সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলার মার্কিন পদ্ধতি প্রতিহত কর
নভেম্বর ৮, ২০১৪
হারুন সিদ্দিকী
হারুন সিদ্দিকী লিখেছেন, গত সপ্তাহে কুইবেক ও অটাওয়ায় পৃথক হামলার ঘটনার পর স্টিফেন হারপার উভয় ঘটনাকে সন্ত্রাসী হামলা হিসাবে চিহ্নিত করেন এবং এই হামলাকে ইরাকের ইসলামিক স্টেট-এর বিরুদ্ধে আমেরিকার যুদ্ধে কানাডাকে অঙ্গীকারাবদ্ধ করার জন্য জনমত সৃষ্টির কাজে ব্যবহার করেছেন।
বিভিন্ন সময়ে সন্ত্রাসবাদ বিভিন্ন মতবিশ্বাসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলো। বর্তমান সময়ে এটি মুসলিমদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এ নিয়ে তিনটি বৃহত্তর অভিমত স্পষ্ট:
একটি গ্রুপ মনে করে, এটি সম্পূর্ণভাবে ইসলামের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট Ñ কোরআনে কি বলা হয়নি যে, ‘‘কাফেরদের হত্যা করো?’’ সুতরাং যেখানে যত মুসলমান আছে তাদের সবাইকে সন্ত্রাসবাদের দায়দায়িত্ব নিতে হবে। আর এজন্যই প্রতিটি মুসলমানকে সন্দেহভাজন হিসাবে গণ্য করতে হবে।
দ্বিতীয় একটি গ্রুপ রয়েছে যারা বলে, ইসলাম অর্থ শান্তি। মূলত বাইবেলই হলো সন্ত্রাসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট উদ্ধৃতিতে ভরপুর Ñ ‘‘ওদের সব নেতাদের ধরে আনো এবং প্রকাশ্য দিবালোকে তাদের হত্যা করো,’’ ইত্যাদি। অপেক্ষাকৃত মুষ্ঠিমেয় কিছু লোকের কর্মকান্ডের জন্য বিশ্বের দেড়’শ কোটি মুসলমানকে দায়ী করার কোনও যুক্তি নেই। কানাডাসহ সারা বিশ্বের ইসলামী পন্ডিত ও ইমামরা সন্ত্রাসবাদের নিন্দা করেছেন Ñ সম্প্রতি কানাডার ইমাম কাউন্সিল, কানাডীয় মুসলিমদের জাতীয় কাউন্সিল, গ্রেটার হেমিলটনের মুসলিম কাউন্সিল (যারা হেমিলটনের আর্মারিতে করপোরাল নাথান সিরিল্লোর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে পুস্পস্তবক অর্পণ করেছে, যেমনটা করেছে অটাওয়ার মুসলমানরা ন্যাশনাল ওয়ার মেমোরিয়ালে)।
তৃতীয় আরেক লোক বলেন, আসল সমস্যা হলো ধর্মের মধ্যে, সে যে কোন ধর্মই হোক। সব ধর্ম নিষিদ্ধ করে দেয়া হোক, তাহলেই আমরা ভালো থাকবো।
বিভিন্ন দেশের সরকার এবং জাতীয় নেতারাও এমনভাবে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেন যা অনুমানযোগ্য।
দক্ষিণপন্থীরা যে কোনও সহিংসতার ঘটনায় কোন মুসলমানের জড়িত থাকার প্রমাণ পেলেই সেটিকে ‘‘সন্ত্রাস’’ হিসাবে চিহ্নিত করেন। এর প্রতিক্রিয়ায় তারা সামরিক ব্যবস্থা নেন, নজরদারি বাড়িয়ে দেন, পুলিশের ক্ষমতা বাড়ান, আরও বেশি অস্ত্রশস্ত্র কেনেন, উর্দীধারীদের গৌরবান্বিত করেন এবং দেশপ্রেমকে উস্কে দেন।
কিছু নেতা যেমন জর্জ ডব্লিউ বুশ, যুদ্ধংদেহী হয়ে ওঠেন এবং জনগণকে উদ্দেশ্য করে বলেন, আমাদের ভীত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে কিন্তু আমি যখন নেতৃত্বে রয়েছি তখন আমার সঙ্গে আপনারাও নিরাপদ।
বাম নেতা ও সরকারগুলো ভীতি না ছড়ানোর চেষ্টা করেন এবং নীতিগতভাবে দূরদর্শিতার মাধ্যমে সমাধানের চিন্তা করেন।
গত সপ্তাহে দু’টি পৃথক হামলার ঘটনায় দু’জন সৈনিকের হত্যা এবং পার্লামেন্ট ভবনে ঢুকে পরার ঘটনার পর স্টিফেন হারপার উভয় ঘটনাকে সন্ত্রাসী হামলা হিসাবে চিহ্নিত করেন এবং এই হামলাকে ইরাকের ইসলামিক স্টেট-এর বিরুদ্ধে আমেরিকার যুদ্ধে কানাডাকে অঙ্গীকারাবদ্ধ করার জন্য জনমত সৃষ্টির কাজে ব্যবহার করেছেন।
থমাস মালকেয়ার এবং জাস্টিন ট্রুডো ‘‘ত্রাস’’ শব্দটি এড়িয়ে গেছেন এবং ভিন্ন কৌশল গ্রহণ করেছেন। মালকেয়ার বলেন, ওই হত্যাকা- ‘‘ছিলো ঘৃণার দ্বারা পরিচালিত এবং আমাদেরকে ঘৃণার পথে ঠেলে দেয়ার লক্ষ্যে পরিকল্পিত। তারা পারবে না বরং আমরাই বিজয়ী হবো এবং আমরা সম্মিলিতভাবে বিজয়ী হবো।’’
ট্রুডো ছিলেন একমাত্র ব্যক্তি যিনি কানাডার মুসলিমদের উদ্দেশ্য করে কথা বলেছেন। তিনি বলেন, ‘‘মুসলিম কমিউনিটির আমাদের বন্ধুদের এবং সাধারণ নাগরিকদের বলি, কানাডীয়রা জানে ইসলামের নামে এধরণের কর্মকান্ড আপনাদের বিশ্বাসের পরিপন্থী। কেবলমাত্র আমাদের পারস্পরিক সহযোগিতা ও অব্যাহত শ্রদ্ধাবোধই ধর্মের নামে পরিচালিত বিকৃত আদর্শিক প্রচারণার প্রভাব প্রতিহত করতে সহায়ক হতে পারে। আমরা আলাদাভাবে নয়, একসঙ্গেই হেঁটে যাবো।’’
দু’টি হত্যার ঘটনা সম্পর্কে আমরা কতটুকু জানি?
দু’টি ঘটনার মধ্যে কোনও সম্পর্ক ছিলো না। কুইবেকের দু’জন ব্যক্তি যারা খ্রিস্টান ধর্ম থেকে ইসলাম গ্রহণ করেছে, তারা পরস্পরকে চিনতো না এবং দৃশ্যত তারা কোনও জিহাদি গ্রুপের সঙ্গেও সংশ্লিষ্ট ছিলো না।
দু’জনই ছিলো ব্যক্তিজীবনে হতাশাগ্রস্ত। একজন ছিলো দীর্ঘ দিন ধরে অপরাধমূলক কর্মকান্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত যা তাকে ধর্মান্তরিত হতে উৎসাহ যোগায়; অন্যজনের ব্যবসা লাটে ওঠার পর থেকেই সে ছিলো গভীরভাবে হতাশাগ্রস্ত।
আরসিএমপির কমিশনার বব পলসন জানান, একজনের পাসপোর্ট জব্দ করা হয়েছিলো। অন্যজনকে পাসপোর্ট দিতে অস্বীকৃতি জানানো হয়েছিলো। এতে দু’জনই ক্রুদ্ধ হয় এবং তাদের খুনে প্রবৃত্তি চরিতার্থ করার মতই ভূমিকা পালন করে।
ভাগ্যের পরিহাস যে, আমরা তাদেরকে বিদেশের মাটিতে সন্ত্রাসে লিপ্ত হওয়া থেকে নিবৃত করি কিন্তু তারা কানাডার মাটিতেই কানাডার দু’জন সৈন্যকে হত্যা করে।
জল্পনার উদ্ধৃতি দিয়ে পলসন জানান, পার্লামেন্ট ভবনে ঢুকে গুলিবর্ষণকারী মাইকেল জিহাফ-বাইবিউ ‘‘সম্ভবত চরমপন্থী বিশ্বাস লালন করতেন।’’ তিনি বলেন, বাইবিউর মা বলেছেন যে তার ছেলে সিরিয়ায় যেতে চেয়েছিলো।
কিন্তু দীর্ঘ পাঁচ বছর পর গত সপ্তাহেই প্রথম ছেলের সঙ্গে কথা বলতে পেরেছিলেন বাইবিউর মা। ফলে তার মনের খবর পাওয়ার সুযোগ ছিলো নিতান্তই সামান্য। যাহোক, ব্রিটিশ কলম্বিয়ার বারনাবিতে স্যালভেশন আর্মির একটি আশ্রয়কেন্দ্রের একজন লোক জানিয়েছেন, বাইবিউর মধ্যে অতিরিক্ত ধর্মপ্রীতির কোনও লক্ষণ দেখা যায়নি বরং তিনি ছিলেন মানসিকভাবে অসুস্থ। তিনি জিহাদ করার জন্য বিদেশে যেতে চাননি বরং আরবি ভাষা ও ধর্মীয় বিষয়ে লেখাপড়ার জন্য সেখানে যেতে চেয়েছিলেন। এদিকে অটাওয়াস্থ মিশনের একজন বাসিন্দা জানিয়েছেন, বাইবিউ তাকে বলেছিলেন যে তিনি তার বাবার জন্মস্থান লিবিয়ায় যেতে চান এবং সেখানে তার মদ্যপানের নেশার ইতি টানবেন বলে আশা করেন।
হারপার সরকার দেশের ভেতরের বা বাইরের সন্ত্রাসবাদের মোকাবিলায় তাকে আরও নতুন নতুন হাতিয়ার Ñ যেমন বর্ধিত নিরাপত্তা, গোপনীয়তা, নজরদারি ও আটকের ক্ষমতা দেয়ার জন্য পার্লামেন্টে যে নতুন আইন উত্থাপন করতে যাচ্ছে সেটি পাস করার সময় উপরোক্ত বিষয়গুলির সবই বিবেচনায় রাখতে হবে।
রাজনীতিকে একপাশে সরিয়ে রেখে কানাডার উচিৎ অবিলম্বে হাউস অব কমন্সের সার্জেন্ট অ্যাট আর্মস কেভিন ভিকারকে আমাদের অর্ডার অব কানাডার শরিক করে নেয়া। এছাড়া করপোরাল সিরিলো গুলিবিদ্ধ হবার সঙ্গে সঙ্গে ওয়ার মেমোরিয়ালে উপস্থিত যেসব সাধারণ নাগরিক তার প্রাণ বাঁচাতে ছুটে এসেছিলেন তাদেরও চিহ্নিত করে অবশ্যই সম্মাননা জানানো উচিৎ। -সৌজন্যে : টরন্টো স্টার