প্রবাসে পরহিতকর্ম -৫
নভেম্বর ৮, ২০১৪
॥ রীনা গুলশান ॥
যে কবিতা শুনতে জানে না
পরভূতের গ্লানি তাকে ভূলুন্ঠিত করবে।——
যে কবিতা শুনতে জানে না
নিঃসঙ্গ বিষাদ তাকে অভিশপ্ত করবে ।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে মূক এবঙ বধির থেকে যাবে।
যতবার এই কবিতাটি পড়ি ততোবারই জীবনটাকে এত সুন্দর মনে হয়। তখন বারবার আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ কবিবরকে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে প্রণতি জানাই। সত্যিই তখন হৃদয়ের ভেতরে একটি মিষ্টি বেদনা তোলপাড় করে, আহা — জীবনটা সত্যিই যদি কবিতার মত ছন্দময় হতো!
কিন্তু, না জীবনটা ‘কবিতা’ নয়! — হঠাৎ মুঠোফোনটা বেজে উঠলো। একজন অপরিচিতা— চিনিনা — সালাম জানিয়ে অত্যন্ত ভদ্র কন্ঠে বললো – সত্যিই কি আপনি মনে করেন মহিলাদের ৯১১ কল করা উচিৎ নয়?
আমি একটুও থমকে যাইনি। বা অপ্রস্তুতও হয়নি। শান্তভাবে বললাম, আমার গত সংখ্যার লেখাটি ভাল করে পড়েন। তাহলেই বুঝবেন। অযথা ৯১১ কলা করা উচিৎ নয়। কোন কিছুই মাথা গরম করে উচিৎ নয়। এমন অনেক ঘটনা জানি। এক মহিলা (টরন্টোতেই থাকেন) ৯ বার ৯১১ এ কল করেছেন। এবং প্রত্যেকবার কল করার পর অনুশোচনায় ভুগেছেন। শুধু তাই নয়, একাধিকবার সে ৯১১ এ কল করার পর যখন পুলিশ এসেছে তখন সে বলেছে – আমরা কল করিনি। কিন্তু পুলিশেরতো কলার আইডি আছে। পরে মহিলাটি বিপদ দেখে মিথ্যা কথা বলেছে। পুলিশকে সে বলেছে- হয়তো আমার বাচ্চারা ভুল করে এটি করেছে।
কিছু দিন আগের কথা (৭/৮মাস আগে সম্ভবত)। আমার এলাকাতে, খুব কাছে না হলেও খুব দূরেও নয়। এক বাড়ীর সামনে দেখি ২/৩টি পুলিশের গাড়ি। তখন বিকেল ৪টা কি ৫টা হবে। তারপর রাত ৯টার দিকে ওরা চলে গেল। ওদেরই এক প্রতিবেশী যারা আমাদেরও পরিচিত, তাদের কাছে জানলাম- গত রাতে পুলিশ কল করেছিল ঐ বাড়ির মহিলাটি। ঘটনাটি এ রকম- স্বামীটি (মাসুদ) একজন ট্যাক্সি চালক। অথচ দেশে তিনি খুব বড় মাপের একাউন্টেন্ট ছিলেন। এখানে কোন ভাল জব না পেয়ে ট্যাক্সি চালানো শুরু করেন। কিন্তু মনে মনে মনে স্বপ্ন দেখছিলেন কিছু অর্থ জমিয়ে একটা নিজস্ব ব্যবসা প্রতিষ্ঠা করার। তাই দীর্ঘ ৪/৫ বছর ধরে একটু একটু করে অর্থ জমাচ্ছিলেন স্ত্রীর কাছে। স্ত্রীকে প্রতিনিয়ত বলে আসছিলেন, লিয়া আমাদের এই দিন আর খুব বেশী দিন থাকবে না। খুব শীঘ্রই আমাদের নিজস্ব একটি ব্যবসা হবে। আমরা দুজন মিলে সেই ব্যবসা চালাবো। মাসুদ সাহেবের দীর্ঘ দিনে স্বপ্ন। জলদি বাস্তবায়িত হবে এই স্বপ্œ চোখে। মনের ভিতর ছিল এক উদ্বেলিত আনন্দ। একজন পরিচিত বন্ধু খুব চালু অবস্থায় একটি ব্যবসা বিক্রি করে দিচ্ছে। সেই লোক মধ্যপ্রাচ্যে ভাল বেতনের একটি জব পেয়ে সে দেশে চলে যাচ্ছেন। এখন দ্রুত একজন খরিদদার খুঁজছেন। জলের দামে বিক্রি করে দিবেন ব্যবসাটি। মাসুদ সাহেব সুযোগ বুঝে চাপাচাপি করে, ক্যাশ দিব ভাই। আরেকটু দাম কমান। ইত্যাদি বলে বেশ কমে রাজী করিয়ে দৌড়ে স্ত্রীর কাছে এসেই চিৎকার করে আনন্দে ফেটে পড়ছিলেন। লিয়া কৈ গেলে। আমি যে টাকা অফার দিয়েছিলাম মবিন ভাই শেষ পর্যন্ত তাতেই রাজী হয়েছে। জলদি করে ক্যাশগুলো দাও। আজই দোকান আমাকে বুঝিয়ে দিবে।
লিয়া কথাই বলে না। স্বামীর আনন্দে অংশীদারও হয় না। যাই হোক, দীর্ঘক্ষণ পর যখন ক্যাশ এনে দিল, তখন দেখা গেল অর্ধেকেরও কম। মাসুদ সাহেব প্রথমে ভেবেছিল তার স্ত্রী বুুঝি মজা করছে। তাই তাড়াতাড়ি করে বলেন, বাকী ক্যাশ কই। এখন কি মজা করার সময়? লিয়া তখন আমতা আমতা করে বলে : আমি মজা করছি না। এখানেই সব ক্যাশ। মাসুদ সাহেব হতভম্ব কন্ঠে বলেন, মানে কি? বাকি অর্থ কোথায় গেল? তখন ধীরে সুস্থ্যে লিয়া বলে, আমার বাবাকে পাঠিয়েছি।
পাঠক বুঝতেই পারছেন এর পর কি হতে পারে। আমি ওখানে ছিলাম না। তবে আন্দাজ করতে পারি, হয়তো কিছু চিৎকার, জিনিষপত্র ছুড়া ছুড়ি হয়েছে। হয়তবা কিছু চড় থাপ্পরের ঘটনাও ঘটেছে। আমি জানিনা। তবে মহিলা যে পুরো অক্ষত ছিল তা বলা বাহুল্য। বাচ্চাগুলোও সব বেশ বড়সড়ই। গ্রেড টুয়েল্ভ, গ্রেড এইট, গ্রেড থ্রি। তারাও পুলিশকে কিছু বলেনি। মাসুদ সাহেব পরের দিনই থানা থেকে ছাড়া পেয়ে চলে এসেছেন। তবে সে তার নিজের বাসায় আসেননি। বোনের বাসায় চেলে গেছেন। এরপর কি হয়েছে আমি জানিনা। জানতে চাইও না।
পুরো বিষয় বস্তুটার উপর আলোকপাত করতেই আমার খুব খারাপ লাগছে। খুবই অস্বস্থিও লাগছে। বিরক্তিকর। বাপের বাড়িতে টাকা পাঠানো কোন খারাপ কথা নয়। অনেকের বাবা মার অবস্থা খারাপ হতেই পারে। তাদের সন্তানের উপর অবশ্যই প্রত্যাশাও থাকতেই পারে। তবে সেসব ক্ষেত্রে মাসে ৫০ থেকে ২০০ ডলার পাঠালেই স্বচ্ছন্দেই চলে যায়। কাজ চালানোর মত করে হলেও চলে যায়। কিন্তু এইভাবে স্বামীর সমস্ত স্বপ্নকে উজার করে টাকা পাঠানোর কথা ভাবাই যায় না। প্রথমত: আমানতের খেয়ানত করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত: নিজের অর্থই আত্মসাৎ। এটা খুবই ভয়ংকর অপরাধ। আমার মনে হয় না এখানে আসা কোন স্বামীই এই ধরণের ছোট মনের হয়ে থাকে। তাদের অর্থনৈতিক অবস্থান স্ত্রীর সাথে আলোচনাপূর্বক দুজনেরই বাবা
মা বা ভাই বোনদের যথা কিঞ্চিত সাহায্য করা যেতে পারে। এবং তাদের যদি সত্যিই প্রয়োজন থেকে থাকে, তাহলে সাহায্য করা অবশ্যই উচিৎ। তবে অনেকে আছে যারা (আমরা বিদেশে থাকি তো তাই কোনসময় লোক দেখানোর জন্য ডলার পাঠানো দরকার!) শো-আপ করার জন্য ডলার পাঠাতে চায়। এটা উচিৎ নয়। কারণ আমরা যারা ৪/৬ দিন কাজ করি এবং যখন চেক আসে তখন হৃদয়ঙ্গম করা যায় যে রক্ত জল করা ডলার কাকে বলে। সেই এত কষ্টের ডলার নয়/ছয় করা কি ভাল? এখানে কত মানুষ আছে ১০ বছর হয়ে গেছে দেশে যেতে পারছে না। জিজ্ঞেস করলে বলে, ভাইরে, ১০/১৫ হাজার ডলারের ধাক্কা। কোথায় পাবো?
মোটের উপর আমরা (স্বামী-স্ত্রী) মিলে যে অর্থ উপার্যন করি – খুব কম পরিবারেরই বছর শেষে সঞ্চয় থাকে। উল্টো কারো কারো মাইনাস থাকে। ক্রেডিড লাইনের ডলার তুলে সংসারের এটা ওটা করা লাগে। তাই ফ্যাশন (আমরা কানাডা আছি, তাই লোক দেখানোর জন্য ) করার জন্য দেশে ডলার পাঠানো, বড়ই বাহুল্যতা। স্বামীর সংসার যারা সত্যি খুব ভালবাসে, আমার মনে হয় না সেইসব রমনীরা এই নিকৃষ্ট মনের কাজ করবে।
আর এই ঘটনাটি বিচার করলে এটা একদম বোঝা যায়, মহিলাটির (লিয়া) ৯১১ কলা করা রীতিমত অপরাধ হয়েছে। এতো চোরের মার বড় গলা। আমি একজন মহিলাকে জানি। ৩ কন্যা। স্বামীটি নেহায়েতই ভালমানুষ। বেশ ভাল জব করেন। বর্তমানে ব্যবসা করছেন। তাদের মধ্যে যখনই কোন ঝগড়া লাগে , স্ত্রীটি এই বলে ধমকান স্বামীকে যে, একটি মাত্র কল-৯১১। তারপর সারা জীবন জেলের ঘানি টানতে হবে। মনে রেখ – ইত্যাদি ইত্যাদি। ঐ স্বামী বেচারা একদিন আমার স্বামীকে জিজ্ঞাসা করছে, ‘ভাই আপনার বউ কি ৯১১ এর ভয় দেখায়? ভাইরে, এটা কোন দেশে এলাম? স্বামীরে কোন রেসপেক্ট তো করেই না, উল্টো ভয় দেখায়! একদিন ভাবছি সত্যিকার অর্থেই বউয়ের ঘাড় চেপে ধরে নিজেই পুলিশ কল করবো। ঘারে তেল জমেছে।’ হা -হা – হা, স্বামী বেচারা স্ত্রীর ঘাড় কখনোই চাপেনি। এবং ওরকম কোন ঘটনাও কখনো ঘটেনি। তারা বেশ সুখেই আছে।
আমি জানি এই ৯১১ সত্যিকার অর্থেই কোন বিপদগ্রস্থ মানুষের জন্য করা হয়েছে। এটাকে মোটেও মিসইউজ করা উচিৎ নয়। আমি মনে করি যাদের নিজেদের মনের জোর কম, তারাই অন্যের সাহায্য নিতে পছন্দ করেন । বর্তমান বিশ্বে মহিলারা কি না করছে! কোন পেশায় তারা নেই? দেশ চালানো থেকে প্লেন চালানো এমন কি মহাকাশও জয় করছেন এই মহিলারা। অতএব নারীরা এই প্রবাসে – আপনরা সবাই ভাল আছেন। পরম নিরাপত্তায়ও আছেন। তবে এই প্রবাসে , প্রত্যেক রমনীদেরকেই কিছু না কিছু কাজ করা উচিৎ। আমি অনেক মহিলাদের জানি, যাদের স্বামীরা উদয়স্থ পরিশ্রম করছেন, কিন্তু তারা কাজ করতে চান না। সারাদিন টেলিফোন অথবা ল্যাপটপে চ্যাট করছেন, টিভি দেখছেন অথবা শপিং করছেন। আর শপিং করার সময় এটাও ভুলে যান যে এই ডলার কত কষ্টে আয় করা হয়েছে। একজন মহিলাতো ‘ঈদ বাজার’ থেকে একই ডিজাইনের নানা রং এর ১৯টা ড্রেস কিনলো। আমার তো অক্কা পাবার দশা। বলাম, কি করছেন ভাবী, ১৯টা! তিনি অম্লান হাসি হেসে বললেন, আরে রোজার ঈদ বলে কথা। তাছাড়া আমার আবার প্রায়ই পার্টি-ফার্টি লেগে থাকে।’ শপিং ব্যাগগুলো সবই বেচারা স্বামীর হাতে। উল্টো একটা ভালবাসার ধমকানী দিলেন ভাবীসাহেবা- ‘এই তুমি আমাদের মহিলাদের প্যাচাল খাড়াইয়া খাড়াইয়া কি শুনতাছ? আগাইয়া যাও।’ স্বামীর মুখ ততক্ষনে চুপসানো বেলুনের মতো। এবং হৃদয়টা অবশ্যই বারবিকিউর মতো ঝলসানো। হায়রে শপিং। প্রবাসে পরহিতের মনোবাসনায় বললাম (একটু মিউঁ মিউঁ করে) ভাবী কিন্তু সবগুলোই প্রায় একই ডিজাইন। বাপরে, তড়িৎ জবাব- ‘আরে বোঝেন না, ডিজাইন এক হইলে কি অইবো? ম্যাটরিয়াল কারুকাজ এক নয়। আর এইডা বাংলাদেশ পাননাই, এইখানে নানান সমস্যা, এক পার্টিতে একটা ড্রেস পরলে ঐটাতো আর রিপিট করা যাইবো না।’ আমি হতভম্ব কন্ঠে বলালাম – ওমা, তাই নাকি? এতো দেখি বিরাট সমস্যা। ‘হ্যা, আর বইলেননা। খাই না খাই শাড়ি এবং ড্রেস কয়েকটা নতুন রাখাই লাগে।’ আমি তখন বেশ নিরীহ কন্ঠে বললাম, তা এই সব পার্টিতে আপনারা করেনটা কি? তাছাড়া বাচ্চাদের পড়াশুনার ব্যপার স্যাপার আছে না? ‘হ, হেউডা তো আছেই। তয় সামারে করি। হেরপর ফ্রাইডে নাইট আর সাটারডে নাইটেই করি আমরা।’ হু। করেনটা কি এই সব পার্টিতে? ‘এই গপসপ করি। ভিন্ন ধরনের রান্না টেস্ট করি। তাছাড়া কত কি আলাপ আলোচনা। (পরচর্চা যে কি মজার!) তার কি শেষ আছে! এই মরার দেশ, বোঝেন না, কামের লোক নাই, কষ্ট করতে করতে মইরা গেলাম! (দেখে মনে হলো না, গোটা শরীরটাই চর্বির পাহাড়! চকচকে মুখাবয়াব) হাত দুইটা ছিল্যা গেলোগা ধুইতে ধুইতে আর পুলাপানগোর লাইগা নানার রান্না করতে করতে (কিন্তু হাত দুটো তো সুন্দর পারপল রঙের মেনিকিউর করা!)। বলাম, আপনার হাত দুটো তো সুন্দর চক চক করছে। একটুও নষ্ট হয়নি, এত কাজ কাজ করেন। সাথে সাথে তিনি মিষ্টি হাঁসি ঝরিয়ে বললেন ‘হেইডা ঠিকই কইছেন। রনির (ছেলের নাম) বাপেও একই কথা কয়।এইর লাইগা অফিস যাওনের আগে দিয়া হাড়িপাতিল সব ধুইয়া দিয়া যায়। এমনকি ভাতের চাইলও ধুইয়া দিয়া যায়। এমন ভাল মানুষ জীবন কালে দেখবেন না।’
হায় আল্লাহ! বিশাল ছক্কার আকারে একটি দীর্ঘশ্বাষ ফেললাম। ছেলেদের ভবিষ্যত (২টাই তো ছেলে আমার) চিন্তা করে। স্ত্রীর মুখে ভাল শোনা চাট্রিখানে কথা নয়। কিন্তু তার জন্য তাদের কত ধরনের পাপর বেলতে হবে কে জানে।আর তিন দশক পরে মনে হলো হায়রে আমার ঘরের মানুষটারে। তো এই ভাবে কখনো ধরিইনি – হু! আর ছাড়া ছাড়ি নাই- দেখি আজই- আচ্ছামতন ধরতে হবে।
কেন রে ভাই। এই যে তিরিশটা বছর ধরে -এই যে ভালবাসার এত কথোপথন, সবই কি কথার কথা–! ভালবাসর এই রকম দেখানেপনাতো, কখনোই দেখলাম না! তবে কি আমাকে কখনোই ভাল লাগেনি? ভালবাসেনি??
হায়রে! এখন আর জিজ্ঞাসা করলেই বা কি? না করলেই বা কি! বরং, জিজ্ঞাসা করলেই গভীর সমস্যায় পড়বো। স্বামী বেচারা গভীর গাড্ডায় পড়বে। বউটা কি কানাডায় এসে ‘খাইট্যা খাইট্যা’ বোধ হয় সত্যিকারের অর্থে পাগলই হয়ে গেল নাকি? তখন আবার টরন্টো টু হেমায়েতপুর টিকিট কাটতে পারে। সে আবার বড়ই সিরিয়াস ধরনের মানুষ। ৩০ বছর পর আমার দরকার নেই বাপু, নতুন ধরনের ভালবাসায়। বরং ভালবাসারে আমি ইদানিং বড়ই ডরাই—বড় হ্যাপা ভালবাসার দাবী গুলোর!!
অবশেষে নচীকেতার বিখ্যাত গানটি হেড়ে গলায় গেয়ে উঠলাম ‘এই বেশ আছি….।’
রীনা গুলশান