স্মৃতির মীজান ভাই
ফেব্রুয়ারি ৭, ২০১৫
সুলতানা শিরীন সাজি
৫ জানুয়ারী সন্ধ্যাবেলা বসে টিভি দেখছিলাম। বাইরে ভীষন শীত। কবীর ভাই এর ফোন এলো। মীজান ভাই(ডঃ মীজান) অসুস্থ্য। সিভিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আমি যাবো বললাম। হাইওয়ে দিয়ে গাড়ি ছুটছে। একের পর এক ফোন আসছে। টরন্টো,মন্ট্রিয়েল এবং অটোয়া থেকে। সবার একই প্রশ্ন। মীজান ভাই এর খবর কি? কেউ কেউ বললেন উনারা জেনেছেন,মীজান ভাই আর নেই। আমরা হাসপাতালে যাচ্ছি। পৌছে খবর জানাবো বলে ফোন রেখে দেই।
হাসপাতালে পৌছে আই সি ইউ তে পৌছুলাম যখন, ঘড়ির কাঁটা তখন সাতটা প্রায়। রিসিপশনের মেয়েটাকে বেড নং আর মীজান ভাই এর নাম বলতেই ফোন করলো। করিডোর ধরে বিষণœ মুখে কিছুটা ব্যস্ততা নিয়ে এগিয়ে এলেন মীজান ভাই এর এক ছেলে। জানালেন উনি বাবু । মীজান ভাই এর বড় ছেলে। উনি একঘন্টা আগে এসে পৌছেছেন ক্যালিফোর্ণিয়া থেকে। জানালেন,”আব্বুর কষ্ট হচ্ছে,লাইফ সাপোর্ট খুলে নেয়া হবে কিছুক্ষনের মধ্যে।” আমরা মীজান ভাইকে দেখতে যেতে চাইলে বললেন,থাকনা আব্বু তোমাদের স্মৃতিতে যেমন আছে তেমন। বললাম, আমরা উনাকে দেখতে চাই। মীজানভাই এর বেডের কাছে যখন পৌছুলাম আমরা, দেখলাম উনার ছোট ছেলে দাঁড়িয়ে আছে বাবার হাত ধরে। একরাশ যন্ত্রপাতীর ভীড়ে বিছানায় শুয়ে আছেন মীজান ভাই। মনে হলো ঘুমিয়ে আছেন। আমি উনার পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে প্রার্থণা করলাম। জীবন আর মৃত্যুর সন্ধিক্ষন বুঝি একেই বলে! একেই বলে মৃত্যু, একেই বলে চলে যাওয়া! যার স্বাদ সবাইকে গ্রহন করতে হবে।
রুম থেকে বের হয়ে হেঁটে আসছি। ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে চোখ। নিজের বাবা থেকে শুরু করে অনেক আপনজন হারানোর খবর পেয়েছি দীর্ঘ বাইশ বছরের প্রবাস জীবনে। অমোঘ সেই মৃত্যু! আজ মীজান ভাই চলে যাচ্ছেন। ক্যালেন্ডারের পাতায় আজকের এই দিনটায় উনি চলে যাবেন এটাই লেখা ছিলো। লাইফ সাপোর্টটা খুলে নিলেই উনি অতীতের একজন হয়ে যাবেন। নিশ্চিন্তে চলে যাবেন সেই অন্যজীবনে, যার ঠিকানা বেঁচে থাকা মানুষ জানেনা। কোন সে দেশ, কোন সে আকাশ নাকি কোন সে মহাশূন্য!
গেটের কাছে আসতেই অনেক চেনা মুখ। সবাই মিলে নানান কথা। এখনো লাইফ সাপোর্টে আছেন মীজান ভাই। তাই উনি নেই এই কথাটা মুখ দিয়ে আসছিল না। সবাই কথা বলছে। আমি চুপ বসে ভাবছিলাম কোথায় যাচ্ছেন মীজান ভাই? ভালোই তো ছিলেন। ছিমছাম। একাকী নিজের মতন জীবনযাপন। নিজস্ব নিয়মে ,নিজস্ব ভালোলাগার জগতে। ইচ্ছে হলেই বেড়িয়ে পড়তেন বেড়াতে। মন্ট্রিয়েল, টরন্টো সহ নর্থ আমেরিকার বিভিন্ন শহরে। সবখানেই তাঁর জন্য অপেক্ষায় থাকতো তার প্রিয় মানুষরা। বাসায় ফিরে অনলাইনে বসতেই দেখি মীজান ভাইএর চলে যাওয়ার খবর। তাঁকে নিয়ে অনেকের লেখা, ছবি। ভীষন কষ্ট হচ্ছিল। কোন ছবি বা লেখাতে একটা শব্দ লেখার শক্তি হয়নি।
শুধু মনে হচ্ছিল মীজান ভাই তাঁর প্রত্যাশা ধরেই কোন সে অজানায় চলে গেলেন। উনার লেখা “লাল নদী” বই এ
“শরণার্থী” শিরোণামে এক লেখায় উনি লিখেছিলেন , উনার বড়ছেলে আর বউমা উনাদের জন্য তাদের বাড়িতে একটা ঘর সাজিয়ে রেখেছে। কিন্তু উনি সিদ্ধান্ত নেননি যাবেন কি যাবেন না। লিখেছেন, “হয়তো একদিন নিতে হবে। হয়তো একদিন আমার বা আমার স্ত্রীর চলার শক্তি থাকবেনা। তখন ছেলেরাই হবে একমাত্র ভরসা। সে অবস্থায় যেনো পড়তে না হয় কখনো করুণাময়ের কাছে সেই আমাদের প্রার্থণা। “করুণাময় তার কথা শুনেছেন ,নিশ্চিত করেই শুনেছেন বলে আমার ধারণা।
মীজান ভাই এর জানাজা হলো পাইন ক্রেস্ট এ একটা হলে। উনাকে কার্প রোডের একটা কবরস্থানে সমাহিত করা হলো। এর আগের দু’দিন ধরে মীজান ভাই আর মীজান ভাই ছিলেন না। মীজান ভাই এর শরীর হয়ে গিয়েছিলেন। আত্মাহীন মানুষ কত সহজে শুধুমাত্র শরীর হয়ে যায়!
আমাদের একটা সাহিত্য আড্ডা শুরু হয়েছিল রাশেদ নবী ভাই এর বাসা থেকে। মীজান ভাই এর বাসায় আড্ডা হলো যেবার, রীভার সাইড ধরে ড্রাইভ করে উনার বাসায় যাচ্ছিলাম । পথের ধারে অনেক উইলো গাছ দেখেছিলাম। নদীর পানি ছুঁয়ে যাচ্ছিলো উইলোর ডালপালা। মনে ভাবছিলাম আহা কি দারুণ দৃশ্য। মীজানভাই প্রতিদিন এই পথ দিয়ে যাওয়া আসা করতেন। এমন সুন্দর দেখলে তার কলম থেকে তো লেখা আসবেই। মীজান ভাইকে কথাটা বলতেই উনি বললেন ,তুমি হলে কবি। তোমার তো এমন মনে হবেই। আমাকে মাঝে মাঝে উনি কবি ডাকতেন। আমার সাজি নামটা উনি কেমন ছন্দে ডাকতেন। আমাদের সাহিত্য আড্ডায় মধ্যমনি ছিলেন তিনি। আড্ডা শেষে বলতেন গান গাইতে।
এতবড় একজন গণিতজ্ঞ। তবে আলোচনা যে বিষয়েই হোক না কেনো উনি স্বাচ্ছন্দ্যে চালিয়ে যেতেন। শুধুমাত্র রাজনীতি এবং ধর্মছাড়া। এই দু’টো বিষয়ে আমি কখনো কথা বলতে শুনিনি। যে কোন আড্ডা খুব জমে ওঠে এইসব বিষয়ে। অনেকেই আনন্দ পান এইসব বিষয়ে কথা বলতে,তর্ক করতে। মীজান ভাইকে যেসব আড্ডায় পেয়েছি। আমাদের আলোচনার বিষয় আগেই ঠিক করা হতো এবং সেই বিষয়ের উপরেই কথা বলা হতো। কখনো কোন বরেণ্য মানুষ,কখনো কোন বই বা ম্যূভি নিয়ে আমাদের কথা হতো।
আমাদের সাহিত্য আড্ডা অনেক সাহিত্যপিপাসু মানুষদের নিয়ে শুরু হলেও ক্রমশঃ তা কমে যায়। আমাদের সাহিত্য সভার একজন আইয়ুব খান ভাই এর আকস্মিক মৃত্যুর পর (জুন ৮’২০১৩) আর বসা হয়নি। মে ১১, ২০১৩ শেষবার বসেছিলাম আমরা ফেরদৌস ভাই এর বাসায়।
মীজান ভাই এর “শূন্য” বইটা নিয়ে যেবার আলোচনা হলো, মীজান ভাই এত সুন্দর করে বললেন। বইটার ইংরেজী ভার্সন এর ফটোকপি দিয়েছিলেন রাশেদ ভাই আগেই। বাংলা বইটা হাতে পেয়ে খুব ভালো লাগলো। অটোগ্রাফ সহ দিলেন বইটা। লিখেছিলেন, “প্রিয় কবি এবং সুকন্ঠী রবীন্দ্রশিল্পী সাজিকে” মীজান রহমান ১৭ই জুন, ২০১২। বইটা পেলাম আইয়ুব ভাই এর বাসায় আড্ডায়।
বাসায় ফিরেই বইটা পড়েছিলাম। “শূন্য”র ভুমিকার শুরুতে তিনি লিখেছেন,” সৃষ্টির আদিতে কিছুই ছিলোনা ইহসংসারে–এক শূন্য ছাড়া। আধুনিক বিজ্ঞান এর মতে শূন্য থেকেই সবকিছুর উত্তপত্তি। অর্থাৎ ‘নাই’তেই ‘আছে’র জন্ম। “ধাঁধার মত লাগছে? ধাঁধাই বটে, বলেছেন তিনি।
সত্যি তাই! ধাঁধার মতই লেগেছিল। আর বইটা পড়েছিলাম তাই গোগ্রাসে। কিছু বুঝেছি। কিছু বুঝিনি। শূন্য,মহাশূন্য,বিগব্যাং—-মহাবিস্ফোরণ। কয়েকটা দিন এক ঘোরের মধ্যে বাস। এই ঘোরটুকুই চেয়েছিলেন লেখক মীজান রহমান। আমার বড় ছেলে রাশীক ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর ছাত্র। ওকে দিয়েছিলাম ইংরেজী ফটোকপি পড়ার জন্য। ওর সাথে এই নিয়ে ক’দিন কথাও হয়েছিল।
১৬ সেপ্টেম্বর’২০১০ কবীর ভাই আর আমরা দু’জন গেলাম মীজান ভাই এর বাসায়। উনার জন্মদিন। আমাদেরকে দেখে খুব খুশি হলেন। রাশীকের বাবাকে আমাদের সাহিত্য আড্ডায় যায়না ,তাই দেখা কম হতো। ওকে বললেন,” মিঠু তুমি এসেছো,খুব খুশি হয়েছি।”কেক কাটা হলো। উনি রসগোল্লা আর পায়েস রান্না করেছিলেন । মীজান ভাই এর বাড়ির পিছনে সবুজ ঘাসের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম কি করে একা থাকেন এই বাড়িতে। মীজান ভাই বলেই মনেহয় পারেন। সবার এমন মনের জোর থাকেনা। সারাবাড়িতে উনার স্ত্রীর ছবি। ছেলেদের ছবি। ছেলের বউ, নাতিনাতনীর ছবি। সাজানো পরিপাটি সব। একসময় এই বাড়িতেই দুইছেলে নিয়ে কত স্মৃতিময় দিন গেছে তাদের। জীবনের দিনগুলো কত তাড়াতাড়ি চলে যায়। কত তাড়াতাড়ি দেয়ালো আটকানো ছবির মানুষ হয়ে যাই আমরা সবাই।।মীজান ভাই এর ৭৯ তম জন্মদিন খুব বড় করে পালন করা হয়েছিলো “আশ্রম” পত্রিকার উদ্যোগে। মীজান ভাই সারাক্ষন হাসছিলেন। বাচ্চাদের ভীরে উনাকে ওদেরই একজন মনে হচ্ছিল।
অক্টোবর ২৭, ২০১৩ তে আমার কবিতার বই “কফির পেয়ালায় নিশুতি রাত জাগে” এর মোড়ক উন্মোচন করেছিলেন মীজান ভাই। “আশ্রম” আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে অটোয়ার কবিতা,সাহিত্য, সঙ্গীত পিপাসু মানুষদের সমাবেশ হয়েছিল। কবিতা ছাড়া ও সাহিত্যর নানা দিক নিয়ে কথা বলেছিলেন মীজান ভাই।
মীজান ভাইকে নিয়ে লিখতে বসে কত কথা মনে আসছে। কোনটা ছেড়ে কোনটা লিখি! শেষ দেখা হয়েছিল একটা গানের অনুষ্ঠানে। মীজান ভাই বলে কাছে যেয়ে দাঁড়াতেই বললেন, “সুন্দরী,বেশি কাছে দাঁড়িও না,বুড়ো মানুষ, বুক ধুকপুক করে। “হাসলাম আর বললাম, আপনি হলেন চিরনবীন মীজান ভাই। মোটেই বুড়োনা। “এত বড় একজন মানুষ, কিন্তু কোথাও গেলে গম্ভীর হয়ে বসে থাকতেন না। সবার সাথে কথা বলতেন। হাসতে জানতেন,হাসাতে জানতেন।
মে, ২০১৩ তে নিউইয়র্ক থেকে লুত্ফুন নাহার লতা আপা এসেছিলেন মন্ট্রিয়লে এক কবিতার সিডি মোড়কের অনুষ্ঠানে। ওয়াশিংটন থেকে ইকবাল বাহার চোধুরী এসেছিলেন। মীজান ভাই ও গেছিলেন। সবাই মিলে কি দারুণ সময় কাটলো। লতা আপাকে বললাম অটোয়ায় চলে আসেন। পরেরদিন টরন্টোর মনিরুল ইসলাম ভাই আর মীজান ভাই এর সাথে উনি অটোয়ায় চলে এলেন। টিউলিপ ফেস্টিভ্যালে গিয়ে উনাদের সাথে ঘুরলাম,আরো কিছু জায়গায় ঘুরলাম একসাথে। সন্ধ্যায় আমার বাসায়। সেদিন আমার ছোটছেলে রাইয়ানের জন্মদিন ছিলো। মীজান ভাই সহ কেক কাটা হলো। আমার বন্ধুরা মিলে অনেক রাত পর্যন্ত গান আর কবিতা আড্ডা হলো। মীজান ভাই রাত জেগে আড্ডা বেশি দিতেন না। কিন্তু সেদিন থাকলেন।
উনার লেখা “আবার দেখা হবে” আমার খুব প্রিয় উনাকে বলেছিলাম। এই লেখাটা আমি কতবার যে পড়েছি। বোনের প্রতি ভাই এর মমতা আমাকে ছুঁয়ে গেছে। যতবার পড়েছি ততবার কেঁদেছি। ভাইরা বোনদের জীবনে যে কি প্রিয় এক অস্তিত্ব সেটা শুধু বোনেরাই জানে। বেগম নামের সেই বোনটার সাথে উনার দেখা হয়েছিলো লন্ডনে। যখন বোন চিকিৎসার জন্য সেখানে এসেছিলো। লেখার শেষ অংশে উনি লিখেছিলেন,”বললাম আবার দেখা হবে।’ সেও সোৎসাহে বলে উঠল, ‘হ্যাঁ দাদা,আবার দেখা হবে, ইনশাল্লাহ। ‘অভিমান নয়,অভিযোগ নয়,অনুশোচনা নয়,শুধু একটা করুন কামনা,দেখা হবে আবার। স্বরনালীটাকে কে যেন চেপে ধরল আমার। দরজা থেকে দুর্বল দু’টি হাত নেড়ে,ফিসফিস করে শেষবারের মত বলে এলাম অভাগী বোনটাকে, ‘নিশ্চয়ই আবার দেখা হবে।’
সেই দেখার অপেক্ষায় বসে আছি এপারে,ও বসে আছে ওপারে।
আমার খুব জানতে ইচ্ছা করছে মীজান ভাই,দেখা হয়েছে কি বোনের সাথে? ওপারে গেলে কি দেখা হয় কারো সাথে আর?
(স্মৃতিচারণে মীজান ভাইকে চেনা)
৯ জানুয়ারী’২০১৫,শুক্রবার, সন্ধ্যার একটু পর যখন ওভারব্রুক কমিউনিটি সেন্টারে পৌছুলাম, মনটা ভারী হয়ে ছিলো। মীজান ভাই চলে যাবার ঠিক পর দিন আমরা হারিয়েছি আমাদের পরিবারের একজনকে। দেশ থেকে যখন এই খবরগুলো আসে বুকের মধ্যে ঝড় বয়ে যায়। সবকিছু চলতে থাকে। এই ব্যস্ত শহরে কে রাখে কার খবর! ওভারব্রুক সেন্টারে যে কোন অনুষ্ঠানের আয়োজন করিনা কেনো মীজান ভাই শহরে থাকলে ঠিক চলে আসতেন। এমন ও হয়েছে দরজা দিয়ে ঢুকছি,দেখতাম মীজান ভাই সোফায় বসে আছেন। পাঁচটায় বললে ঠিক পাঁচটার কিছু আগে এসে পৌছুতেন মিজান ভাই। আমরা হয়তো হলে ঢুকে চেয়ার টেবিল ঠিক করছি ,উনি এসে জানতে চাইতেন কখন শুরু হবে। ৩০ মিনিট। হাতে ৩০ মিনিট রেখেই সময় বলতে হয় এখানে। আবহাওয়া,ট্রাফিক এইসব মাথায় রেখে। বাইরে আজ ভীষন বাতাস। কাজের দিন। সবাই কাজ শেষ করে ফিরবে। অভ্যাসমত সোফায় তাকালাম। কেউ নেই। শূন্য মনে হলো । এই তো সেদিনই ছিলেন
এখানে বসে।
হলের ভিতর চেয়ার,টেবিল ঠিক করছে সবাই। কিছুক্ষন সাহায্য করলাম। দরজার পাশে একটা টেবিলে মীজান ভাই আর উনার স্ত্রীর ছবি। আর কিছু মোমবাতি আর ফুল। মীজান ভাই এর দীর্ঘ কর্মজীবনের কলিগরা চলে এসেছেন। আসছেন অনেকেই। আমরা বসে আছি। চারিদিকে তাকিয়ে দেখলাম সবাই যে যার মত কথা বলছে। ঘড়ির কাঁটায় সময় এগোচ্ছে।
শুরু হলো মীজান ভাইকে নিয়ে স্মৃতিচারণ।
উনার দুই ছেলে বাবু, রাজা যাদের কাছে জানলাম বাবা মীজান এর কথা। জানলাম মায়ের অসুস্থ্যতার সময় কি করে তিনি ছেলেদের কাছে হয়ে উঠেছিলেন একাধারে বাবা এবং মা। কি করে হয়ে উঠেছিলেন ‘হিরো’। ঘরের কাজ,বাইরের কাজ,ছেলেদের দেখাশোনা সব কিছু করেছেন একা। কথা বলতে বলতে আবেগে কাঁদছিলেন তারা।
কথা শুনলাম নাতি জুনিয়র মীজান এর কাছে আর নাতনী সোফিয়ার কাছে। এত সুন্দর গুছিয়ে কথা বলছিলো দু’জনে। মানুষ চলে যায়। প্রিয় মানুষদের ফেলে। কিন্তু রেখে যায় তার ভালো গুনাবলী এভাবেই, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। মীজান ভাই এর ছেলেদের কাছে শুধু নাতী নাতনীদের কাছে যা কিছু শুনলাম, মুগ্ধতার সীমা ছিলোনা। সোফিয়া বলছিলো দাদু তাকে বলেছে, “Do not do things to please people, do things that make you happy.” চোখ ভেসে যাচ্ছিল ওর কথা বলতে বলতে। আর আমরাও কাঁদছিলাম। স্বজন হারানোর ব্যথা বাজছিল সবার বুকেই। আমি শুধু ভাবছিলাম কি সুন্দর এই স্মরণসভা! একটা মানুষ যাকে নানান জায়গায় দেখেছি। কথা বলেছি। তার জীবনের এই আপন মানুষগুলোর কাছ থেকে না শুনলে জানা হতোনা বাবা মীজানকে। জানা হতোনা লেমন ট্রী গান গাওয়া মীজান ভাইকে। জানা হতোনা কি করে ছেলেদের মাঝে ছড়িয়ে দিয়ে গেছেন বাতাবী লেবুর ঘ্রাণ।
কথা বললো আমাদের শহরের আরো অনেকে। উনার কলিগদের একজন এবং ‘আশ্রম’ পত্রিকার কবীর চৌধুরী,যিনি মীজান ভাইকে শিক্ষাগুরু হিসাবে মনে করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাগুরু নয়। লেখার জীবনের। কথা বললো কিশোর লেখক আদিব বখত। ও বললো, আজকের অনুষ্ঠানে এসে ও জানলো অন্য এক ড. মীজানকে। ইসলাম ভাই বললেন বন্ধু হারানোর কথা। সপ্তাহে কয়েকটা দিন কয়েক ঘন্টা উনারা ফোনে কথা বলতেন।
সময় কমে আসছিলো। ইচ্ছা ছিলো কিছু বলবো। কিন্তু মনে হলো আজ শুধু জানার দিন,মীজান ভাইকে সবার কাছ থেকে জানা। মনে ভাবছিলাম ,মানুষ যখন বেঁচে থাকে,তাঁকে নিয়ে এই মুল্যায়ন হলে বেশ হতো।
সবার কথা শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল, মীজান ভাই এর আত্মা কি শুনতে পাচ্ছেন? যদি শুনতে পেয়ে থাকেন, কি ভালো যে লাগবে উনার! এত ভালোবাসা ছড়িয়ে রেখে গেছেন সবখানে। এই তো মানুষ জন্ম। এই তো সত্যিকারের জীবন। যতদিন বেঁচেছেন মনের মত বেঁচেছেন। লিখেছেন,পড়েছেন,ঘুরেছেন,আড্ডা দিয়েছেন।
ওভারব্রুকের হলটা থেকে যখন বের হয়ে আসছি, ভাবছিলাম ,
আজ আপনি এলেন না মীজানভাই। টাফিকে আটকা পড়েছিলেন?
নাকি ঘড়ির কাঁটা থেমে গিয়েছিলো।
এলে দেখতেন, আপনার সন্তানেরা ,আপনার প্রিয়জনেরা কি ভাবে হৃদয়ে ধারণ করেছে আপনাকে।
আপনার আর ভাবনা কি? আপনি এখন মুক্ত আকাশের কোথাও নাকি কোন নীল সমুদ্রের ধারে, নাকি কোন উঁচু পাহাড়ের অনেক উপরে? নাকি তার চেয়েও সুন্দর কোথাও!
বিরাশী বছরের এই পার্থিব জীবনটা বেশি আনন্দের, নাকি ওখানে? অংকের কোন থিওরীতে কি জানা যাবে সেই রহস্য? আপনার লিখে যাওয়া কোন লেখায় কি আপনি লিখে গেছেন কোন কথা?
কোন ক্লু? যেখানেই থাকেন হাসতে থাকেন,ভালো থাকেন মীজান ভাই।
সুলতানা শিরীন সাজি
অটোয়া -shazi19@gmail.com