প্রবাসে পরহিতকর্ম -৪

অক্টোবর ৫, ২০১৪

রীনা গুলশান ॥

ভাবলাম বিবাহ দেয়া অনেক হলো। তাই ক্ষান্ত দিলাম। তাছাড়া গ্রীষ্মকালে বিবাহ ঠিক হয়ে গেলেও বড়ই হ্যাপা। ব্যাংকুয়েট হলগুলো নানাভাবে দর চড়িয়ে দেয়। কি দরকার বাবা, শীতকালেই দেওয়া যাবে। অতএব অন্য কোন পরহিত করা যাক। মানুষের ভিতর পরহিত করার যদি প্রবনতা থাকে তাহলে এই প্রবাসে অনেক কিছুই করবার থাকে। বিশেষত, বর্তমান সময়ের কিছু কিছু সমস্যা রীতিমত মহামারির আকার ধারণ করেছে। ভীতিকর। উঠতি বয়সী বাচ্চাদের নানাবিদ সমস্যা এবং অবশ্যই বিবাহিত জীবনগুলোর বিশৃঙ্খল পরিনতি। আমরা অনেক সময় নিজেকে সাহায্য কাতে পারি না। কিন্তু অন্যকে পারি। এমনকি নিজের কিসে ভাল হবে, আমর সত্যিই বুঝতে পারিনা। সেক্ষেত্রে কেউ যদি একটু বুঝিয়ে দেয়, তাহলে তার উপদেশ শুনলে কোন অসুবিধা নেই। সাধারণত, শুভাকাঙ্খিরা তাদের জীবন থেকে নেওয়া উপদেশই দিয়ে থাকে। অনেকেই ভেবে নেন, “ইশ! বড় উপদেশ দিতে এসেছে, কেন রে বাবা, আমি কি কম বুঝি নাকি?

আমি নিজেই এরকম বিপাকে যে পড়িনি তা নয়। আমরা যখন কানাডাতে এলাম তার ঠিক ৬/৭ সপ্তাহ আগেই এলো আমার বড় ভাইয়ের একজন অন্তরঙ্গ বন্ধু। পারিবারিক বন্ধুই বলা উচিৎ। আমরা লেকের পাড়ে হাইরেইজ বিল্ডিং এ বাসা নিলাম (১৯ তলাতে)। আমার ব্যালকনিতে দাড়ালেই গভীর সমুদ্রসম লেক আর বাড়ির গা ঘেষেই হাই-ওয়ে। ভাইয়ের বন্ধু হিমেল ভাই ফোনে খুব উচ্চকিত কন্ঠে বললো, ওমা! রীনা তোরা ওখানে বাসা নিয়েছিস? আমরা এখনো ডাউনটাউনটা দেখিনি। তাহলে সামনের রবিবারেই তোর বাসায় আসি, কি বলিস? তোদেরও দেখা হবে একই সাথে। নিম নিম কন্ঠেই বললাম- ঠিক আছে। কারণ, তখনও আমরা কোন ফার্নিচার কিনিনি। শুধুমাত্র কুইন সাইজের দুটো গদি আর ছেলেদের পড়াশুনার জন্য কম্পিউটার। আর রান্নাবান্নার জন্য টুকটাক ছোট ছোট বাসন কোসন। যথা সময়েই হিমেল ভাই এবং জলিভাবী এবং একমাত্র কন্যা অনন্যা এলো। আমি মোটামুটি সকালে উঠেই রান্না করে ফেলেছি। যাতে করে ভাই ভাবীর সঙ্গে তুমুল আড্ডা মারা যায়। তো জলিভাবী প্রায় পুরোটা সময়ই ব্যালকনিতে দাড়িয়ে লেকের শোভা, অগুনিত গাড়ির দেখে চললো। মনে মনে ধাক্কা খেলাম। এখনো দেখি আগের মত ভাবসাব। তবে যে শুনেছিলাম তাদের সম্পর্কের উন্নয়ন হয়েছে! বাংলাদেশে যখন ছিল, তখনই শুনেছিলাম তাদের সম্পর্কের অবনতির কথা। জলিভাবী একবার প্রায় দেড় বছরের মতো বাপের বাড়ি গিয়ে ছিল। সে সম্পর্কের অবসান চাইছিল। তারপর হিমেল ভাই কানাডা আসবার প্রসেসিং শুরু করলো। তখন শুনলাম দুজনের প্রেম আবার বঙ্গোপসাগরের মত উথলে উঠেছে। আমার দেখে খুব ভাল লেগেছিল। কিন্তু আমার ভাইয়া খুবই সংশয় প্রকাশ করেছিল। আমাকে বলেছিল, হিমেল একটা প্রচন্ড গাধা, ঐ মেয়ে ওকে মোটেও ভালবাসে না। জাস্ট কানাডা যাওয়ার জন্য ভাব ধরেছে!

দেখলাম জলিভাবী গোটা সময়টাই হিমেল ভাইয়া থেকে দূরে দূরেই রইল, এমনকি একসাথে খেলোও না এবং বললো- (আমার স্বামীর দিকে তাকিয়ে) ‘কাজিম ভাই আপনারা খেয়ে নিন, আমি আর রীনা পরে খেয়ে নিব।’ যখন আমরা খেতে বসলাম তখন কথায় কথায় জলিভাবীকে বললাম, শুকরিয়া আল্লাহ পাক যে আপনাদের দীর্ঘ দিনের বিতন্ডা ঠিক হয়ে গেছে। সাথে সাথেই ভাবী মুখ বাঁকিয়ে বললো, ‘হু, তুমি এত বোকা! এই বিতন্ডা কোন দিনই ঠিক হবার নয়।’ আমি বোকা বোকা মুখ করে বললাম, ‘তাহলে যে বড় মিটিয়ে ফেললেন বাংলাদেশে সব!’ আরে এটাতো নিজের ভবিষ্যতের (ক্যারিয়ারের কথাটি বলেছিল) কথা ভেবে।’ ণড়ঁ শহড়ি ংড়সবঃরসব বি যধাব ঃড় ঃযরহশ ধনড়ঁঃ ঃযরং ধিু.

ওমা! এ দেখি আবার ইংরেজী বলে। কি সর্বনাশ। হিমেল ভাইয়ের কথা ভেবে একরাশ বিষন্নতায় মনের আকাশ ভরে গেল। মাত্র একমাস টরন্টোতে এসে ইংরেজী বলা শুরু করেছে। কারণ, যতদূর জানি ৩ অথবা ৪ বারের বার এসএসসি পাশ করেছে। কদিন পরতো দেখি ফ্রেঞ্চ বলা শুরু করবে! হা! হতোষ্মি!! এ ক্যামোন জীবন? মানুষ চালে, আটায়, তেলে এসবে ভেজাল দেয় জানি। কিন্তু ভালবাসাতে কিভাবে ভেজাল দেয়? সেই সত্য যুগের, সত্য প্রেম কোথায় গেলিরে তোরা সব? যাই হোক অবশেষে আমার এবং কাজিমের পূন: পূন: মিটিং (রাতের পর রাত লেকের পারে ব্যালকনিতে) শালিসী করে ৪ বছরের মত টিকে গেল কানাডাতে হিমেল ভাইয়ের সঙ্গে। এর মধ্যে জলি ভাবী বেশ কয়েকটি চাকরী বদলিয়েছে। (কারণ তার মেজাজও আকাশ ছোঁয়া)। অবশেষে একটা ডলার স্টোরে তার জব হলো। সেখানেই তার কাঙ্খিত পুরুষের দেখা পেল। সারা জীবন সে যা চেয়েছে -অসম্ভব সুপুরুষ, (আর কিছুই তার কাছে তেমন গুরুত্ববহ ছিল না) তার দেখা পেল। আর তখুনি বিশ্বভূবন ভুলে গেল। ভুলে গেল এতদিনের সাজানো সংসার, এতদিনের প্রেমময় স্বামী, ১৫ বছরের নিজ গর্ভজাত কন্যা, সব ছেড়ে সেই নায়কের বাহু ধরে চলে গেল। একেবারে ডিভোর্স দিয়েই গেল। একেবারের জন্যই গেলো। পিছনে পড়ে রইল দুঃখের সাগরে হাবুডুবু খাওয়া হিমেল ভাইয়া। অসম্ভব ব্যাথার ভারে নিমজ্জিত, হতভম্ব অনন্যাকে। টিন এজ কন্যা। এ বয়সী একটি মেয়ের একটি চারদিকের জগৎ থাকে অসম্ভব স্বপ্নিল, মায়াময়। তারা জীবনের সবকিছুতেই ভালবাসার রং চড়াতে ভালবাসে। এরই মধ্যে অনন্যার

অনেক বন্ধু হয়েছে। যদিও এটা কানাডা। তবুও মেয়েটি দুঃখের ভারে এতটাই কাতর হয়ে গেল যে, বহুদিন স্কুলে গেলনা। বন্ধুরা কেউ বাসায় দেখা করতে আসলে বাবাকে বলতো, বলে দাও আমি বাসায় নেই। এদেশের মানুষের কাছে এটা কোন ব্যাপারই না। কিন্তু বেচারী অনন্যা, ওর অন্তরঙ্গ বান্ধবীগুলো সব বাঙ্গালীই ছিল।

জলি বেগম বিয়ে করলো। কোথায় যেন হানিমুনেও গেল। মজার ব্যাপার, ডিভোর্স পেপারে কন্যাকে বাবার কাছেই দিয়ে গেল। নিজের কাছে নিল না। হায় আল্লাহ। কোন মা কি এটা করতে পারে? আমি একাই ভেবে আজো তাজ্জব হয়ে যাই। তবে এটাও ঠিক,‘ আল্লাহর ঘরে ধের (আলো) হ্যায়, আন্ধের নেহী।’ হয়তোবা বাচ্চাটির দীর্ঘশ্বাষে টরন্টোর আকাশেও অনেক মেঘ জমেছিল। তাইতো জলির জীবনে খুউব শিঘ্রই দুখের বর্ষায়, সমস্ত সুখ ধুয়ে গ্যালো। যাকে বিয়ে করেছিল তার কোন কাগজই (ইমিগ্রেশন) ছিল না। আমেরিকা থেকে এসে রিফিউজি ক্লেইম করেছিল। জলিকে শুধু বিয়েই করেছিল, ভালবেসে নয়। ইমিগ্রেশন পেপারের লোভে। তা না হলে সে মোটেই কারিনা কাপুর ছিল না (যদিও নিজেকে সে ঐ রকমই কিছু ভাবতো)। তারা বিয়ে করেই উকিল নিয়োগ করেছিল। ট্যাক্স রিটার্ন (যৌথভাবে) করেছিল। কিন্তু কোন কিছুতেই কিছু হলো না। তার নতুন ভালবাসাময় জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটলো অত্যন্ত কুৎসিৎ ভাবে। কারণ, ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ তাকে ডিপোর্ট করে দিল। আর জলি ভাবীর রঙ্গীন স্বপ্নও ভেঙ্গে গিয়েছিল বিয়ের ৬ সপ্তাহ পরই, যেদিন নতুন স্বামী তাকে বলেছিল যে তার বৈধ কাগজপত্র নেই। এদিকে এ ঘটনার ছয় মাস আগেই হিমেল ভাই বাংলাদেশ থেকে একটি সত্যিকারের বাঙ্গালী ললনাকে বিয়ে করে এনেছে অন্যন্যার প্রেসারে। নতুন ভাবী অন্যন্যার সাথে রীতিমত সখ্যতা করেই হিমেল ভাইকে বিয়ে করেছে। দুজনকে দেখলে মনে হয় যেন দুই সখী। মজার ব্যাপার হচ্ছে জলি ভাবী আবারও হিমেল ভাইয়ের কাছে ফিরে যেতে চাইছে। ভেবেছে সারা জীবনের মত একটু নাকে কাঁদলেই হিমেল ভাই তাকে বুকে টেনে নিবে। আমাদের কাছে এসেও প্রচুর কাঁদাকাটি করেছে। হিন্দী সিরিয়ালের স্টাইলে ‘আমি ভুল করেছি… অনন্যার জন্য হলেও, তোমার ভাইকে বল আমাকে ফিরিয়ে নিতে।’ মজার ব্যাপার হলো, হিমেল ভাই বরং জলির পরিনতী দেখে সত্যিকার অর্থেই দুঃখিত হয়েছিল। কিন্তু অন্যন্যা! অত্যন্ত ঘৃণাভরে সারাজীবনের মত মায়ের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। হিমেল ভাইয়ের নতুন বউ এর ঘরে একটি পুত্র হয়েছে। অনন্যাই নাম রেখেছে অনিন্দ্য। অসম্ভব সুখি পরিবার। নতুন ভাবী মুবিনা খুউব সুন্দর সুন্দর রান্না করে ভাইকে খাওয়ায়। বাচ্চাদের সামলায়। অনন্যার চুল বেধে দেয়। কোন কোন সময় মা/মেয়ে বাপের পকেট কেটে জেরার্ডে শপিং এ যায়। হিমেল ভাই এখন হা হা হো হো করে হাঁসে।

এই প্রবাসেও একটি একাকী মহিলার জন্য ভাল বোধ নেই। হয়তোবা বাংলাদেশের মত তারা শারীরিক ভাবে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে না। কিন্তু মানসিক ভাবে? ওটা বরং বাংলাদেশ থেকে কোন অংশে কম নেই। এখানে কোন স্বজন নেই। যারা বন্ধুজন, তারা কতটুকু শুভাকাঙ্খী, কে জানে? এখনো মাঝে মধ্যেই আমার কাছে (কাজের স্থানে) এসে বসে থাকে। এখন কথা খুব কম বলে (আগে খুব কথা বলতো)। মুখশ্রী খুব সুন্দর ছিল। এখন ভেঙে… কেমন জানি পূর্নিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি হয়ে গেছে। চোখে, দারুন ভাঙ্গা চোরা হৃদয়ের ছায়াপাত খেলা করে। এখন প্রায়শই আমার কাছে হৃদয় তুলে ধরে। সেখানে শুধুই দীর্ঘশ্বাস, হতাশা, ব্যাপক যন্ত্রণা। অর্থ কষ্ট এবং ভুলের মাশুল খেলা করে। মানুষের জীবন একটাই। সেই জীবনে যদি একবার দরুন কোন ভুল করেন, তো ভুলের মাশুল আমৃত্যু চলতে থাকে।

তার মানে এই নয়, আপনার জীবনে কোন কিছু যদি আরোপিত ভুল থাকে, আপনি তার থেকে অব্যহতি পাবার চেষ্টা করবেন না। জীবন তো একটাই। অবশ্যই করবেন।

শুধু মনে রাখবেন আপনার নিজের জীবনটাকে নিজের হাতে প্রতিমার মত একটু একটু করে গড়বেন। ভুলের শিকার হবেন না। এই প্রবাসে অনেক কু-গ্রহের হাতছানী আছে। প্রথমতঃ ৯১১। ৯১১ আমাদের দক্ষিণ এশিয়ানদের জন্য এখন অনেকটা অভিষাপের মত হয়ে উঠেছে। দেশ থেকে আসবার সাথে সাথেই আমরা কমবেশী সব ভাল ইংরেজী বলার ইচ্ছায় ‘লিং’ এ যাই। সেখানে কতটুকু ইংরেজী শিখা হয় জানিনা, তবে ব্রেনের মধ্যে ওখানকার শিক্ষকবৃন্দ একটা অডিও ক্যাসেট সেট করে দ্যায়, ‘স্বামীরা প্রহার করা দূরে থাক, চিৎকার করিলেই ৯১১ কল করিবে।’ আরো আছে, ৯১১ কল করার পর আপনাদের জন্য আছে রেড কার্পেটের মত সেলটার আর মোটা অংকের মাসিক ভাতা। তখন ঘরে বসে পায়ের উপর পা তুলে খাবে আর বিভিন্ন মলে ঘুরে শপিং করবে।

ব্যস। এটা একটা মরন ফাঁদ। এই ফাঁদে পড়ে আমাদের দক্ষিণ এশিয়ান কত মহিলারা যে সর্বশান্ত হয়েছে তা আপনারা ভাবতেও পারবেন না। মনে রাখবেন যে, ‘চক চক করিলেই সোনা হয় না।’ দুর থেকে যা কিছু খুব উজ্জল, তার বেশীর ভাগই মরিচীকা। (চলবে)।

এই লেখার বিষয়বস্তুতে যে সব নাম ব্যবহার করা হয়েছে তা সবই ছদ্মনাম।