অভিনব এক প্রতারণা

এপ্রিল ১৫, ২০১৭

জয়ব্রত

বিদেশের মোহ কি ধরনের বিপদ ডেকে আনে তারই একটি লোমহর্ষক কাহিনী এটি। কমবেশি অনেক বাংলাদেশী তরুণের মধ্যে দেশে প্রতিষ্ঠার অনিশ্চয়তা আর হতাশা থেকে বিদেশে পারি দেবার প্রবনতা লক্ষ্য করা যায়। বিদেশের নানাধরনের আকর্ষণ এড়ানো অনেক সময় সম্ভব হয় না। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ ফেল যাই হোক না কেন তরুন সমাজের হতাশা থেকে বিদেশ মুখি প্রবনতার দুর্বলতার সুযোগে একশ্রেণীর অসাধু ব্যক্তি ফায়দা তুলে নেয়। অপহরণ গুম করে নিঃস্ব করে দেয় ওদের ভবিষ্যৎ,সপ্ন ভেঙ্গে চুরমার হয় এভাবে। মুক্তিপনের জন্য অপহরণের ঘটনা ঘটে চলেছে চারিদিকে, কোথাও অপহরণকারীকে জীবিত ফেরত মিলেছে কোথাও মৃত অথবা গুম হতে হয়েছে নির্মমভাবে।

অপুর পরিচিত বন্ধু বান্ধব অনেকেই বিদেশের বিভিন্ন স্থানে আছে, ইউরোপ আমেরিকা কানাডাতে অনেক আত্মীয় স্বজনের বাস, বন্ধু আত্মীয় অনেকেই দেশে বেড়াতে গেলে মনপ্রাণ দিয়ে সাহায্য সহযোগিতা করে ছেলেটি, বেড়ানো ঘুরানো বাজার রেস্টুরেন্টে খাওয়া ইত্যাদি সকল কিছুতেই ছেলেটির আন্তরিক অবস্থান সকলে একবাক্যে স্বীকার করে। সকলেই অপুকে ভালবাসে, অপুও সকলকে ভালোবাসে। কিন্তু ওর প্রিয় মানুষগুলি যেসব দেশে আছে তার কোন একটি দেশে সে কিভাবে যাবে একদিন, তা নিয়ে মনে মনে স্বপ্ন লালন করে চলেছে দীর্ঘদিন থেকে। সবাই আসে দেশে বেড়াতে, সেও ওদের সাথে ঘুরে বেড়ায় কিন্তু কেউ ওর মনের কথা জানতে পারেনি বা জানতে চায়নি সে রকম ভাবে হয়তো। মাঝে মাঝে কানাডা যাওয়ার ব্যাপারে আলাপ আলোচনা করেছে কারো কারো সংগে, তবে খুব গুরুত্ব দিয়ে কেউ এভাবে চিন্তা করেনি।

অনেক ভাবেই পশ্চিমা দেশে পারি জমাচ্ছে মানুষ। বিশেষ করে কানাডা সরকারের অভিবাসন প্রক্রিয়া অনুযায়ী বিভিন্ন দেশের মানুষ বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে এ দেশে আসতে পারে, তবে প্রত্যেককে যোগ্যতার মাপকাঠি অনুযায়ী শর্ত পূরণ করতে হয়। স্কিল ক্যাটাগরি, স্টুডেন্ট, ইনভেস্টর, ভিজিট, ফ্যামিলি ভিসা, রিফুউজি ক্লেইম ইত্যাদি নানা পন্থা এখানে প্রচলিত। যার মাধ্যমে কানাডাতে প্রথমিকভাবে থাকার অনুমতি মিলে। পর্যায়ক্রমে অন্যান্য সর্তগুলি পূরণ করলে কানাডা সরকার স্থায়ী ভাবে থাকার অনুমতি প্রদান করে। নির্দ্বিধায় পৃথিবীর অন্যান্য অনেক দেশ থেকে কানাডা স্বাধীন, নিরাপদ, শান্তির এবং অর্থনৈতিক ভাবে আকর্ষণীয় ও লোভনীয় একটি দেশ। তাই এখানে আসতে অনেকেই নানা ভাবে চেষ্টা করবে এটাই স্বাভাবিক।

আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে আজকাল কমবেশি সকলেই নানাবিধ ওয়েবসাইট আর আনলাইনের কার্যক্রমের সাথে পরিচিত। একদিকে যেমন প্রযুক্তির সঠিক ব্যাবহার বয়ে আনতে পারে অনেক সম্ভাবনা সাফল্য অন্যদিকে ভুল ব্যাবহার বয়ে আনতে পারে দুঃখ বেদনা। অপুর ফেসবুক, ইমেইল একাউন্ট ইত্যাদি অন্যান্য অনেকের মতই আছে। এভাবেই একদিন ইমেইলের মাধ্যমে যোগাযোগ হয় এক দুষ্ট ব্রোকারের সংগে, যে কিনা তাকে কানাডা পাঠাবে, পৌঁছার পর পেমেন্ট এমন আকর্ষণীয় প্রস্তাবে অপু তেমন ভাবে কারো সংগে আলাপ আলোচনা না করেই রাজি হয়ে যায়। শুরু হয় অপুর সংগে দুষ্ট ব্রোকারের ইমেইল আদান প্রদান। যা অনেকটা চলে গোপনে দুষ্ট লোকের নির্দেশ অনুযায়ী। অনেকটা সরল মনে অপু বিশ্বাস করে ফেলে লোকটিতে।

দুষ্ট ব্রোকারের মুখপাত্র রিয়াজ আহমেদ বলে পরিচয় দেয় অপুকে, তারপর শুরু হয় অপুর দেশে বিদেশে কে কে আছে তার বর্ণনা সংগ্রহ করা, এবং ওর অর্থনৈতিক অবস্থার মানচিত্র গঠন। শুরু হয় রিয়াজের সংগে অপুর মোবাইল ফোনে যোগাযোগ। দুষ্ট চক্রটি পরিচালিত হয় মূলত ভারত থেকে। অপুর কাছ থেকে সমস্ত তথ্য নিয়ে দুষ্ট চক্রটি শুরু করে ওদের পরিকল্পনা। কানাডার কোন শহরে অপুর বন্ধু বা আত্মীয় স্বজন নাই বুঝতে পেরে ওরা সে রকম প্রস্তুতিও সম্পন্ন করে। ঠিক হয় যাত্রার দিন, কাউকে কিছু না বলে অপু যাত্রা শুরু করে সড়ক পথে রিয়াজের কথা অনুযায়ী। বাংলাদেশের সকল আত্মীয় স্বজন বন্ধুরা জানে সে ভারত বেড়াতে যাচ্ছে।

অনেক ক্ষেত্রে ব্রোকারের মাধ্যমে বিদেশের যাত্রা সফল হয় না বিধায় স্পষ্ট করে সকলকে কিছু বলাও যায়না। তার উপর দুষ্ট চক্রটি স্পষ্ট ভাবে অপুকে বলে দিয়েছে ব্যাপারটি আপাতত গোপন রাখতে, জানাজানি হলে ওর বিদেশ যাওয়ার স্বপ্ন ভেস্তে যাবে। বিদেশের মোহ অনেকের মতই অপুকে অন্ধ করে দিয়ে ছিল, না হলে এমন অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা এড়ানো সম্ভব ছিল হয়ত। এক সময় অপুর মোবাইল ফোন বন্ধ হয়ে গেল। অনেকেই যোগাযোগ করার চেষ্টা করে করে ক্লান্ত ও চিন্তিত! কেটে গেল প্রথম দিন, হঠাৎ অপুর বাবার ফোনে রিং বেজে উঠলে ওপাশ থেকে ভেসে এল অপুর কণ্ঠ, বাবা আমি কানাডার উদ্দেশে রওয়ানা হব, এখন ভারতের কলকাতায় আছি, চিন্তা করনা। আরেকটি ফোন বেজে উঠল পৃথিবীর অন্য প্রান্তে কানাডার টরেন্টো শহরে, আমি অপু বলছি ভারতে আছি আপাতত কানাডার উদ্দেশে কাল রওয়ানা হচ্ছি ইত্যাদি। পরে বিস্তারিত ভাবে জানাচ্ছি সব, ফোনের লাইন কেটে গেল।

শুরু হল চারিদিকে চাপা আনন্দ, উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার পালা। ধারণা অনুযায়ী দীর্ঘ প্লে­নের যাত্রা শেষে প্রায় ২ দিন পর ভেসে এল অপুর কণ্ঠ আবার, আমি কানাডার ভেঙ্কুভারে পৌঁছে গেছি। যে নাম্বারটি থেকে ওর সংগে আলাপ হল, নাম্বার শনাক্ত হল ভেঙ্কুভার শহরের কোথাও থেকে। আবার যোগাযোগ বিছিন্ন সবার সংগে অপুর। বেশ কয়েক ঘণ্টা পরে অপুর সংগে পরিবারের অন্যান্যদের যোগাযোগ। এবার পাওনা টাকা পরিশোধের পর ওকে ভেঙ্কুভার থেকে টরেন্টো আসতে আর কানাডিয়ান কাগজ পত্র আইডি ইত্যাদি প্রস্তুত করে ওকে ছাড়া হবে বলে জানালো রিয়াজ। দুষ্ট রিয়াজ ও তার দল বার বার সম্পূর্ণ টাকা পরিশোধের উপর জোর দিতে লাগলো এবং অপুও ফোনে টাকা পরিশোধের জন্য পরিবারের সদস্যদের বলতে শুরু করল। কানাডা আসলে টাকার ব্যবস্থা সকলে আনন্দের সংগেই করবে, এ আর আমাদের সমজের নতুন কি ঘটনা।

কিন্তু পরিবারের পক্ষ থেকে অপুর সংগে যত বার যোগাযোগ করা হয়, ততবারই সন্দেহের দানা বাঁধতে শুরু হয় সবার মনে। এ কেমন ব্যাপার, টাকা পরিশোধ করলেও কি নিশ্চয়তা আছে অপুকে ওরা ভেঙ্কুভার (কানাডার পশ্চিমের একটি মনোরম শহর) থেকে সত্যি সত্যি টরেন্টো শহরে পাঠাবে? অপুর অসংলগ্ন কথাবার্তা, ইচ্ছে মাফিক ওর সংগে যোগাযোগ করতে না পারা ইত্যাদি সব মিলিয়ে সকলের মনে সন্দেহ প্রবল হল, সম্ভবত অপুকে আটক করে জোরপূর্বক মিথ্যে কথাগুলো বলাচ্ছে। সন্দেহ আস্তে আস্তে সত্যিতে রূপান্তরিত হতে শুরু করে। রিয়াজ নামক অপহরণকারী দলের হোতাকে ফোনে ভারতে যোগাযোগ হলে সে প্রতিবারই অপুকে স্কাইপি বা অন্যকিছু মারফত দেখাতে অপারগতা প্রকাশ করে এবং টাকার জন্য চাপ দিতে থাকে।

এক পর্যায়ে রিয়াজের দলটি পরিষ্কার জানিয়ে দেয় টাকা না পেলে অপুর মুক্তির সম্ভাবনা নেই। প্রকাশ পেল সমস্ত ফোনে আলাপ হচ্ছে ভারত থেকে। অপুর নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে পরিবারের সদস্যরা বাধ্য হয়ে ব্রোকার নামক রিয়াজের অপহরণকারী দলের মুক্তিপণের সমস্ত দাবী এক এক করে মেনে নেন। অসহায় নিরুপায় পরিবারের সদস্যরা অনেক চেষ্টা করার পর সুস্থ শরীরে জীবিত অবস্থায় অপুকে ভারত থেকে মুক্ত করে বাংলাদেশে ফেরত নিয়ে আসতে সক্ষম হন।

১৩দিনের একটানা নানা ভয় আতংক আশংকার পর ফিরে আসতে সক্ষম হয় অপু। ফিরে আসার পর অপুর কাছ থেকে যতটুকু জানা গেলো, এক ভয়ানক অন্ধকার জগতের অজানা কথা, চারিদিক বন্ধ অল্প আলোর ঘরে অপু সহ আরও ২ জন বন্দি ছিল। এলাকাটি খুবই শান্ত ভারত এবং নেপালের সীমান্তবর্তী নির্জন একটি এলাকা, ১০ থেকে ১৫ জনের একটি অস্ত্রধারী দল ওদের পাহারা দিত সার্বক্ষণিক ভাবে, স্থানীয় পুলিশও জড়িত বলে ওদের ধারনা। বাথরূম আর খাওয়ার খুবই অল্প ব্যবস্থা ছিল, ফোনে কথা বলার সময় সবসময় পজেটিভ থাকার কড়া নির্দেশ ছিল ওদের, অন্যথায় কঠোর ব্যবস্থা। মুক্তিপণের টাকা সম্পূর্ণ পাওয়ার পর চোখ বেঁধে অপুকে ও অন্য ২ জনকে দুরের একটি শহরে ছেড়ে চলে যায় অপহরণকারীরা। ভাগ্য ভাল থাকায় সেখান থেকে গুপ্ত পথে স্বদেশে ফেরত আসে অপুরা।

অপুদের মত মিথ্যে প্রলোভনের শিকার হয়ে আর যাতে কেউ রিয়াজদের পাতা চোরাবালির ফাঁদে আটকা না পরে এ জন্য আমাদের সতর্ক সাবধান হতে হবে। যেভাবে ফেসবুকে পরিচয়ের পর প্রথম সাক্ষাতে ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে সমাজে, তেমনি বিদেশে পাঠানোর বদলে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনাও ঘটছে। তাই সকলকে ওয়েবসাইটের সাইড এফেক্ট থেকে বিশেষ করে তরুন সমাজ কে মুক্ত থাকতে হবে।

জয়ব্রত

টরন্টো