অভিবাসন এবং আত্ম পরিচয় সঙ্কট
নভেম্বর ৫, ২০১৬
হেনরী পঙ্কজ বাড়ৈ
অভিবাসন কথাটির মধ্যে এক গভীর ব্যঞ্জনা লুকিয়ে আছে। এর প্রধান বাচ্য হচ্ছে ত্যাগ এবং মূল উৎপাটনের দুঃখ কষ্টের করুণ উপখ্যান। মানব ইতিহাসের গোড়ায় প্রথম অভিবাসনের প্রক্রিয়া শুরু হয় আদম হাওয়ার এডেন উদ্যান থেকে বিতাড়িত জীবনের মধ্যে দিয়ে। বিতাড়নের পরই প্রথম সৃষ্টিকর্তা অভিশপ্ত করলেন জমিকে। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে মৃত্তিকা থেকেই কৃষিকার্য করেই উৎপাদিত শস্যই হবে ক্ষুন্নিবৃত্তির প্রথম শ্রমসাধ্য প্রচেষ্টা। আদম তার স্ত্রী এবং পুত্র সন্তানদের নিয়ে বিতাড়িত জীবন শুরু করলেন উর্বর ভুমির সন্ধানে। নোহর জলপ্লাবনের আগ মুর্হুত পর্যন্ত মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবার বিবরণ পাওয়া যায়। এবং জলপ্লাবনের পর নোহ এবং তার পরিবার পৃথিবীর বুকে আবার কৃষিকাজ এবং পশুপালন করে বংশ বিস্তার শুরু করে। নোহের পুত্র শেম, হাম ও যেফতের বংশধর ক্রমশ পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পরে। ইতিহাস বলে, শেম এবং তার পরিবার নিয়ে বাগদাদে চলে এসে বসতি স্থাপন শুরু করে। শেম থেকে সেমিটিক জাতিসত্বা কথাটি উৎপত্তি হয়েছে। পবিত্র ধর্ম গ্রন্থে দেখি, অব্রাহেমের দুই পুত্র একজন মিস্রয়ী দাসীর গর্ভে ইশ্মাইল এবং তার নিজের স্রী সারা গর্ভে ইসাহাক এই দুই ভাইয়ে মধ্যে এক চরম বিদ্বেষপুর্ণ ভাব ছিল পরস্পরের প্রতি। একটি সময় এসে তারা চুক্তি করে নিজেদের ভিতর। আর চুক্তির ভিতর ছিল ইশ্মাইল তার পরিবার পশু সম্পদ এবং তার লোকজন নিয়ে আরব প্রদেশে গমন করে বসবাস করবে। গোড়ার ইতিহাস বর্নিত বিবরণ ধারাবাহিক অভিবাসনে মানব ইতিহাসের অভিবাসনের প্রক্রিয়া উল্লেখ আছে। আর এই ধারাবাহিক অভিবাসন প্রক্রিয়া যুগ যুগ ধরে চলে আসছে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে, বিভিন্ন প্রান্তে। প্রথম যুগের অভিবাসন ছিল বাস্তুহারা বা অর্থনৈতিক কারণে। ধর্মীয় কারণ ছিল সেখানে অনুপস্থিত। তখন পারিবারিক প্রথা সঙ্গবদ্ধতা, সংহতি ছিল পরিবারের বা গোষ্ঠীর বন্ধন। যেখানেই তারা বসতি স্থাপন করেছে তারা গোষ্ঠীবদ্ধ ভাবেই করেছে। পারিবারিক আচার প্রথা নিয়ম এবং একঈশ্বরবাদ বিশ্বাস দৃঢ় ভাবে আকরে রেখেছে। এই ভাবেই ক্রমশ একই ভাব ধারায় বহু বৃহত জাতিসত্বায় পরিনিত হয়েছে।
বৃহতম অভিবাসন কিন্তু বেশী দিনের কথা নয়। ১৫০ থেকে ২০০ বছরের অভিবাসন যাত্রা ইউরোপ থেকে শুরু হয়। হত দরিদ্র লোকজন ইউরোপ থেকে আমেরিকা, অষ্ট্রেলিয়া, কানাডা, নিউজিল্যান্ড অবিষ্কারের পরই নতুন দেশে বসবাস স্থাপনের জন্য দলে দলে পাল তোলা জাহাজে এসে অজানা অচেনা দুর্গম বৈরী আবহাওয়ায় আসে । স্বল্প পুঁজি আর দৃঢ় মনোবল নিয়ে অর্বননীয় দুঃখ কষ্টের ভিতর দিয়ে জীবিকা শুরু। একদিকে অপ্রতিকুল জলবায়ু, কৃষিকাজের উপযুক্তু জমির অভাব আর অন্যদিকে আদিবাসীদের অতর্কিত আক্রমনের শিকার।
আধুনিক অর্থবিদ্যার জনক অ্যাডাম স্মিথ লিখেছেন যে, যিশুখ্রীষ্টর জন্মের পরের ইতিহাসের সবচেয়ে অর্থপুর্ণ ঘটনা হল ক্রিস্টোফার কলম্বাসের আমেরিকা আবিস্কার। এই সব দুঃসাহসিক অভিযানে ষোড় শতাব্দর রাজা এবং সম্রাটরা উৎসাহ যুগিয়েছেন। খোদ সম্রাট পঞ্চম চার্লাস সম্মতি আদায় করে ১৫৩০ শতাব্দে বেরিয়ে পরে নতুন অভিযানে। আবার স্পেনের রাণী – ইসাবেলর সাগরযোগে বাণিজ্যর চেয়ে ক্যাথলিক ধর্ম প্রচার এবং প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে উদগ্র উৎসাহের প্রমান পাওয়া যায়। ইতিহাসে স্পেনের সম্রাটের অনুমতি নিয়ে পিজারো দক্ষিণ আমেরিকার পেরু দখল করে সম্রাটের সেনাবাহিনী নিয়ে। বিপুল ধনভান্ডার লুন্ঠন। একের পর এক দখল করে নেয় দক্ষিণ আমেকিরার সমৃদ্ধপুর্ণ দেশগুলি। শুরু হলো নতুন অভিবাসনের ইতিহাস। ইউরোপের ভাষা আর সংস্কৃতি অগ্রাসনের কারণে আক্রান্ত হলো স্থানীয় সংস্কৃতি এবং ভাষা। সৃষ্টি হলো সংকর সংস্কৃতি। বিলুপ্ত হলো নিজস্ব ধর্ম, সভ্যতা আর সামাজিক আচার প্রথা মুল্যবোধ। আমেরিকার প্রায়ত প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি আমেরিকাকে আখ্যায়িত করেছিলেন ল্যান্ড অফ ইমিগ্রেন্ট। আজকের আমেরিকার গণতন্ত্র, সমৃদ্ধি, টেকসই অর্থনিতি, সামরিক শক্তি, উচ্চতর প্রযক্তির উন্মেষ ঘটেছে ইউরোপ এবং অনান্য দেশের অভিবানদের সন্মলিত শ্রম আর প্রচেষ্টার মধ্যে দিয়ে।
ইতিহাস বিশেষজ্ঞদের মতে ভারতবর্ষই হচ্ছে সত্যিকার অর্থে অভিবাসনের দেশ। পারস্য বা ইরান থেকে আসা বৈদিক আর্যদের পরে বহু বিদেশি দল দলে ভারতবর্ষে এসে বসতি স্থাপন করেছে। এর প্রধান কারণ ছিল রাজনৈতিক অত্যাচার, ধর্মীয় বিদ্বেষ, ব্যবসা বাণিজ্যর সুযোগ সুবিধা। ভারতীয় মুলস্রোতে বিভিন্ন শোণিত ধারা সংমিশ্রিত হয়েছে। প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে নিষাদ, দ্রাবিড়, কিরাত আবার বৈদিক আর্য আগমনের পর এসেছে সৈনিক বেশে যবন গ্রিক, রোমানরা বণিকরুপে। অন্য জাতির মধ্যে আছে কুষাণা, হুণ, আরব, তুরস্কের সেম বংশ, ইথউপিয়া, কাফ্রি, এবং পর্তুগিজ এবং বিতাড়িত ইহুদিরা। এদের শোণিত মিশে গছে অন্য অঞ্চলের আদি অধীবাসীদের ধমনিতে। মিশ্রিত সংকর জাতিসত্বা যা ছিল জটিল এবং বিভ্রান্তিকর। সেই সময় সমাজের বোদ্ধা এবং শাস্ত্র-বেত্তারা সহজ সমাধা করেছিল বর্ণভিত্তিক সমাজবিন্যাসে। আর সেই বর্ণ প্রথার প্রর্বতনের ভিতর দিয়ে আজও ভারতে বর্ণবিদ্বেষ, বিভেদ আর বৈষম্য বিরাজমান।
বর্তমান যুগে অভিবাসনের সংজ্ঞা বদলে গেছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর পর আর্থসামাজিক এবং ভূরাজনীতির পটভুমি দ্রুত বদলে যায়। একচ্ছত্র সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির হাত থেকে তাদের উপনিবেশ গুলি হাত ছাড়া হয়ে যেতে থাকে। অর্থনীতির ভঙ্গুরতার কারনেই তারা বিশ্বরাজনীতির দর্দন্ড প্রতাপ থেকে ছিটকে পরে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তর জন-জীবনে নেমে আসে রোগ শোক, র্দুভিক্ষ, কর্মের সুযোগের অভাব। মিল-কারখানা ধ্বংস স্তুপে পরিনিত হয়। কর্মদক্ষ শ্রমিকের অভাব দেখা দেয় লক্ষ লক্ষ পুরুষ যুদ্ধে নিহত এবং পঙ্গুত্ব বরণ করায়। এই সব কারনে যখন গোটা ইউরোপীয় দেশ গুলি হতাশাগ্রস্ত তখন পাশে পরিত্রাতা হিসাবে আমেরিকা আবির্ভুত হয় তার মার্শাল প্ল্যান নিয়ে। বিলিয়ন বিলিয়ন অনুদান আর সহজ শর্তে স্বল্প সুদে ঋৃণের সুযোগ নিয়ে রুগ্ন, ধ্বংস প্রাপ্ত মিল কারখানা আবার আস্তে আস্তে উজ্জিবীত হয়। ঘুরে দাড়ায় ইউরোপ এবং তার অর্থনীতির চাকা। মিল-কারখানার জন্য প্রয়োজন হয় হাজার হাজার শ্রমিক। ব্রিটেন, ফ্রান্স তাদের উপনেবিশ থেকে নিয়ে আসে সস্তা শ্রমিক। জার্মান রাস্তা ঘাট দালান বাড়ি র্নিমানের প্রয়োজনে নিয়ে আসে তুর্কি থেকে শ্রমিক। এই ভাবেই দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর ইউরোপের বিভিন্ন দেশে অভিবাসন প্রক্রিয়া শুরু হয়। আর আমেরিকা বেশ সুক্ষ এবং দক্ষতার সাথে অভিবাসনের মধ্যে দিয়ে আশ্রয় দেয় ইহুদিদের। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলা কালিন এরাই সব চাইতে নিগৃহীত,অত্যাচারিত এবং নিরাশ্রয়ী হয়েছিল। নির্মম হত্যার মধ্যে দিয়ে ছয় মিলিয়ন ইহুদিকে চরম মূল্য দিতে হয়েছিল। এদের বড় অংশ ছিল ব্যবসায়ী, উকিল, চিকিৎসক, বিজ্ঞানী এবং শিক্ষাক্ষেত্রে আগ্রগন্য। এরা আমেরিকার সকল ক্ষেত্রে মেধা বিকাশের সুযোগ করে নেয়। শুধু আমেরিকা এদেরই মেধা বিকাশের সুযোগ করে দেয়নি বরং পৃথিবীর সব দেশের মানুষ একবার যারা এই দেশে ঢুকতে পেরেছে তাদের সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে উন্নয়নের মুলধারায় সম্পৃক্ত হতে। হাজার হাজার শিক্ষার্থী , শিক্ষক যারা মেধার তালিকায় শীর্ষে, তাদের জায়াগা করে দিয়েছে মেধার পুর্ণ বিকাশে। আমেরিকা সব সময় মেধা এবং দক্ষতাকে সন্মান এবং সুযোগ দিয়ে আসছে। আমেরিকাই প্রথম মেধা পাচারের দৃষ্টান্ত স্থাপনে অগ্রগণ্য। মধ্যেযুগে ক্রিস্টোফার কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের পর ভুস্বামীদের কৃষিক্ষেতে এবং কলকাখানায় শ্রমিকের প্রয়োজন হয়। ইউরোপের শ্বেতাঙ্গ জাহাজের নাবিক আর কিছু লোভী ব্যবসায়ী অফ্রিকা মহাদেশ থেকে কালোমানুষদের বন্দি করে নিয়ে এসে বিক্রি করত আমেরিকার ভুস্বামীদের কাছে। এই অমানবিক দাস প্রথা ব্যবস্থা কিন্তু নতুন নয়। পুরাতন ইতিহাসে এই প্রথার কথা খুঁজে পাওয়া যায়। দাস প্রথার ইতিহাস কখনও সুখকর ছিল না। আদিম এবং মধ্য যুগের দাস প্রথা বিলুপ্তি হয়েছে বটে কিন্তু একটা অলিখিত সুক্ষ মাত্রায় দাস প্রথা লুকিয়ে আছে আধুনিক অভিবাসনের প্রক্রিয়ায়। এর বাহ্যিক রূপটা যা ভিন্ন। এই রূপের ভিতরে ক্রমশ প্রবেশ করলে আস্তে আস্তে আসল স্বরূপটা স্পষ্ট হতে থাকে। সব কিছু সুন্দর আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থা, চাকরিবাকরির সুযোগ, বায়ুদুষণহীন পরিবেশ, ঝকঝকে দালান, রাস্তাঘাট, যানজটমুক্ত সড়ক, কল্যাণকামী রাষ্ট্র, সুনাগরিক হওয়ার সব পথ খোলা। এতসব সুব্যবস্থার পরও একটা অদৃশ্য সুক্ষ দেওয়াল আছে। আর সে দেওয়ালটির নাম হচ্ছে বৈষম্য। এই বৈষম্য তখনই উপলদ্ধি হয় যখন চাকরি এবং উপরে উঠার সুযোগ আসে। এখানে যাদের জন্ম, যাদের প্রপিতামহ এসছিল ১৫০ বছর আগে তারাই উপরে উঠার সুযোগ সর্ব প্রথমে পায়। আর যারা নব্য অভিবাসন নিয়ে এসেছে তাদের কাছে ভাল চাকরি এবং উপরে উঠার সিড়িটা অতিক্রম করা দুঃসাধ্য এবং কষ্টকর। কেউ কেউ যে সোনার হরিনটা ধরতে পারে না তা কিন্তু নয়। তবে সংখ্যায় মুষ্টিমেয়। মূলত ১৯৯০ থেকে বাংগালী মধ্যবিত্ত শিক্ষিত পেশাজীবীরাই পরিবার নিয়ে কানাডায় অভিবাসন নিয়ে আসতে শুরু করেন। এদের সব ধরনের শিক্ষাগত যোগ্যতা, দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও যখন তারা ইপ্সিত লক্ষে পৌঁছাতে পারেন না তখন যে ধাক্কাটা খেতে হয় তা অনেকের পক্ষে সামলে উঠা খুবই করুণাদয়ক। লক্ষভ্রষ্ট আর ফিরে যাওয়ার বাসনা অবদমতি করে মনকষ্ট নিয়ে জীবনযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে শুরু করে যে কোন কায়িক কাজের সন্ধানে শুধু সন্তানদের ভবিষতের কথা চিন্তা করে। বেঁচে থাকার জন্য চাকরি এবং ছেলেমেয়েদের স্কুলে ভর্তি হবার পর
আশাভঙ্গহীন জীবনে কিছুটা মসৃনতা আসতে শুরু করে। এরপর আর একটা আশাভঙ্গের ক্ষীণ স্রোত ধীরে ধীরে ধাক্কা দিতে শুরু করে প্রজন্মকে আকরে ধরে রাখার এক প্রবল ইচ্ছা। নিজের শিকড়ের কাছে টেনে নিবার অদম্য বাসনা জাগে ক্লিশিত হৃদয়ে। এ দেশের বিদ্যালয় গুলি হচ্ছে এক একটা বীজ তলা। এই বীজ তলায় সমবেত হয় নানা দেশের শিশু কিশোর ছেলে মেয়েরা। এই বিদ্যালয় গুলি পাঠ্যক্রমে সাথে সাথে এ দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা এমন করে সাজান যেখান থেকে ঐ সব কিশোর মনে রোপিত হতে থাকে উদার এক পরিবেশ যেখানে মানুষের পরিচয় বর্ণ, ধর্ম বা ভাষা নয় বরং ভ্রাতৃত্ব আর মনুষত্ববোধের বিচারে। এই প্রথম শিশু মনে উপলদ্ধি করে নানা বর্ণে,ধর্মে বিভাজিত হলেও আমারা একটি মানব জাতি। এই শিশুরাই যৌবনের পদার্পন সাথে সাথে পরিনত হয় বর্ণবিদ্বেষ, ক্রোধ, হিংসা, জিগাংসা, কুসংস্কার,ধর্মান্ধতা বিবর্জিত পুর্নাঙ্গ মুক্ত মনের মানুষ হিসাবে। প্রথম অভিবাসন নিয়ে আসা পিতামাতারা সাত সমুদ্র তের নদী পার হয়ে নিজেদের শিকড় উৎপাটনে বিদীর্ণহৃদয় যখন ক্ষিপ্যমাণ তখন দেখতে পায় নিজের স্কুলগামী ছেলেমেয়েদের মধ্যে ভিন্নতর আত্ম সচেতনার পরির্বতন যেটা রক্ষণশীল পরিবেশ থেকে আসা বাবামায়ের সাথে আর্দশিক সাংঘর্ষিক। অনেক বাবামায়েরা বুঝতে পারেনা তাদের ঔরসজাত ও গর্বজাত ছেলেমেয়ে ক্রমশ পরিবর্তিত হয়ে খাপ খাইয়ে নিচ্ছে নতুন মুক্ত পরিবেশের সাথে। বাবামায়েরা অনেক সময় নিজেদের পরম্পরা আদর্শ ব্যূহের ভিতর সন্তানদের রক্ষা করতে গিয়ে মনের অজান্তে ওদের সাথে এক দুরত্ব সৃষ্টি হয়। মঙ্গলাকাঙ্খী পিতামাতার মনস্কাম আর এখানে বেড়ে উঠা সন্তানদের মননশীলতা মধ্যে বড় একটা মনস্তাত্ত্বিক ব্যবধানের সুত্রপাত শুরু হয় ক্রমশ আর এটাই বাস্তব। এই পরির্বতনটা মেনে নেওয়াটাই হবে শুভ লক্ষণ। ঘরের ভিতর বাবমায়ের কাছ থেকে নানা ধরনের বারণ শুনে শুনে যখন অতিষ্ট তখন ওরা নিজেদের প্রতিরোধ গড়ে তুলে । শিশু কিশোর ছেলেমেয়েরা বাড়ি আর স্কুলের পরিবেশের মধ্যে একটা অদৃশ্য রেখা টেনে নেয় নিজের কাছে কোনটা ঠিক আর কোনটা বেঠিক। স্কুলের শিক্ষক, বন্ধুবান্ধব না বাড়ির ভিতর বাবামা। পাল্লা ভরি হয় স্কুলের উদার মুক্ত চিন্তা পরিবেশ বিকাশের প্রতি যেখানে তার দিনের বেশীর ভাগ সময় কাটে বন্ধুবান্ধবদের সান্নিধ্য। জীবনের সোপনটা যেখানে তৈরি হয় সেটাই তো ওদের অরাধ্য স্থান। কোমলমতি ছেলেমেয়েরা প্রথম প্রথম বাবা মায়ের শাসন শোনে কিন্তু একটা সময় এই নিয়ে বন্ধুদের এবং শিক্ষকদের সাথে আলাপ আলোচনা পরার্মশ করে সিদ্ধান্ত নেয়। আর সেই সিদ্ধান্ত হয় বাবামায়ে বিরুদ্ধে এক ধরনের নীরব প্রতিবাদ। পিতা-মাতারা ক্রদ্ধ হন, হৃদয়ে ক্ষরণ অনুভব করেন, নিজের সন্তানদের মনে হয় অনেক দূরের গ্রহ নক্ষত্র, যাদের জন্য এত ত্যাগ এত পরিশ্রম, যাদের ভবিষতের জন্য দেশের মায়া ছিন্ন করে, নিজেদের শিকড় উৎপাটন করে অচেনা অজানা বৈরী আবাহওয়া এসে নতুন করে বাঁচার এক স্বপ্ন বুকে নিয়ে এই দেশে বসতি স্থাপন। সব আশার দেওয়াল গুলি যেন মুহুর্তের মধ্যে চুড়মার হয়ে খসে পড়। নিজের মধ্যে সান্ত¡না খুঁজতে ব্যর্থ চেষ্টা করেন, নীরবে নিষুতি রাতে কেঁদে বালিশ ভিজান। দুঃস্বপ্ন গুলি ঘিরে ফেলে ক্রমশ তখন অনেকেই দিশাহারা হয়ে সন্তানদের শারীরিক নির্যতনের পথটি বেছে নেন। কিন্তু ফল হয় বিপরীত। এদের স্কুল থেকে শিখান হয় যখন বাবামা কেউ মানসিক বা শারীরিক নির্যতন করে তখন ৯১১-এ ফোন করে পুলিশের কাছে সাহায্য চাইতে হয়। এই নির্যাতন অহরহ ঘটছে অভিাসন পরিবার গুলির মধ্যে। পুলিশ নির্যাতিত ছেলেমেয়েদের সাময়িক ভাবে বাবামায়েদের কাছ থেকে উদ্ধার করে সরকারি আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে যায়। কাজের পরিবেশ, বৈরী আবহাওয়া আর এই অনাঙ্খিত পরিস্থিতিতে অনেক পরিবারে নেমে আসে অবসাদ অর বিষন্নতা যা অনেকে সমাল দিতে না পেরে মানসিক ভারসম্য হারিয়ে ফেলেন। যখন ফিরে যাবার কোন পথ খোলা নেই জেনে অনেকেই নিয়তির আমঘ নিয়ম মেনে নিয়ে শত দুঃখ কষ্ট সহ্য করে সন্তানদের আকরে থেকে চেষ্টা করেন পিছুটান দূরে সরিয়ে সন্মুখে আগাতে। পিতামাতারা আপ্রান চেষ্টা করেন সন্তানদের সন্মুখে অতীতের গর্ব স্বাধীনতা সংগ্রাম, ভাষা আন্দলোন, সংস্কৃতি ইত্যাদি তুলে ধরতে। সন্তানদের কাছে এই উৎস সন্ধানে সচেষ্ট হন প্রেরনা যোগাতে। যখন ব্যর্থ হন তখন বিফলতার সাথে নেমে আসে এক কঠিন শুন্যতা। এই শুন্যতা আরও তীব্র হয় যখন চোখের সামনে সন্তানরা ক্রমশ ইংরাজি ভাষা তোতা পাখীর মত আউরাতে থাকে। আমরা নিজেকে বাংগালী ভাবি কারণ আমার মাতৃভাষা বাংলা। এইটাই আমাদেও আত্ম-পরিচয়। আমাদের গর্ববোধের জায়গাটা তো ভাষা আর সংস্কৃতি। কিন্তু এখানে বেড়ে উঠা সন্তানদের কাছে আস্তে আস্তে অপরিচিত হয়ে উঠে বাংলা ভাষা। যদিও কেউ কেউ মুখে বলতে পারে তবে লিখতে এবং পড়তে অনেকেই পারেনা। স্কুল কলেজ রাস্তা-ঘাট, অফিস আদালত বন্ধুবান্ধবের সাথে ভাবের আদান প্রদান সবত্রই মূলধারার সাথে খাপ খেতে হলে এই ইংরাজি ভাষাটাই তো একমাত্র মাধ্যম। এটাই তো বাস্তব সত্য। প্রথম প্রজন্মের কাছে বাংলা মাতৃভাষা আর সেটা দ্বিতীয় প্রজন্মের কাছে যারা এখানে শিক্ষিত হচ্ছে তাদের কাছে বাংলা মাতৃভাষা তবে তার প্রয়োগ সীমিত পর্যায়। বাংলা ভাষা শুধু ঘরে মাবাবা এবং কিছু আত্মীয়-স্বজনদের বাসায় বেড়াতে গেলে চর্চা হয়। আর একটু অদূর ভবিষ্যতের দিকে তাকালেই যে তৃতীয় প্রজন্ম এ দেশে যাদের জন্ম হয়েছে বা হবে তারা মূলধারার সাথে সর্ম্পুণ একাত্ব হয়ে বেড়ে উঠছে বা উঠবে তাদের প্রথম পরিচয় তারা কানাডিয়ান এবং তাদের মাতৃভাষা ইংরেজি। কানাডিয়ান সংস্কৃতি তাদের নিজেদের সংস্কৃতি বলে মনে প্রানে ধারণ এবং পালন করবে। প্রপিতামহদের ভাষা, রবি, নজরুল, বাউল গান, পালা পর্বন আর বাংলা হাজার বছরের সংস্কৃতির গৌরবময় অতীত ইতিহাস আর শ্বাশ্বাত বাংলার রূপ দ্বারা অনুপ্রানিত হয়ে এগিয়ে যাবে না। কারণ প্রপিতামহের অতীতের গর্ব এখন তাদের কাছে মীথ এবং এক বায়বীয় আত্মসত্তা ছাড়া কিছু নয়। এগুলি প্রতি জানার আগ্রহ থাকলে থাকতে পারে কিন্তু এদের এই দেশীয় আধুনিক সংস্কৃতিক ঐতিহ্যে পুষ্ট হবে নবরূপে ওদের অগ্রযাত্রা। গান্ধী, সুভাস, রবীন্দ্রনাথ বা মুজিব বড় আইকন প্রপিতামহের কাছে হলেও এদের কাছে বড় আইকন, স্টিপ জেব, ইলন মাস্ক, ল্যরি পেজ, মার্ক জাকার বার্গ এবং স্টেপ কারী স্পীলবার্গ, যারা দুনিয়াকে ভবিষতের স্বপ্ন দেখায়। আমরা যারা প্রথম প্রজন্ম অতীতের হারানো দিনের কথা ভাবি, আত্ময় পরিচয় আর শিকড়ের সন্ধানে অলীক বায়বীয় স্বপ্ন নিয়ে নিজেদের মধ্যে আটকে আছি। কিছু অর্জন করতে হলে কিছু ত্যাগ করতে হয় তাই শিকড় উৎপাটনে ব্যথা ভুলে গিয়ে আত্ম-পরিচয়ের সন্ধান বৃথা সময় নষ্ট না করে বরং সুযোগ করে দেই আমাদের ত্যাগের বিনিময় আগামী প্রজন্মদের ভবিষ্যত। যারা একদিন মাথা উচু করে মুলস্রোতে মিশে উন্নত সমাজ বির্নিমাণ করবে।
হেনরী পঙ্কজ বাড়ৈ
টরন্টো