শেষ ঠিকানার খোঁজে

মীজান রহমান

আজকাল এমন হয়েছে যে নিজের বাড়িতেও আমি হাঁচি দিতে সাহস পাইনা। হাঁচি দিয়ে কোন বিপদে পড়ে যাই কে জানে। গিন্নী হয়তো সাথে সাথে ৯১১ ডেকে বসবে। ওর ধারণা যে আমার হাঁচিটা অন্যদের হাঁচির মতো নয়। আমার হাঁচির অর্থ সর্দি লাগবে। আর আমার সর্দি মানেই নিমোনিয়া। এবং আমার নিমোনিয়া মানে ওর সর্বনাশ। ফলে হাঁচির ওপর নিষেধাজ্ঞা। যত বলি হাঁচিটাতো এ্যালার্জি থেকে হতে পারে ও কিছুতেই মানবে না। সারা জীবন তোমার এ্যালার্জি ছিল না আজকে গোরের কাছে গিয়ে এ্যালার্জি হতে যাবে কোন দুঃখে। চল তোমাকে এমার্জেন্সিতে নিয়ে যাই।

আমাদের দরজাতে এমার্জেন্সির গাড়ি বেশ কয়েকবার আসাযাওয়া করেছে। ছেলেরা যখন একেবারেই ছোট ছিল তখন অবশ্য ৯১১ ডাকার প্রয়োজন হতো না, নিজের গাড়িটাকেই এ্যাম্বুলেন্স হিসেবে ব্যবহার করতাম। ছেলেদুটির মাঝে বোধ হয় একটা গোপন চুক্তি ছিল যে অসুখ বাধাবার সবচেয়ে উৎকৃষ্ট সময় হল উইকেন্ড, এবং রাত বারটার পর। তবে একসাথে নয়। একেকজন একেক উইকেন্ডে। এক উইকেন্ডে একজনের কানের ইনফেকশন হলে পরের উইকেন্ডে আরেকজনের হবে বুকের ইনজেকশন বা পেটের ইনজেকশন। এভাবে তারা আমাদের উইন্ডেগুলো বুক করে রাখতো। শিশু হাসপাতালের এমার্জেন্সিতে রাতের নার্সগুলোর সাথে আমাদের সম্পর্কটা প্রায় ফার্স্ট নেম-এ এসে দাঁড়িয়েছিল।

তারপর আমার স্ত্রী এমার্জেন্সি জিনিষটাকে নিজেই একচেটিয়া করে নিল। প্রথমে কিডনির ব্যামো। তারপর পক্ষাঘাত। একবার দুবার তিনবার। শেষে তিনি ফুলগাছের গোড়াতে সার দিতে গিয়ে পা মচকে হাড় ভঙলেন। আজকাল ৯১১ ডাকাও মানে এক কেলেংকারী ব্যাপার। শুধু যে হাসপাতালের গাড়ি আসে তা নয়, সাথে সাথে আসে পুলিশের গাড়ি, দমকলের গাড়ি। সবগুলোরই নিজের নিজের সিঙা, ঝলকমারা আলো আছে। রোগী তুলতে এসে যেন বাড়িটাকেই তুলে দেবার যোগাড়। পাড়াপ্রতিবেশীরা নিজেদের কাজকর্ম ভুলে গিয়ে, রাস্তায় এসে কারবার দেখে। কিন্তু আমাদের প্রতিবেশীরা এখন আর তা করে না। সাইরেনের শব্দ হলেই বোঝে কাদের বাড়ি।

পরিবারের অন্য সবাইকে হাসপাতালে নিয়ে নিয়ে এত ব্যস্ত ছিলাম যে নিজে কোনদিন যাওয়ার ফুরসৎ পাইনি। সৌভাগ্যবশত প্রয়োজন হয়নি। প্রচন্ডরকমের স্বাস্থ্যবান পুরুষ না হলেও ভাইটামিন সি আর রক্তচাপের ওষুধ ছাড়া অন্য কোন ওষুধ আমি প্রাপ্তবয়সে খাইনি। অবশ্য আমাকে চর্মচোখে দেখার পর লোকের ধারণা হবে সর্ম্পর্ণ অন্যরকম। ভাববে আমি নিশ্চই ওষুধের শিশিতেই বাস করি। গতযৌবন, গতকেশ, গতদন্ত, খর্বকায় মানুষ যাকে দর্শনমাত্র কোন বাঙ্গালীর মনেই কন্দর্পকান্তি শব্দটা লাফ দিয়ে উঠবে না। তবু এক অলৌকিক উপায়ে আমি এমার্জেন্সির দরজাটা এড়াতে সফল হয়েছিলাম ছেষট্রি বছর বয়স পর্যন্ত। তারপর বিধাতা ভাবলেন, এ লোকটা অ্যাম্বুলেন্স গাড়ির ভেতরটা দেখেনি কোনদিন, এবার দেখানো যাক। ওপরওয়ালার আদেশ খন্ডাবে কার সাধ্য। একদিন ওরা এসে আমাকে চ্যাংদোলা করে শোয়ালো অ্যাম্বুলেন্সের ভেতর। তখন থেকে আমাদের বাড়িতে অ্যাম্বুলেন্স আসে শুধু আমার কারণে।

সুতরাং আমার হাঁচিতে যে গিন্নির এত ভয় সেটা একেবারে অমূলক নয়। বেশি দিন হয়নি হাসপাতাল থেকে ফিরেছি হার্টের যন্ত্রপাতি মেরামত করিয়ে। ডাক্তার বলেছে সাবধানে থাকতে। আমি সাবধানে থাকছি। তার চেয়েও সাবধানে থাকছে আমার স্ত্রী। লোকের কাছে শুনেছে হার্টের রোগীদের রসুন খাওয়া ভাল। ফলে আমি রোজ দুবেলা কাঁচা রসুন চিবোই আমার নকল দন্তসহকারে। একজন বলেছে মেথি খেলে হার্টের উপকার হয়। ফলে আমাকে প্রত্যহ ভাতের সঙ্গে মেথির গুঁড়ো খেতে হচ্ছে। খাওয়ার পর ভাতের স্বাধ ভুলে যাই, কিন্তু মেথির তেতো স্বাদটা লেগে থাকে জিভে। টেলিভিশনে দেখেছে লাল মদটা হার্টের খুবই পছন্দ। ফলে মদের গ্লাশে করে সুরাপান করলাম কিছুদিন। এমন বিস্বাদ বস্তু জীবনে খাইনি কখনো। লোকে কেমন করে খায় জানি না। তবু সহধর্মীনির খাতিরে মাঝে মাঝে ধর্মটাকেও বলি দিতে হয়। সৌভাগ্যবশত আমার কলেস্টেরলের ডাক্তার বললেন, মদ খেলে হার্ট খুশি হতে পারে, কিন্তু মস্তিস্ক বড় নারাজ হয়, অর্থাৎ রক্তচাপ বাড়ে। অনিচ্ছাক্রমে গিন্নীকে মানতে হলো যে মদ জিনিষটা আসলে আমার জন্য ভালো নয়। তবে হাঁচির ব্যাপার আলাদা। কার কাছে যেন শুনেছে হার্টের রোগীদের হাঁচি ভাল লক্ষণ নয়। ঘরপোড়া গরুর সেই সিদুঁরে মেঘেল অবস্থা। আমার হাঁচি হবে সে ভয়ে সে কোন মশলার গুঁড়ো ব্যবহার করে না রান্নায়। দরজা-জানালা বন্ধ করে রাখে সবসময় পাছে বাইরের ধুলোবালি পোকামাকড় এসে নাকে সুড়সুড়ি দেয়।

কিন্তু একটু গভীরে গেলে বোঝা যাবে যে আজকের প্রসঙ্গটা আমার হাঁচি নয়, এমনকি আমার রুগ্ন হার্ট-ও নয়। আজকের প্রসঙ্গ ভয়। অজানার ভয়। অভিবাসী বাঙ্গালী স্ত্রীর প্রাণে কেমন করে অজানা আতংক বাসা বাঁধতে শুরু করে। এদেশে এত প্রাচুর্য, এত সুযোগসুবিধা আর নিরাপত্তা থাকা সত্বেও কেমন করে সময়ের সাথে অপয়া ইঁদুরের মত অন্ধকার গলা বেয়ে উঠতে শুরু করে এই অশরীরী শংকা সে এক রহস্য বটে। প্রথম যখন এসেছিলাম এই দেশে সেই ষাটের দশকে তখন আমাদের এমনটা ছিল না। ও হাসপালে গেলে আমি অস্থির হতাম না বা আমি হাসপাতালে গেলে ও অস্থির হতো না। যদিও অস্থির হওয়ার কারণ ছিল তখই বেশী। তখন আমাদের কিছুই ছিল না। এমনি ভাল স্বাস্থ্যবীমাও ছিল না, জীবনবীমা তো দূরের কথা। এখন আমাদের কোনকিছুরই অভাব নেই। যতরকম বীমা মানুষের দরকার হতে পারে সবই আছে। তবু যেন প্রাণের ভেতরে এমন গুরুগুরু ধ্বনি।

গুরুগুরু ধ্বনি কারণ প্রাচুর্য মানুষের একটা অভাবকে মোচন করে দিলেও আরেকটা অভাবকে হাজারগুণে বাড়িয়ে দেয়। ছোট একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। কিছুদিন আগে ঢাকার কাগজপত্রে একটা চাঞ্চল্যকর খবর বেরুল। অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত পরিবারের এক বর্ষীয়সী মহিলা। একটা অত্যাধুনিক হাইরাইজ বিল্ডিং-এর ফ্যাসনেবল অ্যাপার্টমেন্টে নির্ঝঞাট জীবপযাপন করছিলেন কয়েকবছর ধরে। তাঁর লব্ধপ্রতিষ্ঠিত ভাইবোনদের কেউ দেশে, কেউ বিদেশে। এমন কেউ নেই তাঁর পরিবারে যার যশকীর্তির কথা সর্বজনবিদিত নয়। মহিলাটি বোধ হয় ছিলেন সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠা। ছেলেমেয়েরা সব প্রবাসে স্থায়ীভাবে বাস করছে, স্বামী প্রয়াত। একদিন প্রতিবেশীরা লক্ষ্য করলো তাঁর অ্যাপার্টমেন্টের কাছ থেকে একটা গন্ধ রেরুচেছ। প্রথমে খুব একটা গ্রাহ্য করেনি কেউ। তারপর গন্ধটা আন্তে আস্তে উগ্র হতে লাগলো। শেষে এমন হলো যে এপাশে ওপাশে যারা ছিল তারা নিজের বাড়িতেই টিকতে পারছিল না দুর্গন্ধের জন্য। দরজার বেল টিপে আর ধাক্কাধাক্কি যখন কারো সাড়া পাওয়া গেল না তখন লোকে পুলিশে খবর দিল। পুলিশে এসে দরজা ভেঙে আবিষ্কার করলো ভদ্রমহিলার স্ফীত, গলিত, বিকৃত শবদেহ। পোকায় গিজ গিজ করছে, মাছি ভনভন করছে। অন্তত চার পাঁচদিন ধরে মরে পড়েছিলেন ওখানে। সেই ভ্যাপসা গরমের দিনে। কেউ জানতে পারেনি। কেই টেলিফোন করেনি হয়তো। কেউ খবর নেয়নি। খবর নেবার সময় কারো নেই আজকাল। সবাই নিজেদের জীবন নিয়ে ব্যস্ত। সবারই নির্ঝঞঝাট জীবন। নির্ঝঞঝাট মৃত্যু। দাফনের আগে অভুক্ত মাছি আর পোকাদের ভোজের বস্তু। খবর শুনে সাড়া পড়ে গিয়েছিল সমস্ত শহরে। পাষাণ পরিবার বলে গালাগাল করেছিল কেউ কেউ। কোন কারণ ছিল না গালাগাল করার। যাদের সব থাকে তারাই একসময় বড় একা হয়ে পড়ে। নিঃসঙ্গতাই আধুনিক নাগরিক জীবনের সবচেয়ে বড় শত্রু। প্রাচুর্যের প্রবলতম প্রতিপক্ষ।

আমরা যারা ষাটের দশকের অভিবাসী তাদের বেশীরভাগই একন কর্মজীবন থেকে অবসর নিয়েছি। তারা কে কোথায় কি ভাবে আছে সে খবর রাখার সময় নেই কারো। যৌবনে আমরা কেউ ভাবিনা যে একদিন আমাদের কথা কেউ ভাববে না। আমার মনে আছে কার্যের শেষের দিকে যখন চাকরী জীবনে মোটামুটি একটা স্থায়িত্ব এলো, প্রমোশন হল একটা, দুটি সোনার টুকরো সন্তান জন্মালো, তখন নিজেকে বললাম চাকরী থেকে অবসর নেবার সাথে সাথে দেশে ফিরে যাব। অর্থাৎ জীবনটা দেব এদেশকে মরণটা দেব ওদেশকে। এই ছিল আমার দেশপ্রেমের দৌড়। তখন অবশ্য ভাবিনি যে অবসর পাবার পরেই আমার হার্ট অ্যাটাক হবে। ভাবিনি যে পক্ষাঘাত হয়ে আমার জীবনসঙ্গিনী গৃহবন্দী হয়ে থাকবে চিরকাল। স্বাস্থ্য যখন থাকে মানুষ তখন স্বাস্থ্যহারাদের কথা কল্পনা করতে পারে না। স্বাস্থ্য ভাল হলেও কি আমরা দেশে ফিরে যেতাম? মনে হয় না। দেশে গেলে কি কেউ আমাদের মাগনা ওষুধ দেবে? ডাক্তার কি তার পয়সা মকুব করবে? বাসে ট্রেনে প্লেনে কি কম ভাড়া নেবে? তার ওপর আছে দুই ছেলে। আমরা চলে গেলেও ওরা তো যাবে না। তাহলে বাঁচবো কেমন করে? তাই এখন আর ওটাও বলিনা যে দেশকে দেহটা দিয়ে ধন্য হব। এ কথার খেলা মাত্র। আত্মছলনা। ওই ঘোর যত তাড়াতাড়ি কাটে ততই ভালো। এখন প্রশ্ন হল অবসর জীবনটা কেমন করে কাটাই?

আমার বন্ধুবান্ধব আর চেনাজানা লোকদের কথা যতটুকু জানি তাদের বেশিরভাগই বাড়ি বিক্রি করে কন্ডোতে উঠে গেছেন। নিজের বাড়ি ছেড়ে অ্যাপার্টমেন্টে উঠে যাওয়া সহজ নয় এই বয়সে। অনেক স্মৃতি ফেলে যেতে হয়। অনেক হাঁসি কান্নাকে বুক থেকে নামিয়ে দিতে হয়। ছেলে-মেয়েরা হয়ত ওখানেই জন্মেছে, বড় হয়েছে, হই হল্লা করেছে, রাগ করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে। ওই বাড়িটাই ওদের বসতবাটী, যেখানে ওরা বারবার ফিরে আসতে চাইবে। ওখানেই আমরা বছরের পর বছর ধরে ফুলের গাছ লাগাই, সবজির চাষ করি, অতিথি খাওয়াই, পার্টি করি, রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনি। তারপর একদিন শরীর ঘোষণা করে, এখানে আর নয়। তখন বাধ্য হয়ে দালাল ডেকে উঠোনে সাইনবোর্ড ঝুলাই ‘ফর সেল’। আমার দুজন বন্ধু ইদানিং কন্ডোতে চলে গেছেন। কারো স্ট্রোক, কারো বাইপাস সার্জারি, কারো বহুমুত্র। শুধু বলবো এরা ভাগ্যবান কারণ এঁদের জীবন একেবারে নিঃসঙ্গ নয়। আর কেউ না থাকলেও পরস্পর আছে। কান্না পেলে আরেকটি বুক আছে মাথা পেতে কাঁদবার মত। কিন্তু অনেকে আছে যাদের তা নেই। যাদের জীবন সঙ্গীরা চোখ বুজেছেন। আমি এক ভদ্রমহিলাকে চিনি যার স্বামী একসময় প্রবাসী বাঙ্গালী সমাজের অত্যন্ত গণ্যমান্য সদস্য ছিলেন। এখন তাঁকে কেউ চেনে না। কাঁদবার মত বুকটিকে তিনি হারিয়েছেন ক্যান্সারের কাছে। দেশে তার মা ছিল, ভাই ছিল, বোন ছিল, চাচা মামা ফুফু বালা সবাই ছিল। কিন্তু ছেলেরা এখানে, মেয়েরাও এখানেই বিয়ে-থা করে সংসার পেতেছে। সুতরাং তাঁকে এখানেই থাকতে হল। কিন্তু ঠিকানাহীন উদ্বাস্তুর মত। আজ এক ছেলের বাড়িতে, কাল অন্য ছেলে, তারপর হয়ত মেয়ের বাড়িতে দুদিন। এর নামও জীবন, কিন্তু যে জীবনের স্বপ্ন নিয়ে আমরা প্রবাসে আসি সে জীবন নয়।

পশ্চিমের কল্যাণভিত্তিক সমাজেও বার্ধক্য একটা বিরাট সমস্যা, তবে সামাজিকভাবে যতটা তার চেয়ে অনেক বেশী হল জাতীয়ভাবে। বুড়োদের দেখাশুনার জন্য রাষ্ট্র প্রচুর ব্যয়বহন করে। তাতে কারো আপত্তি নেই, কিন্তু মুস্কিল এই যে বুড়োদের সংখ্যা আনুপাতিকভাবে বেড়েই চলেছে। ফলে অল্প থেকে অল্পতর সংখ্যার উপার্জনক্ষম

নাগরিককে সামাল দিতে হচেছ ক্রমবর্ধমান এবং দীর্ঘায়ুশীল একটি জনগোষ্ঠীর ভারণপোষনের খরচ। সুতরাং বর্তমানের ভীষণরকম উদারমনা রীতিনীতি কতদিন টিকে থাকবে সেটা বলা মুস্কিল। তবে যতদিন টিকে আছে ততদিন আমাদের বুড়োদের কারো অর্থাভাবে, অনাহারে বা বিনা চিকিৎসায় কষ্ট পাওয়ার ভয় নেই। যে ভয়টা এখনো আছে সেটা হল নিঃসঙ্গতার ভয়। এ ভয় চিরকালই থাকবে। বেলা ডুবলে রাত হয়, আঁধার আসে। বুড়ো হলে একলা হওয়াটাও ওই আঁধারের মত। কিন্তু পশ্চিমের সামাজে বুড়োরা যখন নিজেদের দেখাশুনা করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে বা জীবনসঙ্গীকে হারিয়ে সম্পূর্ন একা হয়ে পড়ে তখন পরিবারের অন্যান্যরা তাদের আশ্রমে নিয়ে যায়। অর্থাৎ পরলোকে যবার আগের সময়টুকু তাদের আশ্রমেই কাটে। ওটাই তাদের জীবনের শেষ স্টেশন। মোটামুটি ভাল ব্যবস্থা। প্রায় সমবয়সী লোক সবাই, নিজের নিজের ঘর আছে, নার্সেরা চব্বিশঘন্টা পরিচর্যা করে, আর্দালিরা নানারকম ফুটফরমাশ করে দেয়। কমনরূমে টেলিভিশন আছে, খেলাধুলার সরঞ্জাম আছে, ব্যায়ামচর্চার সুবিধা আছে। অক্ষম দেহে এর চেয়ে বেশী আর কিসেরই বা প্রয়োজন হতে পারে। তবু আমরা সেখানে যেতে চাই না। আমাদের বুড়োবুড়িরা এদেশের হোমে যেতে ভয় পায়। ওখানে গিয়ে আমরা লুঙ্গি বা ধুতি পরে ঘুরে বেড়াতে পারব? আজান দিয়ে নামাজ পড়তে পারব? সুর করে কোরানশরিফ পড়তে পারব? কিংবা গীতাপাঠ বা পূজা অর্চনা করতে পারবো? বুড়োবয়সে এই সবই তো আমরা করি সচরাচর। অর্ধেক সময় বাড়িতে অর্ধেক সময় মসজিদে বা মন্দিরে। তাই হোমে থাকবার কথা ভাবতেই আমাদের গা হিম হয়ে যায়। কালচার শক বলতে যা বোঝায়, যা আমরা ত্রিশচল্লিশ বছর এ দেশে থেকেও অতটা টের পাই না, তা যেন জোয়ারের প্রাবল্য দিয়ে হানা করতে শুরু করে হোমে যাবার কথা চিন্তা করে। এ দেশটা সোনার দেশ সন্দেহ নেই। কিন্তু বুড়োদের জন্য নয়। আমাদের দেশে জীবিকার নিশ্চয়তা হয়তো আর নেই, জীবনের নিরাপত্তাও হয়তো একেবারে ধ্বংস হয়ে গেছে, তবু মৃত্যুর নিরাপত্তা এখনো মোটামুটি অটুট আছে বলে মনে হয়। অন্তত দুর্ভাগ্যবান না হলে ওখানে কেউ একলা মরে না। সেই যে উঁচুঘরের মহিলা নিজের বাড়িতে মরে পড়ে থাকলেন, এটা নব্যধনীদের সমস্যা, দেশের আপামর জনসাধারণের সমস্যা নয়। কিন্তু এখানে অন্যরকম। এখানে জীবনের নিরাপত্তা আছে, কিন্তু একলা ঘরে মরে থাকাটা এখানে মোটেই অস্বাভাবিক নয়। আশ্রমে যেতে পারলে এই একলা মরার সম্ভাবনাটা কমে যায়।

আমাদের এই শহরে অনেক হোম আছে। বেশিরভাগই বেসরকারী তবে কিছু কিছু সরকারী হোমও আছে। ইহুদি সম্প্রদায় নিজেদের জন্য কিছু হোম বানিয়েছে। সম্প্রতি ইটালির শ্রমিকশ্রেণীর সম্প্রদায়ও একটা ইটালিয়ান আশ্রম বানিয়ে ফেলেছে। শুনেছি এমন আরো কিছু সম্প্রাদায় নিজ নিজ কালচারের বয়োজ্যেষ্ঠদের জন্য আশ্রম বানাতে শুরু করেছে। কিন্তু আমরা এখনো মসজিদ আর মন্দির বানাতে ব্যস্ত। আমরা আওয়ামী লীগ আর বিএনপি করি, জেলা সমিতি করি, বাৎসরিক পিকনিকে যাই, সম্মেলনে গিয়ে মারামারি করি। কিন্তু ভেবে দেখছি না যে আমরা যখন বুড়ো হব তখন কোথায় আশ্রয় নেব। এই বিয়য়ের ওপর আমি আগেও লিখেছিলাম একবার। কেউ পাত্তা দেয়নি। এবারও কেউ পাত্তা দেবে বলে আমি আশা করছি না। তবু যা বলার প্রয়োজন তাকে বলে যেতেই হবে। এই প্রজন্ম না হলেও হয়ত আগামী প্রজন্মে তারা বুঝবে যে মানুষ সত্যি সত্যি একদিন বুড়ো হয়।

আজকাল কানাডা-আমেরিকার অনেক জায়গাতেই মুসলমানদের জমি কেনার হিড়িক পড়ে গেছে। বসতবাড়ির জমি নয়, কবরস্থানের জমি। নিজের জন্য, স্ত্রীর জন্য, অনেকে যারা বাবা-মাকে নিয়ে এসেছে এখানে, তাদের জন্য। শুনেছি কবরের দালালি করে কেউ কেউ নিজের কবর কেনার পয়সাও বানিয়ে ফেলেছে। ভাল কথা, চোখ বুঁজার পর যে কংকালটা থাকবে তার একটা স্থায়ী ঠিকানা হল। কিন্তু তার আগেও তো মানুষের একটা ঠিকানার প্রয়োজন। যত অস্থায়ীই হোক ওই ঠিকানাটা না হলে মানুষ সম্মানের সাথে কবরেও যেতে পারবে না। আমার মনে হয় নিজেকে শুধু ব্যক্তি হিসেবে না ভেবে একটি সম্প্রদায়ের অংশ হিসেবে ভাববার সময় এসে গেছে আমাদের। শুধু পিকনিক খাওয়া আর বিচিত্রানুষ্ঠান করার সম্প্রদায় না, ব্যাপক জনকল্যাণকর প্রকল্পে হাত দেওয়ার মত সম্প্রাদয়। অশিক্ষিত আর অর্ধশিক্ষিত ইটালিয়ানরা যদি পারে আমরা এত শিক্ষা আর গুণমানের দাবিদার হওয়া সত্বেও পারব না কেন? আশ্রম একটা প্রয়োজনীয় জিনিষ, অন্তত মসজিদের মতই প্রয়োজনীয়, সে কথাটা মনেপ্রাণে মেনে নেওয়াতেই বোধ হয় সবচেয়ে বড় বাধা। এই বাধটা অতিক্রম করতে না পারলে নিজেদের সম্প্রদায় বলার অধিকার থাকবে না আমাদের।