এই পরবাসে রবে কে-৩

ফেব্রুয়ারি ১, ২০১৮

নাজমুল ইসলাম

“মোদের গরব মোদের আশা
আ-মরি বাংলা ভাষা
মাগো তোমার কোলে তোমার বোলে কতই শান্তি ভালবাসা ॥”

কানাডায় প্রথম ল্যান্ডিয়ের দিন ইমিগ্রেশন পার হবার পর এয়ারপোর্ট থেকে বের হবার সময় কানাডা সরকার একটা ব্যাগ হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল। যাকে বলে ওয়েলকাম প্যাক। বাসায় এসে খুলে দেখি তাতে ওয়েলকাম টু কানাডা লেখা একখানা পুস্তকসহ কলম, নোটবুক ইত্যাদি দরকারী টুকিটাকি দেয়া আছে। নবাগতদের জন্য সরকারের এই আয়োজনে বেশ ভাল লাগলো। কেবল একটা বিষয় মন খারাপ করে দিল। ভিউকার্ড সাইজের এক পাতার একটা কার্ডের মতো পেলাম যাতে ইংরেজী ভাষার ‘ওয়েলকাম’ শব্দটা ইংরেজী ছাড়াও ফরাসী, চায়নিজ, হিন্দি, পাঞ্জাবী, উর্দু, আরবী, স্প্যনিশ, পর্তুগীজ, রাশান, ইত্যাদি বেশ কয়েকটা ভাষায় লেখা আছে। শুধু আমাদের বাংলা ভাষায় ‘স্বাগতম’ নেই।
ওয়েলকাম প্যাকের সেই কার্ডে ‘ওয়েলকাম’ শব্দটা এত ভাষায় থাকলেও বাংলায় ‘স্বাগতম’ নেই কেন এটা নিয়ে মন খারাপ হওয়ার হয়তো তেমন কোন যুক্তি নেই। কিন্তু তারপরেও মনে হলো, কানাডা সরকার কী তাহলে বাংলা ভাষাভাষী ইমিগ্র্যান্টদের স্বাগত জানাচ্ছে না? অনেক্ষণ কার্ডটা হাতে নিয়ে ভাবলাম, আমাদের ইমিগ্রেশনের বয়স তো একেবারে কম না। তারপরেও এই অবস্থা কেন? আমরা বাঙালীরা তাহলে এতবছর এখানে এসে কী করলাম? শুধু অমুক সমিতি, তমুক সমিতির পিকনিক করেই কাটিয়ে দিলাম? যদিও ইদানিং কিছু কিছু স্কুলে টরন্টো ডিস্ট্রিক্ট স্কুল বোর্ডের (টিডিএসবি) ছাপানো ওয়েলকাম পোস্টারে অন্যান্য ভাষার সঙ্গে বাংলায় ‘স্বাগতম’ শব্দটিও শোভা পাচ্ছে।
আমাদের ভাষা নিয়ে গর্ব করার মতো যা আছে পৃথিবীর অনেক জাতিরই তা নেই। কানাডায় ইংরেজী আর ফরাসী দু’টো ভাষাই স্বীকৃত অফিসিয়াল ভাষা। তারপরেও কানাডা সরকার অন্যান্য ইমিগ্র্যান্টদের তাদের নিজ নিজ ভাষায় স্বাগত জানাচ্ছে। ইমিগ্র্যান্টরা কে কোন দেশ থেকে আসছে সেটাও সরকারের অজানা নয়। কাজেই নবাগতদের যদি তাদের নিজ নিজ মাতৃভাষায় স্বাগত জানাবার একটা রীতি চালু করা যায়। তাতে ক্ষতি কী?
কানাডায় হয়তো আমরা বাঙলা ভাষাভাষীরা সংখ্যায় খুব বেশী নই। তাই বলে পৃথিবীতে সপ্তম বা অষ্টম স্থানে যে ভাষা, যে ভাষাভাষী ইমিগ্র্যান্টের সংখ্যা একেবারে নগন্য নয়, ওয়েলকাম প্যাকে তার কোন নাম নিশানাই থাকবে না এটা মানতে কষ্টই হয়। ভাষার যে একটা আলাদা শক্তি আছে আশাকরি এ বিষয়ে কারও দ্বিমত নেই। এটা একটা জাতির সবচেয়ে গর্বের স্থান। আমাদের বাঙালী জাতির ক্ষেত্রে তো বটেই। আমাদের ভাষা আন্দোলনের মতো গৌরবোজ্জল ইতিহাস আছে। পৃথিবীতে ভাষার ভিত্তিতে আর কোন রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে কিনা আমার জানা নেই। ভাষা বা সাংস্কৃতিক আভিজাত্য যে নিতান্ত তুচ্ছ বিষয় নয় তার অন্যতম উদাহরণ ফরাসী ভাষাভাষী কুইবেক, যারা আজও কানাডা থেকে আলাদা হতে চায়।
ভাষা নিয়ে গর্বের প্রসঙ্গে সবিনয়ে একটি অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে চাই। ২০১০ সালে ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যাডাপটেশন বিষয়ক একটা আন্তর্জাতিক শর্ট কোর্সে এশিয়া, আফ্রিকা, ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের কুড়ি জন প্রশিক্ষণার্থী অংশগ্রহণ করছি। প্রতিটা দেশের একজন করে প্রশিক্ষণার্থী। স্থান টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি অব ড্রেসডেন, জার্মানী। কোর্সের শুরুতে প্রত্যেককে একটা করে কান্ট্রি প্রেজেন্টেশন দিতে হচ্ছে। আফ্রিকা মহাদেশের বেশ কয়েকটা দেশ থেকেও প্রশিক্ষণার্থী এসেছে।
ব্রিটিশ উপনিবেশের কারণে আফ্রিকার অনেক দেশের অফিসিয়াল ভাষা বা রাষ্ট্রভাষা ইংরেজী। এদের কারও কারও মাতৃভাষা প্রায় হারিয়ে গেছে। আমাদের ইথিওপিয়ান কোর্সমেট বন্ধু তার কান্ট্রি প্রেজেন্টেশনে জানালো যে, তারাই আফ্রিকার একমাত্র দেশ যারা কখনও ঔপনিবেশিক শাসনে শাসিত হয়নি এবং তাদের গর্ব এই যে, তাদের নিজস্ব ভাষা, লিপি সব আছে ইত্যাদি ইত্যাদি। নিঃসন্দেহে গর্বের ব্যাপার। শুনে সবাই বেশ ধন্য ধন্য করে উঠলো।
এরপর আমার পালা। আমার প্রেজেন্টেশনের সময় আমিও জানালাম যে আমাদের রাষ্ট্রভাষা এবং মাতৃভাষা বাংলা। তবে আমাদের গর্ব এই যে, ব্রিটিশরা আমাদের দু’শো বছর শাসন করলেও আমাদের ভাষা বদলাতে পারেনি। আর সম্ভবত পৃথিবীতে আমরাই একমাত্র জাতি যারা ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছি। ভাষার ভিত্তিতে একটা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছি। স্লাইডে শহীদ মিনারের ছবি দেখিয়ে ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারীর ঘটনা সংক্ষেপে বললাম। আরও জানালাম যে, আমাদের সেই অনন্য ঘটনাকে স্মরণ করে জাতিসংঘ ২১ শে ফেব্রুয়ারীকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে ঘোষণা করেছে যা এখন এই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে পালিত হয়। লক্ষ্য করলাম, বেশ কয়েকটি দেশ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস এবং, ২১শে ফেব্রুয়ারী’র সঙ্গে পরিচিত।


আরও একটি মজার অভিজ্ঞতা হয়েছিল সেদিন। প্রেজেন্টেশনের সময় আমি বারবার ‘বাংলা’ শব্দটা উচ্চারণ করাতে ডায়াসে বসা আমাদের কোর্স ডিরেক্টর জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমাদের ভাষার নাম তো বেঙ্গলী তাইনা? তুমি যে বাংলা শব্দটা বলছো সেটা আর বেঙ্গলী কি একই ভাষা’? আমি ইচ্ছা করেই অবাঙালী বা বিদেশীদের সামনে বেঙ্গলী না বলে বাংলা বলি। ব্যক্তিগতভাবে বাংলার প্রতিশব্দ হিসাবে বেঙ্গলী শব্দটা আমার মোটেও পছন্দ নয়। কোর্স ডিরেক্টরকে বিনীতভাবে বোঝাতে চেষ্টা করলাম- দেখ, আমরা বাঙালী। আমাদের ভাষার নাম আসলে ‘বাংলা’ (বাঙলা)। সম্ভবত ঔপনিবেশিক শাসনামলে ব্রিটিশরা আমাদের বাংলাকে ‘বেঙ্গল’ এবং আমাদের ভাষাকে এবং জাতিকে ‘বেঙ্গলী’ বলে এই শব্দগুলো প্রথম চালু করেছিল। হয়তো তারা ‘বাংলা’ শব্দটা উচ্চারণ করতে পারতো না অথবা অন্য যেকোন কারণেই হোক বাংলাকে তারা ‘বেঙ্গল’ বা ‘বেঙ্গলী’ করেছে। আর সেই থেকে সারা পৃথিবী জুড়ে প্রকৃত শব্দ ‘বাংলা’র বদলে ব্যাপকভাবে পরিচিতি পেয়েছে ‘বেঙ্গল’ বা ‘বেঙ্গলী’। তাকে আবারও বললাম, আমার ভাষার প্রকৃত নাম ‘বাংলা’, ‘বেঙ্গলী’ নয়।
আমাদের কোর্স ডিরেক্টর সাহেব আরও একটু আরগুমেন্ট করতে চাইলেন মনে হলো। তিনি বললেন, ‘এখন তো এটা প্রতিষ্ঠিত। ব্রিটিশদের চালু করা শব্দের বানান, উচ্চারণ সবই তো চলছে। কিছু কি বদলেছে’? আমি তাকে বললাম, নিশ্চই বদলেছে। ব্রিটিশরা আমাদের ‘ঢাকা’ (Dhaka) শহরের নাম ‘ডাক্কা’ (Dacca) করে গিয়েছিল। আমরা সেটাকে উচ্চারণ এবং বানান পরিবর্তন করে প্রকৃত উচ্চারণ ‘ঢাকা’ (Dhaka) করেছি। ওরা ‘কোলকাতা’ (Kolkata) শহরকে ‘ক্যালকাটা’ বা কালকুট্টা (Calcutta) করেছিল। এখন আবার উচ্চারণ অনুযায়ী বানানও ‘কোলকাতা’ (Kolkata) হয়েছে। এরকম অনেক কিছুই চেঞ্জ হয়েছে। কাজেই এতকাল ‘বেঙ্গলী’ (Bengali) উচ্চারণ করা হয়েছে বলে সেটাকে আর ‘বাংলা’ (Bangla) করা যাবে না কেন? এখন থেকে ‘বেঙ্গলী’ (Bengali) শব্দটাকে ‘বাংলা’ (Bangla) উচ্চারণ করতে ক্ষতি কী? অবশেষে আমার যুক্তি মেনে নিতে রাজী হলেন ডিরেক্টর স্যার। আমার কোর্সমেটরাও শেষ পর্যন্ত আমার যুক্তিকে সমর্থন করলো।
মাঝে মাঝে মনে হয়, আমরা যদি Dacca বানান বদলে Dhakaকরতে পারি, বিমানবন্দরের নাম বদলে সারা দুনিয়াকে জানিয়ে দিতে পারি, তাহলে আমার ভাষার নাম যে ‘বেঙ্গলী’ (Bengali) নয় ‘বাংলা’ (Bangla), বিশ্ববাসীকে সেটা জানাতে সমস্যা কোথায়?
পৃথিবীতে প্রথম আটটি ভাষার একটি হলো বাংলা। বিশ্বসাহিত্যে আমাদের ভাষার অবদান একেবারে ফেলনা নয়। সাহিত্যসহ অন্যান্য বিষয়ে বাংলা ভাষাভাষী একাধিক নোবেল পুরস্কার বিজয়ী রয়েছেন। বাংলা ছাড়া ভারতবর্ষের আর কোন ভাষায় সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছে বলেও জানা নেই।
আর একটি বিষয়ে প্রিয় পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। ইদানিং সিলেটি বাংলা বলে আলাদা একটি ভাষাকে প্রমোট করবার উদ্যোগ লক্ষণীয়। বাংলা ভাষা ও লিপির পাশাপাশি আমরা সিলেটি নাগরী লিপির কথা জানি। এটি আমাদের দেশের একটি আঞ্চলিক ঐতিহ্য। এর সঙ্গে বাংলার কোন বিরোধ নেই। সিলেটি নাগরী লিপি নিয়ে অনেক গবেষণাও হচ্ছে দেশে। কিন্তু ভাষার তালিকায় ‘বাংলা’র পাশাপাশি ‘সিলেটি বাংলা’ বলে আরও একটি ভাষাকে প্রমোট করার পেছনে যুক্তি কী? এই মহৎ কর্মযজ্ঞে যারা যুক্ত আছেন তাদের সবিনয়ে বলতে চাই, এধরণের অন্তর্ভূক্তির উদ্যোগ নিঃসন্দেহে এক নির্বোধ চেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়। শব্দের ব্যবহার বা উচ্চারণের পার্থক্য থাকলেও কানাডায় অন্টারিও ইংলিশ বা মানিটোবা ইংলিশ বা আলবার্টা ইংলিশ বলে আলাদা ইংরেজী ভাষার অস্তিত্ব আছে কি? নাকি কেবল ইংলিশ?
আমাদের দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যে আঞ্চলিক ভাষা প্রচলিত তার জন্য আমরা নিশ্চই গর্ব করতে পারি। আমরা ঘরে ঘরে পারিবারিক পরিমন্ডলে এমনকি কমিউনিটিতেও নিজেদের মধ্যে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষার চর্চা বা প্রচলন বজায় রাখতে পারি। কোন ক্ষতি নেই তাতে। কিন্তু ভাষার নামের সঙ্গে এলাকার নাম জুড়ে দিয়ে আলাদা বাংলা ভাষা বলে চালানো কিংবা বাংলা ভাষাকে শুধু আঞ্চলিক ডায়লেক্টের কারণে সিলেটি বাংলা অথবা চাটগাঁইয়া বাংলা বা বরিশাইল্যা বাংলা ইত্যাদি বিবিধ জেলার বাংলা বলে আলাদা নামকরণের কোন সুযোগ আছে কিনা তা ভেবে দেখার বিষয়। এই অদ্ভুত উদ্যোগের জন্য প্রাণাতিপাত নিরর্থক। ভাষা নিয়ে এহেন কর্মকা-ে কেবল আমাদের দীনতাই প্রকাশ পাবে।
বাংলা আমার মায়ের ভাষা। এই ভাষার জন্য আমরা রক্ত দিয়েছি। এই ভাষায় আমরা কথা বলি, চিন্তা করি, আড্ডা মারি, গান গাই, ভালবাসি, স্বপ্ন দেখি, গল্প করি। বাংলা ভাষা আমাদের প্রাণের ভাষা, আমাদের গর্ব। তাই এবারের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে প্রবাসী বাংলা ভাষাভাষী সকলের কাছে সবিনয় নিবেদন- আসুন, এই সুদুর পরবাসে আমরা বাংলা ভাষাভাষীরা শুদ্ধ বাংলা ভাষায় কথা বলবার নতুন শপথ নিই। সাংস্কৃতিক বৈচিত্রের দেশ কানাডায় বাংলা ভাষা এবং সংস্কৃতিকে তুলে ধরে এই বলে উচ্চকণ্ঠ হই- ‘আমরা বাঙালী, আমাদের ভাষা বাংলা’। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে দৃষ্টান্ত রেখে যাই যেন তারাও বলতে পারে, ‘আমি বাংলায় ভালবাসি, আমি বাংলাকে ভালবাসি, আমি তারই হাত ধরে সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে আসি’।

nazmul13@gmail.com
ফেব্রুয়ারী ২০১৭, টরন্টো, কানাডা।