ইমিগ্রেশন বিষয়ে শিশুদের অভিজ্ঞতা

জুন ১০, ২০১৭

লিসা ইভানস

কানাডিয়ান লেখক ও গবেষক ড. জুডিথ কোলবার্ট তার ‘ওয়েলকামিং নিউকামার চিলড্রেন’ গ্রন্থে বলেছেন, ইমিগ্রেশন বিষয়ে শিশুদের যে অভিজ্ঞতা হয় তা তাদের পিতা-মাতার চেয়ে ভিন্ন রকমের। বিশেষ করে ঐ শিশুদের সঙ্গে যদি নতুন একটি দেশে আসার বিষয়ে আগে থেকে আলাপআলোচনা না করা হয়। শিশুটি যদি অল্প বয়সের হয় তবে সাধারণত সে পিতা-মাতার পরিকল্পনা সম্পর্কে কিছুই অবগত থাকে না। তাকে  হয়তো নতুন একটি দেশে নিয়ে আসা হয়েছে খুব সামান্য প্রস্তুতি নিয়ে। সম্ভবত শিশুটি নিজেকে অসহায়ও মনে করতে পারে এই জার্নিতে যেটা হয়তো সে মোটেও চায়নি।

অনেক সময় নতুন আসা ইমিগ্রেন্ট পিতা-মাতারা হয়তো নিজেদেরকে বিচ্ছিন্ন ভাবতে পারেন সবকিছু থেকে বা উদ্বেগ আশঙ্কা ইত্যাদিও তাদের মধ্যে কাজ করতে পারে। তবে মনে রাখতে হবে পিতা-মাতার সঙ্গে নতুন পরিবেশে আসা শিশুদের মনেও কিন্তু আবেগ অনুভূতির নিজস্ব একটা সমস্যা তৈরী হতে পারে।

জুডিথ কোলবার্ট যখন তার গবেষণা চালাচ্ছিলেন তখন একবার একদল স্কুল শিক্ষার্থীদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। তার ধারণা ছিল, শিক্ষার্থীরা খুব আনন্দ ও উৎফুল্লভাবে তাকে জানাবে যে কানাডায় তারা নানারকম সুযোগ ও সুবিধা পাচ্ছে। কিন্তু তিনি আশ্চর্য  হয়ে দেখেলেন যে, ঐ শিশুরা তাকে দুঃখের কাহিনী শুনাল। তাদের দুঃখ, তারা দেশে তাদের দাদা-দাদী, নানা-নানীদের মিস করছে, তারা তাদের বন্ধুদের মিস করছে। জুডিথ কোলবার্ট বলেন, শিশুদের এই অভিব্যক্তি এটাই প্রমাণ করে যে, নতুন দেশে নতুন পরিবেশে তাদের মধ্যে যে অনুভূতি কাজ করে তা অত্যন্ত গভীর এবং অধিকাংশ সময়েই অভিভাবগণ তা বুঝতে পারেন না।

সেন্টার অব এক্সিলেন্স ফর রিসার্স অন ইমিগ্রেশন এন্ড সেটেলমেন্ট এর নলেজ এক্সচেঞ্জ অফিসার মনিকা ভেলেনসিয়া একবার ইমিগ্রেন্ট পরিবারের সন্তানদের মনোভাব নিয়ে একটি নিরীক্ষা চালানোর পরিকল্পনা করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী তিনি ১০ জন শিশু শিক্ষার্থীর হাতে সাদা কাগজ ও ক্রেয়ন (রঙ্গিন পেন্সিল) তুলে দিয়ে বলেন কানাডা আসার পর তাদের মনের মধ্যে সবচেয়ে বেশী যে বিষয়গুলো প্রভাব বিস্তার করেছে সে সম্পর্কে কিছু ছবি আঁকার জন্য। এই শিশুদের বয়স ছিল ৯ থেকে ১১ বছর এবং এরা সবাই গত ৫ বছরের মধ্যে তাদের পিতা-মাতার সঙ্গে কানাডায় এসেছে ল্যাটিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশ থেকে। তারা যে ছবি আঁকে তার মধ্যে দিয়ে ফুটে উঠে তাদের মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা কিছু বেদনার চিত্র। এর মধ্যে ছিল দেশে ফেলে আসা তাদের দাদা-দাদী, নানা-নানী ও অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনের জন্য আকুতি। তাদেরকে ফেলে আসায় এই শিশুদের মনের মধ্যে সর্বক্ষণ কাজ করছে এক গোপন বেদনা। আরো ছিল নতুন ভাষা শিক্ষা করতে হচ্ছে বলে হতাশা। ছিল অব্যাহত মূলোৎপাটনের (কানাডায় আসার পরও এক স্থান থেকে অন্য স্থানে মুভ করা)    উদ্বিগ্নতা।

শিশুদের নিয়ে মনিকা ভেলেনসিয়ার নিরীক্ষার সঙ্গে জুডিথ কোলবার্টের নিরীক্ষারও মিল পাওয়া যায়। মনিকার কাছে সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় ছিল ইমিগ্রেন্ট শিশুদের মনে তাদের দাদা-দাদী বা নানা-নানীর জন্য আকুতির বিষয়টি। মনিকা বলেন, শিশুদের কেউ কেউ আমাকে বলেছে তারা রাতে দাদা-দাদী বা নানা-নানীর কথা ভেবে কান্না করে। তাদের মনে এরকম চিন্তার জন্ম নেয় যে, তারা হয়তো দাদা-দাদী বা নানা-নানীকে আর দেখতে পারবে না। কারণ তারা বৃদ্ধ, হয়তো যে কোন সময় তাদের মৃত্যু হতে পারে। একজন শিশু বলে, সে কানাডার তুলনায় তার ফেলে আসা মাতৃভূমিকেই বেশী পছন্দ করে। কারণ, সেখানে রয়েছে তার সকল আত্মীয়-স্বজন। এখানে এই কানাডায় শুধু সে আর তার বাবা মা।

কানাডায় আমরা দেখেছি নতুন আসা ইমিগ্রেন্ট শিশুদের নিয়ে যে সকল প্রতিবেদন বা খবর প্রকাশিত হয় তার প্রায় সবই তাদের লেখাপড়ার সাফল্য বা ভাষা অর্জন বিষয়ক হয়। কিন্তু মনিকা ভেলেনসিয়ার এই গবেষণাটি সেই দিক বিবেচনায় ব্যতিক্রমী সন্দেহ নেই। তিনি দেখাতে চেয়েছেন কোমলমতি শিশুদের মনে ইমিগ্রেশন কিরকম প্রভাব ফেলে। মনিকা বলেন, আমরা সবসময়ই উদ্বিগ্ন থাকি স্কুলে শিশুদের ভাল ফলাফল নিয়ে। স্বপ্ন দেখি ভবিষ্যত জীবনে তারা ভাল চাকরী পাবে। কিন্তু তাদেরও যে একটা মন আছে এবং সেই মনে নতুন দেশের নতুন পারিপার্শ্বিকতা কি রকম প্রভাব ফেলে তা নিয়ে আমরা ভাবার সময় পাই না বা ভাবার প্রয়োজনীয়তাও অনুভব করি না। অথচ এগুলো শিশুদের মনের উপর অনেক সময় নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। হয়তো তাৎক্ষণিক কোন ফল আমরা দেখতে পাব না। কিন্তু এই শিশুরা যখন বড় হবে তখন হয়তো এর পরিণতিটা চোখে পড়বে।

শিশুদের আবেগ নিয়ে কাজ করা

আমরা দেখেছি কানাডায় অনেক সেটেলমেন্ট এজেন্সী আছে যারা শুধুমাত্র পিতা-মাতাকেই সার্ভিস দিয়ে থাকে। আর যে সকল এজেন্সী শিশুদের নিয়ে কাজ করে তারা শুধুই ভাষা শিক্ষা ও হোমওয়ার্ক বিষয়ে সাহায্য করে থাকে। নতুন আসা শিশুদের মানসিক বা আবেগ অনুভূতি নিয়ে কোন কাজ করে না। মনিকা বলেন, ইমিগ্রেন্টদের ভাষা দক্ষতা বৃদ্ধি করার জন্য কোন প্রোগ্রাম ডেভলাপ করা সহজ। কিন্তু কারো মন ওআবেগ ভাল করার জন্য কোন প্রোগ্রম ডেভলাপ করা কঠিন কাজ।

ফলে ইমিগ্রেন্ট শিশুদের মন ও আবেগ নিয়ে কাজ করার দায়িত্বটা মূলত পিতা-মাতার উপরই বর্তায়। কিন্তু সেখানেও সমস্যা রয়েছে। কারণ, নতুন আসা ইমিগ্রেন্ট পিতা-মাতাদের নিজেদেরই সমস্যার অন্ত নেই। নতুন দেশে এসে নতুন করে বসতি স্থাপন করা, দেশ ছেড়ে আসার মানসিক যন্ত্রণা, সুবিধাজনক চাকরী খুঁজে বের করা ইত্যাদির পিছনে ছুটতে ছুটতে শিশুদের আর সময় দেয়ার সুযোগ হয়ে উঠে না তেমনভাবে।

জুডিথ কোলবার্ট মনে করেন শিশুদের এই মানবিক সমস্যাগুলো মোকাবেলা করা যেতে পারে যদি সেটেলমেন্ট প্রোগ্রামের ফোকাসে কিছুটা পরিবর্তন আনা যায়। যেমন, শিশুদেরকে যদি রিলেশনশীপ গড়ে তোলার ব্যাপারে সাহায্য করা হয়, নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার ব্যাপারে সাহায্য করা হয়, বিভিন্ন খেলাধূলা বা হবি ক্লাবের সদস্য বানিয়ে যদি তাদেরকে নিয়মিত ওখানে নিয়ে যাওয়া হয় তবে তাদের মধ্যে একাকিত্বের সমস্যা অনেকটাই দূর হবে। দূর হতে পারে অন্যান্য আবেগজনিত সমস্যাগুলোও।

পিতা-মাতাগণ কি করতে পারেন

মনিকা ভেলেনসিয়া বলেন, পিতা-মাতাগণ অবশ্যই শিশুদের সেটেলমেন্ট চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কিছু ভূমিকা রাখতে পারেন। শিশুদেরকে তারা জিজ্ঞেস করতে পারেন কানাডায় এসে তারা কিরকম অনুভব করছে, ফেলে আসা দেশ সম্পর্কে অনুভূতি কি এবং কি কি মিস করছে তারা, কানাডায় খাপ খাওতে গিয়ে তাদের কি কি সমস্যা হচ্ছে। এগুলোর মধ্য দিয়ে পিতা-মাতাগণ জানতে পারবেন শিশুদের আবেগ পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে রয়েছে এবং তাদের মানসিক অবস্থা কি। শিশুদের মনের অবস্থাটা জানা জরুরী। অনেক সময় বাইরে থেকে হয়তো মনে হতে পারে তারা খুব ভাল আছে, স্কুলে ভাল রেজাল্ট করছে, ভাল ইংরেজী শিখেছে। কিন্তু সেটিই সব নয়। আপনি বাইরের আচরণ দেখে  মনের খবর নাও জানতে পারেন তারা কতটা সংগ্রাম করছে ইমিগ্রেন্ট শিশু হিসাবে।

মনিকা নিজেও একজন ইমিগ্রেন্ট শিশু হিসাবে প্রথমে আমেরিকায় এসেছিলেন কলম্বিয়া থেকে বাবা-মায়ের সাথে। তখন তার বয়স ছিল ১১। পরে তারা কানাডায় চলে আসেন।

নতুন পরিবেশে আসার পর পরিবর্তনের বিষয়গুলো শিশুদের কাছে ব্যাখ্যা করলে অনেকটাই উপকার হতে পারে। আর এর মাধ্যমে তারা তাদের ভয় এবং নিরাপত্তাহীনতার বিষয়গুলো কাটিয়ে উঠতে পারে। মনিকা বলেন, একটি শিশু তাকে জানায় সে কানাডায় আসার পর দেশে ফেলে আসা তার নানীর জন্য খুবই কাতর হয়ে পড়েছিল। পরে তার বাবা-মা যখন বিষয়টি জানতে পারেন তখন তারা তাকে নিশ্চিত করেন যে সে তার নানীকে আবার দেখতে পাবে এবং কবে নাগাদ দেখতে পাবে সে সম্পর্কেও একটি ধারণা দেন। এতে করে সেই শিশুটি অনেকটাই সহজ হয়ে আসে।

মনিকা বলেন, নিকট আত্মীয়দের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করলে শিশুদের মন ভাল থাকে। ফোন কল, স্কাইপ ইত্যাদির মাধ্যমে এ কাজটি করা যেতে পারে। আর এর মাধ্যমে শিশুদের মনে যে একাকিত্ব ও বিচ্ছিন্নতার ব্যাপারগুলো ডেভলাপ করে তা কাটিয়ে উঠা যায়।

কানাডায় এসে শিশুরা যে সাংস্কৃতিক বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ে সেটিও তাদেরকে ইমশনালি বিপর্যস্ত করে তুলতে পারে। এই বিভ্রান্তিটা ঘটে নতুন আসা শিশুরা যখন স্কুলে যায়। তারা ঘরে দেখে এক সংস্কৃতি, বাইরে গিয়ে দেখে আরেক সংস্কৃতি। জুডিথ কোলবার্ট বলেন, পিতা-মাতাকে এ বিষয়ে উদার হতে হবে। তাদেরকে মনে রাখতে হবে নতুন দেশে সেটেলমেন্ট এর ব্যাপারটি পুরাতন ও নতুনের মধ্যে একধরণের ভারসাম্য রক্ষা করা। ঘরে যদি শিশুরা চপস্টিক ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে থাকে তাতে সমস্যা নেই। কিন্তু যখন স্কুলে যাবে তখন লাঞ্চ বক্সে কাটা চামচ দিয়ে দিন। এতে করে সমস্যা সমাধান সহজ হবে।

কানাডায় নতুন আসা শিশুদের সহায়তা প্রদান

কানাডায় ইমিগ্রেন্ট শিশুদের সংখ্যা অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। কানাডার বড় বড় শহরগুলোর পাবলিক স্কুলে তাদের উপস্থিতি এখন চোখে পড়ার মত। কোথাও কোথাও অর্ধেকেরও বেশী শিক্ষার্থী ইমিগ্রেন্ট শিশু। মনিকা বলেন, পাবলিক স্কুলগুলো ইমিগ্রেন্ট শিশুদের এই সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

মনিকার গবেষণায় দেখা গেছে স্কুলের শিক্ষার্থীরা প্রায়ই তাদের নতুন সহপাঠীদের সহায়তা করে থাকে অনুবাদসহ বিভিন্ন বিষয়ে। কানাডিয়ান সিস্টেম সম্পর্কে নতুন ইমিগ্রেন্ট শিক্ষার্থীদেরকে অবহিত করানোর ক্ষেত্রেও তারা সহায়তা করে থাকে হামেশা। স্কুলে শিক্ষার্থীদের এই অনানুষ্ঠানিক সহযোগিতা প্রদানের বিষয়টিকে গুরুত্বসহকারে উৎসাহিত করা যেতে পারে। এতে ইমিগ্রেন্ট শিশুরা বেশ উপকৃত হবে।

আমাদেরকে মনে রাখতে হবে, এই ইমিগ্রেন্ট শিশুরাই আগামীতে কানাডার আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে মূখ্য ভূমিকা রাখবে। সুতরাং আজকে এদের কল্যানে এদের মন-মানসিকতা ও আবেগের উপর যাতে কোন নেতিবাচক প্রভাব না পড়ে সেজন্য সেটেলমেন্ট সার্ভিসেস, পিতা-মাতা এবং স্কুল কর্তৃপক্ষ সবাইকে একযোগে এগিয়ে আসতে হবে। -সৈজন্যে : কানাডিয়ানইমিগ্রেন্ট.সিএ