিতদের দুঃখ-বেদনা ছাড়া কিছুই নয়।

ভীতির আশংকাগুলো বাস্তবে রূপ নিচ্ছে

সংখ্যালঘুরা স্বাভাবিক কারণেই একটু অনুভূতিপ্রবণ হয়ে থাকে, বিশেষ করে শোষিত হওয়ার ভয়ে কিংবা বর্জিত বা পরিত্যক্ত হওয়ার ভয়ে। এ দেশে দীর্ঘদিন ধরেই তারা তারস্বরে বলা মাদকবিরোধী যুদ্ধের কথা, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের কথা শুনে আসছেন। অতি সম্প্রতি সংখ্যালঘুরা মোকাবেলা করছেন জেনোফোবিয়া’কে (ইমিগ্রেন্টদের সম্বন্ধে অহেতুক ভয়)। আমরা দেখেছি আমেরিকার নব নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট কি করে হুমকী দিয়ে আসছেন মেক্সিকো সীমান্ত বরাবর দেয়াল নির্মানের, মুসলিমদেরকে বহিস্কার করার এবং কৃষ্ণাঙ্গদের যখন তখন তল্লাসী করার আইন পুনরায় চালু করার। কানাডায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের আদর্শে অনুপ্রানিত কনজারভেটিভ পার্টির দলীয় প্রধানের পদপ্রার্থী ক্যালী লিচ সম্প্রতি খবরের শিরোনাম হয়েছেন এক বিতর্কিত বক্তব্য দিয়ে। তিনি বলেন,“যারা কানাডায় আসতে চান নতুন ইমিগ্রেন্ট হয়ে তাদের মধ্যে ‘এন্টি কানাডিয়ান ভ্যালিউজ’ বা কানাডিয়ান মূল্যবোধ বিরোধী কোন প্রবণতা আছে কি না তা পরীক্ষা করে দেখা উচিৎ তাদের আবেদন গ্রহণ করার আগে। পরীক্ষা পাশ করলে তারা ইমিগ্রেশন পাবেন, পাশ না করলে তাদেরকে কানাডায় আসার স্বপ্ন ত্যাগ করতে হবে।”

এখন এই সংখ্যালঘুরা লক্ষ্য করছেন তাদের সর্বাপেক্ষা বড় যে ভয় সেটিই বাস্তবে রূপ নিচ্ছে। তারা এখন বিদ্বেষীদের টার্গেটে পরিনত হচ্ছেন বাসে, ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে, ব্যাংকে এমনকি নিজ আবাসস্থলের আশপাশেও। গত কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই লক্ষ্য করা গেছে এমন কয়েকটি ঘটনা। উদারহরণ হিসাবে উল্লেখ করা যেতে পারে টরন্টোর একটি ব্যাংকের ঘটনা। সেখানে কাউন্টারের সামনে অপেক্ষমান এক এশিয় মহিলা বিদ্বেষী মন্তব্যের শিকার হয়েছেন অপেক্ষমান আরেক গ্রাহকের দ্বারা। ঘটনার সময় কাউন্টারের সামনে উপস্থিত ছিলেন বেশ কয়েকজন গ্রাহক। তাদের কেউই কোন প্রতিক্রিয়া দেখাননি। চুপচাপ শুধু চেয়ে চেয়ে দেখেছেন। এমনকি কাউন্টারে কর্তব্যরত ব্যাংক টেলারদের পক্ষ থেকেও তাৎক্ষনিক কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দেখা যায়নি। পরবর্তীতে তারা শুধু দুঃখ প্রকাশ করেই দায় এড়িয়ে গেছেন। এডমনটনের এলআরটি স্টেশনে এক শ্বেতাঙ্গ ব্যক্তি প্রকাশ্যেই দড়ির একটি ফাঁস হাতে নিয়ে ভীতি প্রদর্শন করেছেন হিজাব পরা এক মহিলাকে। অটোয়াতে অবস্থিত ইহুদীদের একটি ভবনে সয়েস্টিকা (হিটলারের নাৎসি দলের প্রতীক চিহ্ন) একেছেন কে বা কারা। রিজাইনাতে একটি আবাসিক এলাকার এক গলিতে বর্ণবাদী শ্লোগান লিখে রেখেছেন কে বা কারা। স্থানীয় সংখ্যালঘুরা এগুলো দেখে খুবই মর্মাহত হয়েছেন।

কিন্তু তারপরও বর্ণবাদীদের এই বর্ণবিদ্বেষী কর্মকান্ডকে মোটেই আমলে নিচ্ছেন না কিছু কিছু পর্যবেক্ষক। তাদের মতে সংখ্যালঘুরা অতিমাত্রায় প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন।

উল্লেখ্য যে, গত ফেব্রুয়ারীতে প্রকাশিত এক সমীক্ষায় দেখা গেছে কানাডায় ডান-পন্থী বা শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যে বিশ্বাসী চরমপন্থীদের অস্তিত্ব রয়েছে। সমীক্ষায় বলা হয়, এই চরমপন্থীদের কেউ কেউ বাস্তবিক অর্থেই এলোপাথারী সন্ত্রাসী হামলার জন্য বড় ধরণের হুমকী হিসাবে বিবেচ্য। কেউ কেউ আছেন যারা মুসলিম, ইহুদী, কৃষ্ণাঙ্গ, আদীবাসী বা সমকামীদেরকে বিচ্ছিন্নভাবে টার্গেট করে থাকেন।

বর্তমানে সংখ্যালঘুরা যে বিষয়ে নিজেদেরকে অরক্ষিত ভাবছেন তা হলো, শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীদের সম্ভাভ্য আক্রমনের আশংকা যা নিয়ে কোন ভবিষ্যতবাণী করা যাচ্ছে না। অপরাধবিদ্যার অধ্যাপক ও উপরে উল্লেখিত সমীক্ষার গবেষক বারবারা পেরী বলেন, কেউ জানে না কখন  ডান-পন্থী আধিপত্যবাদীরা আঘাত হানবে। এরকম একটা পরিস্থিতিতে সংখ্যালঘুরা যদি অতিমাত্রায় প্রতিক্রিয়া দেখান তবে তাদেরকে দোষ দেয়া যায় কি?

তবে হামলার এই আশংকা বেশী মাত্রায় বিরাজমান আমেরিকায়। আমেরিকার এটর্নী জেনারেল লরেটা লিঞ্চ এফবিআইয়ের একটি পরিসংখ্যানের কথা উল্লেখ করে বলেন, ২০১৫ সালে আমেরিকায় হেটক্রাইম বৃদ্ধি পেয়েছে শতকরা ৬ ভাগ। এই হেটক্রাইমের যারা শিকার তারা হলেন মূলত মুসলিম, ইহুদী, কৃষ্ণাঙ্গ এবং সমকামী ব্যক্তিগণ। আমেরিকায় মুসলিমদের বিরুদ্ধে হেটক্রাইম বৃদ্ধি পেয়েছে ৬৭%।

কানাডায় আমাদেরকে আমেরিকার এই পরিস্থিকে গুরুত্বসহকারে আমলে নিতে হবে। কারণ, হেটক্রাইমের মতাদর্শ খুব সহজেই সীমান্ত অতিক্রম করতে পারে, বিশেষ করে যখন তা মিডিয়ার বদলৌতে ফ্রি প্রচার পায়।

আমরা এখন লক্ষ্য করছি সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে অপরিকল্পিত ও বিচ্ছিন্ন আক্রমনের ঘটনা ঘটছে যা বড় মাপের এবং অধিক সংখ্যায় হেটক্রাইমের পূর্বলক্ষণ হিসাবে বিবেচিত হতে পারে।

আমাদের কাছে এখন যেটি বিবেচ্য বিষয় তা হলো এ ব্যাপারে আমাদেরকে সোচ্চার হতে হবে। তা না হলে অদূর ভবিষ্যতে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা আরো বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। সিংহভাগ কানাডিয়ান সংখ্যালঘুদের উপর এই ধরণের আক্রমনকে ভাল চোখে দেখেন না। আমাদের কানাডিয় সমাজ দয়া ও সহানুভূতির সমন্বয়ে গঠিত। কিন্তু যদি আমরা বিচ্ছিন্নভাবে পরিচালিত এই হেটক্রাইমের বিরুদ্ধে এখনই সোচ্চার না হই তবে এখানকার সংখ্যালঘুরা জানতে পারবেন না কে তাদের সমর্থক আর কে তাদের উপর আক্রমনকারী।

-সৈজন্যে : সিবিসি নিউজ।