কানাডায় সিনেটরদের কেলেংকারী
জুলাই ২৮, ২০১৪
॥ খুরশিদ আলম ॥
বহুল আলোচিত ও বিতর্কিত এবং পদচ্যুত সিনেটর মাইক ডাফির বিরুদ্ধে কানাডার আরসিএমপি ৩১ অভিযোগ গঠন করেছে। অভিযোগে বলা হয় সাবেক এই কনজারভেটিভ সিনেটর মাইক ডাফি দায়িত্বে থাকা অবস্থায় মোট ৩১টি জালিয়াতি ও বিশ্বাস ভঙ্গের ঘটনা ঘটিয়েছেন যা থেকে তিনি দুই লক্ষ ডলারেরও বেশী অর্থিক সুবিধা নিয়েছেন অবৈধভাবে। প্রায় এক বছর তদন্ত করার পর আরসিএমপি জুলাই মাসের ১৭ তারিখে তাদের তদন্ত প্রতিবেদন পেশ করে।
আর্থিক কেলেংকারীতে জড়িয়ে মাইক ডাফি অটোয়ার পার্লামেন্ট হিল ত্যাগ করেন গত বছর ৬ জুন। তবে মাইক ডাফি একা নন, প্রায় একই সময় আরো তিনজন সিনেটরের নাম আলোচনায় আসে যারা বিভিন্ন উপায়ে অবৈধ আর্থিক সুবিধা নিয়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিনত হন। এরা হলেন পামেলা ওয়ালিন, ম্যাক হারব এবং প্যাট্রিক ব্রাজিউ। মাইক ডাফি ও পামেলা ওয়ালিন দুজনেই নামকরা সাংবাদিক ছিলেন সিনেটর হিসেবে যোগদান করার আগে। ম্যাক হারবেরও বর্ণাঢ্য অতিত ছিল। কিন্তু অর্থ লোভের কাছে তারা সবাই হেরে যান। সারা জীবন কঠোর সংগ্রাম করে যে সুনাম ও আভিজাত্য সঞ্চয় করেছিলেন তারা, তা ধুলায় মিশিয়ে দিলেন বাড়তি কিছু অবৈধ অর্থের লোভ সামলাতে না পেরে।
আলোচিত ও বিতর্কিত এই চার সিনেটরের একজন মাইক ডাফির জন্ম ১৯৪৬ সালের মে মাসে। ২০০৮ সালে প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপারের সুপারিশে সিনেটর হিসেবে যোগ দেন তিনি। ঐ সময় তিনি সিটিভি নিউজ চ্যানেল এর অটোয়া এডিটর ছিলেন। এছাড়াও তিনি কানাডার সিবিসি টেলিভিশনসহ বেশ কয়েকটি গনমাধ্যমে কৃতিত্বের সঙ্গে কাজ করেন। কাজের স্বীকৃতি হিসেবে পান বিভিন্ন পুরস্কার।
ম্যাক হারবের জন্ম লেবাননে ১৯৫৩ সালের নভেম্বর মাসে। তিনি কানাডায় আসেন ১৯৭৩ সালে অটোয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে। এর পর আর দেশে ফিরে যাওয়া হয়নি। এখানেই কাজ করেছেন প্রকৌশলী হিসেবে। অধ্যাপনাও করেছেন। একপর্যায়ে তিনি জড়িয়ে পড়েন কানাডার রাজনীতিতে। লিবারেল দলের এমপি ও সিনেটর হিসেবে ২৫ বছর কাটিয়েছেন তিনি পার্লামেন্ট ভবনে। অটোয়াতে তিনি ডেপুটি মেয়রের দায়িত্বও পালন করেছেন একসময়। ২০০৩ সালে তিনি সিনেটরের দায়িত্ব নেন তৎকালীন প্রধানন্ত্রী জন ক্রিশ্চিয়ানের সুপারিশে। গত বছর আগস্ট মাসে তিনি সিনেটর পদ থেকে অবসর নেন। আরসিএমপি তার বিরুদ্ধে প্রতারণা ও বিশ্বাস ভঙ্গের অভিযোগ দায়ের করে চলতি বছর ফেব্রুয়ারী মাসে।
পামেলা ওয়ালি জন্ম ১৯৫৩ সালের এপ্রিল মাসে। ২০০৯ সালে তিনি সিনেটর হিসেবে যোগদান করেন। তার আগে তিনি টেলিভিশন সাংবাদিকতা করেছেন। সিটিভি, সিবিসি, টরন্টো স্টার এর মতো প্রথম সারির গনমাধ্যমে তিনি দীর্ঘ সময় কাজ করেছেন। তার রচিত দুইটি বই রয়েছে। কানাডার হয়ে কূটনৈতিক দায়িত্বও পালন করেছেন তিনি। ২০০৭ সালে তিনি গুয়েল্ফ ইউনিভারসিটির চ্যান্সেলর হিসেবে দায়িত্ব পান। গত বছর নভেম্বর মাসে তাকে সিনেটর পদ থেকে অব্যহতি দেয়া হয় অর্থ কেলেংকারীর দায়ে।
প্যাট্রিক ব্রাজিউর জন্ম ১৯৭৪ সালের নভেম্বর মাসে। তিনি ছিলেন সবচেয়ে কমবয়সী সিনেটর। ২০০৯ সালের জানুয়ারী মাসে প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপারের সুপারিশে কনজারভেটিভ দলের হয়ে সিনেটরের দায়িত্ব নেন। এর আগে তিনি ২০০৬ সাল থেকে ২০০৯ সালের জানুয়ারী পর্যন্ত কানাডার কংগ্রেস অব এ্যবরিজিনাল পিপল এর ন্যাশনাল চীফ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। গত বছর ফেব্রুয়ারী মাসে তাকে কনজারভেটিভ দলের ককাস থেকে অব্যাহতি দেয়া হয় যখন তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয় ডমেস্টিক ভায়োলেন্স ও সেক্সচুয়াল এসাল্ট এর। আর্থিক কেলেংকারির অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। বর্তমানে তিনি অটোয়ার একটি স্ট্রিপ ক্লাবের ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করছেন।
এই হলো কানাডার চার সিনেটরের কাহিনী। তাদের কীর্তি দেখে অডিটর জেনারেল বাকি সিনেটরদের ফাইলও তলব করেছেন আরো কোন অনিয়ম রয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখার জন্য। সমাজের ও রাষ্ট্রের অতি উচ্চ এবং সম্মানজন অবস্থানে থেকে এবং বিপুল পরিমানের অর্থিক সুবিধা পাবার পরও বাড়তি কিছু অর্থ অবৈধভাবে আয় করা যায় কিনা তার চেষ্টা করতে গিয়েই আলোচিত এই চার সিনেটরের জীবনে ঘটে বিপত্তি। এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত হয়েছেন মাইক ডাফি। জনগনের ট্যাক্সের অর্থ আত্মসাৎ করে ভেবেছিলেন পার পেয়ে যাবেন। কিন্তু বিধি বাম। ধরা পড়ে গেলেন। এক পর্যায়ে আত্মসাৎকৃত ঐ অর্থ তাদেরকে ফেরত দিতে হয়েছে বা দেয়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছেন। কিন্তু যে বদনাম তারা কামিয়েছেন তা থেকে তারা মুক্তি পাবেন কি করে?
কানাডায় সিনেটরের পদ অত্যন্ত মর্যাদাশীল। দেশটিতে সিনেট হলো পার্লামেন্টের আপার হাউস। আর হাউস অব কমন্স হল লোয়ার হাউস যেখানে এমপিরা বসেন। তবে আপার হাউসের সিনেট সদস্যরা পদাধিকার বলে উচ্চ আসনে অবস্থান করলেও ক্ষমতার বিচারে লোওয়ার হাউসের এমপিদের চেয়ে কম শক্তিশালী। এমপিরা জনগনের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধি। আর সিনেটররা নিয়োগপ্রাপ্ত হন প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশে। প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশের পর গভর্ণর জেনারেল তাদের নিয়োগ দেন। কানাডায় বর্তমানে ১০৫ জন সিনেটর রয়েছেন। এদের মধ্যে কনজারভেটিভ দলের ৫৫ জন, লিবারেল দলের ৩১ জন ও স্বতন্ত্র ৭ জন। কোন বিল পাশ করতে হলে নিয়ম অনুযায়ী উভয় হাউসের অনুমোদন লাগে। তবে আপার হাউস কোন বিলের অনুমোদন দিতে আপত্তি জানায় এরকম ঘটনা বিরল।
কিন্তু কতিপয় সিনেটরদের কেন এই অর্থলোভ? আলোচিত চারজনের সকলেই অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল ছিলেন। সমাজে তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি, সুনাম ইত্যাদি কোনটারই কোন কমতি ছিল না। একজন বাদে বাকি সকলেরই অবসর গ্রহনের সময় চলে এসেছে। তারপরও কেন এই অবনতি?
এর জবাব মেলা ভার। আর্থিক কেলেংকারির ঘটনা ফাঁস হয়ে যাবার পর প্রথম দিকে তারা তাদের অপরাধ অস্বীকার করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তদন্তের পর সব খোলসা হয়ে যায়। এখন ভাবতে অবাক লাগে কানাডার মতো একটি দেশে সর্বোচ্চ সম্মানের আসনে বসেও কি করে তারা প্রতারণার আশ্রয় নেন। কি করে তারা জনগনের আস্থায় আঘাত হানেন। তাদেরই যদি এই অবস্থা তবে তৃতীয় বিশ্বের দুর্নীতিবাজ রাজনীতিকদেরকে এককভাবে দোষারোপ করে লাভ কি? এই সিনেটররা কি জানেন তাদের কেলেংকারীর ঘটনায় বাকি সিনেটদের ভাবমূর্তিও হুমকির মুখে পড়তে পারে বা পড়েছে? শুধু তাই নয়, কেলেংকারীর নায়ক এই চারজনের মধ্যে তিনজনই বর্তমান ক্ষমতাশীল দল কনজারভেটিভ এর পক্ষ হয়ে সিনেটে আসন গ্রহণ করেছিলেন। এতে করে আগামী বছর ফেডারেল নির্বাচনে দলের ভড়াডুবি হলে আশ্চর্য হবার কিছুই থাকবে না। এ প্রসঙ্গে মাইক ডাফির কথাই বেশী আলোচিত হচ্ছে। কারণ, তাকে এই অর্থ কেলেংকারী থেকে বাচানের জন্য প্রধানমন্ত্রীর সাবেক চিফ অব স্টাফ নিগেল রাইট (যিনি বিপুল অর্থের মালিক) তার ব্যক্তিগত তহবিল থেকে মাইক ডাফিকে ৯০ হাজার ডলার দিয়েছিলেন যাতে করে তিনি আত্মসাৎকৃত অর্থের কিছুটা ফেরত দিতে পারেন। অনেকে ধারণা করছেন এর পিছনে প্রধানমন্ত্রীরও হাত ছিল। তবে প্রধানমন্ত্রী বরাবরই অস্বীকার করে আসছেন এই বলে যে তিনি বিষয়টি জানতেন না। অন্যদিকে মাইক ডাফি এখনো অস্বীকার করে আসছেন তিনি কোন অনিয়ম করেননি।
তবে নিয়ম অনিয়ম যাই হোক না কেন, সিনেটরদের বিশেষ করে মাইক ডাফির অর্থ কেলেংকারীর ঘটনা কনজারভেটিভ দলের যথেষ্ট ক্ষতির কারণ হয়ে দাড়িয়েছে। অনেকে এও বলছেন যে, আগামী পার্লামেন্ট নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপারের আসল প্রতিদ্বন্দ্বি লিবারেল দলের নেতা জাস্টিন ট্রুডো বা এনডিপির নেতা থমাস মুলকেয়ার নয়, আসল প্রতিদ্বন্দ্বি হয়ে দেখা দিবে মাইক ডাফি। অর্থাৎ মাইক ডাফির কেলেংকারীর ঘটনা সামাল দিতে গিয়ে স্টিফেন হারাপারের অবস্থা বেগতিক হয়ে উঠতে পারে। তাছাড়া বিভিন্œ জরীপে ইতিমধ্যেই দেখা গেছে জনপ্রিয়তার দৌড়ে স্টিফেন হারপার জাস্টিন ট্রুডো থেকে পিছিয়ে আছেন। অন্টারিও প্রভিন্সে সেটি প্রমানিত হয়ে গেছে গত ১২ জুনের এমপিপি নির্বাচনে। মাইনরিটি লিবারেল দল নিরঙ্কুশ সংখ্যাগড়িষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠন করে।
আলোচিত এই সিনেটরদের অর্থ কেলেংকারীর ঘটনার পর অনেকে দাবী করছেন এই সিনেট প্রথা বাতিল করে দিতে অথবা এর আমূল সংষ্কার করতে। অবশ্য এই বিতর্ক ও দাবী চলছে অনেক বছর ধরেই। অনির্বাচিত এই সিনেটরগণ কানাডার জাতীয় রাজনীতি ও অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারছে কি পারছে না বা এদের আদৌ কোন প্রয়োজন আছে কি না তা নিয়ে ইতিপূর্বে অনেক আলোচনা ও বিতর্ক হয়েছে। এবার মাইক ডাফি ও অন্য তিনজন সিনেটরের অর্থ কেলেংকারী ঘটনা ফাঁস হয়ে যাবার পর বিষয়টি নিয়ে আবার নতুন করে আলোচনা শুরু হয়। কিন্তু যারা অনির্বাচিত সিনেট প্রথা বাতিল বা সংস্কারের পক্ষে তারা খুব একটা আশাবাদী হতে পারছেন না তাদের অতিত অভিজ্ঞতার কারণে। কারণ, বিষয়টি খুবই জটিল। এর পিছনে রয়েছে সাংবিধানিক জটিলতা। প্রধান মন্ত্রী স্টিফেন হারপার নিজেও চেষ্টা করেছেন সাংবাধানিক জটিলতাকে এড়িয়ে সিনেট প্রথাকে কিভাবে সংস্কার করা যায় বা উন্নত করা যায়। কিন্তু তা সম্ভব হয়ে উঠেনি। কুইবেক প্রভিন্স এর প্রতিবাদ করে এবং বিষয়টিকে আদালত পর্যন্ত নিয়ে যায় যেখানে তাদের পক্ষে রায় হয়। স্টিফেন হারপার শেষ পর্যন্ত আদালতের কাছেই এর সামাধান চান কি ভাবে একে সংস্কার করা যায় বা এটি বাতিল করা যায়। আদালত চলতি বছরের কোন এক সময় হয়তো এ বিষয়ে রুল জারী করতে পারে। কিন্তু তার পরও অন্তত ৭টি প্রভিন্সের সমর্থ প্রয়োজন পড়বে সিনেট প্রথা সংস্কার করতে।
গত বছর অক্টোবর মাসে ক্যালগারির ম্যানিং সেন্টারে কানাডার সিনেট প্রথা সংস্কারের বিষয়ে এক আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানেও আলোচকদের প্রায় সকলেই হতাশা ব্যক্ত করেছেন এই বলে যে, সিনেট প্রথা সংস্কার বা বাতিল কোনটাই সম্ভব হবে না।
তবে এটি সত্য যে, আলোচিত ও সমালোচিত এই চার সিনেটরের বিরুদ্ধে আরসিএমপি’র তদন্ত রিপোর্ট যখন জনসমক্ষে সম্পূর্ণরূপে প্রকাশিত হবে এবং ক্রিমিনাল চার্জ গঠন করা হবে তখন হয়তো সিনেট প্রথা সংস্কারের দাবী আরো জোরদার হবে। আমরা জানি কানাডা একটি গণতান্ত্রিক দেশ। সর্বস্তরে গণতন্ত্র চর্চা হবে এটাই সকলের আশা।
খুরশিদ আলম
সম্পাদক ও প্রকাশক
প্রবাসী কন্ঠ