কানাডায় নতুন আসা ইমিগ্রেন্ট ছেলে-মেয়েরা কঠিন লড়াই করছে স্কুলের সঙ্গে নিজেদেরকে খাপ খাওয়াতে

প্রতি বছর ৫০ হাজারেরও বেশী স্কুল পড়ুয়াছেলে-মেয়ে কানাডায় আসছে যারা শুরুতে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না কি ভাবে স্কুলের সঙ্গে নিজেদেরকে খাপ খাওয়াবে

আগস্ট ১০, ২০১৬

জয়িতা দত্ত রায়

ডায়ানা নেয়াল ২০১২ সালের জুন মাসে টরন্টো আসে তার বোনসহ সুইডেন থেকে। পিছনে ফেলে আসে তার পরিচিত জগত। টরন্টো এসে সে ভর্তি হয় ওয়েস্টওয়ে জুনিয়র স্কুলে গ্রেড ৫ এ। শুরুতে তার অনুভূতিটা খুব সুখকর ছিল না। অনেকটা যেন হারিয়ে যাওয়ার মত ছিল বিষয়টা। তার ক্লাশে কেউই সুইডিশ ভাষা জানে না। ইংরেজী ভাষায় তার দক্ষতা নিয়েও সে সন্দিহান ছিল। তার নিত্যদিনের ভাবনা ছিল -কতদিন লাগবে নতুন এই পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে?

২০১১ সালে বাংলাদেশ থেকে আসে মুনতাসির মোহাম্মদ। ইংরেজীতে তার বাকপটুতা খারাপ ছিল না। ফলে ইটবিকোকের একটি স্কুলে গ্রেড ৫ এ দ্রুতই সে ক্লাসমেটদের সঙ্গ খাপ খাইয়ে নিতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু বাসা থেকে দেওয়া লাঞ্চ বক্স স্কুলে আনাটা তার কাছে খুব অস্বস্তিকর লাগতো। তার লাঞ্চ বক্সে থাকতো সাধারণত ঘরে রান্না করা বিভিন্ন তরকারী, বিস্কিট এবং চিকেন নাগেট।

সালমা সায়েদ (ছদ্ম নাম) স্কুলে হিজাব পরতো গর্ব সহকারেই যেমনটা তার স্কুলে গ্রেড ৭ এর অন্যান্য মুসলিম মেয়েরা পরতো। ইজলিংটন জুনিয়র মিলড স্কুলের এই ছাত্রী তার বাবা মায়ের সঙ্গে টরন্টো আসে ১৯৯৯ সালে। কিন্তু স্কুলে ভর্তি হওয়ার কিছুদিন পরই সে হিজাব পরা বাদ দেয় অন্যান্য ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে মিশতে গিয়ে।

আমার নিজের ১২ বছর বয়সী মেয়ে অনিকা রায় ব্যাংকক (থাইল্যান্ড) থেকে টরন্টো আসে ২০১৩ সালে। নতুন ইমিগ্রেন্ট হিসাবে স্কুলে ভর্তি হয়ে তাকে মোকাবেলা করতে হয়েছে সাইবার বুলিইং এর। তবে সে একা নয়, তার মত আরো অনেকেই সাইবার বুলিইং এর শিকার হয়েছে স্কুলে।

নতুন পরিবেশে অঙ্গীভূত হওয়ার পথ খুঁজে বের করা:

কানাডায় প্রতি বছর নেয়াল, মুনতাসীর, সায়েদ এবং অনিকার মত প্রায় ৫০ হাজার স্কুলগামী শিশু আসে তাদের পিতা-মাতার সঙ্গে। তারা প্রায় সবাই অনিশ্চিত থাকে কি ভাবে তারা নতুন স্কুলের নতুন পরিবেশের সঙ্গে নিজেদেরকে খাপ খাওয়াবে। নতুন এই শিশুদের কেউ কেউ যুদ্ধ উদ্বাস্তু। কেউ কেউ প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হয়ে কানাডা এসেছে। কোন কোন শিশুর বাবা মা’র শিক্ষাগত যোগ্যতা কম। কোন কোন শিশুর বাবা মা আর্থিকভাবে স্বচছল নয়। আর এই প্রত্যেক শিশুর কাছে কানাডার শিক্ষা ব্যবস্থা অপরিচিত।

কানাডায় আসা নতুন এই ইমিগ্রেন্ট শিশুদের বাবা-মা’রা নিজেরাও অনেক সময় বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন নতুন দেশের নতুন জীবনধারায়। রুটি-রুজির চিন্তায় এবং স্বদেশ থেকে মূলৎপাটিত হয়ে এসে একটা গোলকধাঁধার মধ্যে পড়ে যান। কেউ কেউ হতবুদ্ধি বা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। উপায়ন্তর না দেখে তারা সন্তানদের ছেড়ে দেন তাদের নিজেদের সিদ্ধান্তে চলার জন্য।

আমরা জানি, কানাডার স্কুলগুলোতে ছেলে-মেয়েদের বিনা বেতনে শিক্ষা দেওয়া হয়। সব শিক্ষার্থীর জন্য এখানে সমান সুযোগ সুবিধা। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় একটি। কানাডার এই স্কুল সিস্টেম কি নতুন আসা ইমিগ্রেন্ট ছেলে-মেয়েদের শিক্ষাগত সাফল্য নিশ্চিত করতে পারে?

কানাডার বড় বড় শহরগুলোতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রী ইমিগ্রেন্ট বা নির্দিষ্ট একটা সময়ের পর তারা কানাডার নাগরিকে পরিনত হয়। এই ছাত্র-ছাত্রীরা স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর যদি তারা নিজেদের এথনিক ব্যাকগ্রাউন্ডের কোন গ্রুপকে পেয়ে যায় তবে খুব সহজেই তারা তাদের সাথে মিশে যায়। এই মিশে যাওয়ার মাধ্যমে তারা স্কুলের বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশ নিতে পারে সহজে এবং তার সাথে একিভূত হয়ে যেতে পারে। এ কথা বলেন ইয়র্ক এলাকার একটি পাবলিক স্কুলের শিক্ষিকা মানসী চট্রোপাধ্যায়।

ডায়ানা নেয়াল এর বেলায়ও কথাটি সত্য। ডায়ানা সুইডেন থেকে এসেছে কানাডায়। সুইডেনে সে যে স্কুলে পড়তো সেখানে অনেক সোমালী ছেলে-মেয়ে ছিল তার সহপাঠী। কানাডায় আসার পর সে যখন স্কুলে ভর্তি হলো, তখন এখানেও বেশ কিছু সোমালী ছেলে-মেয়ে পেয়ে যায় সে। ফলে নতুন দেশে নতুন স্কুলে নিজেকে সহজেই খাপ খাইয়ে নেয় ডায়না, যদিও তার নিজের এথনিক ব্যাকগ্রাউন্ড সোমালীয় নয়।

ডায়ানা নেয়াল শুরুতে ইএসএল ((English as Second Language)) ক্লাশে ভর্তি হয়েছিল যা তার ইংরেজী ভাষার উপর দক্ষতা বৃদ্ধিতে যথেষ্ট সহায়তা করেছে। প্রথম দিকে এই ভাষা নিয়ে সে বেশ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতো।

নতুন আসা ইমিগ্রেন্ট ছেলে-মেয়েদের জন্য এই ইএসএল ক্লাশ বেশ উপকারী বিশেষ করে যারা ইংরেজী ভাষায় দুর্বল থাকে।

নতুন আসা ইমিগ্রেন্ট ছাত্র-ছাত্রীদের সহায়তা প্রদান:

পিল বোর্ডের অন্তর্গত একটি এলিমেন্টারী স্কুলের শিক্ষক জেন চেন্ডলার বলেন স্কুলগুলো নতুন আসা ছেলে-মেয়েদেরকে নতুন পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে যথেষ্ট সহায়তা করে থাকে। এ প্রসঙ্গে তিনি পিল বোর্ডের প্যারেন্টিং সেন্টারের কথা বলেন। এখানে বয়স্কদেরকে উৎসাহিত করা হয় শিশুদের সঙ্গে যোগ দিতে। এখানে শিশুদের বাবা-মা’রা কানাডিয়ান স্কুলের কালচার সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করতে পারেন। তারা একে অন্যের সঙ্গে নিজেদের অভিজ্ঞতা বিনিময় করার মাধ্যমে অনেক কিছু জানতে পারেন। জেন চেন্ডলার আরো বলেন, আমরা স্কুলের বাচ্চাদেরকে নিজ নিজ বাড়িতে নিজ মাতৃভাষায় কথা বলার জন্য উৎসাহ দেই। এতে করে হয়তো তাদের ইংরেজী শিখা একটু দেরী হতে পারে। কিন্তু শেষ বিচারে এতে লাভই হয়। কারণ মাল্টি ল্যাঙঙ্গুইজমের অনেক লাভ আছে।

কেয়া ঘোষ টরন্টো ডিস্ট্রিক বোর্ডের একজন সাপ্লাই টিচার। তিনি বলেন, আমাদের স্কুলসমূহে বাচ্চাদের শেখানো হয় তাদের নিজ নিজ সংস্কৃতিকে সম্মান করতে এবং একই সাথে অন্যের সংস্কৃতির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতেও বলা হয়। এই উদ্দেশ্যে স্কুলসমূহে আফ্রিকান হেরিটেজ মান্থ, মাল্টিকালচারাল ডে ইত্যাদি পালন করা হয়। গ্রেটার টরন্টোর বাইরে যেমন উইন্ডসরে নিউ কামার্স অরিয়েন্টেশন উইক পালন করা হয় যার মাধ্যমে নতুন আসা বাচ্চাদের উদ্বিগ্নতা ও ভীতি দূর হয় তাদের নতুন স্কুলের নতুন পরিবেশ সম্পর্কে।

পৃথিবীর সেরা স্কুলগুলোর মধ্যে কানাডার স্কুলগুলোও

কানাডায় নতুন আসা বিভিন্ন এথনিক ব্যাকগ্রাউন্ডের ইমিগ্রেন্ট শিশুদেরকে সহায়তা করার জন্য এখানকার স্কুলগুলো নানান ধরণের উদ্যোগ গ্রহণ করে থাকে। এতে প্রমানিত হয় যে, এখানকার স্কুলগুলো যথেষ্ট পরিমানে ইমিগ্রেন্টবান্ধব। সিবিসি নিউজ এর এক প্রতিবেদন থেকেও জানা যায় কানাডিয়ান স্কুলগুলো পৃথিবীর সেরা স্কুলগুলো তালিকায় প্রথম সারিতেই রয়েছে। একটি ইন্টারন্যাশনাল এডুকেশন সার্ভের বরাত দিয়ে সিবিসি এই তথ্য জানায়। ঐ সার্ভের মাধ্যমে আরো জানা যায় যে, কানাডায় স্কুল পড়–য়া ছাত্র-ছাত্রীরা যথেষ্ট ভাল রিজাল্ট করে। কার কি এথনিক বা আর্থ-সামাজিক ব্যাকগ্রাউন্ড সেটি এ ক্ষেত্রে কোন প্রভাব বিস্তার করে না। আঞ্চলিক দিকে থেকে রিডিং স্কিলে অন্টারিও, আলবার্টা এবং ব্রিটিশ কলম্বিয়া সর্বোচ্চ অবস্থানে আছে।

শিক্ষা দানের ক্ষেত্রে কানাডার স্কুলগুলোর গুনাগুন এবং ফ্রি এডুকেশন সিস্টেম এর কারণে কানাডায় নতুন আসা ইমিগ্রেন্ট পরিবারের ছেলে মেয়েরা সমান সুযোগ সুবিধা পায় শিক্ষা গ্রহনের ক্ষেত্রে যা বিশ্বের সেরা স্কুল সিস্টেম হিসাবে বিবেচিত। এ কথা বলেন পাবলিক স্কুলের শিক্ষিকা মানসী চট্রোপাধ্যায়। তিনি আরো বলেন, কানাডার স্কুলগুলো এভাবেই নতুন আসা ইমিগ্রেন্ট ছেলে-মেয়েদেরকে কানাডার সমাজব্যবস্থায় আত্মীকরণ করে নেয়।

জয়িতা দত্ত রায়  , টরন্টো

-সৌজন্যে : নিউ কানাডিয়ান মিডিয়া