প্রবাসে পরহিতকর্ম -৩
সেপ্টেম্বর ৫, ২০১৪
॥ রীনা গুলশান ॥
কেউই বোঝে না, তবু আছে আরো আকাঙ্খিত সুস্নিগ্ধ জগৎ:
যখোন মানুষ তাকে দুঃখ দ্যায়,
দলবেঁধে যখোন ঠোকরায় তাঁকে নষ্ট কিছু পাখি,
তখোন ঘাসের দিকে তাকাও – দেখবে ঘাস নতমখ,
অধোবদনের কিছু ভাষাস্নেহ লেগে আছে তৃষ্ণার্ত তরুর ঠোঁটে
ভোরবেলা শিশিরের মতো।
অধিক শোকে পাথর হয়ে, বেশ কিছুটা সময় নিজেকে নিরস্ত করে রইলাম। ভাবলাম, না বাবা, অনেক হয়েছে। আর নয়। তারপরও …!! এবারে বেশ অন্তরঙ্গ একজন বন্ধু, তার কন্যার জন্য পাত্র দেখতে বললো। কন্যা সবদিক দিয়েই যথার্থ। রীতমত সর্বগুণে গুনান্বিতা প্রত্রী। টরন্টোতে সে প্রফেশনাল জবও করে। অতএব, আমিও কোমর বেধে লেগে গেলাম, সুযোগ্য পাত্রে সন্ধানে। বেশ দ্রুত পেয়েও গেলাম। দুই পক্ষই বললো, বাসায় নয়, অন্য কোথাও। অতএব, ভাল একটা রেস্টুরেন্টে গেলাম। আমরাই আগে গেলাম। পরে পাত্র পক্ষ এলো। মা বাবা ভাইসহ পাত্র নিজে। দেখা শুনা হলো। কথা হচ্ছিল একটু স্তিমিত গতিতে। মাঝখানে টুকটাক খাওয়াও হলো। হঠাৎ কন্যা উঠে দাঁড়িয়ে আমাকে চোখের ইঙ্গিতে উঠিয়ে অন্যদেরকে এক্সিকিউজ মি বলে ওয়াশরূমের দিতে গেলে। আমি ভাবলাম কন্যার বোধ হয় পাত্র পছন্দ হয়নি। কারণ, কন্যার তুলনায় পাত্রে উচ্চতা যথেষ্ট ছিল না। সমান সমান। কিন্তু পাত্রী ওদিকে গেলই না। ওয়াশরূমে গিয়ে আমাকে সরাসরিই বললো:- চাচী, পাত্র বাবা-মা’র সঙ্গে এসেছে। সেকি ওদের সঙ্গেই থাকে? আমি যারপর নাই বিস্মিত ও আহত হয়ে বললাম, তো-কোথায় থাকবে? বাবা-মা ২৭ বছর আগে এসেছে। অনেক কষ্টে দুই ছেলেকে বড় করেছে। বাড়িটা মর্টগেজ ফ্রি করেছে। এখন সুযোগ্য পুত্রের বিয়ের যোগাড়ে লেগেছে। পাত্রীর মুখ সাথে সাথে বেশ কঠোর হয়ে গেল! এবং সরাসরিই আমাকে বললো, তাহলে এখানে আমার বিয়ে করা সম্ভব নয়।
কেন? তোর সমস্যা কোথায়? ওরা অত্যন্ত ভদ্র পরিবার।
পাত্রীর একই জবাব, না না আমি কিছুতেই বাবা-মায়ের সাথে থাকা ছেলের সঙ্গে থাকতে পারবো না।
শেষ পর্যন্ত টুকটাক কথা বার্তা বলে আমরা যার যার মতো বাড়ি চলে এলাম। পাত্র পক্ষ ঐ রাতেই এসে বললো, তাদের পাত্রী খুউব পছন্দ হয়েছে। আমার তো খুশি হবার কথা। অথচ এই প্রথম মনে হলো, ওদের পাত্রী পছন্দ না হলেই বোধ হয় আমি খুশি হতাম। এখন আমি ওদের কি বলবো?
প্রায় দুই মাসের ধাক্কায় ঐ ব্যাপারটি মিটে গেল। বিয়ে হলো না। তবে পাত্র ছয় মাসের ব্যবধানেই অতি সুন্দরী এক পাত্রীর পানি গ্রহন করলো। এবং তারা বাবা-মায়ের সঙ্গেই থাকে।
ব্যাপারটি ওখানেই থেকে গেল। কিন্তু শেষ হয়ে গেল না। পর পর একই রকম ধাক্কায় আমার চিন্তা সূত্র বাধাগ্রস্ত হলো। যাদের শুধুই পুত্র সন্তান, তারা রীতিমত আলোচনা, সমালোচনায় মুখোরিত হলো। এর মধ্যে আবার একজন বেশ অন্তরঙ্গ বন্ধুর তিন পুত্র। বিয়ের পর সে স্বামীর হাত ধরে মধ্যপ্রাচ্যে পাড়ি দিয়েছিল। বছর ছয়েক হলো, কানাডায় এসেছেন। তারই চিন্তা বেশী। ৩৪ বছর ধরে যারা পরবাসী, তাদের প্রকৃত অর্থে দেশে কি শিকড় বলে আর কিছু থাকে? বাবা- মা থাকে না, ভাই-বোনরাও ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। তাহলে দেশে আর রইল কে? আমরা – অবশ্যই আমৃত্যু বাংলাদেশেরই মানুষ। কিন্তু এতকাল বিদেশে থাকার পর দেশে গিয়ে বসবাস করার কথা ৯৫% মানুষই আর ভাবতে পারে না। দেশের জন্য ভালবাসা আর, বাস্তবতা…ব্যাপারটি সত্যিই আর এক থাকে না। এক পর্যায়ে তিন পুত্রে মাতা ঝর ঝর কওে কেঁদেই ফেললো। আমাকে বললো, সত্যি আমাদের কি হবে? আমি হেসে হেসে বললাম, কি আর হবে? যার কেউ নেই, তার আল্লাহ আছেন। অত চিন্তা করার কি আছে? কানাডিয়ান ‘বৃদ্ধ-আবাস’ তো রইলই। যারা ইতিমধ্যেই নিজস্ব বাড়ীর মালিক হয়েছেন তাদেরও রীতিমত চিন্তার বিষয়। কারণ, সমস্ত বাবা-মায়েরাই যখন বাড়ী ক্রয় করেন, অবশ্যই তাদের চিন্তা চেতনায় শেকড় গেড়ে থাকে যে, ছেলে-মেয়েদের নিয়েই থাকবে। তারপর একদিন মেঘে মেঘে অনেক বেলা হয়। কন্যার বিয়ে হয়, সে তার স্বামীর হাত ধওে নিজের ঘওে যায়। অতপরঃ পুত্রের পালা, একদিন পুত্রও বিয়ে করে। একদিন সেও তার স্ত্রীর হাত ধওে নিজস্ব এপার্টমেন্টে চলে যায়। যেতে দিতে হয়। হায়! রবীন্দ্রনাথ কতটা তাৎপর্যপূর্ণভাবে কবিতাটি লিখেছিলেন ‘‘যেতে নাহি দিব … তবু চলে যায়… তবু যেতে দিতে হয়।”
এরপর ঐ প্রায় বৃদ্ধ বাবা-মার কি রইল? এই প্রবাসে সংসারের কাজের জন্য একজন সাহায্যকারী পাওয়া আমাদের মত নিম্ন মধ্যবিত্ত্বদের জন্য অলীক স্বপ্ন!! মাঝে মধ্যে তখন এমন হয়, নিজেরাই আর চলতে ফিরতে সক্ষম নয়। তখন নিজস্ব বাড়ির বরফ পরিষ্কার করা, সামাওে ঘাস কাটা, এমন কি অত বড় বাড়ির ভেতওে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখা আর তাদেও পক্ষে সম্ভব হয় না। অতএব একসময় এত সাধের বাড়ি, স্বপ্নের গৃহস্থালী বিক্রয় করে এই সব দুঃখী, একাকী বাবা-মায়েরা কন্ডো বা ভাড়া করা বাসায় চলে যান। হায়রে জীবন! এই সংসারের জন্য বাবা-মা কত কিই না করেছেন। তিল তিল করে সংসারের প্রতিটি সোপান নির্মান করেছেন। স্বপ্ন দেখেছেন তাঁরা একদিন এই বাড়ির প্রতিটি ঘর তাদের
উত্তরাধিকারদের কলকাকলিতে মূখর হবে। আজ শুধুই শূন্যতা বিরাজমান।
এমনকি আমি সমাওে অনেক পিকনিক অথবা এই সব ধরণের পার্টি (পটলাক পার্টি, ঈদ বা পূজা পূনর্মিলনী ইত্যাদি) তে গিয়ে দেখেছি যদিও বা কেউ তার বাবা-মা নিয়ে আসেও, তো অন্যরা বড়ই অবহেলার ভাব করেন। এমনকি তাদের খাবারটিও কেউ এনে দেন না!! ঈশ!! ভাবা যায়? এই বাবা-মা ই একদিন ১২/১৪ বছরের পুত্রকেও হাতে তুলে খাইয়েছেন। “আমার বাবু একা একা খেতেই পারে না”, “একা একা খেলে অর্ধেকটাই ফেলে দেয়।” এই সব আসলে অজুহাত। মায়েরা আসলে গভীর ভালবাসা থেকে এসব করে।
যাই হোক, এই প্রবাসে আমাদের প্রতিটি সন্তানেরই ভাবা উচিৎ, এই বাবা-মায়ের হাত ধরেই আমরা এখানে আসতে পেরেছি এবং সাফল্যের চূড়ায় উঠেছিও। এ সম্ভব হয়েছে বাবা-মায়ের অপরিসীম ত্যাগ তিতিক্ষার কারণে। আর আজ যখন তারা অক্ষম হয়ে পড়েছেন (তাও শারীরিকভাবে, অর্থনৈতিকভাবে নয়) তাদেরকে আমাদের কোনভাবেই ছেড়ে চলে যাওয়া উচিৎ নয়।
আমি যেহেতু ডাউন টাউনে কাজ করি দীর্ঘকাল ধরে, তাই আশে পাশের অনেক খবরই কানে চলে আসে। সম্প্রতি একটি খবর এলো কানে, এখানেই (আশপাশেই) সরকারী বাসভবনে বসবাসকারী এক মায়ের একটিই পুত্র। বাবা বেশ কিছু কাল হলো গত হয়েছেন, এই কানাডাতেই। মা, একমাত্র পুত্রকে নিয়ে দিন কাটিয়ে দিচ্ছিলেন। ইতিমধ্যে পুত্রটি হঠাৎ করে বছরখানেক আগে একজন ফিলিপিনো মহিলার (বয়সও ছেলেটির থেকে বছর পাঁচেক বড়) প্রেমে পড়েছেন। শুধু প্রেমে পড়া নয়। একেবারে গভীরি সমুদ্রে অবগাহন। অতপরঃ মাকে ছেড়ে ছেলে সরাসরি ঐ মহিলার সাথে তার এপার্টমেন্টে বসবাস শুরু করেছে। ভাল কথা, বাবা তুই থাক না Ñ কে তোকে মানা করেছে? তাই বলে মা’কে ভুলে যাবি? হ্যাঁ … শুধু ভুলেই যাওয়া নয়, মাকে দেখতেও আসে না। একই শহরে থাকা হয়। তবু মা‘কে হ্যালো বলতেও আসে না। মা আবার প্রচন্ড ডায়াবেটিস এর রোগী। ছেলের এই সুকৃতিতে মায়ের একেবারে মৃতপ্রায় অবস্থা। ফোনের উপর ফোন। এমনকি একপর্যায়ে ছেলে মায়ের ফোন পর্যন্ত রিসিভ করে না। অতপর; মা, পাগলপ্রায় হয়ে পুত্রের ঐ এপার্টমেন্টে হানা দিল। ছেলে দরজার হোল দিয়ে মাকে দেখে দরজাও খোলেনি। তবু বৃদ্ধা মা, এক নজর শুধু ছেলেটিকে দেখবার আশায় এপার্টমেন্টের নিচে রাস্তার কোনায় এসে দাড়িয়ে থাকেন। আর অভশপ্ত জীবনের কথা ভেবে অঝোর ধারায় কেঁদে চলেন। তবু ছেলের হৃদয় দ্রবীভূত হয় না। হঠাৎ একজন মহীয়সী বাঙ্গালী রমনী এই ঘটনাটি অবলোকন করেন এবং বৃদ্ধা মহিলার কাছে বৃত্তান্ত শ্রবন করে সরাসরি তার পুত্রের সাথে যোগাযোগ করে বলেন, তোমার প্রব্লেম কি? মায়ের সঙ্গে ঐরকম ব্যবহার করছো কেন? তখন পুত্র বললো, আমার গার্লফ্রেন্ড আমার মাকে পছন্দ করে না। মহিলাটি অত্যন্ত রেগে গিয়ে বলেন, গার্ল ফ্রেন্ড তোমার কতগুলো হবে তার ঠিক ঠিকানা নাই! এমনকি সে তোমার বিবাহিত স্ত্রীও নয়। আর উনি তোমার জন্মদাত্রী মা! এমনকি তোমার বাবাও বেঁচে নেই। এমনি আরো কিছু কথা তিনি শুনালেন ছেলেটিকে। যাইহোক, অবশেষে পুত্রের মন দ্রবীভূত হলো। এবং মায়ের সঙ্গে অনুগ্রহ(!) করে দেখা করেছেন। ধিক! এসব পুত্রদের। যে সব কুলাঙ্গার পুত্রগন গার্লফ্রেন্ড অথবা স্ত্রীর জন্য নিজের জন্মদাত্রী মা’কে ভুলে যায়! নিজেদের অস্তিত্ব ভুলে যায়!! আর নমস্য ঐ অচেনা মহিলাটিকে প্রবাসে একজন বৃদ্ধা অসহায় মায়ের চোখের জল মুছে দেবার জন্য।
এই প্রবাসে যারাই এই রকম স্বতস্ফুর্ত ভাবে অন্যের জন্য কল্যানকর কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন আল্লাহ পাক তাদের সর্বত ভাবে সহায়তা করুন। আমীন।
প্রবাসে এরকম একটি বাবা-মা নন, এরকম প্রচুর অসহায় মা-বাবার দেখা মিলবে। যদি আমরা অন্তত পক্ষে একজন, একজন মা-বাবাকে সাহায্য করি, দেখবেন নিজেই পরম আাত্ম তৃপ্তিতে রাতে গভীর ঘুমে মগ্ন হবেন। এমন নয় যে, সবসময় কোন এনজিও বা কোন সাহায্য সংস্থার মাধ্যমে সমাজ কর্ম করতে হবে। ব্যক্তিগত প্রয়াসও কম কিছু নয়।
প্রিয় বাংলা, প্রিয়জন, সব কিছু থেকে দুরে অবস্থিত এই সুদুর প্রবাসে এইরকম অসহায় কারো জন্য আমাদের প্রত্যেকেরই এগিয়ে আসা উচিত। শুধু কথা দিয়ে নয়, কর্ম দিয়েই আমাদের পরিচয় হোক।