বর্ণবাদের বিরুদ্ধে কানাডা সৃষ্টি করলো এক নজীর বিহীন দৃষ্টান্ত
5 ডিসেম্বর, 2018
যুক্তরাষ্ট্র সহ পাশ্চত্য বিশ্বের অনেক দেশে বর্ণবাদ যখন নতুন করে এক কদর্য রূপ ধারণ করেছে তখন কানাডা সেই বর্ণবাদের বিরুদ্ধে সৃষ্টি করেছে এক নজীর বিহীন দৃষ্টান্ত। কানাডায় বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনের একজন পথিকৃৎ, কৃষ্ণাঙ্গ নারী ভাইয়লা আইরীন ডেসমন্ড এর প্রতিকৃতি ছাপানো হয়েছে কানাডিয়ান মুদ্রায়। গত ১৯ নভেম্বর ১০ ডলার মূল্যমানের এই মূদ্রা অনুষ্ঠানিকভাবে বাজারে ছাড়া হয়েছে। এ উপলক্ষে উইনিপেগে অবস্থিত কানাডিয়ান মিউজিয়াম ফর হিউম্যান রাইটস এর কার্যালয়ে আয়োজন করা হয়েছিল এক অনুষ্ঠানের। এতে উপস্থিত ছিলেন ভাইয়লার ছোট বোন ৯১ বছর বয়সী ওয়ান্ডা রবসন। তিনি বলেন কানাডিয়ান মূদ্রায় ভাইয়লার প্রতিকৃতি ছাপানোর সিদ্ধান্তটি সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠার অগ্রযাত্রায় এক সুবিশাল পদক্ষেপ।
অনুষ্ঠানে ব্যাংক অব কানাডার গভর্নর স্টিফেন পোলোজ বলেন, এই উদ্যোগ সবটাই মানবাধিকার এবং সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে করা হয়েছে।
উল্ল্লেখ্য যে, ১৯৪৬ সালের ৮ নভেম্বর নভাস্কোশিয়ার রসল্যান্ড থিয়েটারে মুভি দেখতে গিয়েছিলেন কৃষ্ণাঙ্গ নারী ভাইয়লা ডেসমন্ড। সেদিন তিনি থিয়েটারের ভিতরে প্রবেশ করে শ্বেতাঙ্গদের জন্য সংরক্ষিত আসনে গিয়ে বসেছিলেন। থিয়েটার কর্তৃপক্ষ তখন ডেসমন্ডকে ঐ স্থান থেকে সরে যেতে বললেও তিনি সরে যান নি। এরপর পুলিশ এসে তাঁকে গ্রেফতার করে এবং ঐ রাতটি তাঁকে জেলে কাটাতে হয়। পরে আদালতও তাকে জরিমানা করেন। তবে ভাইয়লা ডেসমন্ড সেদিন বর্ণবাদ আর আদালতের বিচারে কাছে পরাজিত হলেও শেষ পর্যন্ত তিনি জিতেছেন। তাঁর মৃত্যুর প্রায় ৪৫ বছর পর তাঁকে মরণোত্তর ক্ষমা প্রদান করা হয়। এবং আজ এই ২০১৮ সালে তাকে সম্মানিত করার জন্য তার প্রতিকৃতি ছাপা হয় কানাডিয়ান ব্যাংক নোটে। বর্ণবাদের বিরুদ্ধে এ এক বিরাট জয় সন্দেহ নেই।
বর্ণবাদ একসময় কানাডাও সদর্পে বিদ্যমান ছিল। প্রকাশ্যেই শ্বেতাঙ্গ সম্প্রদায়ের লোকজন আদিবাসী থেকে শুরু করে কৃষ্ণাঙ্গ, বাদামী সবার বিরুদ্ধে বর্ণবাদী আচরণ করতো। কোন বিচার ছিল না এর বিরুদ্ধে। কানাডার জাতির পিতা হিসাবে যাকে আখ্যায়িত করা হয় এবং যিনি কানাডার প্রথম প্রধানমন্ত্রী ছিলেন দীর্ঘ প্রায় দুই দশক ধরে সেই “স্যার জন এ. ম্যাকডোনাল্ড বিরুদ্ধেও রয়েছে বর্ণবাদী আচরণ করার অভিযোগ। তিনি কানাডার আদিবাসীদের দেখতে পারতেন না। কানাডায় বসবাসরত চাইনীজদেরও ভাল চোখে দেখতেন না। চাইনীজদের বিরুদ্ধেও তিনি বর্ণবাদী আচরণ করেছেন।
ম্যাকডোনাল্ড নিজেই স্বীকার করে গেছেন এই বলে যে, আমি এরকম একটি দেশ চালাচ্ছি যে দেশটি বর্ণবাদী মানুষে ভরা। এ কারণেই আমি বর্ণবাদকে সমর্থন করে গেছি।
সুতরাং আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, এই দেশটিতেও একদিন বর্ণবাদ কতটা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে ছিলো। কিন্তু সেই সব দিন আজ ইতিহাস। কানাডার সিংহভাগ মানুষ আজ বর্ণবাদ বিরোধী।
তবে এ কথাও সত্য, কানাডায় এখনো কিছু সংখ্যক লোক আছেন যারা বর্ণবাদী। টরন্টো পুলিশের হেইট ক্রাইম ইউনিটের সর্বশেষ প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী দেখা গেছে, ২০১৬ সালের তুলনায় ২০১৭ সালে হেইট ক্রাইমের সংখ্যা লাফিয়ে ২৮ শতাংশ বেড়ে যায়। অন্যদিকে কানাডায় রক্ষণশীলদের কয়েকটি গ্র“প সাম্প্রতিক সময়ে অধিকমাত্রায় সক্রিয় হয়ে উঠেছে ইমিগ্রেন্ট বিরোধী একটি অনুভূতি বা চেতনা জাগ্রত করতে। এই রক্ষণশীলদের মধ্যে নব্য জাতিয়তাবাদের একটি চেতনা নতুনভাবে জাগ্রত হয়ে উঠেছে এখন। কানাডার মাল্টিকালচারালইম নীতিতে তারা বিশ্বাসী নন। এই গ্রুপের মধ্য আছে La Meute এবং Soldiers of Odin. এদের বিরুদ্ধে বর্ণবাদী বিদ্বেষ ছড়ানো ও বিশৃংখলা সৃষ্টির অভিযোগ উঠেছে। তবে আশার কথা এই যে, এদের সংখ্যা খুব বেশী নয়।
আজকে কানাডায় সিংহভাগ মানুষের মধ্যে বর্ণবাদ বিরোধী যে মনোভাব বিদ্যমান এর কৃতিত্ব ভাইয়লা ডেসমন্ড সহ আরো যারা র্বণবাদের বিরুদ্ধে কঠিন সংগ্রাম করে গেছেন তাদের। আর এই সংগ্রাম আগামীতেও অব্যাহত রাখতে হবে। কারণ বর্ণবাদীদের অনেকে এখনো সক্রিয়।