আমাদের মেয়েরা ও আমরা
মীজান রহমান
আমি কি হিংসা করি কাউকে?
না, এখন করিনা, আগে করতাম। হিংসা করতাম যারা আমার চেয়ে বেশি মেধাবি, বেশি সফল, তাদের। আরো হিংসা করতাম যাদের সৌভাগ্য হয়েছে কন্যাসন্তানের পিতা হবার। অনেকদিন আগের কথা সেগুলো। সেসব দিন পার হয়ে গেছে বহু আগে। এখন সংসারে কারো প্রতি হিংসা বা ঈর্ষার ভাব পোষণ করিনা আমি। বিশেষ করে কন্যার বাবাদের। বরং ভাবি, ভাগ্যিস আমাদের মেয়ে হয়নি।
ভাগ্যবান ভাবার কারণ, আমাকে মেয়ে বিয়ে দিতে হয়নি। প্রবাসে মেয়ে বিয়ে দেওয়া যে কতবড় সমস্যা সেটা আমার সমসাময়িকদের মধ্যে দেখেছি, আমার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট তাদেরও হিমশিম খেতে দেখছি আজকাল। বড় সমস্যা মেয়েরাই। বিশেষ করে যাদের জন্ম এখানে। পশ্চিমের কালচারে আজকাল মেয়েদের কেউ ‘বিয়ে দেয় না’, তারা ইচ্ছে হলে বিয়ে করে নিজেদের পছন্দমত ছেলেকে, ইচ্ছে না হলে আদৌ করেনা। ঐ ‘ইচ্ছার স্বাধীনতা’টুকু দেখে দেখেই তারা বড় হয়েছে। কিন্তু আমাদের বাবামায়েরা ‘মেয়েদের ইচ্ছাকে’ তেমন গুরুত্ব দিয়ে অভ্যস্ত নন—-এটা আমাদের ‘কালচার’এই নেই। পরিবার ভালো, ছেলে ভালো, চাকরি ভালো—আর কি চাই? মেয়ের আপত্তি থাকার তো কোনও কারণই নেই। সমস্যাটা সেখানেই। আমরা, পাক-ভারত-বাংলার বাবামায়েরা সেদিকটা দেখিনা ভালো। বুঝিনা কেন ওদের এদেশে জন্মানো আর বড় হওয়ার সাথে ‘বাবামায়ের পচ্ছন্দকরা’ পাত্রের কি সম্পর্ক থাকতে পারে। আমরা বুঝিনা যে জীবনসঙ্গি হিসেবে ছেলেদের যা চাহিদা মেয়েদের চাহিদা ঠিক তা নয়। বুঝিনা এজন্যে যে আমাদের কালচারে ‘ইচ্ছার স্বাধীনতা’, ‘ছেলেমেয়ের চাওয়াপাওয়ার পার্থক্য’—-এসব সূক্ষ্ম ‘পশ্চিমা’ ব্যাপার স্যাপার নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। আমরা বুঝি যে ‘সংসার সুখের হয় রমনীর গুণে’। এবং সংসার সুখের হতে হলে রমনীকে সুস্থ সবল সন্তান উৎপাদন করতে হবে, স্বামী ও শ্বশুর-শাশুড়ির সেবা-শুশ্রূষা ও দেখভাল করতে হবে, গৃহস্থালীর সুষ্ঠু পরিচর্যা করে শ্বশুরালয়ের ছোটবড় সবাইকে খুশি রাখতে হবে। বিদেশে-জন্মানো ছেলেরা সেটা যত সহজে মেনে নিতে পারে মেয়েরা তত পারেনা। খটমটিটা শুরু হয় সেখানেই। এবং এই ‘খটমটি’র সূত্রপাতটি ঘটে প্রধানত যখন দুপক্ষেরই শ্বশুর-শাশুড়ি একই শহরে বসবাস করেন (একই পরিবারের অন্তর্গত হলে তো কথাই নেই। একেবারে সোনায় সোহাগা)।
আরো একটা বড় সমস্যা—-মেয়েদের কেরিয়ার। দেশে ‘মেয়েদের কেরিয়ার’ হল স্বামীর ঘরে, এদেশেও একসময় তাই ছিল। কিন্তু নতুন যুগের আলোতে সব পালটে গেছে। এখন ছেলেদের কেরিয়ার আর মেয়েদের কেরিয়ার বলে আলাদা কিছু নেই—-সবারই সমান অধিকার। উইমেন্স রাইটস, হিউমান রাইটস, চার্টার অফ রাইটস—–হাজার রকম ‘রাইটসের’ প্রভাবে পশ্চিমের সমাজ একেবারে কানায় কানায় ভরা। মুস্কিলটা এখানেই—আমরা পূর্বাঞ্চলের বাবামায়েরা মনের দিক থেকে চিরপ্রাচ্য, অন্তত মেয়েদের ব্যাপারে, ওদিকে মেয়েরা শতভাগ প্রতিচ্য। ‘প্রাচ্য-প্রতিচ্য দোঁহে নাহি মেলে’—কথাটি দুর্ভাগ্যবশত অধিকাংশ অভিবাসী পরিবারেই প্রযোজ্য।
আমার কথাবার্তায় পাঠক যেন ভেবে না বসেন যে আমাদের দেশের বাবামায়েরা তাদের মেয়েদের সুখশান্তির ব্যাপারে একটু উদাসীন। মোটেও তা নয়। বরং উলটো। পৃথিবীর সব সমাজেই, ধনীদরিদ্র নির্বিশেষে, আমি যতদূর জানি, মেয়েরা প্রায় সবসময়ই বাবাদের চোখের মনি, আদরের ধন, তাদের ‘রাজকন্যা’। প্রাচ্য ও প্রতিচ্য, উভয় গোলার্ধেই বাবারা, মায়েরা তো অবশ্যই, কামনা করেন তাদের সেই পরম আদরের কন্যাগুলি যেন চিরসুখি হয়, দীর্ঘজীবী হয়, রতœগর্ভা হয়। মুস্কিল এই যে তাঁদের চিন্তাধারার সাথে আধুনিক যান্ত্রিক যুগের ছেলেমেয়েদের চিন্তাধারা একেবারেই খাপ খায় না। ‘চিরসুখি’ বলতে বাবামায়েরা যা ভাবেন ছেলেমেয়েরা তা ভাবে না। মেয়েরা তো রীতিমত কয়েদখানা মনে করে তাঁদের সেই ‘চিরসুখ’এর জীবনকে। ছেলেরা তবু আপোস করতে প্রস্তুত অনেক ক্ষেত্রে, কিন্তু মেয়েরা সহজে বশ মানতে রাজি নয়। ওরা নিজেদের জীবন বলতে আলাদা একটা পরিচয় তৈরি করে নিতে চায়—-ওটা তাদের জন্মগত অধিকার।
শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত পরিবারের বাবামায়েরা অনেক সময় মেয়েদের মনের কথা ভেবেই যুগের সঙ্গে পা মিলিয়ে চলতে রাজি হয়ে যান। ঠিক আছে মা, তুমি পড়াশুনা শেষ করে বিয়ের কথা ভাবতে চাও, তা’ই হোক। কিন্তু মনে রেখো, মেয়েদের বিয়ের বয়স কিন্তু চট করে পার হয়ে যায়। তখন কিন্তু তোমার জীবনের দায়িত্ব তোমাকেই নিতে হবে ষোল আনা। এবং সত্যি সত্যি তাই হয়। দেশে যেমন হয় বিদেশে আরো বেশি। দেশে তো তবু টাকা দিয়ে ছেলে কেনা যায়, কিন্তু বিদেশে তা সম্ভব নয়, অন্তত শিক্ষিত সম্ভ্রান্ত পরিবারে সেরকমটি আমি ব্যক্তিগতভাবে দেখিনি। অতএব শেষ পর্যন্ত যা দেখা যায় তা প্রায় কারুরই পরম কাম্য নয়—-মেয়ে চিরকুমারী থেকে যায় সারাজীবন, নতুবা ভিনজাতীয় ভিনধর্মীয় ছেলের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে নেয়। আজকাল ক্যানাডা আমেরিকার অভিবাসী সমাজের ঘরে ঘরেই দেখা যাচ্ছে হয় চল্লিশ পঞ্চাশ বছর বয়স্ক অবিবাহিত মেয়ে, নয়ত ভিনদেশী জামাই। ভিনদেশী ছেলেমেয়ের বিয়েতে অন্তত আমার অমত নেই, কিন্তু সমস্যা অন্যখানে। প্রথমত দুটি ভিন্ন ভিন্ন মানুষ একত্রে আমৃত্যু একসঙ্গে বসবাস একটি অপ্রাকৃতিক ঘটনা, কারণ দুটি মানুষ পরস্পরের সঙ্গে নিখুঁতভাবে খাপ খেয়ে যাওয়া খুবই অস্বাভাবিক। ইংরেজিতে আমি একে বলি ‘ন্যাচুরেল ইনকম্পাটিবিলিটি’। তবু ছেলেমেয়েদের কথা ভেবে, সমাজের কে কি বলবে সেদিকটা লক্ষ্য করে, পারিবারিক শান্তির খাতিরে, এবং সর্বোপরি অর্থনৈতিক কারণে অনেক বিয়েই শেষ পর্যন্ত টিকে থাকে। কিন্তু বর্তমান যুগের নানাবিধ ‘অধিকার’ বোধের কারণে আগেকার সেই বন্ধনগুলো ঠিক একই রকম শক্ত গেঁটোতে আবদ্ধ নয়। অর্থনৈতিক কারণটিও আগের চেয়ে অনেকটাই শিথিল আজকে—-এযুগের বৌমাদেরও কাজে যেতে হয়। প্রধানত একজনের উপার্জনে সংসার চালানো শক্ত, দ্বিতীয়ত লেখাপড়া-জানা বৌ ঘরে বসে থেকে কি কেবল শ্বশুর-শাশুড়ির পা টেপাটেপি আর অজুর পানি গরম করেই জীবন কাটাবে? বিদেশে তো আরো সঙ্গিন অবস্থা। চাকরির বাজারে নিদারুণ সংকট আজকাল। পাস-করা ডাক্তারকে অনেকসময় ট্যাক্সি চালাতে হয়, বিএ-এমএ ডিগ্রিধারী স্ত্রীকে টিম হর্টন বা ওয়ালমার্টের কাউন্টারে কেশিয়ারের কাজ করতে হয়—-নতুবা তাদের মর্টগেজ দেওয়া সম্ভব হবে না, ছেলেমেয়েদের জামাকাপড় কিনে দেওয়া সম্ভব হবে না, তিনচার বছর পর পর দেশে বেড়াতে যাওয়া একেবারেই অসম্ভব, ঢাকা শহরে পাঁচ কাঠা জমি কেনার স্বপ্ন সফল হবে না জীবনেও। অতএব এরা দুজনই অর্থনৈতিকভাবে নির্ভরশীল পরস্পরের ওপর—-আগেকার মত স্বামীর ওপর স্ত্রী, তা নয়। এ এক ভিন্নধরণের বন্ধন—-দুজনই উপার্জনক্ষম, সুতরাং একাধারে মুক্ত অথচ মুক্ত নয়। এসব পরিবারে সবচেয়ে উপেক্ষিত হয় ছেলেমেয়েরা—–ছুটির দিন ছাড়া সচরাচর বাবামায়ের মুখ দেখারই সুযোগ হয়না তাদের। ছোট থেকে বড় হওয়া পর্যন্ত তাদের মূলত আপনা-আপনিই বেড়ে উঠতে হয়। তারপর একসময় বাবামায়ের চোখে পড়েঃ তাইতো, আমাদের মেয়ের যে বিয়ের বয়স হয়ে গেছে। শুরু হয়ে যায় পাত্র খোঁজার হিড়িক। দেশের মুরুব্বিদের কাছে, বিলেত আমেরিকার আত্মীয়স্বজনদের কাছে। তাদের ধারণা নেই যে ইতোমধ্যে, তাদের চোখের আড়ালে, তাদের কর্মজীবনের ২৪/৭ এর আড়ালে, তাদের আদরের ছোট খুকিটির একটা নিজস্ব মন গড়ে উঠেছে, নিজস্ব পরিচয়ের পরিধি গড়ে উঠেছে, বিদেশী সমাজের ধ্যানধারণার সঙ্গে গড়ে উঠেছে এক প্রকারের একাত্মতা।
পাত্রের খোঁজে সারা দুনিয়ার এক মাথা থেকে আরেক মাথা পর্যন্ত চষে বেড়ানোর পর বাবামা মেয়ের সামনে হাজির করলেন একজন অতি সুযোগ্য পাত্র—-মেয়ে তার দিকে না তাকিয়েই বলে দিলঃ উঁহু, তা হবে না। আমি এখন বিয়েই করব না। আমার কম্পিউটার সায়েন্স পাস করতে হবে, তারপর চাকরি বাকরি পেলে দেখা যাবে বিয়ে করব কি করব না। বাপ মা মাথায় হাত দিয়ে বলেনঃ সব্বনাশ, একি বলে মেয়ে? একারণেই কি আমরা দুজন দিনরাত গাধার মত খাটনি খেটে যাচ্ছি? একারণেই কি দেশের আপনজন সবাইকে ছেড়েছুড়ে দিয়ে বিদেশবিভুঁইতে এসে চাকরবাকরের মত জীবনযাপন করা?
ওদিকে ছেলের মুখেও সেই একই কথা। আমি এখন বিয়ে করবনা। কেরিয়ার আগে, তারপর বিয়ে। তাছাড়া বিয়ের দরকারই বা কি। তাইতো। বিয়ের দরকারই বা কি। এমন দুনিয়াছাড়া কথা দেশ-থেকে-আসা পুরনোদিনের বাবামায়েরা বুঝবেন কেমন করে? তাদের ধারণাই নেই যে বিবাহ নামক যে পুরাকালীন প্রতিষ্ঠানটি মানুষ গড়ে তুলেছিল নেহাৎ সামাজিক শৃঙ্খলার খাতিরে, যার অন্য কোনও গূঢ় নৈতিক বা নৃতাত্বিক তাৎপর্য নেই, থাকার কোনও যৌক্তিক কারণও নেই, সেই পরম ‘পবিত্র’ প্রতিষ্ঠানটির ভিত্তি এখন নড়বড়ে হয়ে উঠেছে আধুনিক যুগের ব্যক্তিস্বাধীনতা ও মুক্ত পরিবেশের প্রভাবে। আমরা, পুরনো দিনের সেকেলে মনোভাবের মানুষ, এটিকে কিছুতেই মেনে নিতে পারছিনা। সেটা যেমন স্বাভাবিক, নতুন দিনের নতুন প্রজন্ম যে তাকে গ্রহণ করে নিতে পারছে, তা’ও সমান স্বাভাবিক। সমস্যা হল ওরা আমাদেরই সন্তান—-একই পরিবারে দুটি ভিন্ন শিবির তৈরি হয়ে যাওয়া কারো পক্ষেই কল্যানকর নয়।
আমাদের প্রবীনদের একটা কথা বুঝতে হবেঃ যুগ আমাদের মনের দিকে চেয়ে তার ধারা পরিবর্তন করবে না। বিদেশে তো নয়ই, দেশেও না। পরিবর্তনটা হতে হবে আমাদের নিজেদের ভেতরই। পোশাকে-আশাকে সাজসজ্জায় আর বাহ্যিক আচার আচরণে তো হয়েই যাচ্ছি, কিন্তু বড় পরিবর্তনটা আসতে হবে মনমানসিকতায়। পূব থেকে পশ্চিমে এসেছি আমরা উন্নত জীবনযাপনের আশাতে। পশ্চিমের অগ্রমুখি সমাজের সুযোগসুবিধাগুলো সব উপভোগ করে যাব অবলীলাক্রমে, অথচ পূর্বদেশের পশ্চাতমুখি ধ্যানধারণাগুলি প্রাণপন আঁকড়ে বসে থাকব তা তো হতে পারেনা। কিন্তু তা হয়, অধিকাংশ পরিবারেই হয়। এবং সেকারণে নতুন প্রজন্মের সাথে ঠোকাঠুকিটাও হয় অবধারিতভাবে। এর একটা বিহিত না করতে পারলে একদিকে যেমন স্থানীয় সমাজ থেকে ক্রমেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ব আমরা, বহুলপ্রচারিত বহুজাতীয়তা সত্বেও, অন্যদিকে বিচ্ছিন্ন হব আমাদের ছেলেমেয়েদের কাছ থেকেও। এই ‘বিহিতের’ প্রচেষ্ঠাতে ব্যক্তি আর পরিবারকে কেবল নয়, পুরো সম্প্রদায়কেই এগিয়ে আসতে হবে। সমষ্টির যুগ্ম প্রয়াস ছাড়া একক চেষ্টাতে দীর্ঘস্থায়ী সমাধান প্রায় অসম্ভব বলেই আমি মনে করি।
প্রশ্ন হলঃ এই সমষ্টিগত প্রয়াসটির চেহারা কিরকম হওয়া উচিত। আজ থেকে প্রায় ত্রিশ বছর আগে আমরা কজন মিলে একটা উদ্যোগ নিয়েছিলাম অটোয়াতে একটি বাঙালি সামাজিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে। অনেকটা কমিউনিটি সেন্টারের মত। প্রাথমিকভাবে আমাদের প্রস্তাবটি ছিল, ঠিক কমিউনিটি সেন্টার না হলেও, একটি বৃদ্ধাশ্রম। আমাদের অভিবাসী সম্প্রদায়ের অনেকেই এখন এমন একটা বয়সে এসে পৌঁচেছেন যে তাদের পক্ষে সম্পূর্ণ আত্মনির্ভর হয়ে বেঁচে থাকা হয়ত সম্ভব নয়, সম্ভব হলেও অত্যন্ত দুঃসাধ্য হয়ে পড়ছে বার্ধক্যজনিত বিবিধ সমস্যার কারণে। তাদের সাহায্য দরকার। প্রশ্ন হল এই সাহায্যটি আসবে কোথা থেকে। পরিবার, না, সমাজ (মানে বৃদ্ধাশ্রম)? এদেশের বুড়োরা সাধারণত সিনিয়ার হোমে চলে যান নির্দ্বিধায়। আমরা তা পারিনা সহজে। কালচারের বৈষম্য বিরাট বাধা হয়ে দাঁড়ায় সেখানে। দিনরাত ইংরেজিতে কথা বলা আর ‘বিদেশি’ খাবার খাওয়া দুবেলা, ‘বিদেশি’ আচার আচরণে অভ্যস্ত হয়ে ওঠার আপ্রাণ চেষ্টা করা, সেই প্রবীণ বয়সে সেটা কারুরই কাম্য নয়। আমাদের আশা ছিল বৃদ্ধাশ্রমটি তৈরি হয়ে গেলে তাকে কেন্দ্র করে আস্তে আস্তে একটা কমিউনিটি সেন্টারও নির্মাণ করে ফেলা খুব কঠিন হবে না। কমিউনিটি সেন্টারের ওপর এত জোর দিচ্ছি কেন আমি? জোর দিচ্ছি এজন্যে যে তাহলে সেখানেই একটা সংস্থান হতে পারত আমাদের নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের। তারা সেখানে
গিয়ে পরস্পরের সঙ্গে অবাধ মেলামেশা করতে পারত, খেলাধূলা করতে পারত নিজেদের পরিচিত পরিবেশে, কথাবার্তা বলতে পারত নিজেদের ভাষায়। এভাবেই পরিচয় হতে হতে একসময় ঘনিষ্ঠতা সৃষ্টি হয়ে যেতে পারত, এমনকি মনের আদানপ্রদানও। এতে করে হয়ত বিজাতীয় সম্পর্কের সম্ভাবনাটি অনেকটাই কমিয়ে দেয়া যেত। তারা নিজেরাই বাছাই করে নিতে পারত তাদের ভবিষ্যৎ জীবনসঙ্গিদের। এখন তাদের সে-সুযোগটা নেই। হাই স্কুলে যাবার পরই ছেলেমেয়েরা পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে শুরু করে। তারপর এমন হয় যে বছরের পর বছর কেটে যায় তাদের কোনও যোগাযোগ থাকে না, চিঠিপত্র দূরে থাক, ইমেইলেও নয়। ছোটবেলার পরিচিত মুখগুলি কালে কালে আগন্তুকের পর্যায়ে পৌঁছে যায়। ভিন্ন সম্প্রদায়ের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টির পেছনে এ’ও একটা ইন্ধন যোগায় বলে আমি মনে করি।
কেউ কেউ এমন অভিমত প্রকাশ করেছেন যে ছেলেরা, এমনকি মেয়েরাও, অনায়াসে মসজিদে গিয়ে সেই অভাবটি ঘুচিয়ে নিতে পারে। মসজিদ তো একরকমের ‘কমিউনিটি সেন্টার’ও বটে! দুঃখিত, আমি একমত পোষণ করতে পারছিনা। মসজিদ একটি উপাসনাগৃহ—-কেবল মুসলমান ধর্মাবলম্বী ছেলেদের জন্যে। মেয়েরা সেখানে যেতে পারে বটে, কিন্তু ভদ্র শরিয়ামাফিক মার্জিত পোশাক পরিধান করে (যার মানে হিজাব বা নিকাব বা ঐজাতীয় কিছু একটা পোশাক), এবং ছেলেদের থেকে আলাদা পরিবেশে, ইত্যাদি। এমন একটি শ্বাসরোধকর পরিবেশে কোনও সুস্থমস্তিষ্ক স্বাভাবিক টিনেজার যেতে চাইবে বলে মনে হয় আপনার? না ভাই, মসজিদ শুধু নামাজেরই জন্যে, ছেলেমেয়েদের অবাধ মেলামেশার জন্যে নয়। ‘অবাধ’ শব্দটাই মসজিদ বলতে যা বোঝায় তার সঙ্গে খাপ খায় না। সেখানে বাধাই নিয়ম। ওদিকে টিনেজদের স্বভাবই হল সবরকম বাধা অমান্য করা। ওই অমান্যতার প্রবৃত্তিকে মুক্তির স্বাদ দেবার সুযোগ করে দিতে হবে আমাদের। কিন্তু আমরা তা করছিনা, করার প্রয়োজনটাও বোধ করছিনা।
ত্রিশ বছর আগে বড় একটা সুযোগ ছিল বৃদ্ধাশ্রম তৈরি করার—-ক্যানাডিয়ান সরকার থেকে একটা মোটা অঙ্কের অনুদান পাওয়া যেত তখন। কিন্তু আমাদের কমিউনিটির রথী-মহারথীরা খুব একটা গা করেননি তখন। হয়ত তাঁরা ভাবতেন যে বুড়ো হতে অনেক দেরি তখন, এত তাড়া কিসের। কেউ কেউ হয়ত এমনও ভাবতেন যে তাঁরা কোনদিন বুড়ো হবেন না, বা হলেও ছেলেমেয়েরা থাকতে চিন্তা কিসের। বাপদাদা চোদ্দ পুরুষের কেউ কখনো আশ্রমে থাকেনি, আমরা থাকব কেন? দুঃখের বিষয় যে বাস্তব জীবন এসে কড়া নাড়ছে আমাদের সবারই দরজায়। আমরা বুড়ো হচ্ছি, এবং আমাদের নিজেদের স্বার্থেই আমরা চাচ্ছি না ছেলেমেয়েদের ওপর নির্ভর করতে—-এতে করে আমরা যেমন ওদের পথের কঁটা হয়ে পড়ি তেমনি ওরাও পদে পদে আমাদের পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়। বৃদ্ধবয়সে আমাদের সবচেয়ে কাম্য বস্তু হলঃ স্বাধীনতা, আত্মসম্মান, মাথা উঁচু রেখে চোখ বুঁজতে পারা। সেটি কোনও সন্তানের গলগ্রহ অবস্থায় সম্ভব নয়। সেকারণে আজকাল দেশেও শুনেছি মধ্যবিত্ত পরিবারের বাবামায়েরা আলাদাভাবে থাকার ব্যবস্থা করে নিচ্ছেন, অথবা সরাসরি কোনও পছন্দসই আশ্রমে উঠে যাচ্ছেন। এটাই নতুন যুগের নতুন সামাজিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতার ধারা—-এতে ভালমন্দ সত্যযুগ-কলিযুগের ব্যাপার নেই। সহজ সরল বাস্তবতা। এর সাথে মানিয়ে চলা ছাড়া উপায় নেই আমাদের।
কিন্তু আমরা সেই বাস্তবতাটি অনিবার্য জেনেও কেবল পাড়ায় পাড়ায় মসজিদ ফাণ্ডের জন্যে টাকা তুলে যাচ্ছি। এবং দুঃখের বিষয় যে ‘মসজিদ’ শব্দটা শোনামাত্র আমাদের পকেটের বোতাম আপনা থেকেই খুলে যায়। আদত কথাটা কিন্তু নামাজ নয়, কমিউনিটি নয়, সোয়াব। আমাদের প্রধান চিন্তা হল পরকাল। বেহেশত। হাশরের ময়দান। বেহেশতে যেতে হলে যথেষ্ঠ ‘ব্রাউনি পয়েন্ট’ জমাতে হবে, যার আরেক নাম ‘সোয়াব’। সোয়াবের গন্ধ পেলেই আমরা চোখ বুঁজে ছুটি। তখন আমাদের সন্তানেরা কি গোল্লায় গেল না জাহান্নামে গেল সেসব তুচ্ছ প্রশ্ন নিয়ে মাথা ঘামানোর প্রয়োজন বোধ করিনা। আর বুড়োরা? তাদের আবার সমস্যা কিসের? বয়স হয়েছে, সারাদিন আল্লার কালাম নিয়ে থাকবেন, নামাজরোজা করবেন, বারকয়েক মক্কাশরিফে যাবেন, কোরাণ তেলোয়াত করবেন চব্বিশ ঘন্টা—-তারপর সময় হলে তৌবা পড়ে ইন্তেকাল করবেন। এর চেয়ে শান্তির জীবন আর কি আছে। তাদের আশ্রমের প্রয়োজন হবে কেন?
তাইতো। মসজিদ থাকতে আশ্রম আর কমিউনিটি সেন্টার কেন? অটোয়া, ৭ই জুলাই, ‘১৪