নির্মম ও অর্থহীন আফগান যুদ্ধের মূল্যায়ন

কান্দাহারে কানাডীয় সেন্যরা নিহত হয়েছে শুধুই বাণিজ্যের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্ত উন্মুক্ত রাখার স্বার্থে। এটি তাদের জীবনদানের জন্য যথেষ্ট কারণ হতে পারে না।

এপ্রিল ৫, ২০১৪

টমাস ওয়ালকম

গত মঙ্গলবার কানাডা আনুষ্ঠানিকভাবে আফগানিস্তানে তার সামরিক মিশন বন্ধ ঘোষণা করেছে। এই যুদ্ধ কখনই শুরু হওয়া উচিৎ হয়নি। এই যুদ্ধ এক বিষণœ ব্যর্থতার নামান্তর। এটি সন্ত্রাসী বাহিনীর প্রধান বিন লাদেনকে পাকড়াও করার প্রাথমিক লক্ষ্য অর্জনেও ব্যর্থ হয়েছে। শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানে পরিচালিত একটি মার্কিন গোপন ঘাতক দল কাজটি সম্পন্ন করেছে। তাছাড়া এই যুদ্ধ তালেবানদের পরাজিত করতেও পারেনি। কানাডা এবং অন্যান্য ন্যাটো নেতৃত্বাধীন বাহিনী যখন ২০১৪ সালে দেশটি ছেড়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে তখনও বিদ্রোহী তালেবানরা রয়ে গেছে বিপজ্জনক, সক্রিয় এবং দুর্বিনীত। তারা নিশ্চিভাবেই আফগান সরকারে কোন না কোন রকমের ভূমিকা রাখতে যাচ্ছেÑ আর সেটা সম্ভবত খুব শিগগিরই।

এই যুদ্ধ আফগানিস্তানে অর্থবহ গণতন্ত্র নিয়ে আসা বা স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই একটি জঘন্য দুর্নীতিপরায়ণ সরকারের প্রধান। তিনি নিজে এবং আফগান পার্লামেন্টও একইরকম। দেশটিতে আইন-শৃঙ্খলাহীনতা নিত্য-নৈমিত্তিক বিষয়।

সেখানে অনেক স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ঠিকই। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই পরিবারগুলো তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে ভীত-সন্ত্রস্ত।

বিমানবন্দরে আফগানিস্তান থেকে ফেরত আসা এক কানাডিয়ান সৈন্য। ছবি : অনলাইন

সাহায্য ও সামরিক খাতে শত শত কোটি ডলার আফগানিস্তানে এসেছে। তারপরও যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটে উপস্থাপিত সাম্প্রতিক এক রিপোর্টে যেমনটা বলা হয়েছে যে, ওই অর্থের বেশিরভাগই উৎপাদনশীল অর্থনীতি থেকে দক্ষ শ্রমিকদের সরিয়ে দেয়ার মাধ্যমে (সেখানে একজন প্রকৌশলী হওয়ার চেয়ে এনজিওর গাড়িচালক হওয়া বেশি লাভজনক) পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে।  কানাডার উচিৎ আফগানিস্তানের শিক্ষা নিয়ে গুরুত্বের সঙ্গে ভাবনা-চিন্তা করা।  অত্যন্ত বাজেভাবে প্রণীত এই অ্যাডভেঞ্চারে কানাডার ১৫৭জন সৈনিকসহ ১৬১ জনের জীবন গেছে। সেইসঙ্গে অন্তত ৬১৫ জন কানাডীয় সৈনিক যুদ্ধে আহত হয়েছে যাদের মধ্যে অনেকেরই অবস্থা গুরুতর।

রাজনীতিবিদরা এবং গণমাধ্যম আমাদের সৈনিকদের সাহসিকতা ও পেশাদারিত্বের জন্য ভূঁয়সী প্রশংসা করেছে। তার পরও ভাগ্যের পরিহাস এই যে, এসব প্রশংসা দেশটির জন্য এই বাস্তবতা পাশ কাটিয়ে যেতে বহুলাংশে সহায়ক হয়েছে যে, এই আত্মদান ছিলো বহুলাংশেই অর্থহীন।

আমাদের সেনাবাহিনী স্বেচ্ছাসেবকদের দিয়ে না হয়ে বাধ্যতামূলকভাবে ডেকে নেয়া লোকদের দিয়ে গঠিত হলে জনগণের মধ্যে আরও বেশি অসন্তোষ তৈরি হতো।

কানাডার কর প্রদানকারী জনগণের ওপর এই যুদ্ধের ব্যয়ভার পড়েছে ১১.৩ বিলিয়ন ডলার এবং তা বাড়ছেই। এই হিসাবের মধ্যে যুদ্ধাহত সৈনিকদের চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবার ব্যয় ধরা হয়নি।

এই যুদ্ধ থেকে দুটি শিক্ষা নেয়ার আছে।

প্রথমটি ন্যাটোর সঙ্গে সম্পর্কিত। ৬২ বছর আগে নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন (ন্যাটো) গঠন করা হয়েছিলো একটি পারস্পরিক প্রতিরক্ষা চুক্তি হিসাবে। এর উদ্দেশ্য ছিলো পশ্চিম ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার দেশগুলোকে সোভিয়েত রাশিয়ার হাত থেকে রক্ষা করা। কিন্তু শীতল যুদ্ধের অবসানের পর ন্যাটো একটি আগ্রাসী জোটে রূপান্তরিত হয়েছে যা উত্তর আটলান্টিকের সীমার অনেক বাইরে গিয়েও সশস্ত্র সংঘাতে জড়িয়ে

পড়তে ইচ্ছুক। ন্যাটো তার এধরণের অভিযাত্রার জন্য কখনও জাতিসংঘের অনুমোদন পেয়েছে যেমন আফগান যুদ্ধ কিংবা অতি সাম্প্রতিক লিবিয়ার যুদ্ধ। আবার কখনও জাতিসংঘের অনুমোদন ছাড়াই যুদ্ধে জড়িয়েছে ন্যাটো, যেমন ১৯৯৯ সালের সার্বিয়ায় হামলার ঘটনা।

কিন্তু এসব ঘটনায় জোটের আসল উদ্দেশ্যই হারিয়ে গেছে। আফগান যুদ্ধের ব্যর্থতার পর এখন কানাডার জন্য বুদ্ধিমানের কাজ হবে ন্যাটোকে পারস্পরিক প্রতিরক্ষার তার মূল উদ্দেশ্যের দিকে ফিরিয়ে আনা।

আমরা যদি সেটা করতে না পারি তাহলে আমাদেরকে ন্যাটো জোট ত্যাগ করতে হবে। উত্তর আমেরিকাকে আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য আমরা ইতিমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নোরাড চুক্তি স্বাক্ষর করেছি। এশিয়ায় বা উত্তর আফ্রিকায় আমাদের আর কোন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার প্রয়োজন নেই।

আফগান যুদ্ধের দ্বিতীয় শিক্ষা হলো যুদ্ধের মূল্যায়ন সম্পর্কিত। যুদ্ধ কোনও খেলা নয়। অন্য কোনওভাবে এটি কোনও কূটনীতিও নয়। এটা হলো ভয়ংকর, খুনোখুনির ব্যাপার যা প্রায়শ পেছন থেকেও আঘাত হানতে পারে।

আফগান যুদ্ধের সময়, কানাডীয় রাজনীতিকদের অনেকেই সেটা ভুলে গিয়েছিলেন। গণমাধ্যমও সেটা ভুলে গিয়ে অনেক দীর্ঘ সময় ধরে চরম স্বাদেশিকতায় পরিচালিত হয়েছে। আমরা ত্যাগের মহিমা নিয়ে কথা বলি কিন্তু আমাদের উদ্দেশ্য মহৎ ছিলো না। আমরা আমাদের সৈন্যদের কান্দাহারে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছি শুধু আমাদের বৃহৎ বাণিজ্যিক অংশীদার যুক্তরাষ্ট্রকে তুষ্ট করতে এবং এটা নিশ্চিত করতে যেন বাণিজ্যের জন্য তাদের সীমান্ত উন্মুক্ত থাকে।

যথাসময়ে মোটরগাড়ির যন্ত্রাংশের সরবরাহ যাতে নিশ্চিত থাকে কেবল সেই কারণেই কানাডার সন্তানেরা জীবন দিয়েছে। এটি তাদের আত্মাহুতির যথেষ্ট কারণ হতে পারে না।