মুসলমানরা আবারও তীক্ষè নজরদারিতে
ডিসেম্বর ১, ২০১৪
সীমা খান
কানাডা যখন ছয় মাস বা তারও বেশি সময় ধরে ইরাকে (এবং সম্ভবত সিরিয়ায়) যুদ্ধে লিপ্ত তখন কানাডীয় মুসলমানরা আবারও তীক্ষè নজরদারিতে আছেন বলে অনুভব করছেন। ১৯৯১ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় এবং ৯/১১ এর হামলার পরবর্তী বছরগুলোতে যেমনটা হয়েছিলো তেমনই মুসলমান সম্প্রদায়কে সন্দেহ, বৈষম্য ও পাল্টা অভিযোগের বোঝা বহন করতে হবে।
আপাত দৃষ্টিতে ধর্মের নামে বিদেশের মাটিতে সহিংস চরমপন্থী কর্মকা- তাদের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ায় ইন্ধন জুগিয়েছে যারা কোনওভাবেই অন্য কোন স্থানে বর্বরোচিত কর্মকান্ডের দায়ভার বহন করেন না। ইসলামিক স্টেট-এর (যেটি আদৌ ইসলামিক নয় কিংবা স্টেটও নয়) নির্মম কর্মকান্ড ইতিমধ্যেই ঘৃণার জন্ম দিয়েছে। সেপ্টেম্বরে ক্যালগেরির একজন ইমাম দাবি করেন যে সন্ত্রাসী হিসাবে অভিহিত করে একটি গাড়ি তাকে আঘাত করেছে। আর আল্টার ফোর্ট সাসকাটচেভানে মুসলমানদের একটি নামাজের জায়গায় দুবার ভাঙ্গচুর চালানো হয়েছে। অন্টারিওর পিকারিং ইসলামিক সেন্টারের ভেতরে যখন মুসল্লিরা উপস্থিত ছিলেন তখন সেখানে গুলি চালানো হয়েছে এবং এর কয়েকদিন পর সেন্টারের কাছেই ঘৃণা প্রকাশ করে নানা ধরণের দেয়ালচিত্র আঁকা হয়েছে। একইসঙ্গে অন্টারিওর উইন্ডসরে মুসলমানের মালিকানাধীন একটি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে গুলিবর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও আরববিরোধী দেয়ালচিত্র আঁকা হয়েছে।
এ ধরণের রণদামামার মধ্যে কানাডীয় মুসলমানদেরকে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে। কিন্তু তারা ইতিমধ্যেই চরমপন্থার মোকাবিলায় বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিচ্ছেন। ক্যাালগেরির ইমাম সৈয়দ সোহরাওয়ার্দী বেশ কয়েক বছর ধরে সন্ত্রাসবাদ ও পরমপন্থার স্পষ্টভাষী সমালোচক। ক্যালগেরির মুসলিম কমিউনিটি সম্প্রতি যুবকদের ক্ষমতায়নের মাধ্যমে অপরাধমূলক পরমপন্থা প্রতিরোধের ওপর এক দিনের এক শীর্ষ সম্মেলনে সামাজিক অংশীদারদেরকে সমবেত করে। অন্টারিওতেও একই ধরণের সমাবেশ অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে।
এই লক্ষ্যে কানাডার ইসলামিক সোশ্যাল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন এবং ন্যাশনাল কাউন্সিল অব কানাডিয়ান মুসলিমস-এর পক্ষ থেকে ‘‘ইউনাইটেড অ্যাগেইনস্ট টেরোরিজম’’ শিরোনামে একটি হ্যান্ডবুক বিতরণ করা হচ্ছে। এই বইতে চরমপন্থার লক্ষণ চিনতে পারা, চরমপন্থীদের বক্তব্যকে চ্যালেঞ্জ করা এবং সক্রিয় নাগরিক হিসাবে দায়িত্ব পালনে কানাডীয় মুসলমানদের জন্য নানা ধরণের সহায়ক তথ্য দেয়া হয়েছে। উভয় গ্রুপই ইসলামিক স্টেট-এর নিন্দা জানিয়েছে। হ্যান্ডবুক প্রকাশে ১৪ মাসের প্রচেষ্টায় আরএমসিপিও অবদান রেখেছে কিন্তু সেটি সেটি বিতরণ শুরুর একদিনের মাথায় আরএমসিপি ‘বিরোধিতার সুর’ তুলে এ থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেয়, কিন্তু বিস্তারিত কিছু বলেনি।
আরসিএমপির নিজেকে প্রত্যাহার করে নেয়ার পর এই গ্রুপের সুনাম আরও হোঁচট খেলো ও ক্ষতিগ্রস্ত হলো। বিপর্যয়কর মেহের আরার-এর ঘটনার পর ওই গ্রুপের সুনাম প্রতিষ্ঠায় বছরের পর বছর লেগে যায়। এই প্রত্যাহারের ঘটনায় যে বার্তা পাওয়া যায় তাও বেশ পীড়াদায়ক: ‘‘আরসিএমপি আপনার সঙ্গে মাসের পর মাস ধরে কাজ করবে এবং নিজেকে সরিয়ে নেবে’’। তরুণ মুসলমানরা এটিকে কীভাবে গ্রহণ করবে?
আরসিএমপির ওই পদক্ষেপের জন্য এর চেয়ে খারাপ সময় আর হতে পারে না।
লন্ডনের কিংস কলেজের ‘ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর দি স্টাডি অব রেডিকালিজম’এর পরিচালক পিটার ন্যুমান সম্প্রতি নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেন, ইরাক ও সিরিয়ায় পাশ্চাত্যের হস্তক্ষেপের পর থেকে ‘সহিংস চরমপন্থীদের’ মনোযোগ এখন ক্রমবর্ধমান হারে পাশ্চাত্যের দিকে ঘুরে যাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘‘জেহাদী গ্রুপগুলোর বেশিরভাগেরই পাশ্চাত্যে আক্রমণ চালানোর কোনও আগ্রহ ছিলো না। কিন্তু এখন এটিই তাদের অগ্রাধিকারের বিষয়ে পরিণত হয়েছে।’’
যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ফ্রান্স এখন অনুধাবন করছে যে, চরমপন্থী হয়ে ওঠার প্রবণতা রুখতে হলে মুসলিম সমাজের সঙ্গে সহযোগিতা বাড়ানোর কোনও বিকল্প নেই। ওমার সাকর (২৫) টাইমসকে যেমনটা বলেন, আস্থাই হচ্ছে প্রধান বিষয়। তিনি বলেন, ‘‘আমাদের মধ্যকার সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে আস্থার ভিত্তিতে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র সরকার আমাদেরকে সেই আস্থা গড়ে তোলার কোনও সুযোগ দিচ্ছে না।’’
আমাদেরকে এই আস্থার সম্পর্ক খুব দ্রুতই গড়ে তুলতে হবে। কানাডার মুসলমানরাও এই জাতির অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং নিজেদের বিশ্বাসের কারণে তাদের নিজেদেরকে একঘরে ভাবা উচিৎ নয়।
৯/১১-এর পরের দিনগুলিতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী জিন ক্রেস্টেইন অটোয়ার একটি মসজিদ পরিদর্শনের মাধ্যমে খুবই জোরালো বার্তা দিয়েছিলেন। ২০১২ সালে গাটিনিউর একটি মসজিদে ভাঙ্গচুর চালানো হলে বহুসংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রী জ্যাসন কেনিও সেই মসজিদে গিয়ে মুসল্লিদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছিলেন। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের এধরণের প্রতীকী কর্মকান্ড সামাজিক সংহতি গড়ে তুলতে সহায়ক হয়।
বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে জানতে হবে যে, কানাডার মুসলমানরা নিরাপত্তার হুমকি সম্পর্কে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে অবহিত করছে। যেমনটা প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপার গত মাসে নিউইয়র্কে মন্তব্য করেছেন, ‘‘আমাদের নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এধরণের হুমকি চিহ্নিত করতে সবচেয়ে ভালোভাবে কাজ করছে মুসলিম কমিউনিটির সঙ্গে।’’
সবশেষে বলতে চাই, কানাডার মুসলমানদেরও ব্রিটিশ ও ফ্রান্সের মুসলমানদের মতো ইসলামিক স্টেটের বিরুদ্ধে গণবিক্ষোভে এগিয়ে আসতে হবে। কোনও কার্টুন প্রকাশ করে যতটা না সম্ভব এই গ্রুপটি তার চেয়েও অনেক বেশি ইসলামকে কলুষিত করছে। আমাদের মধ্যে যত বিভেদই থাকুক না কেন প্রতিটি কানাডীয়র নিরাপত্তা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আসুন আমরা সবাই সবার সুরক্ষায় এবং সমাজের জন্য ক্ষতিকর ঘৃণার বিরুদ্ধ সচেষ্ট হই। – সৌজন্যে : দ্য গ্লোব এ্যান্ড মেইল