কানাডার পার্লামেন্টে এন্টি ইসলামোফোবিয়া প্রস্তাব পাস

ডিসেম্বর ১০, ২০১৬

থমাস ওডলী

অবশেষে কানাডার পার্লামেন্টে উত্থাপিত এন্টি ইসলামোফোবিয়া মোশনটি পাশ হয়েছে। গত ২৬ অক্টোবরের ঘটনা এটি। কিন্তু কৌতুহলোদ্দীপক বিষয় হলো, কানাডার মেইনস্ট্রিমের প্রায় কোন পত্রিকা বা ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াতেই এই খবরটি প্রচার হয়নি। কিন্তু গত অক্টোবর মাসের ৬ তারিখে যখন এই একই মোশন পার্লামেন্টে নাকচ হয়ে গিয়েছিল তখন বেশ ফলাও করেই খবরটি প্রচার করা হয়েছিল। বিষয়টি আমার কাছে কৌতুহলোদ্দীপক মনে হচ্ছে এই কারণে যে, যখন মোশনটি নাকচ হয়ে গিয়েছিল তখন তা খবর হলো প্রায় সব পত্রিকা ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াতে। আর যখন সেই একই মোশন পাস হলো তখন তা কোন খবরই হলো না মেইনস্ট্রিমের প্রায় কোন মিডিয়াতেই।

এটা সম্ভত মিডিয়া জগতেও যে ইসলামোফোবিয়া বিরজমান তারই একটি প্রমাণ।

তবে যে ভাবেই এটি ব্যাখ্যা করা হোক না কেন, কানাডার মুসলিম কমিউনিটি সহানুভূতি ও স্বীকৃতি লাভের একটি সুযোগ থেকে বঞ্চিত হলো সন্দেহ নেই। বস্তুত এই ধরণের মোশন বা প্রস্তাব পাশ হওয়ার পর তার তথ্য যদি সঠিক ভাবে জনগণের কাছে না পৌঁছায় তবে তার উদ্দেশ্য ও কার্যকারিতা ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশী থাকে। কল্পনা করুন – ২০০৮ সালে যখন তৎকালিন প্রধামন্ত্রী স্টিফেন হারপার কানাডার আদীবাসীদের কাছে আনুষ্ঠানকভাবে ক্ষমা চাইলেন তাদের সন্তানদেরকে বহু বছর আগে জোর করে আবাসিক স্কুলে নিয়ে আসার জন্য এবং পরবর্তীতে ঐ শিশুদের উপর শারীরিক ও যৌন নির্যাতন চালানোর জন্য, সেই খবরটি কানাডার মিডিয়াতে প্রকাশিত হলো না। তাহলে ব্যাপারটি কি ভাবে ব্যাখ্যা করা হতো? স্পষ্টতই সেটি হতো আদীবাসীদেরকে আরেক দফা অপমান করা।

একইভাবে কানাডার মুসলিম কমিউনিটিও স্বাভাবিকভাবেই মনে করতে পারেন তারা এখানে অনাদৃত ও অসম্মানিত হয়েছেন তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এই খবরটি মেইনস্ট্রিম মিডিয়াতে প্রকাশিত না হওয়ায় ।

কানাডার অন্যান্য সংখ্যালঘুু বা প্রান্তিক সম্প্রদায়ের মত মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্যও এটি ছিল অতি সাম্প্রতিকালের আরেকটি অপমানজনক অভিজ্ঞতা। স্মরণ করা যেতে পারে যে, গত অক্টোবর মাসের ৬ তারিখে যখন পার্লামেন্টে এনডিপি কর্তৃক উত্থাপিত এন্টি-ইসলামোফোবিয়া মোশনটি কনজারভেটিভ পার্টির সদস্যদের বিরোধীতার  কারণে নাকচ হয়ে গিয়েছিল তখন এনডিপি প্রধান থমাস মুলকেয়ার দুঃখ করে বলেছিলেন, “আমি ভাবতে পারিনা ঘৃণা প্রকাশের বিরুদ্ধে উত্থাপিত একটি প্রস্তাবে কি করে কনজার্ভেটিভরা বিরোধীতা করেন।” তিনি আরো বলেন, “আমরা এখানে সমবেত হয়েছি সমাজে সব ধরণের ঘৃণাকে নিন্দা জানানোর জন্য। এটা জেন্ডার আইডিয়েন্টির বিষয়ে হোক, ব্যক্তির এথনিক পরিচয়, সংস্কৃতি বা ধর্মীয় পরিচয়ের বিষয়ে হোক, কোন ব্যাপারেই ঘৃণা প্রকাশ করা যাবে না।”

লিবারেল এমপি ওমর আলগাভরা এই প্রসঙ্গে বলেন, এটি নির্দয় আচরণ। প্রস্তাবটি ছিল একেবারেই নির্দলীয়, প্রতীকমূলক, ভাল ও ইতিবাচক প্রস্তাব। এটি পার্লামেন্টে পাস না হওয়াটাকে এ ভাবে ব্যাখ্যা করা যায় যে, এই বিরোধীতা করাটাও আসলে ইসলামোফোবিয়ারই অংশ।

ইসলামোফোবিয়া বিষয়টি হলো ইসলাম বা মুসলিমদের প্রতি এক ধরণের বিদ্বেষ প্রকাশ করা, বিশেষ করে রাজনৈতিক মহল কর্তৃক।

এন্টি-ইসলামোফোবিয়া মোশনটি গত ৬ অক্টোবর পার্লামেন্টে প্রথমে নাকচ হয়ে গেলে ন্যাশনাল কাউন্সিল অব কানাডিয়ান মুসলিম এর কমিউনিকেশন ডিরেক্টর আমীরা এলগাওয়েবী এক উপসম্পাদকীয়তে লিখেন, “ইসলামোফোবিয়া সম্পর্কে জানতে চান? তবে জিজ্ঞেস করুন কানাডায় বসবাসরত সংখ্যা লঘু সম্প্রদায়ের কোন মুসলিম মহিলাকে অথবা কানাডার মেইনস্ট্রিম মিডিয়ার ওয়েবসাইটে গিয়ে দেখুন যেখানে মুসলিমদের সম্পর্কে কোন প্রতিবেদন বা খবর প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত প্রতিবেদন বা খবরের নিচে যে মন্তব্যগুলো থাকে সেগুলোর প্রতি চোখ বুলালেই বুঝতে পারবেন ইসলামোফাবিয়া কি। একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। জনৈক মন্তব্যকারী লিখেছেন, যদি তুমি কানাডা পছন্দ না কর, অথবা মনে কর যে তুমি যেরকম দেশ চাচ্ছ কানাডা সেরকম দেশ নয় তবে তুমি এ দেশ থেকে চলে যেতে পার। কেউ তোমাকে পাছায় লাত্থি মেরে বের করে দেওয়ার আগেই চলে যাও।”

এখন যদি কানাডার পার্লামেন্টারিয়ানরা মনে করেন যে রাজনীতিকদের আচরণে ইসলামোফোবিক কিছু থাকলেও তার কোন প্রভাব পড়বে না তবে বিষয়টি নিয়ে পুনরায় ভাবার প্রয়োজন রয়েছে। কারণ, আমরা দেখেছি কালিফোর্নিয়ার স্টেট ইউনিভার্সিটি  সম্প্রতি এক রিপোর্ট প্রকাশ করেছে যাতে দেখা যায় আমেরিকায় রাজনীতিকদের মুখে ইসলাম বিরোধী বাগাড়ম্বরপুর্ণ উক্তি এবং মুসলিমদের বিরুদ্ধে হিংসা বা বিদ্বেষ প্রকাশের মধ্যে একটি যোগসূত্র রয়েছে।

এদিকে গত ২২ অক্টোবর কুইবেকের সেপ্টাইয়েলস্ (Sept-Îles) এলাকায় একটি মসজিদে হামলা চালানো হয়েছিল। ২০১৩ সালের পর থেকে ঐ মসজিদে এটি ছিল তৃতীয় হামলা। তবে কোন হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। উল্লেখ্য যে, ঐ সময়টাতে বিশ্ব আহমেদীয়া মুসলিম জামাতের খলিফা হযরত মির্জা মাসরুর আহমদ কানাডা সফর করছিলেন এবং তাঁর ঐ সফরকালে তিনি অটোয়ায় পার্লামেন্ট ভবনেও যান। পার্লামেন্টে তিনি এক অভ্যর্থনা অনুষ্ঠানে ভাষণও দেন ১৭ অক্টোবর সন্ধ্যায়। তাঁর ঐ সফরের সময় লিবারেল এমপি-দের ভূমিকার প্রতি অসম্মান প্রদর্শন করেন স্থানীয় ব্লক কুইবেকোর এমপি।

কানাডিয়ান মুসলিম ফোরামের প্রেসিডেন্ট সেমার মাজুব বলেন, বস্তুত মসজিদের ঐ হামলার পিছনে কারণ হিসাবে উল্লেখ করা যায় এন্টি ইসলামোফোবিয়া মোশনটি পার্লামেন্টে পুণরায় উত্থাপন করার ঘটনাটিকে। এই সেমার মাজুবই প্রথম উদ্যোগ নেন ইসলামোফেবিয়ার বিষয়ে একটি পার্লামেন্টারী পিটিশন পেশ করার। ঐ পিটিশনের জন্য ৭০ হাজার স্বাক্ষর গ্রহণ করা হয়।

মসজিদে হামলা, এন্টি ইসলামোফোবিয়া মোশনের প্রতি কনজারভেটিভ পার্টির সদস্যদের অসম্মান প্রদর্শন ইত্যাদি সত্বেও সেমার মাজুব কৃতজ্ঞ যে অবশেষে পার্লামেন্টে মোশনটি পাশ হয়েছে। তিনি বলেন, মোশনটি পাশ হওয়াতে এখন সুযোগ হয়েছে এই বিষয়টি নিয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহনের এবং এ নিয়ে আরো আলোচনা করে বাস্তবভিত্তিক নীতি গ্রহনের। তিনি অবশ্য আশংকা প্রকাশ করেছেন এই বলে যে, এখন হয়তো ইসলামোফোবিয়া রূপান্তরিত হয়ে অন্য ভাবে কানাডায় আভির্ভূত হতে পারে।

সৌজন্যে : হাফিংটন পোস্ট