কানাডায় টিনএজ ছেলে-মেয়েদের ডেটিং
ডিসেম্বর ১, ২০১৪
॥ খুরশিদ আলম ॥
কানাডায় আপনাদের অপরিনত বয়সের ছেলেটি ডেটিং করতে চাইছে তার স্কুলের এক সহপাঠীনির সঙ্গে। একদিন সাহস করে এ বিষয়ে সে আপনাদের মতামত জানতে চাইল। এদিকে ভাইয়ের বিষয়টি শুনে বড় বোনও অনেকদিন ধরে মনে মনে পুষে রাখা একই আকাংখাটি ব্যক্ত করে ফেললো আপনাদের কাছে। আপনারা তখন কি করবেন? তেলে বেগুনে জ্বলে উঠবেন? দিকবিদিক জ্ঞানশূণ্য হয়ে ছেলে-মেয়েকে মারধর করতে যাবেন? অথবা ঘাড় ধরে দুজনকেই বাড়ি থেকে বের করে দিবেন?
এর কোনটাই আপনারা করতে পারবেন না। কানাডায় সে পথ বন্ধ। কানাডার বিজাতীয় সংস্কৃতির কথা জেনে শুনেই আপনারা এখানে এসেছেন। কেউ আপনাদেরকে জোর করে নিয়ে আসেনি। এ দেশে আপনাদের ছেলে বা মেয়ে “বিপথগামী” হতে পারে সেই ঝুঁকির কথা মনে রেখেই আপনারা এখানে নোঙ্গড় ফেলেছেন বাকি জীবন থাকবেন বলে। কারণ, এই দেশটিতে রয়েছে উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থা, উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা, উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, উন্নত আইন-শৃংখলা তথা নিরাপত্তা ব্যবস্থা, দূষণমুক্ত উন্নত পরিবেশসহ আরো অনেক কিছু।
তাছাড়া আপনারা যখন কানাডায় আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তখন আপনারা আপনাদের অপ্রাপ্ত বয়সী ছেলে মেয়েদের মতামত জানতে চাননি। অথবা আপনাদের ছেলে বা মেয়ের জন্ম যদি কানাডায় হয়ে থাকে সে ক্ষেত্রে বলা যায়, দেশ ছাড়ার আগে সেই ঝুঁকির কথা আপনারা জানতেন। তবে আপনারা হয়তো ভাবেননি ভবিষ্যতে আপনাদের ছেলে বা মেয়ে আপনাদেরকে এরকম একটি বিব্রতকর অবস্থায় ফেলবে।
কানাডায় টিনএজ ছেলে-মেয়েদের ডেটিং এর বিষয়টি আসলে খুবই স্পর্ষকাতর একটি বিষয়। বিশেষ করে আমাদের সাউথ এশিয়ান এবং আরো বিশেষ করে আমাদের বাংলাদেশী পরিবারের অভিবাকদের জন্য এটি সত্যিকার অর্থেই একটি মূর্তমান আতংক । ছেলে মেয়েদেরকে স্কুল, কলেজে বা ইউনিভারসিটিতে পাঠিয়ে আমরা স্বস্তিতে থাকতে পারিনা। আমাদের কেবলি ভয়, ছেলে বা মেয়ে কি বিপথগামী হলো? যদি হয়েই যায় তবে কি করবো? কিভাবে সামাল দিব? এটাতো বাংলাদেশ নয় যে ভয়ভীতি দেখিয়ে বা মারধর করে তাদেরকে পথে ফিরিয়ে আনবো। সেই চেষ্টা করাও বিপজ্জ্বনক। ৯১১ নামের একটি বিপত্তি বা ঝুঁকি রয়েছে।
তাহলে কি করবেন? যে ছেলে মেয়েদের উন্নত ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে কানাডায় আসা, সেই ছেলে মেয়েরাই যদি বিপথগামী হয়ে উঠে তবে এ দেশে আসার স্বার্থকতা কোথায়? সমাজে মুখ দেখাবেন কি করে, অথবা দেশে আত্মীয়-স্বজনদের কাছেই বা কি জবাব দিবেন? আর যদি ছেলে বা মেয়ে অন্য ধর্মের বা অসবর্ণের কাউকে পছন্দ করে বসে ডেটিং এর জন্য তা হলে সে পরিস্থিতি সামাল দিবেন কি করে?
এসব চিন্তা করে অনেকেরই রাতের ঘুম হারাম হয়ে যায়। আর যারা রক্ষণশীল পরিবার থেকে এসেছেন এবং নিজেরাও রক্ষণশীল মনোভাব পোষণ করেন তাদের বেলায় এটি আরো অধিক যন্ত্রনাদায়ক বিষয় হয়ে দাড়ায়। আর এই যন্ত্রণার হাত থেকে মুক্ত হতে তাদের কেউ কেউ অতি চরমপন্থার আশ্রয় নিয়ে ফেলেন পরিনতির কথা না ভেবেই।
পাঠক, আপনাদের হয়তো মনে আছে অবাধ চলাফেরা ও ডেটিং করার দায়ে ২০০৭ সালের ১০ ডিসেম্বর মিসিসাগায় মোহাম্মদ পারভেজ নামের এক ব্যক্তি তাঁর ১৬ বছর বয়সী কন্যা আকসা পারভেজকে গলা টিপে হত্যা করেন নিজ বাসায়। অনার কিলিং তথা পরিবারের সম্মান রক্ষার নামে কিংস্টনে নিজের প্রথম পক্ষের স্ত্রী রোনা আমীর মোহাম্মদসহ তিন কন্যাকে পানিতে ডুবিয়ে হত্যা করেছেন আরেক ব্যক্তি যাঁর নাম মোহাম্মদ সাফিয়া। সঙ্গে মোহাম্মদ সাফিয়ার দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী তোবা ইয়াহিয়া সহায়তা করেন। ঘটনাটি ঘটে ২০০৯ সালে জুন মাসে। সাফিয়ার বড় মেয়ে জয়নব স্কুলে তার এক সহপাঠির প্রেমে পড়েছিল। উভয় ক্ষেত্রে খুনের ঘটনা প্রমানিত হওয়ায় আদালত মোহাম্মদ পারভেজ এবং মোহাম্মদ সাফিয়া ও তার দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী তোবা ইয়াহিয়াকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড প্রদান করেন। উল্লেখ্য যে, এরকম অনার কিলিং এর ঘটনার নজীর আরো আছে এই কানাডায়। তবে রক্ষা যে, বাঙ্গালী বা বাংলাদেশীদের সামাজে এরকম সরাসরি অনার কিলিং এর নজীর নেই। বাংলাদেশেও নেই। কিন্তু পরোক্ষ অনার কিলিং এর নজীর বাংলাদেশে রয়েছে অনেক।
প্রবাসে আমাদের ছেলে মেয়েরা যখন ডেটিং এ উৎসাহী হয়ে উঠে বা আগ্রহ প্রকাশ করে তখন প্রথমেই আমাদের মনে যে প্রশ্নগুলো এসে হানা দেয় সেগুলো হলো, ধর্ম, বর্ণ, শিক্ষা, দেশ, পারিবারিক আদর্শ ও ঐতিহ্য, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি ইত্যাদি। এগুলোর যে কোন একটি না মিললেই মাথায় বাজ পরার মতো অবস্থা হয় আমাদের।
এরকম পরিস্থিতিতে আমাদের করনীয় কি? এর কোন সোজাসুজি জবাব নেই। তবে প্রথমেই ঘবড়ে না গিয়ে বা অসহিষ্ণু না হয়ে পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য নিজেকে তৈরী করে নিতে হবে। মনে রাখতে হবে আপনি বাংলাদেশে বাস করছেন না, বাস করছেন কানাডায় যেখানে ডেটিং অপরাধ হিসেবে গণ্য হয় না। এ বাস্তবতাটুকু মনে রেখেই সামনের দিকে এগুতে হবে।
কানাডার মূলধারায় ডেটিং অপরাধ না হলেও বা সামাজিকভাবে একে খারাপ চোখে দেখা না হলেও এর কিছু বিপজ্জনক দিক আছে। “স্ট্যাটিসটিকস : টিনএজ ডেটিং ভায়োলেন্স ইন কানাডা” এর তথ্য উপাত্ত থেকে দেখা যায় :-
১. কানাডায় শতকরা ৩১ ভাগ যৌন নির্যাতনের ঘটনা ঘটে ডেটিং এর সময়।
২. ডেটিং এর সময় মেয়েরাই বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। ছেলে এবং মেয়েদের মধ্যে এর অনুপাত ১:১০। আর এদের বয়স ১৫ থেকে ১৯ এর মধ্যে। এই তথ্য পুলিশের খাতায় লিপিবদ্ধ রয়েছে।
৩. ডেটিং এর সময় যৌন নির্যাতন কি হারে হচ্ছে তার সঠিক তথ্য পাওয়া আসলে খুব কষ্টকর। কারণ, সিংহভাগ (শতকরা ৯১ ভাগ) নির্যাতনের তথ্য অভিবাবক বা পুলিশ জানতে পারে না। লোকলজ্জা বা ভীতির কারনে মেয়েরা এগুলো চেপে যায়।
৪. ডেটিং এর সময় এই যৌন নির্যাতন শুধু যে একবার বা দুইবার ঘটে তা নয়। এটি অব্যাহতভাবে চলতে থাকে অনেকের ক্ষেত্রেই।
৫. এক জরীপে দেখা গেছে- প্রতি ৫ জন তরুনের মধ্যে একজন তরুন যৌন নির্যাতন করাটাকে অপরাধ হিসেবে দেখে না। তারা মনে করে- সঙ্গীনির পিছনে যদি অর্থ ব্যয় করা হয়ে থাকে, অথবা সে (ছেলেটি) যদি মদ্যপ অবস্থায় থাকে অথবা যদি সম্পর্ক দীর্ঘদিনের হয়ে থাকে তবে যৌন নির্যাতন করাটা বৈধ।
৬. আরেক জরীপ তথ্যে দেখা যায়, শতকরা ৬১ ভাগ তরুন মনে করে ডেটিং এর সময় জোরপূর্বক যৌন সম্পর্ক ধর্ষনের পর্যায়ে পরে না।
৭. কলেজ/স্কুলের শতকরা ৬০ ভাগ তরুন স্বীকার করেছে এই বলে যে, তারা যৌন নির্যাতন করতে পিছ পা হবে না যদি তারা নিশ্চিত হতে পারে যে পুলিশী কোন ঝামেলা হবে না।
৮. স্ট্যাটিসটিকস কানাডার হিসেবে দেখা যায়, শতকরা ৭১ ভাগ তরুন-তরুনী ডেটিং এ লিপ্ত হয় যখন তাদের বয়স ১৫ পার হয়। এদের মধ্যে আবার শতকরা ৫৫ ভাগই মাত্র ১২ বছর বয়সে ডেটিং শুরু করে।
তাহলে বিষয়টি এখন দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে গেল যে, টিনএজ ছেলে-মেয়েদের ডেটিং করা বা ডেটিং এ যাওয়া মোটেও ছেলেখেলার বিষয় নয় বা এটিকে হালকা ভাবে নেওয়ারও কোন সুযোগ নেই। আর এটিও সত্য যে অধিকাংশ ছেলে-মেয়ে ডেটিং এ জড়িয়ে পড়ে স্কুল বা কলেজে থাকা অবস্থায়ই। অভিবাবকরা হয়তো এর খুব অল্প তথ্যই জেনে থাকেন। এর একটি কারণ হতে পারে, ছেলে-মেয়েরা ভয়ে বা লজ্জার কারণে বিষয়গুলো অভিবাকদের কাছে বলেনা। কিংবা ঐ বয়সেই ছেলে-মেয়েরা জেনে যায় যে, কানাডীয় কালচারে ডেটিং অপরাধ নয়। তাই তারা বিষয়টিকে বাবা-মার কাছে বলার প্রয়োজন মনে করে না।
কানাডায় ছেলে-মেয়েরা বড় হয় এখানকার কালচারেই। ঘরে তারা যে সময়্টুকু ব্যয় করে তা শুধু ঘুম, খাওয়া আর হোমওয়ার্ক করার জন্য। খুব কম ক্ষেত্রেই দেখা যায় ছেলে-মেয়েরা বাবা-মার সঙ্গে অবসরের কিছুটা সময় ব্যয় করছে। সমস্যাটা তৈরী হয় এখানেই। ইমিগ্রেন্ট পরিবারের অভিবাকরা অধিকাংশ সময় ব্যয় করেন জীবন-জীবিকার তাগিদে। তাদেরকে বাড়ি ভাড়া বা বাড়ির মর্টগেজ জোগার করতে হয়, জোগার করতে হয় বাজার খরচ, মাস শেষে নানা পদের বিল পরিশোধ করতে হয়, সংসারের দৈনন্দিন কাজ শেষ করতে হয় নিয়মিত, বাচ্চাদের স্কুলে ড্রপ-পিকআপ করতে হয়, তার মধ্যে আবার সামাজিকতা রক্ষা কারার জন্য দাওয়াত দিতে আত্মীয় (যদি থেকে থাকে) বন্ধুদের এবং একই সঙ্গে দাওয়াত রক্ষাও করতে হয়। এরকম আরো অনেক কিছু নিয়ে বাবা-মা উভয়কেই ব্যস্ত থাকতে হয় ঘুমের সময়টুকু ছাড়া দিনের বাকি সময়টুকু। একারণে বাবা-মা কেউই পর্যাপ্ত সময় দিতে পারেন না ছেলে-মেয়েদেরকে। ফলে ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে একটা দূরত্ব তৈরী হয়ে যায়। বাড়ন্ত ছেলে-মেয়েরা বাসায় কি করছে, বা স্কুল-কলেজে কি করছে, কার সঙ্গে মেলা মেশা করছে সেটি দেখার সুযোগ পান না ব্যস্ত অভিবাবকরা। আর কারো কারো ক্ষেত্রে সময় থাকলেও স্কুল-কলেজে ছেলে-মেয়েরা কার সঙ্গে মেলো মেশা করছে তা তদারকী করাও সম্ভব নয়, কারণ কাজটা মোটেও সহজ নয়।
এরকম একটি জটিল পরিস্থিতে আমাদের কি করা উচিৎ? শ্রোতে গা ভাসিয়ে দিলে তো হবে না। আবার পারিবারিক ঐহিয্য, সংস্কৃতি বা ধর্ম রক্ষার নামে ছেলে-মেয়েদের উপর কোন কিছু জোর করে চাপিয়ে দিতে গেলে হিতে বিপরীতও হতে পারে। কারণ আগেই উল্লেখ করেছি, এটি বাংলাদেশ নয়। আমরা বাস করছি এমন একটি সমাজে যেখানে অনেক কিছুর সঙ্গেই আমাদের ফেলে আসা দেশীয় সমাজ ও সংস্কৃতির সঙ্গে মিল নেই।
আমাদের ফেলে আসা দেশীয় সমাজ ও সংস্কৃতি কি? যারা একটু রক্ষণশীল পরিবারের সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী বা ধর্মীয় ক্ষেত্রে গোঁড়া, তারা মনে করেন বাবা-মা যা বলবেন তাই ছেলে-মেয়েদেরকে বেদবাক্য হিসেবে মেনে নিতে হবে। কিন্তু বাবা-মার ঐ ‘বেদবাক্য’ মানলেই যে ছেলে-মেয়েরা নিশ্চিতভাবে সুখী হয় তারও কোন নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারেন না।
সে কারণে যদি দেখেন আপনাদের অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলে বা মেয়ে ডেটিং এ জড়িয়ে পড়েছে বা ইচ্ছে প্রকাশ করেছে ডেটিং এর ব্যাপারে তাহলে তাৎক্ষনিকভাবে কোন লংকা কান্ড না বাধিয়ে ধীরে সুস্থ্যে বিষয়টি নিয়ে একটু ভাবুন। আপনি যে সংস্কৃতি থেকে এসেছেন এবং বয়সকালে আপনার যে এটিচ্যুড বা মনোভাব ছিল প্রেম-ভালবাসার বিষয়ে সেগুলোও একটু স্মরণ করার চেষ্টা করুন। দেখবেন সমস্যা সমাধানের পথ অনেকটাই সহজ হয়ে যাবে। ষাটের দশকে বা তারো কিছুটা সময় আগে ঢাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছেলে-মেয়েদের মধ্যে সামাজিক মেলা মেশাতো দূরের কথা, ক্লাসের মধ্যে কথা বলাও নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু সত্তর বা আশির দশকের কথা চিন্তা করুন, পরিস্থিতির অনেক পরিবর্তন হয়েছিল। আর এখনকার অবস্থাতো আরো খোলামেলা।
এ বিষয়ে কানাডার ভ্যাঙ্গুভারে বসবাসকারী ঋধরুধষ ঝধযঁশযধহ, চয.উ., উঅঈঝ, জচঈ, গচঈচ যাকে গঁষঃরপঁষঃঁৎধষ ঝবী ধহফ জবষধঃরড়হংযরঢ় ঞযবৎধঢ়ু’র একজন পথিকৃৎ হিসেবে বিবেচনা করা হয় তার মতামতটি বিবেচনা করা যেতে পারে। তার মতে, কানাডার এই মাল্টি কালচারাল সোসাইটিতে ডেটিং একটি খুবই স্পর্ষকাতর বিষয়। কারণ এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে পারিবারিক মূল্যবোধ, সাংস্কৃতিক প্রত্যাশা, ধর্মীয় আদর্শ, আন্তপ্রজন্মীয় পার্থক্য, স্বাতন্ত্রবোধ ইত্যাদি আরো কিছু বিষয়। একটি ১৪ বছরের বালকের মনে ডেটিং সম্পর্কে যে ধারণা তৈরী হয় সে ধারণার সঙ্গে আভিবকদের ধারনার মিল নাও থাকতে পারে। ড. ফাইজালের মতে এরকম পরিস্থিতিতে সবচেয়ে ভাল পদক্ষেপ হলো, প্রথমেই আপনার ছেলে বা মেয়েকে ডেটিং সম্পর্কে আপনার পরিবারিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ কি সেটি খুব ভাল করে জানিয়ে বা বুঝিয়ে দেয়া। তবে একই সময় আপনাকে মনে রাখতে হবে যে, দেশে আপনি যে সমাজে বড় হয়েছেন সেখানে ডেটিংতো দূরের কথা, ছেলে-মেয়েদের সাধারণ মেলা মেশাও নিষিদ্ধ ছিল বা এখনো রয়েছে কোন কোন স্থানে। ডেটিং এর বিষয়টিকে ভাল চোখে দেখা হয় না। অন্যদিকে এই প্রবাসে যেখানে আপনার সন্তানেরা বড় হচ্ছে সেখানে ডেটিং একটি খুবই সাধারণ বিষয় বা এখানকার সংস্কৃতিই এটি। সুতরাং বুঝতে চেষ্টা করুন এবং জানারও চেষ্টা করুন, আপনার সন্তান ডেটিং নিয়ে কি ভাবছে এবং কেনই বা তার ডেটিং এর প্রয়োজন দেখা দিল ঐ বয়সে। এমনো হতে পারে যে আপনি ডেটিং সম্পর্কে যা ভাবছেন (হলিউডি মুভির দৃশ্য) আপনার সন্তান মোটেও তা ভাবছে না! আপনি হয়তো আরো ভাবছেন ডেটিং করতে গিয়ে আপনার সন্তানেরা লেখাপড়ায় মন বসাবে না, তাদের ভবিষ্যত নষ্ট হয়ে যাবে, যৌনবাহিত রোগে আক্রান্ত হবে ইত্যাদি আরো অনেক কিছু। কিন্তু আপনি হয়তো আশ্চর্য বা খুশিই হবেন ডেটিং সম্পর্কে আপনার সন্তানের ধারণা বা উত্তর শুনে।
ড. ফাইজালের মতে, ডেটিং এর ব্যাপারে টিনএজ বা অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলে-মেয়েদের আগ্রহী হয়ে উঠার পিছনে প্রাথমিক কারণ হলো সামাজিকভাবে তাদের গ্রহনযোগ্যতা বৃদ্ধি করা। এখানে একটি ছেলে তার সহপাঠিনীর সঙ্গে ডেটিং করে নিজেকে অন্যান্য সহপাঠিদের কাছে যোগ্য ও সমকক্ষ বলে প্রমানিত করতে। কিন্তু তারপরও কথা থেকে যায়। কারণ, অপ্রাপ্তবয়স্ক একটি ছেলে বা মেয়ে- ডেটিং বা রোমান্টিক রিলেশনশীপের মধ্যে যে আবেগ ও অনুভূতিগুলো কাজ করে তাকে সামাল দেয়ার জন্য যথেষ্ট অভিজ্ঞ নাও হতে পারে। তাদের যা বয়স, তাতে ঐ পরিপক্কতা না থাকারই কথা। তাই ডেটিং এর ব্যাপারটি যাতে বেসামাল না হয়ে পড়ে বা কোন সমস্যা সৃষ্টি না করে সে কারণে একে পারিবারিক পরিমন্ডলে নিয়ে আসা যেতে পারে। ডেটিং এ তারা যাতে একা না যায়, আর যদি অগত্যা যেতেই হয়, তবে অন্যান্য বন্ধুরাও যাতে সঙ্গে থাকে সে বিষয়ে পরামর্শ বা উৎসাহ দেয়া যেতে পারে। অথবা তাদের সামাজিক মেলা মেশা যাতে পরিবারের বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা যায় সে ব্যাপারেও সচেষ্ট হওয়া যেতে পারে। এভাবে মেলা মেশার ক্ষেত্রে একটা পারিবারিক পরিবেশ বা আবহ তৈরী করতে পারলে বাবা-মায়েরা যে আদর্শ ও নিয়ম নীতি শিক্ষা দেন তা থেকে ছেলে মেয়েদের কক্ষচ্যুত হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম থাকে।
তবে ড. ফাইজালের এই পরামর্শের সঙ্গে এ কথাও মনে রাখতে হবে যে, ডেটিং এর কিছু বিপজ্জনক দিকও রয়েছে যা আগেই আমরা দেখেছি “স্ট্যাটিসটিকস : টিনএজ ডেটিং ভায়োলেন্স ইন কানাডা”র তথ্যে। কিন্তু যেহেতু এই প্রবাসে ছেলে-মেয়েদের সবকিছুর উপর বাবা-মায়ের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়, তাই যতটা সম্ভব সতর্কভাবে বিষয়টি মোকাবেলা করতে হবে। আর সেটি করতে হলে ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে শৈশব থেকেই বন্ধুর মত আচরণ করতে হবে। সম্পর্ক সবসময় স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করতে হবে । পরিবারের সবকিছুতেই তাদের মতামতকেও গুরুত্ব দিতে হবে। কোন বিষয়ে সংকট তৈরী হলে বা সমস্যা দেখা দিলে আবেগ নির্ভর না হয়ে যুক্তিকে প্রাধান্য দেয়ার চেষ্টা করতে হবে, ছেলে-মেয়েদেরকেও যুক্তিনির্ভর হওয়ার পরামর্শ দিতে হবে। এগুলো করতে পারলে দেখবেন পরবর্তীতে অনেক সমস্যারই সমাধান হয়ে যাবে সহজভাবে। এমনকি ডেটিং সমস্যাও। কারণ, আপনি যদি আপনার সন্তানের বন্ধু হন, তবে সে সব কথা আপনাকে খুলে বলবে। সে ক্ষেত্রে আপনি তাকে সঠিক পথে গাইড করার জন্য প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিতে পারবেন যা সে মেনে নিবে। শৈশব থেকেই যদি ছেলে-মেয়েদেরকে যুক্তিনির্ভর করে গড়ে তুলতে পারেন তবে তারা আবেগের বশবর্তী হয়ে কোন অঘটন ঘটাতে যাবে না। এমনকি ডেটিং এর ক্ষেত্রেও না। পরিবারের সবকিছুতেই যদি সন্তানদের মতামতকে গুরুত্ব দেন তবে সন্তানরাও বাবা-মায়ের মতামতকে গুরুত্ব না দিয়ে পারবে না। এমনকি ডেটিং এর ক্ষেত্রেও না।
সব শেষে বলা যায়, এ সকল ক্ষেত্রে ধৈর্য্য ধরে কাউন্সিলিং করাই সমস্যা সমাধানের সবচেয়ে সহজ পথ। ছেলে বা মেয়েকে নিয়ে আপনাদেরকে আলোচনায় বসতে হবে। কোনরকম চাপ প্রয়োগ না করে বা ভয় ভীতি না দেখিয়ে তাদেরকে বুঝাতে চেষ্টা করুন কোনটা ভাল কোনটা মন্দ। যার সঙ্গে আপনার ছেলে বা মেয়ে ডেটিং করছে বা করতে চাইছে, সেই ছেলে বা মেয়েটি সম্পর্কে খোঁজ খবর নিন। এমনো তো হতে পারে যে সেই ছেলে বা মেয়েটি খুব ভাল স্বভাবের এবং ভাল ঘরেরও। এরকম ক্ষেত্রে আপনারা আপনাদের ছেলে বা মেয়েকে বলতে পারেন তাদেরকে বাসায় নিয়ে আসতে যেমনটা পরামর্শ দিয়েছেন ড. ফাইজাল। আর আপনি ভুলে যাবেন না যে, আপনি জেনেশুনেই এই দেশটাকে বেছে নিয়েছেন আপনার ভবিষ্যত প্রজন্মের স্থায়ী আবাসস্থল হিসেবে। সুতরাং এই ডেটিং কালচার থেকে আপনার মুক্তি নেই। তাই একে ভয় না করে কিভাবে একে নিয়ন্ত্রণ করা যায় সেই ভাবনাই আপনাকে ভাবতে হবে। আর একে নিয়ন্ত্রণ করতে হলে সন্তানদের ভয় দেখিয়ে, তাদের সঙ্গে দুরত্ব তৈরী করে এ কাজটি করা সম্ভব নয়। তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করুন, বন্ধুর ন্যায় আচরণ করুন। তারা আপনাদের সঙ্গে যত সহজ হয়ে উঠতে পারবে ততই তা উভয়ের জন্য মঙ্গল। প্রবাসে সিংহভাগ ছেলে -মেয়েরই বাবা-মা ছাড়া আর কোন নিকট আত্মীয় নেই। যারা আছেন তারা থাকেন সুদূরে। তাই আদর, সোহাগ, শাসন ও পরামর্শ ইত্যাদি যা কিছু তারা আশা করতে পারে তা ঐ বাবা-মায়ের কাছ থেকেই। সুতরাং, শাসন করার পাশাপাশি যথেষ্ট সোহাগও দিন তাদেরকে। দেখবেন অনেক সমস্যারই সমাধান হয়ে যাবে অতি সহজে।
খুরশিদ আলম
সম্পাদক ও প্রকাশক
প্রবাসী কন্ঠ