কানাডার গাজাঁ সমাচার

মে ১৪, ২০১৭

॥ খুরশিদ আলম ॥

একটা কৌতুক দিয়ে শুরু করি। এক গাজাঁখোর গাজাঁর নেশা করে রাস্তা দিয়ে হেটে যাচ্ছিল। তার উদ্দেশ্য ছিল সে বাড়ি যাবে। কিন্তু রাস্তা আর শেষ হয় না। পথে দেখা এক বন্ধুর সাথে। বন্ধু জিজ্ঞেস করলো, কোথা যাচ্ছিস?

-বাড়ি যাচ্ছি।

-বাড়ি? তাহলে উত্তর দিকে হাটছিস কেন? তোর বাড়ি তো দক্ষিণ দিকে।

-এ্যা! তাই নাকি? তাইতো বলি পথ কেন শেষ হচ্ছে না?

এমন সময় রাস্তার পাশে এসে থামলো এক গাড়ি। গাড়ি থেকে নামলেন নৌবাহিনীর এক কর্মকর্তা। পরনে নৌবাহিনীর ড্রেস। তিনি ফুটপাতে উঠে আসতেই ঐ গাজাঁখোর তার সামনে গিয়ে দাড়ালো।

-ভাই আমাকে একটু বাড়ি পৌঁছে দাও না। ভাড়া যা হয় দিয়ে দিব। অনেক্ষণ ধরে হাটছিতো, পা ধরে গেছে। তোমার গাড়িতে মিটার আছে তো?

-এই ছোটলোক কোথাকার। তুই জানিস আমি কে?

-লে বাব্বা! জানবো না কেন। তুমি পরে আছ ড্রাইভারের পোষাক। তোমাকে চিনতে কষ্ট হবে কেন?

এমন সময় পরিস্থিতি সামাল দিতে গাজাঁখোরের বন্ধুটি এগিয়ে আসলেন। তিনি বললেন, এ্যাই কার সঙ্গে কি বলছিস? দেখছিস না উনি একজন নৌ কর্মকর্তা?

-ও তাই নাকি! তা ভালো ভালো। তো আমাকে একটা জাহাজ ডেকে দাও না ভাই। বেশ আরাম করে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে বাড়ি ফেরা যাবে। আমার খুব ঘুমও পাচ্ছে।

গাজাঁখোরদের নিয়ে এরকম আরো অনেক কৌতুকই আছে। আছে প্রবাদও। যেমন- ‘গাজাঁর নৌকা পাহাড় দিয়ে যায়’, ‘যে খায় গাজাঁ সে হয় রাজা’, ‘এক টানেতে যেমন তেমন দুই টানেতে মজা তিন টানেতে উজির নাজির চার টানেতে রাজা’।

এরকম ‘রাজা’র সংখ্যা কিন্তু কানাডায় কম নেই। জরীপ তথ্য থেকে জানা যায় এখানে প্রতি চারজনে একজন গাজাঁ সেবন করেন! অর্থাৎ কানাডার প্রায় এক চতুর্থাংশ লোকই গাজাঁখোর!

সাধারণভাবে আমাদের ধারণা, বিপথগামী বা বখে যাওয়া লোকেরাই গাজাঁখোর হয়ে থাকেন। গাজাঁর নেশা করে এরা যতসব অসামাজিক কার্যকক্রমে লিপ্ত হন। পরিবারে এবং সমাজে এরা একটা উপদ্রপ বই আর কিছু নয়।

তাহলে কি কানাডায় এক চতুর্থাংশ লোকই বখাটে! এরা অসামাজিক!

আমাদের প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোরও নাকি গাজাঁসেবনের অভিজ্ঞতা রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে যখন এমপি ছিলেন তখনও তিনি গাজাঁ সেবন করেছেন। তার ছোট ভাই মিশেল ট্রুডো একবার পুলিশের হাতে ধরা পড়েছিলেন গাজাঁ রাখার দায়ে। প্রায় ২০ বছর আগের ঘটনা। তখন তার বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছিল। পরে অবশ্য তার বাবা সাবেক প্রধানমন্ত্রী পিয়ের ট্রুডো নামিদামী উকিল ধরে মিশেলের বিরুদ্ধে ঐ ক্রিমিনাল রেকর্ড মুছে ফেলতে সক্ষম হন। মিশেল তার মাস ছয়েক পর ব্রিটিশ কলম্বিয়ায় এক এ্যভালেন্স (তুষার ধ্বস) দুর্ঘটনার কবলে পড়ে মারা যান।

গাজাঁ নিয়ে কানাডায় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আলোচনা সমালোচনা বেশ জমে উঠেছে। গত জাতীয় নির্বাচনে গাজাঁ প্রথম সারির একটি ইস্যু হয়ে দাড়িয়েছিল। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো অঙ্গীকার করেছিলন, তিনি ক্ষমতায় এলে কানাডায় গাজাঁ সেবনকে বৈধতা দানের ব্যবস্থা করবেন।

প্রধানমন্ত্রী তার অঙ্গীকার রক্ষা করার জন্য কদিন আগে অনুষ্ঠানিক পদক্ষেপও নিয়েছেন। অর্থাৎ তার সরকারের পক্ষ থেকে গত ১৩ এপ্রিল পার্লামেন্টে প্রস্তাব উঠানো হয়েছে আগামী ২০১৮ সালের জুলাই মাসের মধ্যে এই গাজাঁ সেবনকে বৈধতা দানের জন্য। যদি এই প্রস্তাব পার্লামেন্টে পাশ হয় তবে কানাডায় একজন প্রাপ্তবয়স্ক (১৮+) ব্যক্তি গাজাঁ ক্রয় ও সেবন করার আইনী অধিকার পাবেন। নিজের কাছে ৩০ গ্রাম পর্যন্ত গাজাঁ রাখতে পারবেন এবং বাড়িতে ৪টি পর্যন্ত গাজাঁর গাছ লাগাতে পারবেন।

পার্লামেন্টে যেহেতু বর্তমান ক্ষমতাসীন লিবারেল পার্টির সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে তাই এই প্রস্তাব পাশে কোন সমস্যাই হবে না তাদের পক্ষে। আর জনমত? গাজাঁ সংস্কৃতির একটি ওয়েবসাইট ‘সিভিলাইজড’ এবং যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিএসবি কর্তৃক পরিচালিত যৌথ জরীপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে শতকরা ৮০ জনই বলেছেন, তারা কানাডায় গাজাঁসেবনকে এক প্রকার বৈধতা দানের পক্ষে। আর শতকরা ৪৪ জন বলেছেন তারা চিকিৎসা এবং বিনোদন উভয় ক্ষেত্রেই গাজাঁসেবনকে বৈধতা প্রদানের পক্ষে।

তবে কানাডার ‘ন্যানস’ নামের একটি জরীপ প্রতিষ্ঠান ও সিটিভি নিউজ কর্তৃক পরিচালিত জরীপে দেখা গেছে প্রায় ৭০% কানাডিয়ান গাজাঁ সেবনকে বৈধতা দানের পক্ষে।

আরো কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় হলো, যারা গাজাঁ সেবন করেন না তাদের তুলনায় গাজাঁসেবনকারী বা গাজাঁখোররা নাকি অধিক সংখ্যায় সামাজিক! গাজাঁখোরদের সামাজিক মেলামেশার প্রবণতাও বেশী। তারা বেশী মুভি দেখেন, মিউজিক ফেস্টিভালে যান বেশী, মিউজিয়ামেও যান বেশী। ক্লাবে বা শুঁড়িখানা যান বেশী। এপ্রিল মাসে ‘সিভিলাইজড’ এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিএসবি কর্তৃক পরিচালিত জরীপে এই তথ্য প্রকাশ পায়।

জরীপে অংশগ্রহণকারীরা আরো জানিয়েছেন, গাজাঁ সেবনের পর তারা ঝিম মেরে একা বসে থাকেন না। মুভি দেখলে সাথে কেউ না কেউ থাকেন। শতকরা ৩৬ ভাগ জানিয়েছেন তারা এই সময়টাতে ঘরের কাজে ব্যস্ত থাকেন। শতকরা ৫০ ভাগের বেশী জানিয়েছেন তারা গাজাঁ সেবনের পর বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটান। শতকরা ৩৬ ভাগ জানিয়েছেন তারা এই সময়টা সৃষ্টিশীল বা উদ্ভাবনী কাজে ব্যয় করেন।

এখানেই শেষ নয়। গাজাঁখোরদের মধ্যে শিক্ষিতের হারও নাকি বেশী! ঐ একই জরীপে দেখা গেছে যারা গাজাঁ সেবন করেন না তাদের মধ্যে ব্যাচলর ডিগ্রিধারীর হার ৩০%। অন্যদিকে গাজাঁখোরদের মধ্যে ব্যাচলর ডিগ্রিধারীর হার ৩৬%! তবে এটি কানাডার চিত্র নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। কানাডায় এখনো এই বিষয়টির উপর কোন জরীপ চালানো হয়নি। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, জরীপ চালালে এখানেও প্রায় একই চিত্র পাওয়া যাবে।

‘ডেলোটি’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের অনুমান হলো, কানাডায় গাজাঁ বৈধ করার পর অল্প সময়ের মধ্যেই এটি ২২.৬ বিলিয়ন ডলারের শিল্পে পরিণত হবে। সেই সাথে সৃষ্টি হবে বিপুল সংখ্যক চাকরী।

বর্তমানে কানাডায় ৭৫ হাজার রোগী নিবন্ধিত আছেন চিকিৎসার প্রয়োজনে গাজাঁ ব্যবহার করার জন্য। হেলথ কানাডার অনুমান হলো ২০২৪ সালের মধ্যে এই সংখ্যা সাড়ে চার লাখে পৌঁছাতে পারে।

গাজাঁ সেবনে নাকি অনেক উপকারিতাও আছে! অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন গাঁজা এক ধরনের ওষুধ। কানাডাসহ অনেক দেশে চিকিৎসার কাজে গাঁজার ব্যবহার চলছে। গাজাঁ সেবন করলে নাকি মনে ও মস্তিষ্কে অনেক কিছু ঘটে। এটা এমন এক উদ্ভিদ যা মনের ওপর প্রভাব ফেলে। অন্যান্য মাদক দ্রব্যের ব্যবহার থেকে বাঁচতে বা মানসিক রোগের চিকিৎসাতেও গাঁজার ব্যবহারের প্রচলন রয়েছে বলে জানা যায়। ‘এমএসএন’ এর সূত্রের বরাত দিয়ে কালের কণ্ঠে এ বিষয়ে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। ওতে দেখা যায়:

১. গাঁজায় আছে টেট্রাহাইড্রোক্যানাবিনোল (টিএইচসি)। এটা মস্তিষ্কে এমন এক অংশে কাজ করে যে অংশটি সুখকর অনুভূতির সৃষ্টি করে। কাজেই পেটপুরে খাওয়া বা সেক্সের মতোই সুখ দেয় গাঁজা।

২. গাঁজায় আরো আছে ক্যানাবিডিওল (সিবিডি)। এটি থেরাপির কাজ করে। বিশেষ ধরনের ব্যথানাশক হিসাবে দারুণ কাজের এটি। শিশুকালে কারো মৃগীরোগ থাকলে উপকার মেলে।

৩. বেশ কিছু ক্ষুদ্র গবেষণায় দেখা গেছে, বেশ কিছু অস্বাস্থ্যকর বিষয় থেকে মুক্তি দেয় গাঁজা। দেহের প্রদাহ বিনাশ করে। রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসের মতো যন্ত্রণাদায়ক রোগ উপশমে কার্যকর ভূমিকা রাখে।

৪. গাঁজা দেহের রক্তনালীকে প্রসারিত করে। এর লক্ষণ প্রকাশ পায় চোখে। এ সময় চোখ দুটো লাল হয়ে যায়।

৫. যারা মাঝে মাঝে বা সব সময় গাঁজা সেবন করে থাকেন, তাদের ক্ষুধা বেড়ে যায়। গাঁজা মস্তিষ্কের এমন একটি অংশকে প্রভাবিত করে যা ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণ করে। সম্প্রতি ইঁদুরের ওপর পরিচালিত এক গবেষণা থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

৬. মস্তিষ্কে যে প্রক্রিয়ায় স্মৃতিশক্তি সঞ্চয় করে, তাতে বাধ সাধে গাঁজা। বেশ কিছু গবেষণায় বলা হয়, স্মৃতিশক্তি কমিয়ে দেয় গাঁজা। তবে অনেকের মতে, এর সঙ্গে গাঁজার কোনো সম্পর্ক নেই।

৭. বৈজ্ঞানিক গবেষণায় বলা হয়নি যে, গাঁজা বিষন্নতা আনে বা বিষন্ন মানুষ গাঁজায় আসক্ত হয়। তবে নেদারল্যান্ডসের এক গবেষণায় বলা হয়, যারা বিষন্নতায় ভোগেন, গাঁজা তাদের এ সমস্যা আরো বৃদ্ধি করতে পারে।

উইকিপিডিয়ার তথ্য মতে দেখা যায় “গাঁজা শরীরের বিষ-ব্যথা সারায়। এ কথার বর্ণনা রয়েছে ভারতবর্ষের প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় চিকিৎসাশাস্ত্রে। তবে এ কথাও সুবিদিত যে, গাঁজা, ভাং ও মারিজুয়ানা গ্রহণ মানুষের স্মরণশক্তি হ্রাস করে এবং দীর্ঘ মেয়াদে মনোবৈকল্য ঘটায়। যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীরা এখন গাঁজা, ভাং ও মারিজুয়ানার ওপর গবেষণা করে জেনেছেন, এ সব মাদকদ্রব্য থেকে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন ব্যথানাশক ওষুধ প্রস্তুত করা সম্ভব, যা মানুষের কোনো ক্ষতি করবে না। গবেষণাটি করেছে ফ্রান্সের বায়োমেডিকেল ইনস্টিটিউট। এর নেতৃত্ব দিয়েছে আইএনএসইআরএম।

জার্মানীর ডয়েচ ভ্যালের সূত্র উল্লেখ করে ভোরের কাগজ এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে যাতে বলা হয়:

গাজাঁ মৃগীরোগ কমায়:

যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া কমনওয়েলথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা ২০১৩ সালেই জানিয়েছেন, গাঁজা একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় নিলে মৃগী বা এ ধরণের কিছু স্নায়ুরোগ থেকে দূরে থাকা যায়।

গাজাঁ গ্লুকোমা দূরে রাখতে সহায়তা করে:

যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল আই ইন্সটিটিউট জানিয়েছে, মারিজুয়ানা গ্লুকোমার ঝুঁকিও কমায়। গ্লুকোমা চোখের এমন এক রোগ যা চির অন্ধত্ব ডেকে আনে।

গাজাঁ এ্যালজাইমার এর শত্রু:

দ্য জার্নাল অফ এ্যালজাইমার’স ডিজিজে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, গাজাঁ মস্তিষ্কের দ্রুত নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়াও রোধ করে। আর এভাবে এ্যালজাইমার ঝুঁকিও কমাতে পারে গাজাঁ। তবে গাজাঁ ‘ওষুধ’ হলেই রোগ সারাবে, কারো নিয়ন্ত্রণহীন আসক্তির পণ্য হলে নয়।

গাজাঁ ক্যানসার প্রতিরোধ করে:

এই বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্র সরকারিভাবেই স্বীকার করেছে। ২০১৫ সালে সে দেশের ক্যানসার বিষয়ক ওযেবসাইট ক্যানসার অর্গ-এ জানানো হয়, গাজাঁ অনেক ক্ষেত্রে টিউমারের ঝুঁকি কমিয়ে ক্যানসার প্রতিরোধকেরও ভূমিকা পালন করে।

গাজাঁয় কেমোথেরাপির ক্ষতি কম:

ইউএস এজেন্সি ফর ড্রাগ জানিয়েছে, গাজাঁ ক্যানসার রোগীর রোগযন্ত্রণা অন্যভাবেও কমায়। ক্যানসার রোগীকে এক পর্যায়ে কেমোথেরাপি নিতে হয়। কেমোথেরাপির অনেক পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া। গাজাঁ কেমোথেরাপির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াজনিত অনেক ক্ষতি লাঘব করে।

গাজাঁ স্ট্রোকের ঝুঁকি কমায়:

এটি যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অফ নটিংহ্যামের গবেষকদের উদ্ভাবন। তারা গবেষণা করে দেখেছেন, গাজাঁ মস্তিষ্ককে সুস্থ রাখতেও সহায়তা করে। ফলে স্ট্রোকের ঝুঁকি কমে।

গাজাঁয় ব্যথা নিরোধ:

ডায়াবেটিস চরম রূপ নিলে রোগীদের অনেক সময় হাত-পা এবং শরীরের নানা অংশে জ্বালা-যন্ত্রণা হয়। ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ার গবেষকরা বলছেন, গাজাঁ সেই যন্ত্রণা লাঘব করতে সক্ষম।

গাজাঁ হেপাটাইটিস’সি-র পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কমায়:

হেপাটাইটিস সি-র পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও কমায় গাজাঁ। নির্দিষ্ট মাত্রায় ওষুধের মতো গাঁজা সেবন করিয়ে দেখা গেছে এই রোগে আক্রান্তদের শতকরা ৮৬ ভাগেরই পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া অনেক কমেছে।

কিন্তু সত্যিই কি গাজাঁ এতই উপকারী? ফিটনেস.কম এর সূত্র উল্লেখ করে বাংলা ডেইলী সান পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে,

১. এটি রক্তবাহী শিরা ধ্বংস করে:

গাঁজার ধোঁয়া কতটা ক্ষতি করে তা অনেকেরই জানা নেই। গবেষকরা জানাচ্ছেন, এটি রক্তবাহী শিরার ওপর ব্যাপক ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করে। আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে, তারা ইঁদুরের ওপর গাঁজার ধোঁয়ার প্রভাব পরীক্ষা করে জানতে পেরেছেন যে, এটি রক্তবাহী শিরার মারাত্মক ক্ষতি করে। মাত্র এক মিনিট গাঁজার ধোঁয়াতে থাকলে তা রক্তবাহী শিরার ওপর কমপক্ষে ৯০ মিনিট ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করে। এতে রক্ত পরিবহন বাধাপ্রাপ্ত হয়।

২. টেস্টিকুলার ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়:

পুরুষের টেস্টিকুলার ক্যান্সারের ঝুঁকি অনেকাংশে বাড়িয়ে দেয় গাঁজা। ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়ার এক গবেষণায় দেখা গেছে, গাঁজা সেবনে ব্যাপকভাবে বেড়ে যায় ক্যান্সারের আশঙ্কা।

৩. স্বল্পমেয়াদে স্মৃতিশক্তি লোপ:

গাঁজা সেবনকারীদের প্রায়ই নানা বিষয় ভুলে যেতে দেখা যায়। আর এর কারণ অন্য কিছু নয়, গাঁজার প্রভাব। যুক্তরাষ্ট্রের নর্থওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির গবেষকরা জানিয়েছেন, গাঁজা সেবনকারীদের মস্তিষ্কে কিছুটা অস্বাভাবিকতা দেখা যায়। আর এ কারণে তাদের কিছু স্মৃতিও স্বল্পমেয়াদে হারিয়ে যায়। বেশিমাত্রায় গাঁজা সেবনে মস্তিষ্কের এ ক্ষতি স্থায়ী হয়ে যায়, যা আর ভালো হয় না।

৪. সৃজনশীলতা নষ্ট করে:

বহু মানুষেরই ধারণা গাঁজা সৃজনশীলতা বৃদ্ধি করে। যদিও এ ধারণা ভুল বলেই জানাচ্ছেন নেদারল্যান্ডসের গবেষকরা। এটি তাদের সৃজনশীলতা বাড়ায় না বরং কমিয়ে দেয়।

৫. মস্তিষ্কের কোষ ধ্বংস করে:

গাঁজা মস্তিষ্কের ওপর স্থায়ী প্রভাব ফেলে মস্তিষ্কের কোষ ধ্বংস করে। এ কারণে তা মানুষকে অস্বাভাবিক করে দেয়। দীর্ঘ ২০ বছরের গবেষণায় এ বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছেন গবেষকরা।

৬. জীবনে সাফল্য লাভে অন্তরায়:

গাঁজাসেবীর দেহে নানা ধরনের প্রভাব পড়ে। এতে স্মৃতিশক্তি যেমন ধ্বংস হয় তেমন মানসিক স্থিরতাও আসে না। এ কারণে গাঁজাসেবী কোনো বিষয়ে স্থির হতে পারে না। এতে তার জীবনের সাফল্যও বাধাগ্রস্ত হয়।

উপরে গাজাঁর পক্ষে বিপক্ষে কিছু তথ্য ও গবেষণার ফলাফল দেখলাম। কিন্তু কানাডায় যখন এই গাজাঁ সেবন বৈধ করা হবে তখন তার কুফল বা সুফল কি হতে পারে?

আমরা জানি, বৈধ না হলেও বহুকাল আগে থেকেই কানাডায় ব্যবহার হয়ে আসছে গাজাঁ। সমাজে নারী – পুরুষ, ধনী-গরীব সব শ্রেণীর মানুষই আইনের চোখকে ফাঁকি দিয়ে সেবন করে আসছেন এই গাজাঁ। আর এখন যেহেতু এটি বৈধ হতে যাচ্ছে তখন নিশ্চিতভাবেই গাজাঁ সেবনকারীদের সংখ্যাও বৃদ্ধি পাবে সন্দেহ নেই। ফোরাম রিসার্সের এক জরীপেও এরকমই আভাষ পাওয়া গেছে। জরীপ প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বলা হয়, জরীপে অংশগ্রহণকারী শতকরা ৩০ জন বলেছেন, বৈধতা পেলে তারা গাজাঁ সেবন করবেন। কানাডায় যারা গাঁজা সেবন করছেন তাদের মধ্যে যুবক-যুবতীর সংখ্যাই বেশী। শতকরা ৩৪ ভাগ। পুরুষদের সংখ্যা শতকরা ২৩ ভাগ।

গাজাঁর উপর সাম্প্রতিক কালে ভেষজ বা ঔষধি গুণ আরোপিত করার চেষ্টা করা হলেও মূলত এটি একটি মাদক দ্রব্য। গোটা বিশ্বে বহু কাল ধরেই এটি মাদক হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। কানাডায়ও তাই। জাতিসংঘ গাজাঁকে বিশ্বের সর্বাধিক ব্যবহৃত অবৈধ ড্রাগ হিসাবে বিবেচনা করে।

আমরা জানি এ্যালকোহল কানাডায় বৈধ। তবে গাড়ি চালানোর সময় কি পরিমাণ এ্যালকোহল পান করা যাবে তার একটি সীমা নির্ধারণ করা আছে। কিন্তু দেখা গেছে সেই সীমা প্রতিনিয়তই লংঙ্ঘন হয়ে থাকে। আর তার পেনালটি বা গুনাগারি হলো প্রতিদিন ৪ জন মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যু।

কানাডায় বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান প্রায় আড়াই হাজার লোক। তার মধ্যে অর্ধেকেরও বেশী মারা যান মদ্যপ ড্রাইভারদের কারণে। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায় ২০১২ সালে মোট ২৫৪৬ জনের মৃত্যু ঘটে সড়ক দুর্ঘটনায়। এর মধ্যে ১৪৯৭ জনের (৫৮.৮%) মৃত্যুর জন্য দায়ি মদ্যপ ড্রাইভারগণ।

‘মাদার্স এ্যাগেইনস্ট ড্রাং ড্রাইভিং কানাডা’র ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী দেখা যায়, ২০১২ সালে মদ্যপ (এ্যালকোহল রিলেটেড) অবস্থায় গাড়ি চালানোর কারণে যে সড়ক দুর্ঘটনাগুলো ঘটেছিল তাতে মৃত্যু ঘটেছিল ৪৭৬ জনের। ড্রাগ সেবন করে গাড়ি চালানোর সময় যে দুর্ঘটনাগুলো ঘটেছিল তাতে মৃত্যু ঘটেছিল ৬১৪ জনের। এই ড্রাগের মধ্যে সবচেয়ে বেশী ছিল গাজাঁ। আর ৪০৭ জনের মৃত্যু ঘটেছিল এ্যালকোহল ও ড্রাগ এই দুয়েরই সমন্বয়ে নেশাগ্রস্ত ড্রাইভারগণ যখন সড়ক দুর্ঘটনায় পতিত হন।

সাম্প্রতিক কালের কিছু গবেষণায় যেহেতু দেখা গেছে গাজাঁর কিছু ভেষজ গুণও রয়েছে তখন এর বৈধ ব্যবহার হয়তো আর ঠেকানো যাবে না। অন্তত ঔষধ হিসাবে হলেও এটি ব্যবহারের অনুমতি দিতে হবে। কানাডাও সেই পথেই এগুচ্ছে। ঔষধ হিসাবে ব্যবহারের পাশাপাশি বিনোদনের উপাদান হিসাবেও এটি ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হবে কানাডায়। তবে কিছু বিধিনিষেধও আরোপ করা হবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, যখন এর অপব্যবহার হবে তখন তা কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে সরকার?

স্মরণ করা যেতে পারে যে, ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে টরন্টোর নিকটবর্তী ভন সিটিতে এক সড়ক দুর্ঘটনায় একই পরিবারের তিন শিশুর মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটেছিল। ঐ দুর্ঘটনা শিশুদের দাদাও মৃত্যুবরণ করেন। দুর্ঘটনার জন্য দায়ি যে ড্রাইভার তিনি মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালাচ্ছিলেন। তার নাম মারকো মুজো। বয়স ৩০ বছর। কানাডার একজন বিলিওনারের নাতি এই মারকো। বিচারে তার শাস্তি হয়েছে মাত্র দশ বছরের জেল। কিন্তু যে বাবা-মা তাদের তিন সন্তানকে হারালেন এবং সেই সাথে শিশুদের দাদাকে, তার ক্ষতি পূরণ হবে কি দিয়ে? আর এই যে একসাথে তিন নিষ্পাপ শিশু সন্তান হারানোর বেদনা, তার কি কোন সমাধান আছে? নেই, জীবনভার বয়ে বেড়াতে হবে এই অসহনীয় বেদনাকে, যে বেদনা সৃষ্টি করেছে মাত্র কয়েক আউন্স এ্যালকোহলের অপব্যবহার।

এরকম ভাবে গাজাঁর অপব্যবহারের মধ্য দিয়েও যদি আগামীতে কারো পরিবারে কোন ভয়াবহ ট্র্যাজেডি নেমে আসে তখন তার জন্য আমরা কাকে দায়ী করবো?

খুরশিদ আলম

সম্পাদক ও প্রকাশক, প্রবাসী কণ্ঠ