আমার নতুন বাড়ি
মীজান রহমান
অস্বীকার করব না। যৌবনের সেই স্যাঁতসেতে আবেগপ্রবণতাটি পুরোপুরি কাটেনি এখনো। পুরনো বাড়িটা শেষবারের মত ছেড়ে আসার সময় বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে ছিলাম। গাড়ি চালাচ্ছিল আমার বড় ছেলে বাবু। পেছনের সীটে ছোট ছেলে রাজা। ওরাও চুপ। যেন কারো মৃতদেহ বয়ে নিয়ে যাচ্ছি আমরা তিন বাপ-বেটাতে। আমাদের নীরবতা দিয়ে আচ্ছাদিত সেই মৃতদেহ। তিনটি মানুষ আমরা, বিদায়ী শকটের নরম কেদারাতে বসা তিনটি প্রাণী, তিনজনের তিনটে ভুবন, আপন মনের রঙ দিয়ে গড়া তিনটে স্মৃতির পাহাড়, সেই ত্রিশ বছরের প্রাচীন বাড়িটার ভেতর। লোকে এখনো জানতে চায়ঃ কেমন করে পারলেন আপনি?
তাইতো। কেমন করে পারলাম!
পারলাম, কারণ পারতে হয় মানুষকে। নিষ্ঠুর হতে হয় তাকে নিজেরই বেঁচে থাকার দায়ে। সেই অকল্পনীয় মুহূর্তটি সত্যি সত্যি একদিন এসে যায়, সবার জীবনেই। ভেতর থেকে কে যেন জানান দেয়ঃ এবার সময় হল। হেমন্ত ঋতুর হিরণ্ময় সন্ধ্যাগুলো এবার অস্তবেলার নীলিমার সাথে মিশে যাবে। বিমুগ্ধ যাত্রী, নতুন পথের সন্ধানে বেরুতে হবে এবার তোমাকে। কোনদিন ভাবিনি আমার জীবনেও আসবে তেমন দিন। বড় গলায় বলেছিঃ এ কেবল বাসগৃহ নয় আমার, আমার স্মৃতিমন্দির। এর দেয়ালে ওদের আঙ্গুলের ছাপ। নিচের তলাতে রাজার সেই বড় পিয়ানোটা ছিল একসময়। বাখ, মোৎসার্ট, বেথোফেন, সোঁপা, ব্রাম্স, রাখমানিনভ, আর চায়কোভস্কি—-কত কি বিচিত্র সুর বেরিয়ে এসেছে ওর সেই মায়াবী যন্ত্রটি থেকে। কল্পনাতে আমি সেসব সুর শুনেছি অনেক, অনেকদিন। মনে হয়েছে বাড়িটার প্রতিটি ধূলিকনার ভেতরই ওই সম্মোহনী সুরের অনুরণন অবিরাম কেঁদে বেড়িয়েছে। ঐ বাড়িটাতে আমার স্ত্রীর মৃতদেহকে শেষবারের মত এনে শুইয়েছি লিভিং রুমের মেঝেতে। রাজা তার পিয়ানোতে ব্রাম্সের ইন্টারমেসো বাজিয়ে আমাদের হৃদয়ের প্রতিটি তন্ত্রী ছিন্নভিন্ন করে ফেলেছিল সেদিন, তার মায়েরই ইচ্ছা ছিল তা। সেদিন কারো শুকনো চোখ দেখা যায়নি আমাদের বাড়িতে। ওপরতলার সামনের ঘরটা, যেখানে বিকেলবেলার সূর্যালোক ঝাঁপিয়ে পড়ত বড় বড় দুটো জানালা দিয়ে, ওটা ছিল আমার পড়ুয়া ছেলে বাবুর ঘর। রাত একটা-দুটো পর্যন্ত সে পড়াশুনা করত—-হোমওয়ার্ক শেষ হবার পরও ওর পড়া শেষ হত না। পরের দিন ক্লাসে কি পড়ানো হবে সেগুলোও সে ঝালিয়ে নিত—এই ছিল তার ছাত্রজীবনের অভ্যাস। সকালবেলা আমি ওকে ঘুম থেকে জাগাতাম, আমার সাথে গাড়িতে করে ইউনিভার্সিটিতে যাবে বলে। ও খুব কষ্ট করে চোখ খুলে বলতঃ আব্বু, আর পাঁচ মিনিট ঘুমুতে দেবে? হ্যাঁ, অবশ্যই দেব বাবা। এমনই অদ্ভুত ছেলে আমার যে ঠিক পাঁচ মিনিট পর, যেন ঘড়ির কাঁটা ধরে, নিজে থেকেই উঠে যেত বিছানা থেকে। এসব আমি কেমন করে ভুলি বলুনতো। বাড়ি বিক্রি করে দেয়ার পর বেশ কবার আমি ওপাড়ায় গাড়ি নিয়ে ঘুরে এসেছি। প্রতিবারই ওই ঘরটার দিকে তাকিয়ে দেখেছি একপলক। বাবুর ঘর এখন অন্য কারুর ঘর হয়েছে ভাবতেই বুকটা কেমন মোচড় দিয়ে ওঠে।
আমার নতুন বাসাতে এসেছি, তা’ও মাসতিনেক হয়ে গেল। অভ্যস্ত হয়ে উঠছি এই নতুন পরিবেশের সাথে। নগরের দুটি ব্যস্ত সড়কের ঠিক সন্ধিস্থলে, বেইজলাইন আর ক্লাইড যেখানে মিশেছে তার একপাশে ওয়ালমার্টের বিরাট চত্ত্বর, আর অপরপাশে তিনটি মাঝারি সাইজের দালান, দেখতে ঠিক একইরকম, এর প্রথমটিই আমাদের কণ্ডো। দূরে, মেরিভেল রোডের ওপর দিয়ে যে রেললাইন চলে গেছে টরন্টো পর্যন্ত, তার ওপার থেকে উত্তর দিকে তাকালে দেখা যাবে বাড়িটা। আশেপাশে তেমন কোনও উঁচু দালান নেই বলে মাইলদুয়েক দূরে যে কার্লটন বিশ্ববিদ্যালয় সেখান থেকেও আমি দেখতে পাই আমার বাসভবন। এই বাড়ির সাত তলাতে আমার নতুন ঠিকানা। তিনটি এলেভেটর পুরো দালানটিতে। লোকজন আসাযাওয়া করছে অবিরত। সামনের দরজা দিয়ে ঢুকে বেশ ভদ্রমত একটা লাউঞ্জ, যেখানে পক্ককেশ বৃদ্ধারা বসে বসে কত কি বলেন সারাদিন ব্যাপী। নিশ্চয়ই পৃথিবীর যাবতীয় সমস্যার সকল সমাধান তাঁরা প্রত্যহই উদ্ধার করে ফেলছেন। বাইরের বারান্দাতে দুটো বেঞ্চ। সেখানে একা একা বসে দিনযাপন করেন বিরানব্বুই বছরের এক হাঙ্গেরিয়ান ভদ্রলোক। প্রথমদিন আমাকে দেখে হয়ত ভাবলেন, এবার একজনকে পাওয়া গেল কথা বলার মত। হাতের ঈশারাতে আমাকে বললেন তার পাশে বসার জন্যে। বসলাম। সময় ছিল বলে নয়, মায়া লাগল বলে। বুড়ো বললেন, তিনি একাই থাকেন একটা কণ্ডোতে, এবং আমার কণ্ডোর ঠিক নিচেরটিতে। জিজ্ঞেস করলাম তাঁর আপনজনেরা কে কোথায় থাকে। স্ত্রী বিগত হয়েছেন ত্রিশ বছর হল, জানালেন তিনি। তাদের এক ছেলে। আমেরিকায় থাকে সপরিবারে—-নিউ জার্সি অঙ্গরাজ্যের কোনও এক বিশ্ববিদ্যালয়ে সঙ্গীত বিভাগের অধ্যাপক। সঙ্গীতের অধ্যাপক? এবং পিয়ানোতেই তার বিশেষত্ব। বাহ, বেশতো। আমার ছেলেও তো তাই। না, আমার ছেলে অধ্যাপক নয়, বিশেষজ্ঞ কিনা তা’ও জানিনা, শুধু জানি পিয়ানোই তার জীবন। ভদ্রলোকের নাম স্ট্যানলি। বললেন, মাঝে মাঝে ছেলে আসে বাবাকে দেখতে। আমার ছেলে যেমন আসে আমাকে দেখার জন্যে। ভাবলাম, আমিও কি একদিন এই বৃদ্ধের মত বাইরের বেঞ্চিতে বসে মানুষের আসাযাওয়া দেখে সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি কাটিয়ে দেব, আর তাকিয়ে থাকব কখন আমার ছেলে আসবে আ্মার সঙ্গে একটু সময় কাটাবে বলে? স্ট্যানলির সাথে একদণ্ড সময় কাটিয়ে বার্ধক্যের নিঃসঙ্গতাটি তীব্রভবে অনুভব করা গেল।
আমার এই নতুন বাসাটি কিন্তু নেহাৎ মন্দ নয়। যারা দেখতে এসেছেন তারা কেউ খারাপ বলেননি। বরং জানতে চেয়েছেন এরকম কণ্ডো আরো আছে কিনা এ-দালানে। আসলেই তাই। সবকিছু যেন একেবারে হাতের কাছে। সাত তলাতে এলিভেটর থেকে বেরিয়ে আপনি ডানদিকে মোড় নেবেন। বাঁদিকের প্রথম দরজাটাই আমার। বাইরে সুন্দর একটা ল্যাম্প ঝুলানো, সবগুলো কণ্ডোতেই। দিনরাত চব্বিশ ঘন্টা জ্বালানো থাকে আলোগুলো। দরজায় এসে হালকা টোকা দিলেই আমি শুনতে পাব। আপনি একটা মাঝারি সাইজের ভেস্টিবোলে ঢুকবেন। আরাম করে বসে জুতো খোলার ব্যবস্থা থাকবে। কোট খুলে হ্যাঙ্গারে ঝুলানোর মত বিস্তর জায়গা আছে ক্লসেটে। তারপর আপনাকে তাকাতে হবে বাঁ দিকে, যেখানে আমার নিজস্ব এলাকা বলতে পারেন। প্রথমেই চোখে পড়বে বেশ বড় আকারের একটা লিভিং রুম। ছোট পরিসরের ভেতর একটা বিশাল ব্যাপ্তির অনুভূতিতে আপনার মন ভরে যাবে, আশা করি। মানুষের মানসিক প্রশান্তি ও প্রসারের জন্যে এই স্পেস জিনিসটার ভীষণ প্রয়োজন। ভেতরদিকে আমার রান্নাঘর, লিভিংরুম থেকে একটা দরজার আড়াল দিয়ে আলাদা করে রাখা (যদিও দরজাটা সবসময় খোলাই রেখে দিই আমি। আমার তো আড়াল করার কিছু নেই)। সেখানে নিচের দেরাজ থেকে শুরু করে বেশ উঁচুতে অবস্থিত বেশ কতগুলো কাবার্ড, যার অধিকাংশই আমার নাগালের বাইরে। অর্থাৎ এই কিচেন আমার মত বেঁটে মানুষদের জন্য তৈরি হয়নি। ছেলেরা বুদ্ধি করে একটা টুল কিনে দিয়ে গেছে আমার জন্যে। এই টুলে দাঁড়িয়ে আমি ওপরের জিনিস খুঁজি, দরকার হলে ওতে বসেই নিচের দেরাজ থেকে রসদ বের করি, যাতে কোমর আর হাঁটুর ওপর বেশি চাপ না পড়ে। কিচেনের ঠিক বিপরীত পাশেই বেশ ভদ্র আকারের ডাইনিং রুম। সেখানে আমার পুরনো বাফে আর হাচ চমৎকারভাবে খাপ খেয়ে গেছে, ছয়জনের লম্বা টেবিল, তা’ও। ছেলেরা সেখানে একটা আধুনিক কায়দার শ্যাণ্ডেলিয়ার লাগিয়ে গেছে। দেয়ালে দুটো পুরনো বাটিকের কাজ। মোটামুটি একটা সম্ভ্রান্ত চেহারা দাঁড়িয়ে গেছে আমার ছোট্ট খাবার ঘরটির। খাবার ঘর আর বসার ঘরের মাঝে কোনও দেয়াল-দরজা নেই। উত্তরদিকের শেষ ঘরটাই আমার শোবার ঘর—-বেশ বড়ই বলা চলে, রীতিমত দুটি ডাবল বেড পাশাপাশি রাখলেও সুন্দর এঁটে যাবে, এতটাই প্রশস্ত। এখানেও সেই একই অনুভূতি সাড়া দেয় মনে—ব্যাপ্তি, বিশালতা। ভেতরে, একেবারে শেষপ্রান্তে সুন্দর একটা বাথরুম। উল্টোদিকে মাঝারি সাইজের একটা ওয়াক-ইন ক্লসেট।
এবার চলুন বাড়ির ওপাশটা ঘুরিয়ে আনি। সেদিকে আরো দুটো বেডরুম—-একটি ছোট, আরেকটি মাঝারি আকারের। আমার ছোট ছেলেটি খুব সুন্দর করে সাজিয়ে রেখে গেছে ঘরদুটি। দেয়ালে বেশ ক’টি ছবি। মাঝেরটিতে, যেটি আকারে বেশ বড়, সেখানে বেডের দুপাশে দুটো ছোট ছোট টেবিল, যাতে কায়দা করে স্থাপন করা হয়েছে দুটি আধুনিক ডিজাইনের লাইটস্ট্যাণ্ড। অপর পাশে দেয়াল ঘেঁষে বেশ ভদ্রমত একটা পড়ার টেবিল, যাতে অনেকগুলো দেরাজ, এবং তার ওপর একটা টেবিল ল্যাম্প। বেশ লাগে। আশা করি আপনার পছন্দ হবে। এটি আমার গেস্টরুম হিসেবে রাখা হয়েছে। যখনই আসতে ইচ্ছে হবে আসুন—-আমার আকর্ষণে না হলেও আমার এই নতুন বাড়িটার টানে। ভাল কথা, ওপাশেও কিন্তু একটা বড়সড় বাথরুম আছে, প্রধানত অতিথিদেরই জন্যে। বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, দেখলে মনেই হবে না আপনার যে পঁয়ত্রিশ বছরের পুরনো বাড়ি।
তবে কি জানেন? ব্যক্তিগতভাবে, আমার সবচেয়ে পছন্দের জায়গা গোটা কণ্ডোটাতে, না, কোনও ঘর নয়, মেঝে নয়, দরজা-দেরাজ কোনটাই নয়, পছন্দের জায়গা হল লিভিঙ্গরুমের কাচের দরজা খুলে বাইরে পা বাড়ালেই যে ছোট্ট ব্যালকনিটুকু, ওটি। সেখান থেকে আমি আকাশ দেখি, পৃথিবীকে দেখি, এমনকি দুটি একটি পাখি, তারাও রেলিঙ্গে এসে বসে মাঝে মাঝে। এই ব্যালকনি থেকে আমি অটোয়া শহরের স্কাইলাইন দেখতে পারি অনেকটাই—-উত্তরে গ্যাটিনোর ছোট ছোট পাহাড়গুলো একটা নীলাভ রহস্যময়তা নিয়ে দাঁড়ায় আমার সামনে। পূবদিকে সকালের সূর্য রোজই আমার শোবার ঘরের জানালাতে উঁকি দিয়ে দ্যাখে আমি জেগেছি কিনা। শেষ বিকেলে এই একই সূর্য উল্টোদিক থেকে লাল রশ্মি ছড়ায় অদূরে উদ্ধত স্পর্ধায় দাঁড়িয়ে থাকা একটি কাচের দালানের জানালাতে—-সেই লালের আভা ছিটকে পড়ে আমার এই ব্যালকনির গায়ে। কয়েক মুহূর্তের জন্যে আমার ছোট্ট কণ্ডোখানি শিল্পীর বিমূর্ত ছবিতে পরিণত হয়। বাবু আমার জন্যে দুটি প্লাস্টিকের লন চেয়ার কিনে দিয়েছে ব্যালকনিতে বসার জন্যে। মাঝে মাঝে আমি চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে বসে যাই তাতে—-একটা বিরল সুখের মুহূর্ত বটে। ডানদিকে নগরের চলমান জীবন সকাল থেকে রাত দশটা এগারোটা পর্যন্ত স্রোতের মত ভেসে যায় আমার চোখের সামনে। ওয়ালমার্টের দোকান ঘিরে সবসময়ই দারুণ ব্যস্তসমস্ততা—-ক্রেতাদের অবিরাম আসাযাওয়া, দূর থেকে তাদের গাড়িগুলোকে মনে হয় পরস্পরের গায়ে গায়ে আঁট হয়ে আবদ্ধ হয়ে আছে। গতির মধ্যেও স্থবিরতা তার নিজের ঠাঁইটুকু কেমন করে যেন গুছিয়ে নিয়েছে। ওয়ালমার্টের ঠিক পেছনেই বেশ বড় একটা জনপদ গড়ে উঠেছে গত দুচার বছরে। আমার ব্যালকনি থেকে সেই বাড়িগুলোর ছাদ পাশাপাশি দাঁড়িয়েছে ইউক্লিডের জ্যামিতির ত্রিভুজাকৃতি মূর্তি নিয়ে—-অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলে মনে হবে তারা সবাই মিলে প্রকাণ্ড এক ঢেউ সৃষ্টি করেছে, যাতে সময় হঠাৎ করেই থিতু হয়ে গেছে। দূরে, বেশ অনেকটাই দূরে, একাকি একটি অট্টালিকা, আকাশ ভেদ করে ছুটবে যেন। তার পাশে কোনও টেলিভিশন স্টেশনের উঁচু, ভীষণ উঁচু অ্যান্টেনা—-সন্ধ্যার পর তার মিটমিটে আলোটির পিতপিত করে জ্বলা-নেভার
দৃশ্য, সে’ও যেন এক অলৌকিক ঘটনা রাতের তারাদের মাঝে। আমার সাততলার সীমানা থেকেই মনে হয় আমি ভাসছি, মেঘের মত, আলাদিনের ঐন্দ্রজালিক উত্তরীয়ের মত, যেন কুয়াষা হয়ে আচ্ছন্ন করে রেখেছি চারদিকের শান্ত পরিবেশ। নিচে কণ্ডোমিনিয়ামের ব্যস্ত জীবন অব্যাহত গতিতে চলছে—তা’ও দেখতে পাচ্ছি আমি। গ্যারাজ থেকে গাড়ি বেরুচ্ছে, গাড়ি ঢুকছে, বাইরে ফুটপাথের ওপর বুড়োরা হাঁটছে, কেউ লাঠিতে ভর করে, কেউ ওয়াকার ধরে, কেউবা তার সঙ্গীর হাতে হাত রেখে। বেশ কজন আছেন এখানে যারা একেবারেই পঙ্গু, হুইলচেয়ার ছাড়া কোনও উপায়ই নেই তাদের। বৃদ্ধকে ঠেলে নিচ্ছেন বৃদ্ধা, কিংবা বৃদ্ধাকে নিচ্ছেন বৃদ্ধ। তরুণ পরিবার যে নেই একেবারে তা নয়, কিন্তু তারা নিদারুণভাবে সংখ্যালঘু। উপমহাদেশীয় পরিবারও দেখেছি দুচারটে। অন্তত একটি বাংলাদেশী পরিবারের সাথে আলাপ হয়েছে। হয়ত আরো আছে। মজার ব্যাপার যে এদের কোনটিতেই কোনও পুরুষের উপস্থিতি লক্ষ করা গেল না। আমাদের দেশের মেয়েরা বিদেশে এসে স্বাধীনতার স্বাদ পাচ্ছেন, নিজেদের জীবন, এবং সম্ভবত তাদের ছেলেমেয়েদের জীবনেরও, দায়িত্ব সব নিজেদেরই হাতে তুলে নিতে পারছেন, দেখে আনন্দে ভরে যায় মন। এভাবে তারা যদি অন্যান্য সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বেড়িগুলো থেকেও মুক্ত হতে পারতেন তাহলে সমাজের চেহারাটাই আগাগোড়া পালটে যেতে পারত। তা কি হবে কখনো আমাদের দেশে? সম্ভবত, না, তবুও আশা করতে দোষ কি।
আমার এই নতুন বাড়িখানার কোনও খুঁত আছে কিনা তলিয়ে দেখার চেষ্টা করিনি। থাকবে নিশ্চয়ই, কিন্তু তা নিয়ে নালিশ করার মানসিকতা আমার নেই। জীবনের কোনকিছু নিয়েই আমি কোনও অভিযোগ করার পক্ষপাতী নই। অভিযোগ করার অভ্যাসটাও একধরণের চারিত্রিক দীনতা বলে আমি গণ্য করি। আমার এবাড়ি ঠিক আগের বাড়িটির মত নয়, তাতে হয়েছে কি? প্রথম প্রেমের মত প্রেম দ্বিতীয়বার কখনোই হয় না। বর্তমান কেবল বর্তমানেরই মত, তার সঙ্গে অতীতকে মেলাবার চেষ্টা করাটাই বোকামি। আসলে আমার আগের বাড়ির তুলনায় এবাড়ির অভাব কিছু নেই, বরং যা আশা করেছিলাম তার চেয়ে বেশিই পেয়েছি বলে নির্দ্বিধায় ঘোষণা দিতে পারি।
শুধু একটি জায়গায় ছোট একটা কিন্তু আছে।
নতুন বাড়িতে আসার পর আমার কলম থেমে গেছে। ‘কিন্তু’টা এখানে। ২৫শে জুন থেকে আজ অবধি একটা লেখাও দাঁড় করাতে পারিনি। না, একটা শব্দও বের হয়নি আমার মাথা থেকে। যেন সব বোবা হয়ে গেছে সহসা। খুঁজে পাচ্ছিলাম না কারণটা কোথায়। কারণ তো একটা থাকতেই হবে—গত চব্বিশ বছর ধরে আমি লেখালেখি করে এসেছি, ছাইভস্ম যা’ই লিখিনা কেন। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই একটা নতুন লেখা তৈরি করতে পেরেছি, ব্যক্তিগত সমস্যা আমার যা’ই থাকুক। সেই একই আমি হঠাৎ করে একেবারে চুপ, এটা আমার নিজের কাছেই ভীষণ বিসদৃশ লাগতে শুরু করেছিল। কারণ, কারণ একটা অবশ্যই আছে। এসব স্থূল বিষয়গুলোতে কার্যকারণ সম্পর্কের নীতিতে আমি বিশ্বাসী। কিন্তু সেই কারণটা কি?
বাড়িবদলের সময় আমার দুই ছেলেই এসেছিল ওদের কাজকর্ম ফেলে। ছোট ছেলে ছিল চারদিন, বড় ছেলে পুরো দু’সপ্তাহ। দরকার ছিল না, তবুও ছিল। আমার সবকিছু গোছগাছ করে দিয়ে যাবে, এই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। যাতে কোথাও কোনও অসুবিধা না হয় আমার, যখন যা দরকার হাতের কাছে পেয়ে যাই। এমনকি তারা দু’ভাইতে মিলে আমার জন্যে আলাদা একটা ‘পড়ার ঘর’, যাকে ভদ্রভাষায় বলা হয় ‘স্টাডি’, তা’ও ঠিক করে গিয়েছিল। আমার আগের বাড়িতে আমি যে পড়াশুনা করিনি একেবারে তা নয়, বইপত্র ছিল নেহাৎ মন্দ না, কিন্তু সেখানে ‘পড়ার ঘর’ বলতে সত্যিকার অর্থে আলাদা কোন ঘর ছিল না আমার। লেখাপড়ার যত কাজ সব হয়েছে আমার রান্নাঘরের টেবিলে বসে। ওই টেবিলে বসে আমরা খাবার সময় সবাই মিলে খেয়েছি (যখন ওরা সবাই ছিল আমার সাথে), নাস্তার সময় নাস্তা করেছি, আবার আড্ডা দেবার সময় হলে আড্ডাও দিয়েছি। তারপর যখন পড়ার সময় হত তখন বাসনপত্র সরিয়ে পড়ার বই বা খাতাকলম নিয়ে বসেছি। এভাবেই কেটেছে আমার ত্রিশটা বছর। ওই টেবিল থেকেই ছেলেরা একে একে চলে গেছে দূর দূর জায়গাতে, নিজ নিজ জীবনের খোঁজে। ওই টেবিল থেকেই বিদায় দিয়েছি আমার ৪১ বছরের জীবনসঙ্গিনীকে। ওখানে বসে আমি সমাধান করেছি অনেক জটিল গাণিতিক সমস্যা। লিখেছি অনেক ব্যক্তিগত গল্প-নিবন্ধ, যা ছাপা হয়েছে অটোয়ার ‘মাসিক বাংলাদেশ’ পত্রিকাতে, তারপর টরন্টোর ‘দেশে-বিদেশে’তে, ‘আমরা’তে, নিউ ইয়র্কের ‘প্রবাসী’, ‘বাঙালি’ ও ‘নতুন প্রবাসী’তে। সবই ঐ পুরনো নড়বড়ে টেবিলটার ওপর বসে—খাবার সময়কার খাবারদাবার আর বাসনপত্র সরিয়ে নেবার পর। বাড়িবদলের সময় আমার ছেলেরা বললঃ আব্বু, এই মান্ধাতার আমলের টেবিলটাকে ফেলে দিতে হবে। এটা এখন আর এন্টিকও নয়, স্রেফ জাঙ্ক। আস্ত আবর্জনা ছাড়া কিছু নয়। এর পায়াগুলো দেখেছ? কেমন বাঁকা হয়ে যাচ্ছে দেখেছ? আর এই ছেঁড়া বাঁকাচোরা চেয়ারগুলো? ছিঃ ওগুলোতে তুমি বস কেমন করে? গদির ভেতরটা সব বেরিয়ে এসেছে। লোকে বলবে কি? বলবেঃ এবাড়ির ছেলেরা বুড়ো বাপের ছেঁড়া চেয়ারগুলোও বদলাতে পারে না। কি পাষাণ ছেলেরে বাবা! অতএব আউট। এই টেবিল আর এই শতছিন্ন চেয়ার সব চলে যাবে জাঙ্কইয়ার্ডে। না, স্যালভেশন আর্মিতেও নয়, একেবারে সোজা বর্জ্যস্তূপে। ওরা দুজনই এমন জোর দিয়ে বলছিল কথাগুলো যে আমি মুখ খুলে বলারই সাহস পেলাম না যে ভাঙ্গা হোক ছেঁড়া হোক এতে তো আমার আরামের কোনও অভাব হচ্ছে না, আমার কাজ যা করার তা তো ঠিকঠাকই চালিয়ে যেতে পারছি, তাহলে অনর্থক আমার এতদিনের পুরনো সঙ্গীটাকে তোমরা ফেলে দিতে চাচ্ছ কেন? জানি ওরা নতুন যুগের মানুষ, ওরা বোঝে আমার চেয়ে অনেক বেশি, অতএব ওরা যা বলছে তা নিশ্চয়ই ভেবেচিন্তেই বলছে। শেষ পর্যন্ত ওরা আমার চোখের সামনে দিয়ে সেই নিরীহ টেবিল আর চেয়ারগুলোকে পাঁজাদোলা করে বের করে নিয়ে গেল বাড়ি থেকে। জীবনের এই প্রথম আমার মনে হয়েছিল একটা জড়পদার্থও অনেকদিন একটা মানুষের সঙ্গী হয়ে থাকার পর তার জড়তাটা কেটে যায়, একসময় সেই মানুষটির আত্মার সাথে একাত্ম হয়ে যায়। অর্থাৎ সে তার জড়ত্বের আবরণ ছাড়িয়ে একপ্রকার স্পর্শকাতরতা অর্জন করে নেয়, প্রায় জীবনসঙ্গীদের মত, দুটিতে মিলে পরস্পরের হৃদস্পন্দনের মধ্যে অভিন্নতাপ্রাপ্ত হয়।
সেই সঙ্গীটিকে তারা পোড়োবাড়ির পচা কাঠের মত পরম অবজ্ঞায় তুলে নিয়ে গেল আমার বাড়ি থেকে। ছেলেরা আশ্বাস দিয়েছিল আমাকেঃ এবার একটা দেখার মত ‘স্টাডি’ হবে তোমার আব্বু। লোকের চোখে তাক লেগে যাবে যদি দেখতে আসে কেউ। বেশ ভদ্রমত একটা মেপল কাঠের টেবিল, তার পাশে আরামপ্রদ ক’টি চেয়ার, মানে যাকে চেয়ার বললে লোকে হাসাহাসি করবে না। বেশ তো, দেখা যাক, দেখা যাক, বললাম আমি। আমি সেই ‘মেপল কাঠের টেবিল’ আর ‘আরামপ্রদ’ চেয়ারের দিকে তাকিয়ে থাকলাম ক্ষুধিত কাকের মত।
ওরা চলে গেল। বাড়িতে কেবল আমি। আর আমি। প্রথমদিকে এই ‘আমিময়তার’ অনুভূতিটা কেমন অদ্ভুত মনে হতে লাগল। চতুর্দিক থেকে কেমন একটা অচেনা শব্দ ছুটে আসে আমার দিকে, শরের মত ঘা দিয়ে চেতনাকে অবশ করে ফেলে। দুদিন পর আমার এই আধুনিক সরঞ্জাম দিয়ে সাজিয়ে রেখে যাওয়া ‘পড়ার ঘর’টিতে প্রবেশ করার সাহস পেলাম বুকে। চেহারা দেখে তো ভালই মনে হল। বেশ ঝকঝকে একটা টেবিল বটে। চেয়ারটাও নেহাৎ মন্দ না। কিন্তু দুটোর কোনটাই ঠিক পরিচিত নয় আমার। একটু সময় লাগবে, মনকে বুঝালাম। নতুন জামাকেও সময় দিতে হয় গায়ের সঙ্গে খাপ খেতে। পড়ার টেবিল আর চেয়ারও তো তাই। আমার শরীরের সাথে তাদের খাপ খাইয়ে নিতে হবে। শরীর কেবল নয়, মেজাজমর্জির সাথেও। অর্কেস্ট্রার মিহিন, মিষ্টি তারের সঙ্গে যেমন করে খাপ খেতে হয় ভারি সুরের ব্যাজবাদ্যকে। এগুলো আমার আধুনিক ছেলেদের বোঝাই কেমন করে বলুন তো।
তাই সময় নিলাম। নিজেকে বুঝালাম। জীবনের কতগুলো সূক্ষ্ম বিষয় আছে যা প্রচলিত ব্যাখ্যার শাসন মানতে রাজি নয়, যা কেবল নিজেরই ধর্ম অনুযায়ী নিজের জায়গা খুঁজে নেয়। আমার ছেলেদের যতœ করে সাজানো-গুছানো স্টাডিতে এসে আমি টুকটাক দুচারটে শব্দ লেখার চেষ্টা করি। বিশ্বস্ত ল্যাপটপটি, যা কখনোই কোন সমস্যা দেয়নি আমাকে, কেন জানি এগুতে চাইল না। একটা বাক্য, বা একটা তুচ্ছ শব্দ, তা’ও ভীষণ বেসুরো মনে হচ্ছিল। নাহ, এসব আজেবাজে কি লিখছি আমি? লোকে বলবেঃ মীজানভাই ঠিক আছেন তো? মাথায় কোনও গণ্ডগোল হয়নি তো? এবয়সে গণ্ডগোল হওয়াটা এমন কোনও অস্বাভাবিক কিছু নয়। অতএব ডিলিট করে দিই সব। তারপর আবার লিখতে শুরু করি কিছু একটা—-যাচ্ছেতা যা মাথায় আসে তা’ই। দুচার লাইন লেখার পর পড়ে দেখি কেমন লাগছে। লজ্জায় মরে যাই আমি—আমার হাত দিয়ে এসব কি বেরুতে শুরু করেছে? এবার আমি উদ্বিগ্ন হতে শুরু করি। লেখার হাতটা কি হারিয়ে ফেললাম শেষ পর্যন্ত? নিজেকে নিয়ে এক মহা ভাবনায় পড়েছি আমি। অবশেষে কি সেই ভয়াবহ রোগটি আমাকেও পাকড়াও করে ফেলল? যা আমার বয়সের শতকরা ৬০ জনের কাছ থেকে সাধারণ হিতাহিতজ্ঞানটুকুও হরণ করে নিয়ে যায়? তাকে শিশুতে পরিণত করে? কিন্তু না, তাই বা হয় কি করে। গণিতের ফর্মুলাগুলো তো ভুলিনি। দৈনন্দিন জীবনের স্বাভাবিক প্রক্রিয়াগুলোর কোনটাই তো খেলাপ হচ্ছে বলে মনে হয়না। খাওয়ার সময় খাচ্ছি, নাওয়ার সময় নাইছি, লোকজনের সাথে কথাবার্তাও তো মনে হচ্ছে আগের মতই জড়তাহীন। এমনকি, আগের মত করে আমি এখনো ফোন নাম্বার মনে রাখতে পারি অনেকেরই। নাহ্, এটা ডিমেন্সিয়া নয়, অন্যকিছু। অন্য কোনও রহস্যময় পীড়াতে ধরেছে আমাকে।
তারপর সেই ‘পীড়া’র সন্ধানে বেশ ক’টা দিন কাটলো আমার। কি হতে পারে? কেন হঠাৎ করে সবকিছু এমন আড়ষ্ট হয়ে গেল। তাকালাম চারদিকে। আমার শোবার ঘর, বসার ঘর, পাকের ঘর, শেষে ওদের যতœ করে সাজিয়ে রেখে যাওয়া ‘পড়ার ঘর’ খানি। কোথায় যেন একটা খটকা লাগলো মনে। কিছু একটা নেই আমার সুসজ্জিত ‘পড়ার ঘর’ টিতে। হঠাৎ, হঠাৎ করেই গাড়ির তীব্র হেডলাইটের মত এক পশলা আলো এসে আমার সামনে আছড়ে পড়ল। ওমা, তাইতো! এ তো আর কিছু নয়, আমার সেই হতভাগা টেবিলখানা, আর তার সাথে একাঙ্গি হয়ে থাকা ছেঁড়া চেয়ারখানি। ওগুলোকে ফেলে দিয়েছি বলে ওরা আমাকে অভিশাপ দিয়েছে। পুরো ত্রিশটা বছর আমি ওই পায়াভাঙ্গা, সস্তা, রদ্দিমার্কা টেবিল আর চেয়ারে বসে লেখালেখি করেছি, অঙ্ক করেছি। খুব একটা আরাম যে ছিল সেখানে তা নয়। দিনের বেলাতেও সেখানে আলো জ্বেলে কাজ করতে হত। সেখানে খাবারের গন্ধ লেগে থাকত হরহামেশা। তরিতরকারির ঝোল লেগে বিশ্রি একটা রঙ ধরে গিয়েছিল তাতে। লোকজন এলে বইপত্র সরিয়ে কাপড় দিয়ে মুছে কোনরকমে একটা ভদ্র চেহারা দাঁড় করানোর চেষ্টা করতাম। তারপর অতিথি চলে গেলে খাতাপত্র মেঝে থেকে তুলে আগের মত স্তূপ করে রাখা হত টেবিলের ওপর। চিরকাল তাই করে এসেছি। সেই বিশ্রি, ময়লা, হতচ্ছিরি টেবিল আর চেয়ারখানি, কি এক বিচিত্র উপায়ে আমার অস্তিত্বের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে মিশে গিয়েছিল। ওই চেয়ারে বসে ওই টেবিলের ওপরকার নানা জঞ্জাল একপাশে ঠেলে রেখেই আমি নিশ্চিন্তে, নিরবচ্ছিন্ন একাগ্রতার সাথে লেখালেখি করতে পেরেছি। আমার ছেলেরা সেগুলো ফেলে দিয়েছে। কেমন করে বোঝাই ওদের যে তার সাথে আমার আমিত্বেরও একটা বড় অংশ ক্ষয় হয়ে গেছে। না, আমি তোমাদের হাল ফ্যাশানের আসবাব চাই না, চাইনা মেপল কাঠের শক্ত, মজবুত টেবিল, চাইনা আনকোরা নতুন কোনও চেয়ার—-আমাকে সেই ভাঙ্গা আসবাবগুলোই ফিরিয়ে দাও।
অটোয়া, ১লা অক্টোবর, ‘১৪