কানাডার রাজনীতিতে দলীয় প্রধান পদে বাদামী রঙ মিশালেন জাগমিত সিং

নভেম্বর ৩, ২০১৭

খুরশিদ আলম ॥

কানাডার জাতীয় রাজনীতিতে দলীয় প্রধানের পদে শুরু থেকেই চলে আসছে শ্বেতাঙ্গদের একচ্ছত্র আধিপত্য। সেখানে কালো বা বাদামী বর্ণের কোন স্থান ছিল না। কিন্তু এবার সেই অচলায়তন ভাঙ্গলেন বাদামী বর্ণের জাগমিত সিং। তিনি কানাডার তৃতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল নিউ ডেমোক্রেটিক পার্টি’র (এনডিপি) নেতা নির্বাচিত হয়েছেন অতি সম্প্রতি। আগামী ২০১৯ সালের জাতীয় নির্বাচনে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাটিস্টন ট্রুডোর প্রতিদ্বন্দ্বী হতে যাচ্ছেন জাগমিত সিং।

জাগমিত সিং এর এই বিজয়কে অনেকেই ঐতিহাসিক ঘটনা হিসাবে বর্ণনা করেছেন। কারণ, ফেডারেল লেভেলের কোন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতা হওয়া সহজ কাজ নয়। তিনি একটি অলিখিত নিষেধাজ্ঞাকে ডিঙ্গিয়ে এমন একটি দলের প্রধান নেতা নির্বাচিত হতে পেরেছেন যে দলটি গত জাতীয় নির্বাচনে ক্ষমতা দখল করতে যাচ্ছিল। নির্বাচন শুরুর কয়েক মাস আগে থেকে পরিচালিত বিভিন্ন জরীপে দেখা গিয়েছিল এনডিপি জয়ী হতে চলেছে। অবশ্য নির্বাচনের দিন এগিয়ে আসার সাথে সাথে পরিস্থিতি পাল্টে যেতে থাকে। এবং নির্বাচনের দিন ভোট গননার পর দেখা যায় এই দল তৃতীয় স্থান দখল করে।

কে জানে, আগামীতে এনডিপি হয়তো আবারো ঘুরে দাড়াতে পারে। তখন জাগমিত সিং-ই হবেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী। আর কানাডার ইতিহাসে সৃষ্টি হবে আরেক মাইলস্টোন।

গত বছর জুলাই মাসে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল হাফিংটন পোস্টে যাতে বলা হয়েছিল আগামী দশ বছরের মধ্যে কানাডার প্রধানমন্ত্রী পদে নির্বাচিত হবেন একজন সমকামী ব্যক্তি। আর কোন একটি  মূখ্য রাজনৈতিক দলের দলীয় প্রধান হবেন একজন মুসলিম। এটি ছিল সিংহভাগ কানাডিয়ান নাগরিকদের ভবিষ্যতবাণী।

সেই ভবিষ্যতবাণী এক বছরের মাথায়ই কিছুুটা হলেও সত্য প্রমানিত হলো। অর্থাৎ দলীয় প্রধান মুসলিম না হলেও অন্তত একজন শিখ বা বাদামী রঙ এর কেউ হলেন।

উল্ল্লেখ্য যে, কানাডায় সমকামী রাজনীবিদগণ গত কয়েক বছরে অনেকটাই অগ্রসর হয়েছেন ক্ষমতায়নের দিকে। এ ব্যাপারে প্রথমেই উল্লেখ করা যেতে পারে অন্টারিও প্রভিন্সের প্রিমিয়ার ক্যাথেলিন উইন এর কথা। ২০১৩ সালে অন্টারিও প্রভিন্সের নির্বাচনে ক্যাথেলিন উইন এর নেতৃত্বে লিবারেল পার্টি বিপুল আসনে জয় লাভ করে। শুধু তাই নয়, নির্বাচিত হওয়ার পর এখন পর্যন্ত তার সমকামীতার বিষয়টি কোন ইস্যু হয়ে দাড়ায়নি অন্টারিওতে। বরং তিনি যে নির্ভিঘেœ ক্ষমতায় আছেন সে বিষয়টি একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দিচ্ছে। আর সেই বার্তাটি হলো, কানাডার সমাজ ব্যবস্থা পরিবর্তিত হচ্ছে। আর সেই পরিবর্তনের ধারায়ই কানাডার তৃতীয় বৃহত্তম রাজনৈতি দলের প্রধান নির্বাচিত হলেন জাগমিত সিং।

জাগমিত সিং এর জন্ম ১৯৭৯ সালে টরন্টোর স্কারবরোতে। ছবি: টুইটার

জাগমিত সিং বয়সে তরুণ। মাত্র ৩৮ বছর বয়স তার। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর বয়স ৪৫। আর প্রধান বিরোধী দল কনজারভেটিভ পার্টির নবনির্বাচিত দলীয় প্রধানের বয়সও জাগমিতেরই সমান, অর্থাৎ ৩৮। এটিও কানাডার রাজনীতিতে এক বড় ধরণের পরিবর্তন। অর্থাৎ বেবী বুমারদের দিন শেষ হয়ে এখন শুরু হয়েছে তরুন প্রজন্মের যুগ। কানাডার ইতিহাসে এটি ইতিহাস সৃষ্টিকারী ঘটনা। কানাডিয়ান প্রেস এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এরকম ঘটনা আগে কখনো ঘটেনি।

জাগমিত সিং এর জন্ম ১৯৭৯ সালে টরন্টোর স্কারবরোতে। শৈশব কেটেছে তার ‘সেন্ট জন্স’ এবং ‘নিউফাউন্ডল্যান্ড এ্যান্ড ল্যাবরাডর’ এ। পরে অন্টারিওর উইন্ডসরেও তার শৈশবের কিছুটা সময় কেটেছে। হাই স্কুল শেষ করেছেন ১৯৯৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানে অবস্থিত ডেট্রয়েট কাউন্টি ডে স্কুল থেকে। বাইয়োলজীতে ব্যাচেলর অব সাইন্স ডিগ্রী অর্জন করেন অন্টারিওর ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটি থেকে এবং ব্যাচেলর অব ল ডিগ্রী অর্জন করেন ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি থেকে ২০০৫ সালে।

পেশায় তিনি ছিলেন একজন ক্রিমিনাল ডিফেন্স ল’ইয়ার। ইংলিশ, ফ্রেঞ্চ, হিন্দী এবং পাঞ্জাবী ভাষায় তার রয়েছে দক্ষতা। তার বাবা জাগতারান সিং এবং মা হারমিত কাউর ভারতের পাঞ্জাব থেকে কানাডা আসেন অভিবাসী হিসাবে। তার দাদা সেওয়া সিং ঠিকরীওয়ালা ছিলেন বৃটিশ ভারতে একজন বিপ্ল্লবী কর্মী। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।

জাগমিত সিং তার রাজনৈতিক কর্মজীবন শুরু করেন এনডিপি’র হয়ে এমপি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মাধ্যমে। ২০১১ সালে টরন্টোর নিকটবর্তী ব্রামেলিয়া-গোর-মল্টন রাইডিং থেকে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। ঐ সময় তিনি তার নাম থেকে ‘ডালিওয়াল’ অংশটি বাদ দেন। কারণ, তার নিজ ধর্মে এই নামটি জাত প্রথার সঙ্গে জড়িত যা মানুষের মধ্যে বিভেদ তৈরী করে। তিনি ঐ বছর নির্বাচনে কনজার্ভেটিভ প্রার্থী বাল ঘোষাল এর কাছে ৫৩৯ ভোটে পরাজিত হন।

পরে ঐ একই সালে জাগমিত সিং অন্টারিও প্রভিন্সিয়াল নির্বাচনে এমপিপি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিধা করে লিবারেল প্রার্থী কুলদীপ কুলারকে ২২৭৭ ভোটে পরাজিত করেন এবং প্রথম পাগড়ী পরা এমপিপি হিসাবে শপথ গ্রহন করেন। পরে তিনি নিজ দলের ডেপুটি হাউজ লিডার হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।

গত বছর এনডিপি’র কনভেনশনে তৎকালীন নেতা টম মুলকেয়ার লিডারশীপ রিভিউতে দলের আস্থা হারালে জাগমিত সিং এর সম্ভাবনা উজ্জল হয়ে উঠে। পরে দলের নানান প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তিনি ফেডারেল এনডিপি’র নেতা হিসাবে নির্বাচিত হন গত ১ অক্টোবর। এবং কানাডার রাজনীতিতে তৈরী হয় নতুন ইতিহাস।

উল্লেখ্য যে, গত ২০১১ সালের জাতীয় নির্বাচনে ৪২ জন এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন পার্লামেন্টে যাদের জন্ম কানাডার বাইরে। সেই সময় পার্লামেন্টে আসন সংখ্যা ছিল ৩০৮ টি। তবে বিভিন্ন রাইডিং এ বিদেশে জন্ম নেয়া ভিজিবল মাইনরিটি বা দৃশ্যমান সংখ্যালঘু (শ্বেতাঙ্গ বা আদিবাসী নন) সম্প্রদায় থেকে মোট জয়ী হয়েছিলেন ৩০ জন। শতকরা হিসেবে এটি ৯.৪%। কিন্তু কানাডায় লোকসংখ্যা দিক থেকে ভিজিবল মাইনরিটির সংখ্যা ১৫%। আর পৃথিবীর অঞ্চল ভেদে হিসেব করলে দেখা যায় বিদেশে জন্ম নেয়া কানাডিয়ান এমপিদের মধ্যে রয়েছেন ১৫ জন ইউরোপীয়, ১১ জন এশিয়, ১১ জন আমেরিকান এবং ৫ আফ্রিকান। (তথ্য সূত্র : নিউ কানাডিয়ান মিডিয়া)।

সুতরাং এ কথা বলাই যায় যে, কানাডার এথনিক গ্রুপের সদস্যরা এ দেশের রাজনীতিতে এখন বেশ সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। ক্যালগারীর মেয়র  নাহিদ নেনসী নির্বাচিত হয়েছেন এথনিক গ্রুপের সদস্য থেকেই।

নিউ কানাডিয়ান মিডিয়াতে মাইকেল এ্যাডামস এবং এন্ড্রু গ্রিফিত যৌথভাবে একটি প্রবন্ধ লিখেছেন যেখানে তারা উল্লেখ করেছেন যে, “কানাডায় একটি ব্যাতিক্রমধর্মী ঘটনা হলো, এখানে বর্তমান ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বিদেশে জন্ম নেয়া লোকদেরকে দলে ভিড়িয়েছেন এবং এমপি পদে লড়ার সুযোগ দিয়েছেন যাদের অনেকেই পরবর্তীতে এমপি নির্বাচিত হয়েছেনও। কিন্ত পৃথিবীর অন্যান্য দেশে দেখা গেছে রক্ষণশীল দলগুলো ইমিগ্রেন্ট বিরোধী হয়।”

তবে কানাডার রাজনীতিতে এই ইমিগ্রেন্টবান্ধব পরিস্থিতি সবসময় ছিল না। সাংবাদিক পল বারবার আইপলিটিস.কম এ প্রকাশিত এক প্রবন্ধে লিখেছেন, “একসময় ব্রিটিশ বংশোদ্ভূত কানাডিয়ানরা প্রকাশ্যেই রাজনীতিতে ইমিগ্রেন্টদেরকে সন্দেহের চোখে দেখতেন। বিষয়টি এখন অনেকেই ভুলে গেছেন। ১৯২৪ সালে উইনিপেগের এক বিশিষ্ট ব্যবসায়ী বলেছিলেন, আমরা বিদেশ থেকে আসা সব ভাল নাগরিকদেরকে স্বাগত জানাই। কিন্তু তারা যদি খ্রীষ্ট ধর্মে বিশ্বাস না করেন এবং আমাদের গড়া আইনকে সম্মান না দেখান তবে তারা যেখান থেকে এসেছেন সেখানে চালে যাওয়াই উচিৎ।”

ইমিগ্রেন্ট বিরোধী এরকম উক্তি বা বক্তব্য অথবা সোজা কথায় বর্ণবাদী অচরণের প্রমাণ কানাডার ইতিহাসে ভুড়ি ভুড়ি রয়েছে। মাত্রায় কম হলেও সেই বর্ণবাদী আচরণ এখনো করা হচ্ছে বিভিন্ন এথনিক গ্রুপের প্রতি। টরন্টোর গত সিটি নির্বাচনেরও এরকম কিছু ঘটনা ঘটেছে। এথনিক ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে আসা বিশেষ করে মুসলমান পরিচয়ের প্রার্থীদের ব্যানার তছনছ করার ঘটনা ঘটেছিল। কানাডার জাতীয় রাজনীতিতে বিশেষ পরিচিত মুখ এনডিপি’র সাবেক এমপি অলিভিয়া চাও’কে নানা ভাবে বিব্রত করা হয়েছিল তার বিরুদ্ধে বর্ণবাদী মন্তব্য করে।

তবে এর পরও এথনিক ভোট ব্যাংক যে কানাডায় কতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে তার একটি প্রমাণ আমরা দেখেছি দুই দশক আগের কুইবেক রেফারেন্ডমে। সেদিনের নির্বাচনে কুইবেকের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের পরাজয় ঘটলে ঐ রাতেই কুইবেকের তৎকালীন প্রিমিয়ার জ্যাকুস পারিজাও ক্ষোভে দুঃখে বলে উঠেছিলেন “অর্থ ও এথনিক ভোটারদের কারণেই আমরা হেরেছি”। পারিজাও এর ক্ষোভের মধ্যে সত্যতা ছিল বৈকি। এথনিক ভোটারদের একটা ভূমিকা অবশ্যই ছিল সেদিন। তবে এ কথা বলার জন্য পরের দিন পারিজাওকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল।

এদিকে গত ২৫ অক্টোবর প্রকাশিত স্ট্যাটিসটিকস কানাডার সর্বশেষ হিসাব (২০১৬) অনুযায়ী দেখা যায় ৭.৭ মিলিয়ন কানাডিয়ান এখন দৃশ্যমান সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অন্তভূক্ত। শতকরা হিসাবে কানাডার মোট জনসংখ্যার ২২.৩%। ১৯৮১ সালের তুলনায় এই হার বৃদ্ধি পেয়েছে ৪.৭%। ধারণা করা হচ্ছে ২০৩৬ সালের মধ্যে কানাডার এক তৃতীয়াংশ জনসংখ্যা হবে দৃশ্যমান সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের।

এসকল কারণে আজকে কানাডার প্রভিন্সিয়াল নির্বাচন থেকে শুরু করে ফেডারেল নির্বাচনে এথনিক ভোটারদের গুরুত্ব আগের যে কোন সময়ের তুলনায় অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। আমরা কানাডার রাজনীতিতে নতুন এক যুগে প্রবেশ করছি যেখানে এথনিক কমিউনিটি নতুন এক শক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে। ফলে কানাডার সব রাজনৈতিক দলই এখন এই এথনিক কমিউিনিটিকে খাতির করে চলছে।

তবে এত আশার মাঝেও একটি নিরাশার কথা না বললেই নয়। সেটা জাগমিত সিং-কে নিয়েই। তিনি দলীয় প্রধান নির্বাচিত হয়েছেন নিজ গুনেই। আগামীতে কানাডা তরুন এই নেতার কাছে অনেক কিছুই আশা করতে পারে। কিন্তু তিনি যে বেশ-ভুষা নিয়ে জনসমক্ষে হাজির হন, সেই বেশ-ভুষা তাকে একটি নির্দিষ্ট ধর্মের প্রতিনিধি হিসাবে পরিচয় করিয়ে দেয়, যার কারণে অনেক কানাডিয়ানই তাকে ভোট দিবেন না বলে জানিয়েছেন। হবি অহমঁং জবরফ ঢ়ড়ষষ এর সাম্প্রতিক এক জরীপে দেখা গেছে শতকরা ৭৭ ভাগ ভোটার মনে করেন একজন রাজনীতিকের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পরিচয় কোন বিষয় হওয়া উচিৎ নয়, তার রাজনৈতিক মতাদর্শ বা পরিকল্পনা কি সেটাই বিবেচনা করা উচিৎ। কিন্তু এর উল্টো মতও প্রকাশ পেয়েছে ঐ জরীপে। জরীপে অংশগ্রহনকারীদের অর্ধেকই বলেছেন তারা এবং তাদের আত্মীয় বন্ধুরা একজন আচারনিষ্ঠ শিখ ব্যক্তির নেতৃত্বাধীন পার্টিকে ভোট দিবেন না।

আমরা জানি কানাডা একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। অন্যদিকে বহু ধর্মের লোব বাস করেন এই দেশটিতে। ফলে নির্দিষ্ট একটি ধর্মের লেবাস পরে জাতীয় রাজনীতিতে কেউ এখানে বিশেষ একটা সুবিধা করতে পারবেন বলে মনে হয় না। জরীপেই তার কিছুটা আভাষ মিলে।

খুরশিদ আলম

সম্পাদক ও প্রকাশক

প্রবাসী কণ্ঠ