‘শিশুরা ভালো নেই’: কোভিড-১৯ এর মধ্যে অন্টারিওর শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটছে

মহামারির প্রথম তরঙ্গের সময় ৭০% শিশুরই মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে

সিলিধ চপোউইক, অন্টারিওর পিকারিংয়ে তার বাড়ির কাছে তোলা ছবি। তিনি বলেন, ‘এমন দিন গেছে যেদিন কোনও কিছুই করার ইচ্ছা জাগতো না। আমি শুধু বিছানায় শুয়ে থাকতাম।’ (ক্রিস ইয়াং/কানাডিয়ান প্রেস)

সিলিধ চপোউইক বলেন, তিনি পুরোপুরি ভালো নেই, তবে চেষ্টা করছেন ভালো থাকার।

অন্টারিওর পিকারিংয়ের ১০ম গ্রেডের শিক্ষার্থীদের জন্য এটি ছিলো এক কঠিন বছর।

চপোউইক বলেন, “এমন দিন গেছে যখন কোনও কিছুই করার ইচ্ছে জাগতো না। আর আমি শুধুই বিছানায় শুয়ে থাকতাম।”

“স্কুলে যাওয়া এবং স্কুলের পড়া তৈরি করা কঠিন মনে হতো, আর অনেক সময় এটা আরও বেশি কঠিন মনে হতো যেমনটা বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা এবং যোগাযোগ করা। কারণ দীর্ঘদিন ধরে তাদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হচ্ছিলো না, তাই অনেকটাই উদ্বিগ্ন ছিলাম।”

তখন ভালো দিন, মন্দ দিন দু’টিই ছিলো।

১৫ বছর বয়সী চপোউইক বলেন, মহামারির আগে তিনি বুলিমিয়ায় (খাওয়া-দাওয়ায় বিশৃক্সক্ষলা) ভুগছিলেন, কিন্তু লকডাউনে সেটি আরও তীব্র হয়ে ওঠে।

“কেউ যখন একা ও বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তখন তার পক্ষে আবেগ-অনুভূতি বুঝে ওঠা দুরূহ হয়ে ওঠে।”

তিনি তার পারিবারিক চিকিৎসক এবং একজন থেরাপিস্টের সাহায্য চান, কিন্তু এতে তার উদ্বেগ আরও বেড়ে যায়। নাচের চর্চা বেশ উপকারী ছিলো কিন্তু লকডাউনের কারণে স্কুলের ক্লাস দুবার বন্ধ হয়ে যায়।

সিলিধ বলেন, “যখন নাচের ক্লাসে যেতাম, স্টুডিওতে যেতাম তখন সেটা ছিলো এমন জায়গা যেখানে সব কিছুই, যেমন আমার সব উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা পেছনে ফেলে যেতে পারতাম।”

তিনি বলেন, বাবা-মার সঙ্গে নিজের সমস্যা নিয়ে কথা বললে উপকার হতো।

তার বাবা মাইক চপোউইক বলেন, “সে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে কঠোরভাবে চেষ্টা করেছে, আর সে যথাসম্ভব নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে, কিন্তু যখন সবকিছুই চূড়ান্তভাবে থেমে যায় তখন সবার পক্ষেই এটা করা খুব কঠিন হয়ে পড়ে।”

সিলিধ একাই এ অবস্থায় পড়ে তা নয়।

গবেষকরা বলছেন, শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর মহামারি ব্যাপক প্রভাব ফেলে।

সিককিডস তরুণদের ওপর সমীক্ষা চালাচ্ছে

টরন্টোর একটি হাসপাতালে অসুস্থ শিশুদের চিকিৎসায় নিয়োজিত শিশু ও বয়োসন্ধি বিষয়ক চিকিৎসক ডা. ডেফনি করজাক বলেন, তরুণ-তরুণীদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর মহামারির প্রভাব পরীক্ষা করেদেখার জন্য গত এপ্রিলে একটি সমীক্ষা শুরু করেন।

তারা গত বসন্তে প্রথম লকডাউনের সময় ১০০০এর বেশি বাবা-মা এবং সাড়ে তিন শ’ শিশুর ওপর সমীক্ষা চালান এবং তার পর থেকে তাদের পর্যবেক্ষণ করছেন।

কারজাক বলেন, “আমরা দেখেছি যে, মোটামুটিভাবে ৭০% শিশুরই মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে।”

“উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিশুর মধ্যে বাড়তি বিষন্নতা, উদ্বেগ, খিটখিটে মেজাজের লক্ষণ দেখা দেয়। আর দৈনন্দিন হতাশা সামলে নিতেও তারা মহামারিকালের আগের তুলনায় কম সক্ষম ছিল।”

তিনি বলেন, “বাচ্চারা আগের চেয়ে খুব সহজেই প্রায়শ কান্না জুড়ে দিতো। তারা হতাশা সহ্য করতে পারতো কম, কাজে অংশ নিতে উৎসাহ পেতো না এবং তারা অস্থির, বিরক্ত হয়ে উঠেছিল। তাদের মধ্যে একাকীত্ব ও নৈরাশ্যের বোধ সৃষ্টি হয়।

শিশুদের খাওয়া-দাওয়ার অভ্যাসেও বিশৃক্সক্ষলা বেড়ে যায়। 

করজাক বলেন, “আমার মনে হয়, এটা বলাই যথাযথ যে, এই মুহূর্তে শিশুরা ভালো নেই।”

তিনি বলেন, “গবেষকরা দেখতে পেয়েছেন, শিশুরা যে সামাজিক বিচ্ছিন্নতার সম্মুখিন হয় তার মাত্রাটাই হলো মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার সবচেয়ে বড় পূর্বাভাস।

তিনি বলেন, “এর পর আসে দ্বিতীয় লকডাউন এবং শিশুরা তখনও স্কুলে হাজির হওয়া, খেলাধুলা করা বা কোনও কাজে জড়িয়ে পড়া এবং বন্ধুদের সঙ্গে সমবেত হওয়া এসবের কোনওটাই করতে পারেনি।

তিনি জানান, মহামারির আগেই মানসিক সমস্যায় ভুগছিল এমন শিশুদের অনেকে মহামারির শুরু থেকেই চরমভাবে ভুগতে শুরু করে। আর আগে কোনওরকম মানসিক সমস্যা ছিল না এমন ৪০% শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে।

তিনি বলেন, আরও বেশি উদ্বেগের বিষয় এই যে, গত শরতে স্কুলে ফিরে যাবার পরও ওই শিশুদের মধ্যে সমস্যাগুলো থেকেই যায়।

করজাক বলেন, “প্রথম লকডাউনের পর আমরা শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার লক্ষণগুলোর কোনওরকম উন্নতি দেখতে পাইনি কিন্তু তারপরই দ্বিতীয় লকডাউন শুরু হলে তারা আরও বেশি নিষ্প্রাণ হয়ে পড়ে।”

‘বিদ্যালয় আকর্ষণ হারিয়েছে’

শরতে স্কুলগুলো দেখতে ছিলো একেবারেই ভিন্ন। প্রত্যেকেই মাস্ক পরা। শরীরের তাপ ও রোগের লক্ষণ আছে কিনা পরীক্ষা করা হচ্ছিলো। পাঠ্যবহির্ভুত অনেক কার্যক্রম ও খেলাধুলা বাতিল করা হয়।

কোভিড-১৯এর অধিক সংক্রমণ ঘটেছে এমন জায়গার হাইস্কুল শিক্ষার্থীদের সশরীরে হাজিরার সময় উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়ে দেওয়া হয় এবং অনেক স্কুল কর্তৃপক্ষ এমন দল গঠনের পদ্ধতি আরোপ করেন যেখানে শিক্ষার্থীদের গ্রুপগুলো পরস্পরের সঙ্গে মিশতে না পারে।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরকে শ্রেণীকক্ষের কঠোর দলগত শৃক্সক্ষলার মধ্যে সীমিত করা হয়। এমনকি স্কুল প্রাঙ্গনেও সেটা মেনে চলা বাধ্যতামূলক ছিলো। ট্যাগ-এর মত খেলাগুলো নিষিদ্ধ ছিলো।

সিলিধ বলেন, “স্কুল একেবারেই ভালো লাগেনি। আমি কিছু বন্ধুকে দেখতে পেতাম মাত্র পাঁচ মিনিটের জন্য, অন্যদের দেখা একেবারেই পেতাম না যদি তারা ভিন্ন গ্রুপে থাকতো।”

সিককিডস শিক্ষার্থীদের স্কুলে উপস্থিতির পক্ষে

অসুস্থ শিশুদের হাসপাতাল বেশ কিছু কারণে শিশুদের সশরীরে স্কুলে ফেরার পক্ষে কথা বলছে। এর মধ্যে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপকারিতার বিষয়টিও রয়েছে।

করজাক বলেন, “আমি যেসব কথা শুনি তার মধ্যে বাবা-মায়েদের ওই কথাটি সবচেয়ে উদ্বেগজনক যারা বলেন যে, এটি আমার সন্তানকে পাল্টে দিচ্ছে। আমার সন্তান ছিলো সামাজিক এবং সুখি। সে শেখার ব্যাপারে আগ্রহী ছিলো কিন্তু এখন সে নতুন মানুষের সংস্পর্শে এলে সচকিত ও স্নায়বিক দৌর্বল্যে ভোগে। আর সে স্কুলে যেতেও আগ্রহ বোধ করে না।”

“আমাদেরকে শিশুদের এবং তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টিকেও অগ্রাধিকার দিতে হবে।”

তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দানকারী সংগঠন ইওর লাইফ কাউন্টস-এর প্রতিষ্ঠাতা রুয়ারিধ বাটলার বলেন, তাদের পরিষেবার চাহিদা কখনই খুব বেশি ছিলো না।

বাটলার বলেন, প্রতিষ্ঠার পর গত দুই দশক ধরে তাদের কাজের ধরণ ছিলো সহজতম, কেবল আশা জাগিয়ে তোলা।

মহামারির অবসানের কোনও লক্ষণ এখনও দৃশ্যমান না হওয়ার প্রেক্ষাপটে অনেক তরুণ তাকে বলেছে যে,তারা আশা হারিয়ে ফেলেছে। তারা ভাইরাসের ভয় পাচ্ছে, মৃত্যুর ভয় পাচ্ছে, তাদের পুরো জীবনটাই রূপান্তরিত হয়ে গেছে এবং এক বছর পর তাদের মধ্যে এমন বিশ্বাস দানা বেঁধেছে যে, জীবন চিরতরে পাল্টে যাবে।

সুতরাং বাটলার ইতিহাসের শিক্ষা থেকে দৃষ্টান্ত উল্লেখ করে তার সাহায্যপ্রার্থীদের বলছেন: দেখ, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ১৯১৪ সালে শুরু হয়ে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত স্থায়ী হয়, আর স্প্যানিশ ফ্লু মহামারি শুরু হয় ১৯১৮ সালে এবং বেশ কয়েক বছর ধরে ছিলো।

বাটলার বলেন, “ঠিক এই মুহূর্তে আমরা যে পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছি সেটিও ঐতিহাসিক, যদিও এটি নিষ্ঠুর, এটি ভয়ানক। কিন্তু অনুমান করতে পার কি? পেছনের দিকে তাকালে দেখবে, এটা এখানে আগেও ছিলো, তোমরা দেখবে, আমরা এর ভেতর দিয়েই এগিয়ে যেতে পেেিরছি।”

তিনি বলেন, ইতিহাসের ওই শিক্ষা অনেক তরুণের জীবনে কিছুটা হলেও আশার সঞ্চার করতে সহায়ক হয়েছে।

বাটলার বলেন, “আমাদের জীবনে ও আমাদের অন্তরে আশা ফিরিয়ে আনতে হবে। বিভিন্ন মানুষের কাছে আশার অর্থও ভিন্ন, তবে আমি এটিকে তার মূল জায়গা থেকে ভাবি, এটি হলো আশাবাদের একটি চেতনা, এমন চেতনা যা মনে করে এই মুহূর্তে সব নিঃশেষ হয়ে গেলেও পরিস্থিতি ভালো হবেই।

০২ ফেব্রুয়ারি ২০২১

সৌজন্যে : লিয়াম কেসি – দি কানাডিয়ান প্রেস