এই পরবাসে রবে কে
মার্চ ১১, ২০১৭
নাজমুল ইসলাম
‘ফেডারেল স্কীলড ওয়ার্কার’ ক্যাটাগরিতে ইমিগ্রেশন নিয়ে কানাডায় পারমানেন্ট রেসিডেন্ট (পিআর) হিসাবে দেশ ছেড়ে এসেছি। দু’বছর হয়ে গেল, তবু মন বসছে না। আদৌ বসবে কিনা কে জানে? কানাডা চমৎকার দেশ, বৈচিত্রময়, বহুরঙা, বহুমুখী সংস্কৃতির দেশ। এক কথায় সবার স্বপ্নের দেশ কানাডা। তার পরেও যদি এখানকার ইমিগ্র্যান্টদের প্রশ্ন করা হয়, জন্মভূমি নাকি ইমিগ্রেশন নিয়ে আসা নতুন দেশ কানাডা, কোনটি ভালো? তাহলে নিশ্চিত বলতে পারি এই তর্ক শেষ হবে না।
এখানে আসার পর থেকে সবার মুখে যে কথাটি হরহামেশাই শুনছি তা হলো, এখানে স্থায়ী হতে গেলে বা সফল হতে গেলে মনে প্রাণে কানাডিয়ান হতে হবে। আর মনে প্রাণে কানাডিয়ান হওয়ার অর্থ হলো এখানকার প্রকৃতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে হবে। এখানকার সমাজে মিশে যেতে হবে। শিক্ষা সংস্কৃতি বা কালচার গ্রহণ করতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। মুশকিল হয়েছে সেখানেই। প্রকৃত কানাডিয়ান কারা? তাদের কালচার কি? আসল কানাডিয়ান কালচার কোনটি? অন্যান্য দেশের অভিবাসীদের কথা জানি না তবে বাংলাদেশী ইমিগ্র্যান্টরা প্রায় সবাই এসব বিষয়ে কনফিউজড। আর তাই তারা তাদের নিজ নিজ দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী তাদের পরবর্তী প্রজন্মকে গড়ে তুলতে চাইছেন বিচিত্র গুনের আধার হিসাবে। ফলে নানা ধরণের কর্মকান্ডে সারাক্ষণই কাটে এখানকার বাচ্চাদের। লেখাপড়ার পাশাপাশি গান বাজনা, সুইমিং, জিম, স্কেটিং, হুজুর রেখে আরবী শেখা কিছুই যেন বাদ যায় না। একেবারে যাকে বলে জুতো সেলাই থেকে চন্ডীপাঠ আর কি। এখানকার স্বদেশী সামাজিক আচার অনুষ্ঠানে কখনও কখনও তার অতি উজ্জ্বল এবং বাড়াবাড়ি রকমের বহিপ্রকাশ লক্ষ্য করা যায়।
কোন সামাজিক অনুষ্ঠানে বা সমাবেশে গল্পের বা আড্ডার প্রধান আলোচ্য বিষয় হলো বাংলাদেশ। দেশের অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ সব থাকে আলোচনায়। দু’টি বড় রাজনৈতিক দলের মধ্যে কে ভালো আর কে খারাপ এই নিয়ে কখনও কখনও তর্ক প্রায় হাতাহাতির পর্যায়ে চলে যায়। এইসব তার্কিকদের মধ্যে দু’টি ধারা লক্ষ্যণীয়। যারা অনুর্ধ পঁচিশ-ত্রিশ বছর বয়সে মাইগ্রেট করেছে, দেশ সম্পর্কে তাদের এক ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি। আর যারা চল্লিশ-পয়তাল্লিশোর্ধ হয়ে মাইগ্রেট করেছে, তাদের আর এক ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি। দুই দলেরই শক্ত যুক্তি স্বপক্ষের বক্তব্যে। তবে ঘুরে ফিরে প্রায় সবার যেটি প্রধান কাজ তা হলো, দেশের ব্যাপারে চরম নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করা।
২০১৩ সালে যখন প্রথম কানাডায় আসি, তখন বাংলাদেশ সম্পর্কে কারও কারও এরকম মনোভাব দেখে এবং কথা শুনে রীতিমতো ভয় পেয়েছিলাম। একদিন এরকম একটি ছোটখাট ফ্যামিলি গ্যাদারিংয়ে দেশের সামাজিক অবস্থা, রাজনীতি, অর্থনীতি ইত্যাদি বিষয়ে নানান কথায় তর্কের এক পর্যায়ে একজন তো বলেই ফেললেন, ‘বাংলাদেশের মতো ঐটুকু একটা দেশ দুনিয়ায় না থাকলে কী হয়?’ কী সাংঘাতিক কথা! অথচ যিনি এটা বলেছিলেন, তার কেবল জন্মই বাংলাদেশে নয়, প্রায় ত্রিশ বছর পর্যন্ত বড় হয়েছেন বাংলাদেশে। নিজেকে মনে মনে বলেছিলাম, এরকম চিন্তা মাথায় আসার আগেই যেন ইহধাম ত্যাগ করি।
আরও একজনের কথা মনে পড়ছে। প্রথমবার এসে এখানকার এই খিচুড়ি কালচারাল শক নিতে না পেরে যখন সাড়ে তিন মাসের মাথায় সপরিবারে দেশে ফিরে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। তখন আমার দেশে ফিরে যাওয়া নিরুৎসাহিত করতে আমার মুরুব্বী পর্যায়ের একজন বললেন, ‘যা….হাসিনা খালেদার দেশে গিয়ে যদি ভালো থাকতে চাস, তো যা…।’ শুনে আবারও ধাক্কা খেলাম। করুনা হলো এই মানুষগুলোর জন্য। ভাবলাম, হায়রে ইমিগ্রেশন! কী মহিমা তোমার যে, তুমি জন্মভূমিকেও ঘৃণা করতে শেখাও। দেশটা তো শুধু হাসিনা খালেদার নয়, আমারও। আমিও তো ঐ দেশের মালিকদের একজন। হ্যাঁ হয়তো এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, আমার দেশেও অনেক খারাপ মানুষ আছে। তারা দেশটাকে লুটেপুটে খাচ্ছে। ঝুঁকিপূর্ণ করে ফেলেছে দেশের সামাজিক নিরাপত্তা। তাই বলে দেশ তো আমার পর হয়ে যায়নি। অস্পৃশ্যও হয়ে যায়নি।
তবে যারা এভাবে বলেন, এটা তাদের দোষ বলবো না আমি। কারণ তাদের সবাই অনেক কম বয়সে দেশ ছেড়েছেন। ফলে তাদের সঙ্গে দেশের সেই বন্ধনটিই তৈরী হয়নি, যার জন্য একটা নির্দিষ্ট সময় দেশের মাটিতে, দেশী জল-হাওয়ায় বড় হতে হয়। দেশের মাটির সঙ্গে, মানুষের সঙ্গে সমাজের গভীরে মিশতে হয়। এই মানুষগুলোর সেই সুযোগ হয়নি। তারপরেও এখানে যারা কম বয়সে এসেছেন এবং দীর্ঘদিন আছেন, দেশ সম্পর্কে তাদের গভীর নেতিবাচক এবং তাচ্ছিল্যপূর্ণ মনোভাব দেখলে মনটা সত্যিই ভারাক্রান্ত হয়।
জন্মদিন, বিয়েবার্ষিকী বা যেকোন গেট টুগেদারের মতো সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আসা বেশীরভাগ মানুষের মধ্যেই কতকগুলো সাধারণ প্রবণতা লক্ষ্যনীয়। যেমন,
১. স্বদেশের ভবিষ্যৎ, রাজনীতি ইত্যাদি নিয়ে আলাপ করতে গিয়ে জন্মভূমির মুন্ডুপাত করা বা চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করা।
২. প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বাড়ী, গাড়ী, টাকা-পয়সা এগুলো দেখানো বা ইনিয়ে বিনিয়ে প্রসঙ্গ তুলে বন্ধুমহলে সেই গল্প জাহির করা।
৩. মহিলাদের একাংশের ক্ষেত্রে শাড়ী গহণার গল্প প্রযোজ্য হলেও সেটি নতুন কিছু নয়। কারণ শাড়ী গহনার গল্প তারা সৌরজগতের যেখানেই সুযোগ পায় সেখানেই করে।
প্রায় সবার মধ্যে নিজের সম্পর্কে বাগাড়ম্বর গল্প বলার প্রবণতা লক্ষণীয়। সাত পুরুষ আগে ঘি খেলেও এখনো হাত শুঁকে চলেছি সবাই। অনর্গল এবং কৌশলী মিথ্যাচারে অভ্যস্ত অনেকেই। কিছুদিন আগে অনলাইনে একটা মজার কথা পড়েছিলাম। কার কথা মনে নেই। তবে কথাটি ছিল এরকম যে, প্রবাসে এসে বাঙালীরা নিজেদের নানা রকম দলে বিভক্ত করে সামাজিকতা করে। যেমন বাড়ী বনাম এপার্টমেন্ট, প্রফেশনাল জব বনাম অড জব, দেশে বড়লোক খান্দানী বংশ বনাম অখ্যাত অজ্ঞাত কুলশীল ইত্যাদি।
‘মানি মেকিং’ শব্দটির বহুল ব্যবহার দেখা যায় এখানে। মানি মেক করা শুনলে দেশের টেলিভিশনের খবরে দেখা জাল টাকা তৈরীর মেশিনসহ ধরা পড়া ক্রিমিনালদের নিয়ে সচিত্র টিভি রিপোর্টিং চোখে ভাসে। এই ধরণের পরিবেশে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারি না। অস্বস্তিকর লাগে। কারণ জীবনে টাকা পয়সার অবধারিত প্রয়োজনকে স্বীকার করলেও দামী গাড়ী, বাড়ী, পোষাক পরিচ্ছদ এইসব বৈষয়িক আলোচনায় আমি খুব একটা উৎসাহ বোধ করি না। কখনও করিওনি। যেখানেই যাচ্ছি, কোন না কোনভাবে এক্সপেনসিভ জিনিসের গল্প শুনতে শুনতে ক্লান্ত হয়ে পড়ছি। ‘শো-আপ’ নামক এক অদ্ভুত রোগে যেন সবাই আক্রান্ত এখানে।
শো-আপ নিয়ে এখানকার একটি মজার ঘটনা দিয়েই আজ শেষ করবো। কোন এক গ্যাদারিং-এ এক ভদ্রলোক নতুন গাড়ী (একটু দামীই হবে হয়তো) কিনে নিয়ে গেছেন। নতুন কিছু কিনলে স্বাভাবিকভাবেই মানুষ প্রশ্ন করে, ‘কোথা থেকে কিনলেন? কত দিয়ে কিনলেন?’ ইত্যাদি। কিন্তু তার গাড়ী নিয়ে কেউ তাকে কোন প্রশ্ন করছে না দেখে ভদ্রলোক খুব আপসেট হয়ে পড়লেন। অন্য ইস্যু নিয়ে আড্ডা চলছে। অথচ গাড়ী প্রসঙ্গে কেউ কোন কথাই বলছে না। ভদ্রলোক গাড়ীর গল্প করার ইস্যু খুঁজে পাচ্ছেন না। ভারী মুশকিলে পড়া গেল। পরীক্ষায় রচনা এসেছে গরু। আর ছাত্র মুখস্ত করে গেছে শ্মশান। মহা সমস্যা। কিন্তু হাল ছেড়ে দিলে তো চলবে না। প্রয়োজনে গরুকে মেরে শ্মশানে নিয়ে যেতে হবে। অতঃপর শ্মশান রচনা লিখতে হবে। যেই কথা সেই কাজ। এক পর্যায়ে ভদ্রলোক নিজেই প্রসঙ্গ উঠালেন ইনসিওরেন্স নিয়ে। শুরু করলেন এভাবে…..‘আর বলবেন না, ইদানিং ইনসিওরেন্সের প্রিমিয়াম যে এতো বেড়েছে, তা আর বলার না…..’ এরপর যা হবার তাই হলো। ইনসিওরেন্স প্রসঙ্গ গাড়ীতে ঢুকে গেল। গাড়ী প্রসঙ্গে আড্ডা জমে উঠলো।
জানুয়ারী ২০১৭
টরন্টো, কানাডা।