এল্ডার এবিউজঃ শেষকথা
মার্চ ২৮, ২০১৬
হাসিনা বেগম
[বাংলাদেশ সেন্টার এন্ড কমিউনিটি সার্ভিসেস (বিসিসিএস) টরন্টোতে বসবাসরত বাংলাদেশি কমিউনিটি সদস্যদের মধ্যে এল্ডার এবিউজ সম্পর্কিত সচেনতা বৃদ্ধির লক্ষে একটি প্রকল্পের কাজে হাত দিয়েছে। তারই শেষ অংশ আজকের এই প্রবন্ধ। বিসিসিএস এই প্রয়াস যদি সবাইকে একটু হলেও প্রভাবিত করে থাকে তবে আমরা অত্যন্ত আনন্দিত। ]
সংসার জীবনে প্রত্যেক পিতামাতা আদম্য উৎসাহে –নিঃস্বার্থ হৃদয়ে, সকল ব্যথা বেদনা ,কষ্ট ভুলে সন্তান পালনে এক অভূত পূব দায়িত্ব পালন করে থাকে। সুখের সংসার গড়ায় থাকে ব্যতিব্যস্ত। অন্ন আর অর্থ আহরনে নিত্যদিন কাটে তাদের কর্ম ব্যস্ততায়। কালের গতিতে তারাই একদিন হয়ে যায় স্তিমিত, -জীবনী শক্তিতে, মেধাতে আর আর্থিক দিক দিয়ে। পৌছায় তারা জীবনের শেষ প্রান্তে। পরিবারে তাদের অবদান হয়ে যায় সীমিত, কর্মে শিথিল আর যোগ্যতায় তখন তারা শূন্যের কোঠায়। পরিবারে তখনই তারা হয় অয্যেগ্য, সমাজে অবাঞ্ছিত আর তাদের ভাগ্য হয় দুর্বিসহ যন্ত্রনার এক অবয়ব। এই সময়টাতেই বয়স্ক ব্যক্তিদের নিগৃহীত ও নিপীড়িত হতে দেখা যায়। বিভিন্ন ভাবে, বিভিন্ন জায়গায়, ভিন্ন ভিন্ন রুপে। বাংলাদেশী সমাজে ও এর প্রভাব আছে। পূর্বেও ছিল। এখনও আছে। দেশে বিদেশে এদের করুন দৃশ্য আমাদের সচেতন হৃদয়ে ব্যথার উদ্রেগ করে। সমাজ সচেতন ব্যক্তি বা গোষ্ঠিকে এগিয়ে আসতে হবে এই সমস্যার সমাধান বা নিবারন পদ্ধতি নিয়ে। এই সমস্যার কারণ ও করনীয় খুঁজে বের করা আমাদের অবশ্য কর্তব্য। এখনই ভাবতে হবে আমাদের এ বিষয় নিযে।
‘বয়োজ্যেষ্ঠদের সন্মান করা’ এটা প্রতিটি পরিবারের লোকই জানে এবং শেখে পরিবার থেকেই। প্রথমতঃ বাবা- মা শেখান ‘গুরুজনকে ওভাবে কথা বলতে হয় না’ উনি বয়স্ক, তাকে সন্মান করে কথা বলবে।” বাড়ীর বড় ছেলে বা মেয়ে শেখে মা- বাবা এর কাছ থেকে। আবার ছোট ভাই বোনেরা শেখে বড় ভাই বোনেদের কাছ থেকে। এটাই বাঙ্গালী পরিবারের এৗতিহ্য এবং সভ্যতার অঙ্গ। এর ব্যতিক্রম ঘটে কখনও বা। কালের চক্রে প্রতিটি মানুষই যৌবন পার হয়ে বৃদ্ধ বয়সে এসে দাড়ায়। এ সময় থেকে পরে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দুয়ারে পৌছে যায়। মৃত্যুর পূর্বের এই সময়টাই বয়োজ্যেষ্ঠদের পার করতে হয় একটা কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে। দৈহিক,মানসিক, সামাজিক, আর্থিক এ সকল ক্ষে্ত্রেই তাকে বুঝতে হয় , আনুভব করতে হয় এক শূন্যতার ভেতর দিয়ে। ধৈর্য্য,আর মানসিক শক্তি নিয়ে বেঁচে থাকতে হয় পরিবারে, সমাজে। মা- বাবা পুরোপরিবার টিকে ঘিরে অদম্য সাহসে ভবিষ্যতের সন্তান গড়ার কারিগরের দায়িত্ব পালন করে থাকে। পর-বর্তীতে সেই সন্তানরাই যখন তাদের নিজেদের সংসার গড়ার দায়িত্বে নিয়োজিত হয় তারা তখন ভুলে যায় তাদের বাবা মায়ের কর্ম ক্ষমতা, তাদের সহনশীলতা ও তাদের ত্যাগ স্বীকারের অবদান। বয়োবৃদ্ধ পিতামাতার সেই অবদান ও তাদের কর্তব্য ভুলে তাদেরকে বোঝা স্বরুপ মনে করে। আর বৃদ্ধ বাবা- মা হয়ে যায় তাদের হাতে দু্র্ব্যবহার ও নির্মমতার শিকার। এর অগ্রগতি রোধ করতে সমাজ সচেতন সবাইকেই চিন্তা করতে হবে। এর বিস্তার লাভে লাগাম টানতে আমাদের এখনই। বিভিন্ন প্রকল্পের ধ্যান ধারনার আশ্রয় নিতে হবে। বয়োবৃদ্ধদের স্বল্প সময়ের জীবনটা যাতে আরো নিগৃহীত না হয়ে-সুন্দর,ও সহন ভাবে কাটে তার জন্য আমাদের চেষ্টার প্রয়াসে কিছু পদক্ষেপ নিতে পারি। প্রথমতঃ পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় করা এবং এই প্রচেষ্টায় বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া যায়। সন্তান যাতে পিতামাতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়, তাদের ভালবাসা পিতামাতার অবুঝ ব্যবহার,সামান্য তিরস্কার,বা কিছু ব্যবহার ক্ষমাশীল চোখে দেখে- তাহলে অবস্হার প্রেক্ষিত পটে কেউই আহত হবার সুযোগ পাবে না। বয়স বৃদ্ধিতে কর্ম ক্ষমতা ,চিন্তাশক্তি, দৃষ্টিভঙ্গি এ সবকিছুই পরির্তন হবে। সন্তানদের এই মানসিক শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে। এই সময়ে তারা একটুতেই আবেগ প্রবন,অভিমানী বা কখনও বেশী উওেজিত হয়ে থাকে। সন্তানদের চিন্তাধারায় এগুলোকে বিশেষ স্হান দিতে হবে। সদয় ব্যবহারের চেয়ে আর অন্য কোন ব্যবস্হা-এর চেয়ে দৃঢ় হবার নয় ।পরিবারের নাতি- নাতনী কে ছোট থেকেই বাবা- মা সতর্ক করবে। যেন তারা দাদা-দাদী বা নানা- নানী কে কোন প্রকার তুচ্ছ –তাচ্ছিল্য বা আপমান-অবমাননা করা থেকে বিরত থাকে।। হাসি-মুখে, হাস্যেজ্জল স্বভাবে তাদের সাথে কথা বলার চেষ্টা করে। আমাদের ইসলাম ধর্মে আছে –‘মুরুব্বীর দোয়া আল্লা কবুল করেন।’ সন্তান কে এই শিক্ষা দিলেও তাতে ওরা প্রলুব্ধ এবং সজাগ হবে। অন্য দিকে দাদা- দাদী এবং নানা-নানীকেও কিছু ব্যপারে সজাগ থাকতে হবে। তাদেরও কিছু করনীয় আছে –এ ব্যপারে তাদেরও কিছু পরিমান শিক্ষায় দীক্ষিত করার প্রয়োজন আছে। পরিবারের ছেলে –বউ এবং মেয়ে –জামাই দুজনেই যদি চাকুরিজীবি হয় তাহলে খেয়াল রাখতে হবে – ওরা দুজনেই ক্লান্ত। কোন রকম উপদেশ, আদেশ বা চাওয়া পাওয়ার হিসাব এ সময় নয়। সুযোগের অপেক্ষায় বা সময়ের বিবেচনায় সে গুলো বলা যেতে পারে। তবে অসুস্হ অবস্হায় যদি বয়োবৃদ্ধ মা –বাবা সময় ও সুযোগের অপেক্ষা না করে তবে ছেলে মেয়ে কে ও তা উপলব্ধি করার বিবেচনা থাকতে হবে। পুরো ব্যপারটাই দুপক্ষের শিক্ষা, বিবেচনা ও সহানুভূতির উপর স্হাপন করতে হবে। তাছাড়া আর্থিক ভাবে স্বনিরভর হওয়ার জন্য ও বয়স্ক ব্যক্তিদের উৎসাহিত করা যায়। তাদের সংগঠিত করে মিটিং, গেট টুগেদার, ভ্রমন ও প্রমোদ ব্যবস্হার আয়োজন করা যেতে পারে। এছাড়া ও আমরা সমাজ সচেতনতায় অংশ নিতে পারি বিভিন্ন ভাবে। প্রবন্ধ লেখা, ওয়ার্কশপ করা এমন কি -স্কুলের কারিকুলামে বয়োবৃদ্ধদের সাথে ব্যবহার সংক্রান্ত বিষয় সংযোগ করানোর পদক্ষেপ নিতে পারি।
একজন কমিউনিটির সেবক হিসেবে আমরা কিছু দিক নির্দেশনার বা মানবাধিকারের গুরুত্ব দিতে পারি।
১)প্রথমত বার্ধক্য ও বয়োজ্যেষ্ঠদের সম্পর্কে ইতিবাচক ভাবমূর্তি তুলেধরা।
২) পরিবারে কেউ নির্যাতিত হচ্ছে কিনা নির্দিষ্টভাবে তার খোঁজ করা বা রাখা
৩) অধিকার সম্পর্কে তারা অবগত আছে কি না
৪) আর্থিক দিক দিয়ে তারা অবগত আছে কিনা
৫) প্রয়োজনে (O A S) ওল্ড এজ সিক্যুরিটি প্রোগ্রাম এর আওতায় নিতে তাদেরকে সাহায্য করা। এই ভাতা পেতে হলে পূর্বের কোন রকম কাজ করার প্রয়োজন পড়েনা
৬) বয়োজ্যেষ্ঠদের বাড়ীতে কমিউনিটি স্বাস্থ সেবা প্রদান করে থাকে। সেইসব পেশাদানকারীগন কে আমরা প্রয়োজনে বয়োজ্যেষ্ঠদের সাহায্য করতে পারি। গৃহ সাহায্য, যত্নকারী সহায়তার ব্যবস্থা করতে পারি
৭) প্রাপ্ত বয়স্কদের কেয়ার প্রোগ্রামের মাধ্যমে ব্যায়াম, বন্ধুত্ব ও রিক্রিয়েশন এর ব্যবস্থা করতে পারি
৮) প্রয়োজনে কমিউনিটি হাউজিং এর ব্যবস্থা করা
আমরা আমাদের সমাজ, পরিবার সবকিছু নিয়ে পৃথিবীতে ‘স্বল্প সময়ের জীবনটাকে’ সার্থক, পরোপকার ও সুখ –শান্তি দিয়ে কাটানোর দীপ্ত অঙ্গীকার করতে চাই।
-হাসিনা বেগম, টরন্টো